::মীরার প্রতি আমার ভালোবাসা যত গভীর ছিলো, তার প্রকাশটা ততই কম ছিলো। আমি কখনোই রোমান্টিক ছেলে ছিলাম না। তাই বিয়ের ব্যাপারে আমার তেমন কোন মেয়ে পছন্দ ছিলো না।
বাড়ি থেকে প্রায়ই বলা হতো বিয়ে করতে। সময় নাই অসময় নাই, মা বলবে, ও মতিন, এইবার তো বাপ একটা বিয়েথা করা লাগে। কোনো মাইয়া পছন্দ আছে?
আমি বিরক্ত হয়ে মায়ের দিকে তাকাই। মা আমাকে ভয় পায়। আমার চোখ দেখেই অন্য রুমে চলে যায়। আব্বাকে দিয়ে বলায়। আব্বাও মায়ের মত অসময়ে বিয়ের গল্প উঠায়। হয়তো শুয়ে আছি ক্লান্ত হয়ে। আব্বা ডেকে উঠাবে। বলবে- মতিন, আর কদ্দিন? মেয়ে কি পছন্দ করা আছে?
আমি রাগ করে বলি, আব্বা, তুমি আর মা কি মাছি নাকি?
বাবা অবুঝের মত উত্তর দেয়, মাছি? মাছি হইতে যামু ক্যান? এইডা কী কথা!
আমি অন্য কাজ করতে করতে বলি, তাইলে এত প্যান প্যান করো কেন? বিয়ে করবো না কইছি?
একদিন রাতে খাবার সময় মা লটারী বিজেতা নারীর মত প্রায় চিৎকার করে বললো, মাইয়া পাইছি। খুব সুন্দর।
আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। বললাম, মাইয়া পাইছো মানে? মাইয়া কি হারায় গেছিলো নাকি?
মা আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলে, খুব সুন্দর মাইয়া। অনেক লক্ষ্মী।
আমি ভাত চটকাতে চটকাতে বলি, সুন্দর-অসুন্দর নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নাই। মাইয়া হইলেই হবে।
আমার ইচ্ছাতেই এক ঝুম বৃষ্টির দিনে সাদামাটাভাবে মীরা আমার ঘরে এলো। সাধারণ ঘরের মেয়ে। খুবই লক্ষ্মী। দেখতে ভালো। অনেক মায়াবী।
বিয়ের রাতে আমি ঘুমাতে যাওয়া আগে শুধু বললাম, ঘুমায় পরো। আমি কিন্তু তোমাকে অনেক বিরক্ত করবো। মেনে নিও। তোমার নাম যেন কী?
মীরা বিছানায় স্থির হয়ে বসে থাকলো। প্রায় আধাঘণ্টা পর বললো, আমার নাম মীরা।
আমাদের বিয়ের নয় মাসে মীরার সাথে কখনো ঝগড়া করিনি- তা নয়, ঝগড়া করেছি। অতি ক্ষুদ্র আর তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করেছি, রাগও দেখিয়েছি। মীরা নিঃশব্দে সব মেনে নিয়েছে। বাড়াবাড়ি রকমের মেজাজও দেখিয়েছি। তবুও মীরা তেমন কিছু বলেনি।
একবার মাঝরাতে কী নিয়ে রাগারাগি হলো। আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে ওকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেললাম। মীরা অসহায় মেয়ের মত হোচট খেয়ে নিজেকে সামলে নিলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কতক্ষণ। আমার বড় লজ্জা লাগতে লাগলো।
সকালে রাগ করেছি, দুপুরে রাগ ভেঙে গেছে। বাসায় ফিরে বলেছি, ভাত দাও তো মীরা। ক্ষুধা লাগছে। মীরা হাসতে হাসতে চুপচাপ খাবার দিয়েছে। আমি খেতে খেতে মিথ্যা বলেছি, রাগারাগির কথা মনে ছিলো না। কেবল মনে পড়লো। ভাত খাওয়া বাদ দেবো?
মীরা খুশি হয়ে আরেক চামচ ভাত তুলে দিয়েছে।
মাঝে মাঝেই রাগ করে সারাদিন বাড়ি আসিনি এমনও হয়েছে । দুপুরে ঘরে খাইনি, ইচ্ছা করে সারা সন্ধ্যায় আড্ডা দিয়ে রাতে ফিরেছি বাসায়। প্রতিবার মীরা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থেকেছে।
পোলাও মাংস রান্না হলে আব্বা আমাদের সাথে না নিয়ে একা খান না। তাই আমরা আগে খেয়ে ফেললেও আব্বার সাথে বসে খেতে হয়। কোনো অজুহাত আব্বা শোনেন না। অনেক রাতে ফিরে আব্বার সাথে খেতে বসেছি। তখন টেবিলে খেতে বসলে দেখা যায়- মীরা আমার পাতেই বেশি বেশি খাবার তুলে দিচ্ছে। তখন মীরার সাথে চোখাচোখিও হয় না । ভেতরে সেই ঝগড়া করার রাগটা পুষেই রাখি। আমি খেয়ে-দেয়ে আবার বেরিয়ে যাই।
আমি বেশ রাত করে ঘরে ফিরি। মীরা পাশ ফিরে শুয়ে থাকে। আমিও চুপচাপ কথা না বলে শুয়ে পড়ি। সময় গড়াতে থাকে, রাত বাড়তে থাকে। আমি ইচ্ছা করে নিশ্বাসের শব্দ গাঢ় করি। ভাবখানা এমন যে আমার খুব ঘুম হচ্ছে। আমি এপাশ ওপাশ করি- ঘুম আসে না।
এক পর্যায়ে আমি আস্তে করে মীরার কাঁধে হাত রাখি। মীরা চমকে আমার দিকে মুখ তুলে তাকায়। তখন অভিমানে মীরার দুচোখ ভেজা থাকে। অন্ধকারেও আমি বুঝি। শতভাগ নিশ্চিত হতে আমি সে চোখ মুছে দেয়ার জন্য হাতের আঙুল মীরার গালে রাখি।
মীরার চোখের জল মুছতে গিয়ে নিজের চোখও ভিজিয়ে ফেলি আমি। অবাক হই আমি আমাকে দেখে।
নিজের এক অচেনা পরিচয়ে খুব পরিতৃপ্তি পাই। অন্ধকারে দুজনে চোখে চোখে তাকিয়ে থাকি। যেন দুজন দুজনকে দেখতে পাচ্ছি।
জীবনে প্রথমবারের মত কাউকে বলি-
মীরা তোমাকে ভালোবাসি।
আব্বার বন্ধু সন্তোষ কাকা প্রায়ই এসে আমাদের বড্ড বিরক্ত করেন। অত্যন্ত ভালো লোক। অথচ আমার বিরক্ত লাগে। পান খাওয়া মুখে মুখ বাঁকা করে কীভাবে যেন বলে, তা বৌমা মিষ্টি খাওয়াবা কবে?
মীরা বোঝে না। নাকি না বোঝার ভাণ করে কে জানে। ও করে কী ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে পিরিচে সাজিয়ে দিয়ে বলে, এই নিন কাকা মিষ্টি খান। সন্তোষ কাকা অসন্তোষে বলেন, আরে কী কয়, ডায়াবেটিস রোগীর আবার মিষ্টি।
একবার সীতাকুণ্ড থেকে আমার বোন লায়লা আসবে কিছুদিন থাকার জন্য। দূরের পথ। বাচ্চা-কাচ্চা আর তল্পিতল্পা নিয়ে আসবে তাই মা আমাকে বাস স্টেশনে যেতে বললো। কাজ থাকায় গেলাম না। বললাম আব্বাকে যেতে। আব্বা জানালো মাকে নিয়ে আব্বাই যাবে। সমস্যা নাই।
সেদিন দুপুরে বাসায় ফিরে দেখি গেট খোলা। মা-বাবা নিশ্চয়ই আপাদের আনতে গেছে। দরজা খোলা যেহেতু তাই আমি চুপি চুপি বারান্দায় আসতেই গেস্টরুমের পাশে এসে থমকে দাঁড়ালাম।
রুমের ভেতর থেকে সন্দেহজনক শব্দ আসছে। আমি কখনো লুকিয়ে কিছু দেখার আগ্রহ কখনো বোধ করিনি। বাসায় যেহেতু মীরা একা, তাই আমি আগ্রহ ভরে জানালার সামান্য ফুটো দিয়ে ভেতরে তাকালাম।
আমার পুরো পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেলো।
সাদা পাঞ্জাবী পরা সন্তোষ কাকা, আর মায়ের দেয়া সবুজ শাড়ি পরা মীরা। ছিঃ!
জানালার দিকে মুখ করে সন্তোষ কাকা। পানের পিকে মুখ-গলা ভেসে গেছে। জানালার দিকে পিঠ দিয়ে চুল ছেড়ে রাখা মীরা এর সাথে এমন ঘনিষ্ঠভাবে বসেছে।
আমি বেরিয়ে এলাম।
এই অবস্থার প্রতিবাদ করার মত শক্তি ও রুচি কোনোটাই আমি পেলাম না।
প্রায় মাঝরাতে বাসায় ফিরে দেখি উঠোনে মীরা দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঢুকতেই এগিয়ে এলো। আমি কেন রাত করে ফিরেছি এ নিয়ে প্রশ্ন। উত্তর দিতে ইচ্ছে করলো না। মীরাকে কিছু বললামও না।
বাসায় খুব হৈচৈ হচ্ছে। আমি বাচ্চাদের মত অভিমান, কষ্ট, লজ্জায় শুয়ে থাকলাম। কারো সাথেই দেখা করলাম না। আপা একবার এলো রুমে।
শুনলাম মীরা বলছে, ওর মনে হয় শরীর ভালো না। ঘুমিয়ে পড়েছে।
কয়দিন আমি বাসায় ঠিকমত এলাম না। আমি কিছুতেই মীরার এমন কাজ মেনে নিতে পারলাম না।
আমি জীবনের কঠিন সিদ্ধান্তগুলি হুটহাট নিয়েছি। তাই এবারও সিদ্ধান্ত নিলাম মীরাকে ডিভোর্স দেবো। এক দুপুরে বাসায় ফিরে কাগজপত্র মায়ের হাতে ধরিয়ে দিলাম। মা অবাক হয়ে বলে,
কীসের দলিল এইগুলা?
আমি উত্তর না দিয়ে মায়ের হাত থেকে কেড়ে নিলাম কাগজগুলো। সরাসরি মীরাকে দিলাম। মীরা কিছুই বুঝলো না মায়ের মত। প্রশ্ন করার আগেই গায়ের শক্তি দিয়ে চড় বসিয়ে দিলাম ওর গালে।
বাড়ি যাই না কিছুদিন। মা দোকানে লোক পাঠায় বাড়ি যেতে। আব্বা আসে। সাফ জানিয়ে দিয়েছি মীরা চলে না গেলে আমি বাড়ি যাবো না।
মীরা নাকি সারাদিন কান্নাকাটি করে। আমার একটুও মায়া লাগে না। নিজে ঠকেছি, এজন্য কষ্ট পাই। মীরার কষ্ট ভাবার সময় আমার নাই।
ছয়দিনের দিন মীরা চলে গেলো।
বাড়ি ফিরলাম। দুদিন খুব ঘুমালাম। আপারা আনন্দ করতে এসেছিলো। আমার জন্য সব নষ্ট হয়ে গেলো। আপা রাতে আমার ঘরে এসে একদিন বললো,
মতিন, সন্তোষ কাকা যেন আর বাড়ি না আসে। বাবাকে নিষেধ করে দিস।
সব শুনলাম।
আমাদের বাড়িতে কোন রান্নাবান্নার বড় কাজ হলে মিঠুর মা সাহায্য করতে আসে। মিঠুর মা এসে আপাকে বলেছে সন্তোষ কাকা নাকি মিঠুর মাকে খুব জ্বালায়। যেদিন আপারা আসবে সেদিন মিঠুর মা আসে দুপুরে।
মীরা গিয়েছিলো পাশের বাসার মনি খালার কাছে কী একটা দরকারে। তখন মিঠুর মাকে গেস্টরুমে ডেকে নিয়ে নাকি সন্তোষ কাকা….!
আমি সবুজ কাপড়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম মিঠুর মাকে ডেকে। জানালো, মীরাই নাকি দিয়েছে সেই দুপুরে। বলেছে পুরাতন কাপড় বদলে ওটা পরে নিতে।
আমি মীরাদের বাড়িতে মীরার ঘরের বিছানায় বসে আছি। অনেকেই আমাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখছে। হয়তো বলতে চাইছে, মীরার মত ভালো একটা মেয়েকে আমি এভাবে কষ্ট দিতে পারলাম।
মীরার সাথে একা কথা বলার জন্য সবাইকে বাইরে যেতে বললাম। মীরার দিকে তাকাতে পারছি না। এত লজ্জা লাগছে। মীরার চোখের নিচে কালি জমে গেছে। শুকনো মুখ। যেন ঝরে যাওয়া ফুল। মীরাই আগে বললো, কেন এটা করলে?
আমি ক্রমেই ডুবে যেতে লাগলাম অন্ধকারে। ফিসফিস করে বললাম, আমাকে মাফ করে দাও। চলো আমার সাথে।
মীরা কারণ জানতে চায় আবার। আমি আবারও বিড়বিড় করি, কোন কারণ ছিলো না। কারণ ছাড়াই নিতে এসেছি আবার। চলো। আমার মাথায় সমস্যা আছে মীরা। বিয়ের রাতে বলেছিলাম না আমি তোমাকে খুব জ্বালাবো। তুমি তো মেনে নিয়েছিলে।
মীরা আমার কাছে এসে মাথার চুলে হাত লেপ্টে দেয়। কাঁপা গলায় বলে, কাঁদো কেন? আমি যাচ্ছি তো। বলো কাঁদো কেন?
আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, দ্বিতীয় বারের মত আমি মীরার সাথে কাঁদছি।
মীরার গালের জল মুছে দিতে দিতে বলি, তেমন কোনো কারণ নেই। কাঁদতে ভালো লাগছে। অদেখার মানুষেরা মাঝে মাঝে কাঁদে।
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প