কথায় বলে, নাপিতের ষোল চুঙা বুদ্ধি! নাপিত বাদশা-উজির হইতে আরম্ভ করিয়া পণ্ডিত, বৈজ্ঞানিক, গায়ক, কবি, সওদাগর বহু রকমের লোককে খেউড়ি করে। খেউড়ি করিবার সময় সে তাহাদের নিকট বহু রকমের কথা শোনে, বহু রকমের কেচ্ছাকাহিনী শোনে। তাই সাধারণ লোকের চাইতে নাপিতের বুদ্ধি বেশি। হইলে কি হইবে ? সবাই নাপিতকে অবহেলা করে। কিন্তু তাহার কাজটা এমনই বা খারাপ কিসে? সে না থাকিলে দাড়ির জঙ্গলে সকলের মুখ ঢাকা থাকিত। কেউ কাহাকেও চিনিতে পারিত না । হাতের পায়ের নখ বড় হইয়া মানুষ বনের বাঘ ভালুকের মতো হইত।
বামুন ঠাকুরের নাপিত চাকর । ঠাকুর মহাশয় শিষ্য বাড়িতে যায়– যজমান বাড়িতে যায়। এদেশে সেদেশে তার ঝুলি-কাথা মাথায় করিয়া নাপিতও সঙ্গে সঙ্গে যায় । তিন চার বৎসর এইভাবে চাকুরি করিয়া সে ঠাকুর মহাশয়ের পূজা-আর্চা, তন্ত্রমন্ত্র সবই শিখিয়া ফেলিল । কেহ কোনো অপরাধ করিলে তাহার প্রায়শ্চিত্তের কি কি বিধান দিতে হইবে, কোন দিন কোন মাসে কি খাইতে হইবে, সকলই সে জানিয়া ফেলিল । সে মনে মনে ভাবে, “দেখরে আমি কেন দেশে দেশে এই বামুন ঠাকুরের বোচকা-কাথা মাথায় করিয়া ঘুরি ? ইচ্ছা করিলে আমিই ত বিদেশে যাইয়া লোকের পূজা-আর্চা করিয়া বেশ দুই পয়সা উপার্জন করিতে পারি। বিদেশে কে কাহাকে চেনে ? আমাকে চাকর বলিয়া সকলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। আর যখন জানিতে পারে, আমি জাতিতে নাপিত, তখন আমাকে লইয়া কত ঠাট্টাই না করে । কিন্তু আমার বুদ্ধি আছে। এই বুদ্ধির জোরে আমি বিদেশে যাইয়া ব্রাহ্মণ হইয়া সকল জাতির সম্মান পাইব ।”
সত্য সত্যই একদিন সে মাথা হইতে ঠাস করিয়া মাথার আপনার চাকরি আমি আর করিব না! এই রহিল আপনার গাট্টিবোচকা, আমাকে বিদায় দিন।”
ঠাকুর মহাশয় ত আকাশ হইতে পড়িলেন : “কেনরে! তুই চাকরি করবি না কেন ?” নাপিত বলিল, “আজ তিন চার বৎসর আপনার গাট্টিবোচকা মাথায় করিয়া দেশে দেশে ঘুরিতেছি। আপনি মাসে আট টাকা মাত্র বেতন দেন। আমি এ চাকরি আর করিব না।”
কতদিনের বিশ্বাসী চাকর, কার ছাড়িতে প্রাণ চায়! ঠাকুর টাকা বাড়াইয়া দিব।”
“দুই টাকার আর কি লোভ দেখান ঠাকুর মশাই ? আপনি তার সবই শিখিয়া ফেলিয়াছি। আমি নিজেই এখন বামুন সাজিয়া দেশে দেশে গাওয়াল করিব! আপনার মতো আমিও বহু টাকা কামাই করিব! বিদেশে কে বামুন, কে নাপিত, কার কে খোজ রাখে !”
সত্য সত্যই নাপিত বামুনের চাকরি ছাড়িয়া, গলায় একটি পৈতা ঝুলাইয়া একখানা পুরান নামাবলী গায় দিয়া এদেশ হইতে আর এক দেশে যাইয়া উপস্থিত হইল। সেখানে যাইয়া সামনে দেখে মস্ত এক গৃহস্থবাড়ি। গৃহস্থ জাতিতে কায়স্থ। নাপিত ত জানেই কায়স্থদের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতে খুব ভক্তি ।
তখন বেলা সন্ধ্যা হইয়াছে । বাড়ির সামনে যাইয়া, বামুনবেশী নাপিত বলিল, “দেখুন, আমি একজন বিদেশী ব্ৰাহ্মণ । আজিকার মতো আপনাদের এখানে থাকিতে চাই ।”
গৃহস্থ লোকটি বড় ভাল, আবার ব্রাহ্মণের উপর তার বড়ই ভক্তি। সে বলিল, “আপনি অনায়াসে আমার এখানে থাকুন। আপনি ত ব্রাহ্মণ । আমাদের রান্না খাইবেন না। আপনার রান্নার ব্যবস্থা করিয়া দিতেছি।”
বামুনবেশী নাপিত তার বোচকা-বুচকি রাখিয়া-বাহির বাড়িতে রান্না করিতে আরম্ভ করিল। এই বিদেশী লোকটিকে রান্না করিতে দেখিয়া পাড়ার যত ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আসিয়া চারিপাশে
ভিড় করিয়া দাড়াইল । এ বাড়ির বড় কর্তা, ও বাড়ির মেজো কর্তা, সে বাড়ির ন কর্তা আরও অনেকে আসিল । ঠাকুর মহাশয় রান্না করে আর গায়ের লোকদের সঙ্গে একথা সেকথা আলাপ করে ।
তারপর বলে, “দেখুন, আপনাদের গ্রামে এতগুলি ছোট ছোট ছেলেপেলে, এদের জন্য একটা ভাল টোল নাই। লেখাপড়া না শিখিয়া ইহারা সকলে মূর্থ হইয়া থাকিবে।” গায়ের প্রধান উত্তর করেন, “দেখুন, এই অজ পাড়াগায়ে একজন ভাল বামুন পণ্ডিত নাই। এখানে কি করিয়া টোল খুলিব ?”
নাপিত একগাল হাসিয়া বলে, “আপনারা যদি ইচ্ছা করেন, আমি এখানে টোল খুলিয়া আপনাদের ছেলেপেলেদের লেখাপড়ার ভার লইতে পারি।” আগেকার দিনে স্কুলকে টোল বলিত । গ্রামের মোড়ল যেন আসমানের চাঁদ হাতে পাইলেন। তিনি বলিলেন, “বিলক্ষণ, আপনার মতো পণ্ডিত ব্যক্তি যদি ছোট ছেলেপেলেদের পড়ানোর ভার নেন, তবে কাল হইতে আমারই এখানে টোল খুলিতে পারি।”
গ্রামের লোকেরা অতি উৎসাহে সারা রাত জাগিয়া টোলের ঘর তৈরি করিল। পরদিন সকাল হইতে নাপিত ছেলেদের পড়াইতে আরম্ভ করিল। ছোট ছোট ছেলেপেলে । কি আর এমন কঠিন পড়া! ক, খ, র বইও পড়ে নাই। নাপিতের ত বর্ণ-পরিচয় পড়াই ছিল ।
এদের পড়াইতে নাপিতের এতটুকুও বেগ পাইতে হইল না। শোনাশোন নাপিতের প্রশংসা নানা গ্রামে ছড়াইয়া পড়িল । এমন পণ্ডিত কোনো দেশেই দেখা যায় না! সাতশাস্ত্র তার মুখের মধ্যে পোরা!
দেশে না রকম আচার পদ্ধতি, নিয়ম কানুন, কুলাচার, লোকাচার, দেশাচার ; এগুলির পানটুকু হইতে চুনটুকু খসিবার উপায় নাই। কেউ যদি সেইসব নিয়মের এতটুকু ভঙ্গ করে, অমনি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের কাছে ছুটিয়া যায়। তাকে জিজ্ঞাসা করে, কি করিলে সেই অপরাধ হইতে মুক্ত হওয়া যায়। আর আর ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা এরূপ অবস্থায় কত শাস্ত্র ঘাটিয়া, বেদ-বেদান্ত উল্টাইয়া পাল্টাইয়া, কত অনুস্বর বিসর্গ শ্লোক আওড়াইয়া সামান্য অপরাধের জন্য বড় বড় প্রায়শ্চিত্তের ফর্দ দেন। তাহা পালন করিতে অপরাধীর জীবন-অন্ত । কিন্তু নাপিতবেশী পণ্ডিত অত বই পুথি ঘাটে না ; সে যাহা বিধান দেয় অশিক্ষিত গ্রামবাসীরা সহজেই তাহা পালন করিতে পারে।
কেহ আসিয়া বলে, ঠাকুর মহাশয়! আজ আমি গঙ্গাস্নান না করিয়াই দুইটা সবরি কলা খাইয়া ফেলিয়াছি। আমার কি হইবে?”
নাপিত তৎক্ষণাৎ উত্তর করে, “আট হালি সবরি কলা আনিয়া এই ব্ৰাহ্মণকে উপহার দেও ! তোমার কোনো অপরাধ হইবে না ।”
আর একজন বলে, “আজ রাতে স্বপ্নে দেখিয়াছি, আমি রসগোল্লা খাইতেছি । ঘুমে খাওয়া ত অন্যায়! আমাকে কি করিতে হইবে ?”
নাপিত উত্তর করে, “বিশেষ কিছুই করিতে হইবে না । সোয়া পাঁচ সের রসগোল্লা আমার কাছে আনিয়া দাও । আমি মন্ত্র পড়িয়া তোমার সকল অপরাধ খণ্ডন করাইয়া দিব ।”
লোকটি খুশি হইয়া সোয়া পাঁচ সের রসগোল্লা লইয়া আসে । এইভাবে এটা ওটা ভেট পাইয়া নাপিতের দিন খুব সুখেই কাটিতে লাগিল ।
সেই দেশে ছিল একজন কুলীন ব্রাহ্মণ । তার দুইটি মেয়ে। বরকে অনেক টাকা দিতে হয় । মেয়ের বাপ গরিব বলিয়া এতদিনেও মেয়ে দুইটির বিবাহ দিতে পারেন নাই। সেদিন ব্রাহ্মণের স্ত্রী বলিতেছেন, “বলি ঠাকুর মশায়, তোমার চোখের কি মাথা খাইয়াছ ?”
ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন ? কি হইয়াছে ?” গৃহিণী ঝঙ্কার দিয়া উত্তর করেন, “ওদিকে মেয়ে দুটি যে কলাগাছের মতো বাড়িয়া উঠিল, এদের বিবাহের বন্দোবস্ত করিবে না ?” ব্রাহ্মণ যুবক নাই। কার সঙ্গে মেয়ের বিবাহের যোগাড় করিব ?”
ব্রাহ্মণী বলেন, “তোমার চোখে কি ঢেলা ঢুকিয়াছে ? শুনিয়াছি, গ্রামের টোলে যে নতুন পণ্ডিত মহাশয় আসিয়াছেন, তিনি বিবাহ করেন নাই । তার সঙ্গে মেয়ের বিবাহের প্রস্তাব কর না কেন ?”
ব্রাহ্মণ উত্তর করিলেন, “এ অতি উত্তম প্রস্তাব। কালই দুপুরে যাইয়া আমি টোলের পণ্ডিত মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করিব।”
পরদিন সত্য সত্যই ব্রাহ্মণ দুপুরবেলা নাপিতের টোলে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেশী একজন ব্রাহ্মণকে দেখিয়া নাপিত মনে মনে প্রমাদ গণিল । না জানি কোন কঠিন শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করিতে
পারে নাই ; তাই আমার কাছে সাহায্য চাহিতে আসিয়াছে। হায় হায় রে! আজই বুঝি ধরা পড়িয়া যাই ।
ব্রাহ্মণ নাপিতকে শুভ সম্ভাষণ জানাইয়া বলিলেন, “দেখুন, একটা হাতি যদি কাদায় পড়ে, আর একটা হাতি দিয়া তাকে ডাঙায় তুলিতে হয়। একটা জাহাজ যদি বালুর চরায় আটকা পড়ে, আর একখানা জাহাজ দিয়া তাহাকে টানিয়া জলে নামাইতে হয় । আমি ব্রাহ্মণ— আপনিও ব্রাহ্মণ । আমার বিপদে আপনিই শুধু আমাকে সাহায্য করিতে পারেন।” শুনিয়া নাপিতের মুখ আরও শুকাইয়া গেল। এইবার বুঝি ব্রাহ্মণ কোনো কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন ! কোনো রকমে ঢোক গিলিয়া নাপিত উত্তর করিল, “তা আমি আপনার কি কাজে আসিতে পারি ?”
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প