বিহারী দারোগা ঠুঁটাে জগন্নাথ নয়। তল্লাটের দশ-বারো জন ছিচকে চােরকে লকআপে পুরে অ্যায়সা টাইট দিয়েছেন বলেই সব চােরের এখন ‘পালাই-পালাই’ অবস্থা। শোনা গেছে দাগী চোর-বাটপাড় আর বদমাশরা চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই ছেড়ে দিয়ে, খুন-খারাপি-গুণ্ডামি ছেড়ে দিয়ে ট্রেনে বাদাম লজেন্স হকারি করছে। ফলে, মগরা-হাট থানায় এখন কোনও ঝক্যি নেই। ঝক্যি বলেই নাদুস-নুদুস ভুড়িঅলা বিহারী দারোগা থানার সেই গদিঅলা চেয়ারে বসে, টেবিলে জুতো-সমেত পা তুলে দিয়ে ফো-র-র ফোৎ-ফো-ব্র-র ফোৎ—ৎ করে দিনেরাতে নাক ডাকিয়ে ঘুমোন।
সেই ঘুম হালদার পুকুরের পশ্চিম পাড় থেকে স্পষ্ট শোনা যায়। পাড়ার ছোকরা ছেলেরা সেই ডাক শুনে হাসে। প্রাইমারী স্কুলেল ছেলেরা বলে, বাহিরী দারোগার নামের ভেতর দিয়ে ডায়মণ্ডহারবার লোকাল যাচ্ছে।
সেই ঘুমের মাঝে হস্তদন্ত হয়ে থানায় ছুটে আসেন হরিপদ। তখন দারোগার মতো খৈনি জল মুখে দিয়ে কাঠের টুলে বলে ঝিমোচ্ছিল জোকার মার্কা কনস্টেবলটিও। সব মিলিয়ে শান্তির পরিবেশে, থানায় বড়বাবু থেকে মেজবাবু, মেজবাবু থেকে সেজবাবু, সেজবাবু থেকে কনস্টেবল-হােমগার্ড সবারই ক্লান্তিহীন অবিরাম ঘুমের কমপিটিশন চলছিল। নিদ্রাভঙ্গের কোন কারণই ছিল না।
সেই শান্তি ভঙ্গে বাদ সাধল সোনার কারবারি হরিপদ বেনে। হরিপদ সেলিম-ডাকাতের ভয়ে কাঁপতে-কাঁপতে বড়বাবুর মানে বিহারী দরোগার ঘরে ঢুকে বলে—“বাঁচান বড়বাবু! বাঁচান! বাঁচান!”
কে কাকে বাঁচাবে! থানার সব জীবিত প্রাণীগুলো বুদ্ধদেবের নীতি-আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে, ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গিয়ে যেন গভীর ধ্যানে মগ্ন। হরিপদ প্ৰাণের ভয়ে যতই চেঁচাক না কেন, কে শুনবে সেই হাদয়বিদারক কাতর আবেদন!
হরিপদ বেনে জুতো সমেত বিহারী দরোগার দু’টাে পা জড়িয়ে ধরে বলে—“দারোগাবাবু আপনার পদ ধরে ডাকছে হরিপদ, আমাকে বাঁচান। আমি ডাকাতের ভয়ে জর্জরিত!”
বিহারী দারোগার তবুও সেই ফোর-র-র ফোৎ-ফোর-র-র ফোৎ থামছে না। মনে হচ্ছে, ক্রেন দিয়ে চেয়ার সমেত দারোগাবাবুকে পুলিশ মন্ত্রীর সামনে কিংবা পুলিশের হেড কোয়ার্টার লালবাজারে নিয়ে গেলেও, শান্তিপ্রিয় মানুষটির ঘুম ভাঙবে না।
হরিপদ হাত কচলাতে-কচলাতে বলে—“ইস যদি ব্যবসা না করে, সরকারি চাকরি করতুম তাহলে ভালো হত। সরকারি চাকরিতে এমন ঘুমোন যায়, তা জানা ছিল না।
ভাবতে ভাবতে হরিপদর মনে পড়ে যায় ডায়মন্ডহারবারের সেলিম ডাকাতের কথা। সন্ধে হলেই সেলিম আসবে দলবল নিয়ে। সেলিম-সেলিম ভাবতে-ভাবতে ডুকরে কেঁদে ফেলে হরিপদ। থাকতে না পেরে কুম্ভকৰ্ণ দারোগার ঘুম ভাঙানোর জন্য জুতো সমেত পা ধরে হেঁচকা টান মারে হরিপদ। সেই টানে বিহারী দারোগা চমকে উঠেন। কাঁচা অমন ঘুমের ব্যাঘাত কেন হল, তা ঠাওর করতে পারলেন না। ধড়মড়িয়ে চেয়ার থেকে কাৎ হয়ে পড়ে গিয়ে পকেট থেকে হুইসেলটা বাজিয়ে দিলেন।
হুইসেলের আওয়াজে মগরাহাট থানার সব ক’টা ‘ফোর-র ফোৎ- ফোরর ফোৎ লোকাল ট্রেনের যাত্রার বিঘ্ন ঘটল। রে-রে-রে করে ছুটে এলো। সেজ-মেজ-ন’ সেজ সবাই।
হরিপদ কানো হাত দিয়ে মাফ চাইবার ভঙ্গিতে বলে, মাফ করবেন হরিপদকে। অধম আপনার ঘুমের বিঘ্ন ঘটিয়ে ফেলল।”
বিহারী দারোগা আড়মোড়া ভেঙে হাঁসের ডিমের মতো বড় বড় চোখ বার করে গর্জে ওঠেন—‘বটে! কাঁচা ঘুম পাকা ঘুম কাকে বলে জানো না? পুলিশের লোকের গায়ে হাত দেওয়া মোটেই শোভন কাজ করনি। শান্তিভঙ্গের অপরাধে—”
—“শান্তিভঙ্গ নয়—শান্তিভঙ্গ করিনি। আপনার পদযুগল ধরে ঘুম ভাঙাতেই—।”
—“নো-নো-নো ঘুম! আমি ঘুমুই নি। অন ডিউটিতে চােখ বুজে থাকার ভান করেছিলুম। তাই শান্তিভঙ্গের অপরাধে তোমাকে আমি লকআপে পুরে দিতে পারি।”
—“মাফ করে দিন হুজুর। আপনি আমাদের বড়বাবু, দুদে অফিসার। আপনি আমাদের পালনকর্তা, আপনি আমাদের বাপের মতো।”
বিহারী দারোগী হঠাৎ ফিক করে হেসে বলে—“আমাদের সম্পর্কে তোমার একটা ধারণাবোধ রয়েছে জেনে তোমাকে ক্রিমিন্যাল প্রসিডিওর থেকে শর্তহীন জামিন দিলাম। তবে আমাকে ‘বাপ’ বলবে না।” বিহারী দরোগা হঠাৎ মুচকি হাসি হেসে বলে—“মানে কী জানো, আমি তো বিয়ে করিনি-চিরকুমার।”
হরিপদ কাঁদো-কাঁদো মুখ করে বলে—“চিরকুমার কেন স্যার? তাহলে তো জেনারেশন অফ হয়ে যাবে!”
—“তা হােক ক্ষতি নেই। আমি জেনারেশনের চিন্তা করি না, আমি আমার এরিয়া থেকে ডাকাতি অফ করতে চাই। ডাকাত নিধনই আমার ব্রত।” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিহারী দারোগা আবার বলেন— ‘চোর ডাকাত ধরতে ধরতে বিয়ে করার সময় পাচ্ছি না। আমি চোর-ডাকাতকে দেশ ছাড়া করতে চাই।”
—“আপনার হাতে তাড়া খেয়ে সব ডাকাত এখন আমার বাড়িতেই ধাওয়া করছে!”
—“দ্যাটস ক্রিমিন্যাল অফেন্স। তুমি জানোনা? চাের-ডাকাতদের শেল্টার দেওয়াও অপরাধ!”
হরিপদ কাঁপতে-কাঁপতে বলে—“আমি ওদের শেল্টার দিতে চাইনি, ডাকাতরা শেল্টার নিতেই আজ আসবে।”
—“কোন ডাকাত স্যার?”
—“সেলিম ডাকাত স্যার। টেলিফোনে জানিয়ে দিয়েছে, রাত্রি আটটার সময় সেলিম ডাকাত সাঙ্গাপাঙ্গ নিয়ে আসবে, ওদের পাঁচ ভরি সোনা দিতে হবে নইলে আমাকে সহ আমার পুরো ফ্যামিলি মেম্বারদের খতম করে’ দেবে।”
হরিপদর কথা শুনে বিহারী দরোগা গর্জে ওঠেন। অন্যান্য অফিসারদের নিয়ে বোর্ড বসিয়ে দেন। তারপর হাতের রুলবাড়িটা বন্বন্ করে ঘুরিয়ে বলেন— “দেখাচ্ছি। মজা! সেলিম ডাকাত তোর
একদিন কী আমার একদিন! লকআপে এনে অ্যায়সা টাইট দেব, তোর বাপের নাম ভুলিয়ে দেবো।”
—“কি হবে স্যার আমার ? আমি যে ভয় রাখতে পারছি না। আপনি আমার ফ্যামিলিকে বাঁচান।”
—“কোনও ভয় নেই! সেলিম ডাকাত কী ভুলে গেছে পুলিশ প্রশাসনের কথা ? তুমি বাড়িতে ফিরে যাও। বিকেল থেকেই তোমার বাড়ির চারধারে পুলিশ পোস্টিং করে দিচ্ছি।”
—“দেখবেন স্যার।” হরিপদ গুড়ি-সুড়ি মেরে থানা থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ।
বিকেল থেকেই জনাদশেক বন্দুকধারী পুলিশ সেলিম ডাকাতের অপারেশনে রুখতে ঘিরে ফেলে হরিপদর বাড়ি। হরিপদকে বলে দেওয়া হয়েছে, বাড়ির ভিতরে নির্ভয়ে থাকতে।
পাঁচজন বন্দুকধারী রাইফেলের ট্রিগারে হাত রেখে অতি সাবধানে পায়চারি করতে থাকে। আর মাঝে মধ্যে বিহারী দারোগা জিপ হাঁকিয়ে এসে টহল দিয়ে যান। সব মিলিয়ে পুরো বাড়িটাই বিকেল থেকে পুলিশের দখলে। পুলিশের অনুমতি ছাড়াও কুকুর-বেড়াল দূরে থাক্, একটা মশা-মাছিও হরিপদ বেনের বাড়িতে ঢোকার জো নেই।
এমনি কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সারারাত কেটে যায়। পুলিশের শক্ত বুটের ভয়ে সেলিম ডাকাত ও তার সাঙ্গপােঙ্গরা হানা দিতে ভয় পায়। ভোরের দিকে হরিপদর বউ ঘটি বোঝাই চা করে দেয়
পুলিশদের। পুলিশের লোকজন চা খেয়ে, কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে খৈনি ডালতে-ডলতে বলে—“এবার আমাদের ডিউটি অফ। সকাল হয়ে গেল তো, তাই থানায় গিয়ে রিপোর্ট দিতে হবে।”
পুলিশের লোকজন বিদায় নেয়। হরিপদ ঠাকুরের উদ্দেশ্যে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে—“ঠাকুর, সোনা রাখার জায়গা পাই, কিন্তু ভয় রাখার জায়গা পাই নে!”
পুলিশের লোকজন থানায় ফিরতেই বিহারী দারোগা তুড়ি দিয়ে বলে— “দেখলে তো, আমার নাম শুনেই সেলিম ডাকাত কুঁচকে গেছে, গর্তে ঢুকে গেছে। তোমরা জানবে এই বিহারী দারোগা ডাকাত দমন করেই লালবাজারের পুলিশ কমিশনার পর্যন্ত প্রমোশন নেবেই।”
একজন কনস্টেবল বলে—“পুলিশ কমিশনার হয়ে আমাদের কথা ভুলে যাবেন না স্যার ! দেখবেন তো ?”
—“তোমাদের তখন দেখবো কী করে? পুলিশ কমিশনার পর্যন্ত উঠতে পারলে তবেই বিয়ে করবো। আমি তখন আর চিরকুমার থাকবো না।”
—“আপনার বিয়েতে বলবেন তো স্যার ?”
—“অবশ্যই-অবশ্যই” বিহারী দারোগা খাড়া-খাড়া গোঁফজোড়া নাচাতে থাকে।
ঠিক তখনই একটা বেঁটে সাইজের লোক হাতে বিরাট সাইজের কাতলা মাছ নিয়ে একমুখ হাসি ছড়িয়ে থানায় ঢোকে। লোকটিকে দেখতে পেয়ে বিহারী দারোগা মনে-মনে বলে—“সাত সকলে ঘুমোবার সময় আবার কী নতুন কামেলা ?”
লোকটি হাসতে হাসতে বলে—“ঝামেলা নয়। স্যার, ঝামেলা নয়। আপনাকে একটা পুরস্কার দিতে এলাম।”
—“পুরস্কার কেন?”
—“আপনি যেভাবে ডাকাত দমন করেছেন, মানে হরিপদ বেনের বাড়ি পাহারা দিলেন তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে মগড়াহাটের নাগরিকবৃন্দের তরফ থেকে এই মাছটা দিয়ে গেলাম।”
বড় মাছটা মেঝেতে রেখে লোকটা নমস্কার জানিয়ে বিদায় নেয়।
ঠিক তারপরেই হরিপদ কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসে থানায়— “আমার সর্বনাশ হয়ে গেল বড়বাবু, আমার সর্বনাশ হয়ে গেল! সেলিম ডাকাত সব লুটেপুটে নিয়ে গেল!”
—“সেলিম ডাকাত ! সেলিম ডাকাত! কেন? আমাদের ফোর্স তো সারারাতই ছিল, এই তো মাত্র ফিরল।”
হরিপদ কাঁদতে-কাঁদতে বলে—“পুলিশের লোকজন ফিরতেই সেলিমের লোকজন বোমা ফাটিয়ে আমার বাড়ি দখল নিল। তারপর ভোজালি-ছুরি দেখিয়ে সর্বস্ব লুঠ করে নিল।”
বিহারী দারোগা হুকুম দেয়—“রতন চাঁদ, এক্ষুনিই ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে যাও, তদন্ত করে এসো।”
হরিপদকে জিপে তুলে সেকেন্ডে অফিসার রতন চাঁদ বিরাট পুলিশ বাহিনী নিয়ে তদন্তে রওনা দিলেন।
তখনও ইয়া সাইজের কাতলা মাছটা মেঝেতে পড়ে আছে। মাছ দেখে বিহারী দারোগা হাঁফ ছাড়ে—“আন্নামাসি—আন্নামাসি, মাছটা নিয়ে যাও।”
আন্নামাসি হস্তদন্ত হয়ে বলে—“কি মাছ বড়বাবু?”
—“আমার পুরস্কার, ভালো কাজের পুরস্কার। ভালো করে রান্না করো দিকি। মাছটা খেয়ে ঘুমোব একটু।”
আন্নামাসি চলে যাবার পর বিহারী দারোগা মনে-মনে বলে—“সেলিমের কথার দাম নেই! রাত্রে আসবে বলে সকাল-সকাল হানা দিল। পুলিশ কি দিনরাত সব আগলে রাখবে নাকি!”
রান্নাঘর থেকে আন্নামাসি ছুটতে-ছুটতে এসে বলে—“চিঠি!’ চিঠি মাছের পেটে। আর সোনার হার।’
—“দেখি-দেখি।”
সোনার হারটা দেখে বিহারী দারোগা বলে—“স্টেঞ্জ! মাছটাও ডাকাত নাকি! মাছের পেটে এত বড় সোনার হার?”
তারপর ছোট্ট চিরকুটটা পড়তে থাকে—
হরিপদ বেনের বাড়ি ডাকাতি করে, আপনার হিস্যা স্বরূপ ৫ ভরি ওজনের হারটা পাঠিয়ে দিলুম।
শ্ৰদ্ধাসহ
সেলিম ডাকাত