বিরাট ভূখণ্ড জুড়ে বিস্তৃত একটি দেশ। সেই দেশে ছিল মহাপ্রতাপশালী এক রাজা। তাকে সবাই বলতো ‘মালাক ইউনান’। অ্যাতো বিরাট দেশের রাজা হলে কী হবে, তারা ছিল চর্মরোগ। কতো ডাক্তার কবিরাজের ওষুধ খেয়েছে রাজা, কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না। চর্মরোগের চুলকানিতে রাজা একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লো। কোনো হেকিম বা কবিরাজই যখন রাজার চর্মরোগ সারাতে পারলো না, তখন রাজা একেবারে বিমর্ষ হয়ে পড়লো, মনটা একেবারেই ভেঙে গেল তার। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল রাজা।
এরকম পরিস্থিতিতে হঠাৎ সেদেশে এক বুড়া ডাক্তার এলো। ঐ ডাক্তারকে ‘হাকিম রুয়ন’ বলে ডাকতো সবাই। হাকিম, রাজার অসুখের কথা শুনতে পেয়ে সোজা রাজ প্রাসাদে গিয়ে হাজির হলো। হাকিম রুয়ন বাদশাকে খুব দৃঢ়তার সাথে বললোঃ আমি কোনো ওষুধ ছাড়াই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আপনার এই চর্মরোগের চিকিৎসা করতে পারবো। মালাক ইউনান বৃদ্ধ ডাক্তারের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। বিস্ময়ের সাথে সে ডাক্তারকে বললোঃ‘তোমার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে তুমি যা চাইবে তা-ই পাবে’। হাকিম রুয়ন ‘আগামিকাল আসবো’ বলে বাদশাকে সম্মান দেখিয়ে চলে গেল।
পরদিন সকালবেলা হাকিম সময়মতো চলে এলো বাদশার প্রাসাদে। সঙ্গে নিয়ে এলো পোলো খেলার স্টিক আর বল। সেগুলো বাদশার হাতে দিয়ে বললোঃ ঘোড়ার পিঠে চড়ে মাঠে যাবেন। তারপর এই স্টিক দিয়ে ইচ্ছেমতো বলটা পেটাবেন। পেটাতে পেটাতে যেন আপনার হাতের পাঞ্জা আর বাজু নরম হয়ে যায়। নরম হয়ে গেলে প্রাসাদে ফিরে আসবেন। হাম্মামে গিয়ে ভালো করে গোসল করবেন। গোসল সেরে দেবেন ঘুম। টানা ঘুম দেওয়ার পর জেগে উঠে দেখবেন আপনার চর্মরোগ ভালো হয়ে গেছে।
মালাক ইউনান বৃদ্ধ ডাক্তারের কথাগুলো মনোযোগের সাথে শুনলো এবং অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো। সবকাজ সেরে ঘুম দিয়ে উঠে বাদশাহ দেখলো সত্যি সত্যিই সে সুস্থ হয়ে গেছে। তার গায়ে চর্মরোগ বলতে আর কিছুই নেই। আশ্চর্য এক আনন্দে চীৎকার করে উঠলো রাজা। কী বিস্ময়কর ব্যাপার। চর্মরোগটা সত্যি সত্যিই ভালো হয়ে গেছে। রাজা তো খুশিতে একেবারে আত্মহারাপ্রায়। চীৎকার করে উল্লসিত স্বরে আদেশ দিলো হাকিম রুয়নকে খবর দিতে। হাকিম রুয়ন এলো। বাদশা হাকিমকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললোঃ ‘হে অভিজ্ঞ হাকিম! আমার এই সুস্থতার জন্যে আমি তোমার কাছে ঋণী।’
এই বলে বাদশা হাকিমকে নিজের পাশে বসালো, একসাথে খাওয়া দাওয়া করলো, কথাবার্তা বললো। এককথায় হাকিমকে বাদশা ভীষণ আদর আপ্যায়ন করলো। তারপর হেকিমকে একটা স্বর্ণমুদ্রার থলি আর মূল্যবান কিছু উপহার দিতে আদেশ দিলো বাদশা। হেকিম সেগুলো গ্রহণ করলো এবং বাদশার জন্যে দোয়া করলো। বিদায় দেওয়ার সময় বাদশা হেকিমকে পরদিনও প্রাসাদে আসতে অনুরোধ করলো। এভাবে মালাক ইউনান আর হেকিম রুয়নের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো।
মালাক ইউনানের এক মন্ত্রী ছিল ভীষণ হিংসুটে। হেকিমের সাথে বাদশার এই বন্ধুত্ব আর হেকিমকে উপহার দেওয়ার বিষয়টা সহ্য করতে পারছিলো না। সেজন্যে সে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছিলো যেন বাদশা হেকিমকে দুই চোখে দেখতে না পারে। মন্ত্রী একদিন বাদশার সামনে গিয়ে বললোঃ হে মহান বাদশাহ! আমি আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষ। আপনার জন্যে আমার মনও কাঁদে। সেজন্যে আপনাকে যে-কোনো বিপদ থেকে বাঁচানো আমার দায়িত্ব। বাদশা বললোঃ কিসের বিপদ মন্ত্রী! মন্ত্রী বললোঃ বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি আপনি আপনার জানের শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছেন, এর পরিণতি ভালো না।
বাদশা একটু নড়েচড়ে উঠে বললোঃ আমার জানের দুশমন! কে সে? বলো! মন্ত্রী বললোঃ সে হলো হেকিম রুয়ন। হেকিম চাচ্ছে আপনাকে মেরে ফেলতে।’ একথা শুনে রাজা ক্ষেপে গিয়ে বললোঃ ‘কী আজেবাজে বকছো? হেকিম রুয়ন আমাকে রোগের কষ্ট থেকে বাঁচিয়েছে, তাকে যদি আমার সকল সম্পদও দিয়ে দিই তারপরও তা হবে সামান্য প্রতিদান। বোঝা যাচ্ছে তুমি তাকে হিংসা করছো। তাই চাচ্ছো হেকিমকে যেন আমি সহ্য করতে না পেরে হত্যা করি এবং শেষে অনুতপ্ত হই।’ চতুর মন্ত্রী তারপরও বললোঃ কিন্তু হুজুর! আমি কখনোই আপনার ভালো ছাড়া মন্দ চাই না। আমি তারপরও বলবো হেকিম রুয়ন আপনার জানের দুশমন। আপনি যদি তাকে না মারেন, সে আপনাকে মারবে।
মন্ত্রীর এই চাতুর্যপূর্ণ কথায় রাজা ভড়কে গেল। ভাবতে শুরু করলো বাদশা। একটু পরে মন্ত্রীকে বললোঃ ‘তুমি হয়তো ঠিকই বলছো! কেননা হেকিম বেশ শক্তিশালী মানুষ। যত সহজে আমার কঠিন রোগটা সারিয়ে ফেললো, তত সহজেই আমাকে মেরেও ফেলতে পারবে।’ বাদশার এ কথায় মন্ত্রী খুশি হলো। সে ভাবলো তার কথায় তাহলে চিড়া ভিজেছে। বাদশাকে বললোঃ খুশি হলাম হুজুর আমার কথা কানে তোলার জন্যে। বাদশা সাথে সাথে আদেশ জারি করলো হেকিম রুয়নকে ডেকে আনার জন্যে। হেকিম তো কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই এসে হাজির।
বাদশা বললেনঃ জানন হেকিম! কেন আপনাকে ডাকা হয়েছে? হেকিম বললোঃ না, কেন? বাদশা রেগেমেগে বললোঃ তোমাকে হত্যার আদেশ দিতে ডেকেছি।’ হেকিম বিস্ময়ের সাথে বললোঃ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, আমাকে হত্যা, কিন্তু কেন, কী দোষ করেছি আমি? বাদশা বললোঃ তুমি ভালো করেই জানো..তুমি একটা গুপ্তচর..আমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছো’.. বলতে বলতে জল্লাদকে ডাকা হলো। হেকিম কাঁদতে কাঁদতে বললোঃ হে মহারাজ! আমার আকর্ষণীয় পুরস্কার কি এটা?’’ বাদশা বললোঃ ‘আমি যদি তোমাকে না মারি, তুমি তো ঠিকই আমাকে মেরে ফেলবে..’। জল্লাদ হেকিম রুয়নের কাছাকাছি এসে বাদশার আদেশের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। হেকিম মাটিতে পড়ে বলতে লাগলোঃ হে বাদশা রহম করো। আমাকে মেরো না, আমি নির্দোষ।’
বাদশা কান দিলো না। জল্লাদকে আদেশ দিতে যাবে, ঠিক সে সময় বাদশার কাছের কেউ একজন বললো ‘হেকিমকে ছেড়ে দিন।’ হেকিম চীৎকার করে বলে উঠলোঃ দেখো নি ও কীভাবে পোলো খেলার লাঠি আর বল দিয়ে আমার কঠিন রোগ সারিয়ে তুলেছে? এখন কি সে আমার হাতে এক গোছা ফুল দিয়ে তার গন্ধ শুঁকিয়ে আমাকে মেরে ফেলতে পারবে না?’ হেকিম বুঝতে পেরেছে যে বাদশা তার সিদ্ধান্ত পাল্টাবে না। সে রাজার দিকে তাকিয়ে বললোঃ মৃত্যুর জন্যে আমি প্রস্তুত। তবে মরার আগে একটা আবদার আছে আমার। আমাকে অনুমতি দিলে আমি একটু বাসায় গিয়ে অসিয়্যত করে আমার মূল্যবান বইগুলো আপনাকে উপহার দিতে চাই।’ বাদশা বললোঃ “মূল্যবান বই? কী বই?”
হেকিম বললোঃ বিস্ময়কর বই, যাদুর মতো। অনেক কাজে দেবে। আমাকে মৃত্যুর পর বইটি খুললে বাঁ পাশে যে পৃষ্ঠাটি পড়বে, ঐ পৃষ্ঠার তিনটি লাইন পড়বেন। দেখবেন আমার কাটা মাথা কথা বলছে। আপনি যা-ই জানতে চাইবেন, জবাব পাবেন।” রাজা সম্মত হলো। হেকিম বাদশার পেয়াদার সাথে বাসায় গিয়ে তিন দিন পর প্রাসাদে ফিরে এলো। হাতে তাঁর পুরোণো একটা বই আর একটা বাটি। বাটিতে ভর্তি ছিল ধূলামাটি। তিনি বড়ো একটা পাত্র চাইলেন। বইটা বাদশার হাতে দিয়ে বাটির ধূলা পাত্রটাতে খালি করে বললেনঃ ঐ তশতরিতে আমার কাটা মাথাটা রাখবেন। যে ওষুধটা আমি তশতরিতে দিয়েছি ঐ ওষুধ আমার কাটা মাথায় লাগাবেন যাতে রক্ত বন্ধ হয়। তারপর বই খুলে, বাঁ পাশের পৃষ্ঠার দিন লাইন পড়বেন। এরপর আমার কাটা মাথার কাছে যে প্রশ্নই জানতে চাইবেন, জবাব পাবেন।”
রুয়ন বইটির দিকে একবার তাকালেন। পৃষ্ঠা উল্টাতে চাইলেন। কিন্তু দেখলেন পৃষ্ঠাগুলো একটার সাথে আরেকটা লেগে আছে। আঙুল মুখে নিয়ে ভিজিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাতে চাইলেন। পাঁচটি পৃষ্ঠা খুললো। কিন্তু সেগুলোতে কোনো লেখাই ছিল না। বাদশা হেকিমের দিকে তাকিয়ে বললোঃ ‘এখানে তো দেখছি কোনো লেখাই নেই, সাদা পৃষ্ঠা।’ হেকিম বললোঃ হুজুর! আরো উল্টান। বাদশা এবার নিজের জিহ্বায় আঙুল ভিজিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখলো কোনো লেখাই নেই। কিছু একটা বলতে চাইলো। কিন্তু হঠাৎ রাজা মাথা চক্কর দিয়ে ঘুরতে লাগলো। তার চেহারার রঙ পাল্টে গেল। শ্বাসকষ্ট দেখা গেল। চীৎকার করে উঠেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
প্রিয় পাঠক, রাজা কেন মরে গেল বলতে পারেন? যে কারণেই মরুক না কেন জনগণ বলাবলি করতে লাগলোঃ বাদশা যদি হেকিমকে মারার সিদ্ধান্ত না নিতো, তাহলে রাজাও মরতো না।’ যারা সঙ্গ দিলেন, সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।