আকাশে একটু একটু করে আলো ফুঁটতে শুরু করেছে।
কুয়াশার কারণে এখনো পুরোপুরি মাটিতে পৌঁছাতে পারেনি।
গ্রামের মুরব্বীরা সবে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হলো।
বিছানা ছেড়ে ঝটপট উঠে পড়লো মাহিন।
সবকিছু গুছিয়ে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পা বাড়ালো শহরের বুকে।
উদ্দ্যেশ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব বিদ্যালয়।
আজ প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে সে।
নব্য কলেজের গন্ডী পেরিয়েছে। সংসারে মা আর ও ছাড়া আর কেউ নেই।
…
..
মাহিনের বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তির সমস্ত ফর্মুলা শেষ। এখন হোস্টেলে ভালো একটা সীট পেলেই মুশকিল আশান।
মাহিনকে বাইরে সোফায় বসিয়ে রেখে পিয়ন অনেকক্ষণ চলে গেছে।
সে পিয়নের জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর পিয়ন এসে জানালো, হোষ্টেলে একটা সীটও খালি নেই।
অন্যান্য ছাত্ররা আগে থেকেই এসে উঠে গেছে।
মাহিন আর দেরী করলো না।
বাড়ীর পথে রওনা দেওয়ার কথা ভাবছে।
বিশ্ব বিদ্যালয়ের গন্ডী পার হতেই মাহিনের চোখে পড়লো একটা পোড়াবাড়ী।
সামনে লিফলেটে লেখা “ভাড়া দেওয়া হবে। যোগাযোগঃ ০১৯৪৫৮৬….”
মাহিন বাড়ীর মালিকের কাছে ফোন করলো।
বেশ কিছুক্ষণ ফোনালাপের পর তিনি মাহিনকে তার বাড়ীতে দেখা করতে বললেন।
মাহিন ঠিকানাটা নিয়ে চলে গেলেন।
,,
বাড়ীতে পৌঁছাতেই ভদ্রলোক দরজা খুলে মাহিনকে ভেতরে বসতে দিলেন।
ঘরের ভেতরটা কেমন অদ্ভূদ ভাবে সাজানো!
সব কিছু অগোছালো ভাবে পড়ে আছে।
দেয়ালের উপরের ঘড়িটা টিক টিক আওয়াজ করে এগিয়েই চলেছে।
ঘড়ির দিকে একপলক চোখ মিলিয়ে নিলো মাহিন।
দুপুর ১:১৯…..
ভদ্রলোক মাহিনের কাছ থেকে পরিচয় জিজ্ঞাসা করে ভাড়া দিতে রাজী হলেন।
সাথে বাড়ীটা সম্পর্কে অনেক তথ্যই দিলেন।
আজ ৪ বছর ধরে বাড়ীটা খালি পড়ে আছে।
এর আগে যে সব ভাড়াটিয়ারা এখানে আসতো তারা কেউ দুই দিনের বেশী টিকতে পারতো না।
মাহিনের মনে মনে কেমন একটা সন্দেহ হতে লাগলো…..
যদি ভূত-প্রেতের কোনো ব্যাপার থাকে তাহলে কী হবে?
এসব কথা ভেবেই সে জানালো….
– আমি ওই বাড়ী ভাড়া নিতে চাই না। (মাহিন)
> সেটা তোমার ইচ্ছা। তবে এই মুহুর্তে শহরের বুকে এর থেকে ভালো থাকার জায়গা আর তুমি পাবেনা। (বাড়ী ওয়ালা)
এবার মাহিনের কপালে একটা ভাবনার ছাপ ফুঁটে উঠলো।
যদি সে এই বাড়ীটা ছেড়ে দেয় তাহলে অন্য কোনো বাড়ীও আপাতত থাকার জন্য পাওয়া যাবে না।
তাই অনেক ভেবে চিন্তে অবশেষে রাজী হয়ে গেলো।
তিনি বাড়ীর মালিককে মাসিক ৩০০ টাকা চুক্তিতে রাজি করালেন।
,,
,,
বাড়ীতে মায়ের সাথে বসে আছে মাহিন। সব কিছু খুলে বলেছে তাকে।
তবে মায়ের মন বলে কথা!
কেমন উশখুশ করছে।
তবুও ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার কথা ভেবে তিনি ছেলেকে শহরে পাঠালেন।
পরেরদিন সকাল বেলা পোড়াবাড়ীটাতে এসে উঠলো মাহিন।
সংক্ষেপে বাড়ীটার বর্ণনা দিই।
একতলা বিশিষ্ট ৩টা রুম।
ইলেক্ট্রিসিটি নেই। বাড়ীর আঙিনায় বড় বড় কিছু কাঁঠাল গাছে পুরো এলাকাটা ছেয়ে নিয়েছে।
৩টা রুমের মধ্যে ১টা রান্নাঘর আর অন্যটা গুদামঘর হিসাবে পড়ে আছে।
মাঝখানের ঘরটা শোবার ঘর।
মাহিন শোবার ঘর আর রান্নাঘরটা বেশ ভালো করে ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করে নিলো।
শোবার ঘরে একটি মাত্র জানালা।
সে জানালার পাশে কিছু পাখির পালক পড়ে থাকতে দেখলো।
আপন মনে সেগুলো জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো।
,,
,,
রাত ৯ টা……
টেবিলে বসে মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়ছে মাহিন। বেশ ভালোই লাগছে নতুন বাড়ীতে।
তবে ইলেক্ট্রিসিটি না থাকায় বেশ অস্বস্তির মুখে পড়তে হচ্ছে তাকে।
তবুও এই বাড়ীটা থেকে তার বিশ্ব বিদ্যালয় অনেকটা কাছেই।
শরীরটা অনেক ক্লান্ত লাগছে।
দুপুরে রান্নাকরা খিঁচুড়ির অবশিষ্ট অনেকটা রয়ে গেছে।
তবে এখন খেতে ভালো লাগছে না। তাই শুয়ে পড়লো সে।
মোমবাতিটা নিভিয়ে দিতেই পুরো ঘরে নেমে এলো অন্ধকার।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো সে।
সারাদিনের ক্লান্তির ফল এটা।
,,
,,
রাত ২টা……
ঝন ঝন শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো মাহিনের।
শব্দটা বেড়েই চলেছে।
মনে হচ্ছে কেউ নুপুর পায়ে তার ঘরের ভেতর হেঁটে চলেছে।
শব্দের তালে তালে মাহিনের হার্টবিটও বেড়ে চলেছে।
বেশ শঙ্কার মধ্যেই শুয়ে আছে সে।
যদি ভূত-প্রেত হয় তাহলে তো আজ আর ওর রক্ষা নেই।
আস্তে আস্তে মাথার কাছে হাত দিলো মাহিন।
দেয়াশলাইটা হাতের নাগালে আসতেই জ্বালালো।
পুরো ঘর একদম ফাঁকা…….
কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
তাহলে এতক্ষণ কে ঘরের মধ্যে নুপুর পায়ে হাঁটছিলো?
আর বেশীক্ষণ দেয়াশলাইটা জ্বালিয়ে রাখতে পারলো না সে।
হাতে গরম ছ্যাঁকাটা অনুভব করলো সে।
,,
,,
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই মেঝেতে পা রাখলো মাহিন।
ঘুমের ঘোরে কেমন একটা ভিঁজে ভিঁজে অনুভব করলো পায়ের নিচে।
চোখ দুটো ডলে মেঝেতে তাঁকাইতেই শিউরে উঠলো সে।
পুরো মেঝে রক্তের দাগে পরিপূর্ণ।
কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা নয়। কাল সকালেই ঘরটা ভালো করে পরিষ্কার করেছে সে।
তাহলে রক্ত এলো কোথা থেকে?
আর নুপূর পায়েই রাতে কে হেঁটেছিলো?
এসব কথা ভেবে নিচের দিকে তাঁকাতেই সে দেখে মেঝে থেকে রক্ত উধাও!
একটু আগেও তো মেঝেতে রক্ত দেখেছে সে।
হয়তো সে ভূল দেখেছে।
বাড়ীটা নিয়ে একটু বেশী ভাবছে বলেই হয়তো এতো কিছু দেখতে সে!
আজকে বিশ্ব বিদ্যালয় ছুটি।
তাই সারাদিন বাড়ীতেই কাটালো মাহিন।
বিকালের দিকে বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছে।
হঠাৎ সামনের কাঁঠাল গাছে নজর যায় তার।
একটা কাকাতুয়া পাখি বসে আছে।
শহরের মধ্যেও কাকাতুয়া দেখে বেশ খুশি হলো সে।
ঘর থেকে কিছু মুড়ি এনে উঠানে ছড়িয়ে দিতেই কাকাতুয়া নিচে এসে খেতে লাগলো।
অন্যদিকে ফিরে কাগজ কলমে কবিতা লিখতে সে।
সাহিত্য চর্চা তার কাছে অনেক বড় একটা বিষয়।
লিখতে লিখতে কলমের কালি ফুরিয়ে গেছে।
অন্য মনস্ক হয়েই কলমটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে।
তবে কলমটা কোথায় গিয়ে পড়েছে সেদিকে কোনো খেয়াল করলো না মাহিন।
,,
,,
সন্ধ্যার দিকে ঘরে যেতেই উঠানের কোণে চোখ পড়ে তার।
কাকাতুয়া পাখিটার বুকে কলম বিঁধে আছে।
দেখেই আৎকে উঠলো সে।
কিন্তু ততক্ষণে পাখিটা মারা গেছে।
.
মাহিন ঘরে টেবিলে বসে পড়ছে।
মোমবাতিটা আলো ছড়িয়ে চলেছে।
কিন্তু জানালা দিয়ে এক ঝলক বাতাস এসেই নিভিয়ে দিলো মোমবাতি।
মাহিন টেবিলের উপর অন্ধকারেই হাত দিয়ে দেয়াশলাই খুঁজতে লাগলো।
কিন্তু কিছুতেই দেয়াশলাই হাতের নাগালে পেলো না। হঠাৎ রুমের মধ্যে আবার শুরু হয়ে গেলো ঝন ঝন নুপুরের শব্দ।
শব্দটা মনে হয় মাহিনের দিকেই এগিয়ে আসছে।
আচমকা টেবিলের উপর থাকা মোমবাতিটা জ্বলে উঠলো।
সেই আলোতে মাহিন দেখতে পেলো খোলা চুলের একটা মেয়ে ছাদের সাথে ঝুলে আছে।
জিভ একহাত বেরিয়ে গেছে।
চোখ থেকে লাল রক্ত গলিয়ে পড়ছে।
আর একটা কাকাতুয়া তার ঘাড়ের উপর বসে আছে।
মাহিন চোখের সামনে এরকম দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না।
তবুও অনেক কষ্টে উঠে পালানোর চেষ্টা করলো সে।
চেষ্টা ব্যর্থ হলো……
মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো মেঝেতে।
মেয়েটি মাহিনের এই অবস্থা দেখে জোরে জোরে হাসতে লাগলো।
কাঁধে বসে থাকা কাকাতুয়া পাখিটাও ডানা ঝাপটাচ্ছে।
হয়তো কারো জীবন নিতে যাওয়ার আনন্দ উপভোগ করছে তারা।
মাহিন কাকাতুয়া পাখিটাকে চিনতে পেরেছে।
বিকালে যে পাখিটা কলমের আঘাতে মারা পড়েছিলো এটা সেই পাখি।
মেয়েটা ছাদ থেকে নেমে এসে মাহিনের গলার কাছে তার লম্বা দাঁত বসিয়ে দিলো।
ধীরে ধীরে ওর শরীরের রক্ত চুষে নিলো।
তারপর কাকাতুয়া পাখি এসে মাহিনের চোখ দুটো তুলে ঠুকরে ঠুকরে খেতে লাগলো।
যে খাওয়ার মাঝেই লুকিয়ে আছে প্রতিশোধের গন্ধ।
……………………………………….সমাপ্ত………………………………