এই নিয়ে তিন বার বেলটা বাজছে। দশ মিনিট হতে চলল রাজিতা দাঁড়িয়ে। ফিরে যাবে কি না ভাবছে, এমন সময়ে দরজা টা খুলল। “রাজিতা দত্ত ফ্রম দিশারী?”
-“হ্যাঁ।”
-“আসুন”
বাড়িটার ভেতর পা দিয়ে ভারী ভালো লাগলো রাজিতার। রুচিশীল ভাবে সাজানো। রবীন্দ্রনাথের ছবি থেকে ফুলদানির টাটকা রজনীগন্ধা, সব টুকুই বড় স্নিগ্ধ। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে দরজা খুলে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া মানুষটাকে দেখছিল সে। ঘোর কাটল কথা বলার শব্দে।
-” আমি দ্বৈপায়ন সেন। আমার মা, যার জন্য আপনি এসেছেন। একলা থাকেন তো, একটা বন্ধু দরকার আসলে। আমি কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকি। আপনার ভাল লাগবে আশা করি মায়ের সাথে আলাপ করে।”
কথা গুলো এক নিঃশ্বাসে বলে থামলেন উনি। রাজিতা এসছে দিশারী নামক এক সংস্থা থেকে। পেশায় সে জেরিট্রিশিয়ান। অর্থাৎ বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের সবকিছু দেখভাল করার দায়িত্ব যাদের। সে শারীরিক অসুস্থতা হোক বা মানুষিক একাকিত্ব। সামলাতে হয় সব, নিজের সন্তানের মত। দেখা যাক, এই অমৃতা সেন কেমন মানুষ।
আজকের মত কাজ শেষ রাজিতার । দৈনিক আট ঘণ্টা করে থাকার কথা তার অমৃতা দেবীর সাথে। কিন্তু প্রথম দিনেই ওর মনে হচ্ছে আরও কিছুক্ষণ থাকলে পারত। প্রথম দিনেই তিনি ম্যাডাম থেকে ওর কাকিমা। মানুষটাই এমন। যেন কতদিনের চেনা। ফেরার সময়ে নয়তো কেউ বলে, “সকাল সকাল আসবি কাল। অনেক গল্প জমে আছে।”
সেন ভিলায় বেশ কিছু দিন কেটে গেছে রাজিতার। কাকিমা এখন অনেক সুস্থ। ওনার প্রধান অসুখ ছিল একাকিত্ব। রাজিতা তা কাটিয়ে ফেলেছে অনেক টাই। দ্বৈপায়ন বাবুর সাথেও দেখা হয়েছে কয়েকদিন। উনি সত্যিই বড়ই ব্যস্ত আর ভারী চুপচাপ। কথা না বলার কারণ অবশ্য কাকিমা বলেছে ওকে। তিন বছর আগে ভালবেসে করা বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছে ওনার। মেয়েটি নাকি অন্য এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। “দিপ আটকায় নি, ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে গেছে ছেলে টা। ওর বাবা চলে যাওয়ার পর আমার শরীরের কথা ভেবে আমায় বলে না কিছু। কিন্তু আমি জানি ও ভালো নেই।” অমৃতা সেন এমনটাই বলেছিলেন ওকে।
আজকাল রাজিতাও অপেক্ষা করে সেন ভিলায় যাওয়ার। কাকিমা বড্ড ভালোবাসেন ওকে। ছোট্টবেলায় বাবা মাকে হারিয়ে মামারবাড়ি তে বড় হওয়া রাজিতার কাছে এই ভালোবাসা আশীর্বাদ। কাকিমা কে বই পড়ে শোনানো থেকে কাকিমার কাছে রান্না শেখা, সবটাই যেন অভ্যাস হয়ে গেছে ওর। তাছাড়া…. সকালে ও ঢোকার সময় দ্বৈপায়ন বাবু যে বলেন, ” এসে পড়েছেন? আমি বেরোই তবে? ”
ও হেসে বলে,”আসুন “…. এই মুহূর্ত টার অপেক্ষায় থাকে ও।
কেটে গেছে আরও বেশ কিছু দিন। বাড়ি ফেরার পথে গত পরশুর কথা ভাবছিল রাজিতা। পরশু জন্মদিন ছিল দ্বৈপায়নের। কাকিমার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে ও করেছে সবটাই। দ্বৈপায়নের প্রিয় সর্ষে ইলিশ থেকে শুরু করে সারাদিন লো ভলিয়্যুমে রবীন্দ্র সঙ্গীত চালানো। দ্বৈপায়ন দূর থেকে তাকিয়ে দেখেছে আর হেসেছে খালি। খাওয়া দাওয়ার পর বলেছে, “আপনার রান্না তো দারুণ।” আর রাজিতা বাড়ি ফেরার সময়ে বলেছে, “আপনাকে আজ ভারী সুন্দর লাগছিল।”
ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তাটা পেরোতে যেতেই কারা যেন চিৎকার করল খুব জোরে। আচমকা কিছুর সাথে ধাক্কা, খুব হালকা লাগল নিজেকে। আর কিছু মনে নেই তার।
আজ সাতদিন হল রাজিতা নার্সিংহোমে। মামা মামীর মুখ দেখেই বোঝা যায় বিল মেটানোর জন্য যারপরনাই অসন্তুষ্ট তারা। ওদিকে কাকিমার কি খবর তাই বা কে জানে। জানানো হয় নি কিছুই। আনমনে জানলার দিকে তাকিয়ে ছিল রাজিতা। এমন সময় “ওই তো রাজি” শুনে ঘাড় ঘোরাল ও। “কাকিমা তুমি? তুমি এই শরীরে আমায় দেখতে এসেছো?”
“তুই কি রে? কোন দিকে মন থাকে তোর? এভাবে চলা ফেরা করে কেউ রাস্তা ঘাটে? কোন খবর পাচ্ছি না তোর। চিন্তায় মরছি আমি। দিপ কাল রাতে দিশারী তে ফোন করে জেনেছে সব। সকাল হতেই ছুটে এসছি। সুস্থ হ তুই। আর ছাড়বো না তোকে। আমার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখব তোকে এবার।
-” মানে? কিছু বুঝতে পারছি না কাকিমা তোমার কথা আমি! ”
– “তোকে ছাড়া আমার চলবে না রাজি। এই সাতদিনে বুঝেছি। তাছাড়াও, আমার ছেলেটার জন্মদিন এত যত্ন নিয়ে পালন করতে দেখি নি আগে কাউকে । ও আবার হাসছে রাজি । তোর জন্য। কাকিমা থেকে মা হতে পারি না তোর?
আর কি বলার থাকতে পারে রাজিতার!
-“আচ্ছা, বিশ্রাম কর তুই। আমি তোর মামা মামীর সাথে কথা বলি একবার। ওনাদের অমত হবে না আশা করি ।”
এতক্ষণে দ্বৈপায়ন ঘরে ঢুকল।
-” কেমন আছেন এখন”
-” ভাল, আপনি? অফিস ছুটি বুঝি?
-” আপনি আসলে তারপর আপনাকে বলে বেরোতাম রোজ। আপনি না আসলে যাই কি করে? ”
হেসে ফেলে রাজিতা।
-” ভালোবেসে ফেলেছি তোমায় রাজিতা। তুমি ও কি…?”
জানলার দিকে তাকায় রাজিতা। একটা কোকিল ডাকছে। সময়টা মনেহয় বসন্তকাল।