কোন এক সময়ে এক মহাজন ও একজন টেটন (বুদ্ধিমান) একটি সংকীর্ণ পাৰ্ব্বত্যপথে বিপরীত দিক হতে এসে হঠাৎ এক স্থানে মিলিত হল; কিন্তু রাস্তা এরূপ সংকীর্ণ যে তাতে একবারে একাধিক লোক যাতায়াত করতে পারে না। পথিকেরা উভয়ই গর্বিত যুবক। কে পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াবে, এই ভাবনায় উভয়েই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মহাজন ভাবল, আমি দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী, আমার যেমন ধনসম্পত্তি তেমনি সম্মান, প্রতিষ্ঠা, আমি এই সামান্য লোকের জন্য এক পার্শ্বে সরে যাব কেন?
টেটন ভাবল, বুদ্ধির জন্যে রাজদরবারের আমার কত প্রতিপত্তি, আমি কেন সরে যাব। টেটন, কিছুক্ষণ পরে, নির্বোধ লোকের সহিত পথিমধ্যে কলহ করা বুদ্ধিমানের শোভা পায় না, এই ভেবে বিনা বাক্য ব্যয়ে একপার্শ্বে একটুকু সরে দাঁড়াল।
মহাজন একটুকু অগ্রসর হয়ে ভাবল, লোকটা কি বেয়াদব। উপযুক্ত অভিবাদন না করেই চলে গেল। সুতরাং তাকে সম্বোধন করে বলল, “ওহে, আমি তোমার সম্মানের পাত্র, এ কথা কি ভুলে গেছ? অভিবাদন না করেই চলে যাচ্ছ কেন?”
টেটন বলল, “ধনসম্পত্তি থাকলে কি হবে? তোমার মত বুদ্ধিহীনের ছায়া স্পর্শ করাও পাপ, তাই সরে গিয়েছিলাম।”
অনেক তর্ক বিতর্কের পর নিজ নিজ শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণের জন্য তারা উভয়ে নিকটবর্তী গ্ৰাম্য পঞ্চাইতগণের নিকট উপস্থিত হল। পঞ্চাইতগণ যুক্তি করে দেখলেন, মহাজনকে শ্রেষ্ঠ বললে মামলা মোকদ্দমার সময় টাকাকড়ির ধান পাওয়া কঠিন। অবেশেষে তাঁরা বললেন, “মহাশয়গণ! বিষয়টি বড়ই জটিল। আমরা সামান্য গ্রাম্য লোক, আমাদের বুদ্ধিও সামান্য। আপনারা রাজার নিকট বিচার প্রার্থনা করুন।”
তখন তারা বিরোধ নিস্পত্তির জন্য রাজার নিকট উপস্থিত হল। রাজা দেখলেন, বুদ্ধি ও ধনসম্পত্তি ইহার কোনটাই উপেক্ষণীয় নহে। বুদ্ধির শ্ৰেষ্ঠত্ব ঘোষণা করলে, রাজ্যের সকল অর্থশালী ব্যক্তিই অসন্তুষ্ট হবে; আর ধনসম্পত্তির শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করলে মন্ত্রী, অনুচরবর্গ ও
রাজ্যের সকল বুদ্ধিজীবীই আমার বিরুদ্ধাচরণ করবে। সুতরাং রাজা স্বয়ং এই বিচারে হস্তক্ষেপ না করে মন্ত্রীর উপরই বিচারের ভার অর্পণ করলেন ।
মন্ত্রী ঈষৎ হাস্য করে বললেন- “নীলাচলের রাজকন্যা জন্মাবধি পুরুষের মুখ দর্শন করেন না। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এই রাজকন্যা বিবাহ করে আনতে পারব সে-ই শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হবে।”
টেটন বলল, “আমি অগ্ৰে গেলে কৃতকার্য হব, সন্দেহ নেই। কিন্তু পরে মহাজন সগর্বে বলবে-আগ্রে গেলে আমিও রাজকন্যাকে বিবাহ করে আনতে পারতাম, সুতরাং সেই অগ্ৰে যাউক।”
মহাজন নৌকা বোঝাই করে ধনরাশি নিয়ে যাত্রা করল। কিন্তু ক্ষিপ্রতাবশত; নির্দেশপত্র সঙ্গে নেওয়ার কথা ভুলে গেল – অত:পর নীলাচলের প্রান্তভাগে উপস্থিত হলে, প্রহরীগণ নিদর্শনপত্র ব্যতীত তাকে নৌকা ভিড়াতে নিষেধ করল।
তখন মহাজন প্রহরীদের আত্মপরিচয় দিয়ে বলল, “আমি তোমাদের রাজকন্যাকে বিবাহ করতে এ রাজ্যে এসেছি। তাকে এনে দিতে পারলে তোমাদের বিশেষভাবে পুরস্কৃত করব। এক্ষণে সহস্র মুদ্রা দিতেছি, গ্রহণ কর।”
তারা নানা ছলে কার্য পরিত্যাগ করে গৃহে চলে গেল। এইরূপে নানা নিষ্ফল চেষ্টায় ধনরাশি নিঃশেষ করত: মহাজন দেশে এসে বলল, “আমার দ্বারা এ কার্য হল না, টেটন একবার চেষ্টা করে আসুক।” টেটন একখানা নিদর্শনপত্র ও যৎসামান্য অর্থ নিয়ে নীলাচলে গমন করত: নানা কৌশলে রাজকন্যার মালিনীর গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করল। ক্রমে তার সঙ্গে একটুকু আত্মীয়তা জন্মালে পর, একদিন কথাপ্রসঙ্গে বলল, “মাত! শুনে বড়ই আশ্চৰ্য্যান্বিত হলাম যে, রাজকন্যা জন্মাবধি পুরুষের মুখ দর্শন করেন না। এবং যৌবনে স্বেচ্ছায় অবিবাহিতা রয়েছেন। এ রহস্য ভেদ করতে না পারায় মন বড়ই ব্যাকুল হয়েছে।”
মালিনী বলল, “বাপু, এ বিষয় রাজকন্যার অতি গোপনীয়। কেহ এ বিষয় উল্লেখ করলেই তিনি কাটতে উদ্যত হন। তাই জিজ্ঞাসা করতে মনে বড় ভয় পায়।”
টেটন বলল, “মাত:, কথা গুছিয়ে বলতে জানলে এতে ভয়ের কারণ কিছুই নেই। আমি উপায় বলে দিব । উত্তম মাল্য রচনা করে নিন, এবং কথা প্রসঙ্গে বলুন – মাগো! আমি বৃদ্ধ হয়েছি, কখন যে মারি ঠিক নেই, মনে বড় কষ্ট যে তোমাকে এখনও সংসারী দেখলাম না। চলে যেতে চাও, যাও, কিন্তু তুমি যে ভীষণ পণ করেছ তার কারণ না জেনে মরলেও শান্তি পাব না।”
পরদিন মালিনী উপদেশমত কার্য করল। মালিনীর আন্তরিক সহানুভূতি দেখে রাজকন্যা একটুকু বিচলিত হলেন।
রাজকন্যা বললেন—“মা! এ অতি গোপনীয় বিষয়। সাবধান! দেখিও যেন আর কেহ শুনতে না পায়!”
মালিনী বলল, “মা! ভাবনা নেই, এ বিষয় কখনাে প্রকাশ পাবে না।”
তখন রাজকন্যা বলল, “দেখ মা! পূর্বজন্মে আমি হরিণীরুপে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। একদা অনাবৃষ্টি ও রৌদ্ৰে আহার্য দুষ্পাপ্য হল। তখন আমি আসন্ন প্রসবা। আহার অন্বেষণে ইচ্ছামত বিচরণ করতে কষ্ট অনুভব করতাম। ভাগ্যক্রমে একদিন পাহাড়ের ধারে একটি ঝরণার নিকটে অতি
সুন্দর কচি ঘাস দেখতে পেলাম। এই ঘাস দেখে আমার স্বামী লোভ সম্বরণ করতে পারলেন না। পাহাড়ে তখন আগুন জ্বলছিল বলে তাকে তথায় যেতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু তাতে তিনি ভ্রুক্ষেপ ও করলেন না। তাঁর আগ্রহে আমি ও ঘাস খেতে প্রবৃত্ত হলাম। ক্রমে চারদিকের জঙ্গলে আগুন দেখা গেল। পুনরায় স্বামীকে বললাম-, “দেখ, আমি গৰ্ভবতী, চলতে কষ্ট বোধ হচ্ছে। অগ্নি আরও অধিক প্রবল হলে তোমার ন্যায় লম্ফ দিয়ে অগ্নি অতিক্রম করতে সমর্থ হব না। এসো, সময় থাকতে চলে যাই।”
আমার স্বামী উপহাস করে বললেন, “এই সামান্য আগুনের ভয় পাচ্ছ! হরিণ শিশুও এ আগুনে ভয় পায় না। চল আরও কিছু আহার করে নিই।”
ক্ৰমে অগ্নিরাশি আমাদেরকে সম্পূর্ণরুপে বেষ্টন করে ফেলল। পুরুষরা নিজের প্রাণ নিয়েই ব্যস্ত। একবারও আমার কথা তাঁর স্মরণ হল না। তুচ্ছ প্ৰাণ নিয়ে এক লাফে তিনি বিপদ হতে মুক্ত হলেন। পলায়নের চেষ্টায় বিফল মনোরথ হয়ে অগ্নিমধ্যে ভীষণ যাতনা নিয়ে আমি প্ৰাণ হারালাম । মৃত্যুকালে, প্রতিজ্ঞা করলাম,-“পরজন্মে স্বার্থপর পুরুষের মুখ দর্শন করব না।”
টেটন মালিনীর নিকট হতে সমস্ত বিষয় অবগত হয়ে নিজদেশে গমন করে মন্ত্রীর সাহায্যে নীলাচলের রাজার নিকট দিবার জন্য একটা পত্ৰ সংগ্রহ করে পুনঃ তথায় যাত্রা করল। পত্রে লেখা ছিল যে, “পত্ৰবাহক সন্ত্রান্ত বংশীয়। তিনি শৈশব হতে স্ত্রীলোকের মুখ দর্শন করেন না। সপ্তাহকাল নীলাচল দেখতে তার বাসনা। এ সময়ে রাজ্যের স্ত্রীলোকদিগকে ঘর হতে বের হতে নিষেধ করলে অত্যন্ত সুখের বিষয় হবে।”
রাজার আদেশে তথায় উপস্থিত হয়ে প্রথম দিন ভ্ৰমণ করলে পর, উক্ত রাজ্যের মন্ত্রী রাজাকে বললেন,-“মহারাজ! যুবা পুরুষ স্ত্রীলোকের মুখ পর্যন্ত দর্শন করেন না, এরূপ আশ্চৰ্য্য কথা কখনও শুনি নাই। বোধ হয়। ইহার মধ্যে কোন রহস্য থাকবে।”
রাজারও কৌতুহল হল এবং এই আশ্চর্য পণের কারণ জানার জন্য রাণী এবং রাজকন্যারও কৌতুহল জন্মাল। মণ্ডপের মধ্যে পর্দার আড়ালে তারা রইলেন। টেটনকে নিমন্ত্রণ করে কথাপ্রসঙ্গে তার পণের কারণ জিজ্ঞাসা করা হল।
একথা শোনামাত্ৰ টেটন ক্ৰোধে অধীর হয়ে অসি ধারণ করল। কিন্তু অবিলম্বে যেন বহু কষ্টে ক্ৰোধ সংবরণ করে বলল- “অন্য কেহ জিজ্ঞাসা করলে হয়ত এখনই কেটে ফেলতাম। কিন্তু আমি অদ্য আপনার অতিথি। বিষয়টি গোপনীয় হলেও আপনার নিকট বলছি। কিন্তু দেখবেন ইহা যেন কোনক্রমেই প্ৰকাশ না পায়।”
টেটন বলতে লাগল, “মহারাজ! পূর্বজন্মে আমি হরিণ ছিলাম। একদা পায়ে কণ্টক বিদ্ধ হওয়ায় চলতে এক প্রকার অসমর্থ হয়ে পড়ি। তখন একদিন ধীরে ধীরে স্ত্রীর সঙ্গে বিচরণ করছি, এমন সময় পৰ্বতের ধারে কোনও স্থানে অতি সুন্দর কচি ঘাস দেখতে পেলাম। সে সময় চারদিকে অগ্নি জ্বলছিল, অগ্নি আমাদের বেষ্টন করেছে দেখে স্ত্রীকে বললাম “আমার পায়ে কাটা ফুটেছে, আমি চলতে এক প্রকার অসমর্থ। অগ্নি প্রবল হলে আমার পক্ষে অগ্নি অতিক্রম করা কঠিন হবে।” কিন্তু মহারাজ ! স্ত্রীজাতি স্বভাবতঃই একটু পেটুক, স্বল্পাহারে কখনও তৃপ্ত হয় না।
“আমি স্ত্রীলোক হয়েও ভয় করি না, আর তুমি পুরুষ হয়ে ভয় কর?”–স্ত্রীর এই ভৎসনায় আমিও ঘাস খেতে প্ৰবৃত্ত হলাম। দেখতে দেখতে অগ্নি চতুর্দিক বেষ্টন করে ফেলল। তখন আমার স্ত্রী হরিণ এক লাফে অগ্নি পাড় হয়ে গেল; কিন্তু আমি ভীষণ যন্ত্রণায় অগ্নিমধ্যে প্ৰাণ হারলাম। মৃত্যুকালে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, “পরজন্মে আর স্ত্রীলোকের মুখ দর্শন করব না।”
রাজকন্যা এই সময়ে আর ক্ৰোধ সংবরণ করতে পারলেন না । মনের আবেগে বলে উঠলেন–“নির্লজ্জ! কেন আর মিথ্যা কথা বলছ? তুচ্ছ প্ৰাণ নিয়ে পালানোর কথা কি এত শ্ৰীঘ্রই ভুলে গেছ। আমি তোমার জন্যই তো গর্ভাবস্থায় অগ্নিমধ্যে প্রাণ হারাই।”
টেটন বাধা দিয়ে বলে উঠল,-“কখনই না, তুমিই আমাকে অগ্নিমধ্যে ফেলে দিয়ে তুচ্ছ প্ৰাণ নিয়ে পলায়ন করেছিল।”
এইভাবে পর্দার উভয় দিক হতে বাকবিতণ্ডা চলতে লাগল। তখন মন্ত্রী বলে উঠলেন,-“মহারাজ! দু’জন পূৰ্ব্বজন্মে নিশ্চয়ই স্বামী-স্ত্রী ছিল, এখানে অবিলম্বে তাদের বিবাহ দিন।”
এইরূপে টেটনের সহিত রাজকন্যার বিবাহ হল । দেশে ফিরে এসে টেটন পরম সুখে বাস করতে লাগল।
একদিন রাজা, মন্ত্রী ও টেটনকে রাস্তায় একসঙ্গে ভ্রমণ করতে দেখে মহাজন প্রথমে রাজাকে, তৎপর মন্ত্রীকে এবং অবশেষে টেটনকেও অভিবাদন করল ।
অমনি মন্ত্রী বলে উঠলেন,-“মহাজন! এতদিনে তোমার প্রশ্নের সম্পূর্ণ মীমাংসা হল, তুমি নিজেই-ধন সম্পত্তির চেয়ে বুদ্ধির প্রাধান্য স্বীকার করলে।”
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প