-প্রতিদিন এখানে কি?
-কিছু না ।
-কিছু না মানে?বাসা থেকে বের হবার সময়ও দেখি,বাসায় ঢুকার সময়ও দেখি । সমস্যাটা কি?
-কোন সমস্যা নেই ।
-তাহলে,আর যেন এখানে না দেখি ।
-জ্বী,ঠিক আছে ।
ঝাড়ি দেওয়ার পর থেকে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকা হালকা-পাতলা,বাবড়ি চুলের ছেলেটাকে রেহনুমা আর দেখে নি । প্রথম প্রথম বিষয়টা ভালো লাগলেও পরে কেন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগলো । হঠাত করে রেহনুমার মনে ছেলেটার প্রতি একটা অনুভূতির জন্ম হতে লাগলো । দিনকে দিন সেটা বাড়তে লাগলো । একদিন সে বুঝলো সে ছেলেটাকে ভালোবেসে ফেলেছে ।
প্রতিদিনের মতোই আজও সে বাসা ফিরছিল । হঠাৎ সে দেখে সেই হালকা-পাতলা,বাবড়ি চুলের ছেলেটা যাচ্ছে,সাথে একটা মেয়ে,দুজন দুজনার হাত ধরে আছে । মেয়েটাকে রেহনুমা চিনতে পারলো । চিনবেই না বা কেন? তার পাশের ফ্ল্যাটেই তো থাকে । মিস্টার অ্যান্ড মিসেস রহমানের রূপবতী কন্যা।
দৃশ্যটা দেখার পর রেহনুমা অনেকটা দৌড়ে ঘরে এল,দরজা বন্ধ করলো,আয়নার সামনে টুল টেনে বসলো,নিজেকে দেখলো । বেশ কালো মুখটায় কুতকুতে ছোট চোখ,মাথায় হালকা চুল,একটা বোঁচা নাক । এমন মেয়েকে কে ভালোবাসবে এই ফেয়ার এন্ড লাভলী প্রেমী পৃথিবীতে ।
হুমায়ুন আহমেদ ঠিক ই বলেছিলেন,এই উপমহাদেশে সুন্দরীর সংজ্ঞা ফর্সা চেহারা । সে ট্যারা হোক,নাক বোঁচা হোক,কিন্তু তবুও সুন্দরী । কারণ তার গায়ের রঙ ফর্সা ।
রেহনুমা আর কিছু ভাবতে পারে না । কান্নায় গলা ধরে আসে । সে কাদঁতে থাকে,অঝোর ধারায় কাদঁতে থাকে । তবে সেটা ভালবাসার মানুষটিকে না পাওয়ার জন্য না, নিজের চেহারার জন্য। তার সাথে তাল মিলিয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টিও পড়া শুরু হয় । জানালার কাঁচ ঝাপসা হয়ে আসে । সেখানে বিন্দু বিন্দু জলবিন্দু জমে,এঁকে চলে অর্থহীন নকশা,ঠিক আমাদের সমাজের মত ।
হঠাৎ দরজাটা খুলে যায়।রেহনুমার মা রায়না বেগম ঘরে ঢুকেন। অশ্রুসিক্ত রেহনুমাকে দেখে তিনি সব বুঝে ফেলেন।কারণ, তিনি এমন দৃশ্যের সাথেপরিচিত। রেহনুমার বুঝ হবার পর থেকেই এভাবে কাঁদত, কাঁদছে, হয়তো কাঁদবে…
রেহনুমা তার মাকে দেখে কান্না মোছার বৃথা চেষ্টা করে। কেনসে তার মায়ের সূর্যশ্যামলা রঙটি পেল না, কেন সে তার বাবার কালো রঙ পেল, এই নিয়ে তার মনে ক্ষোভের শেষ নেই।
রায়না বেগম রেহনুমার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার বিয়েটা হয়েছিল “ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে” টাইপের। কলেজ থেকে এসে বই-পত্র রাখতেই জানতে পারি পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। দেখে যাওয়ার দুদিন পরে বিয়ের পর যখন সম্পূর্ণ পরিচিত জগত থেকে সম্পূর্ণ অপরিচিত এলাম, তখন আমার মনে ভীষণ ভয় হচ্ছিল।
তোর দাদাবাড়ির লোকজন কানাকানি করছিল যে, আমি নাকি তোর কাল্টু বাবার সাথে প্রেম করে বিয়ে করেছি। শুনে আমি তোর দাদীর কাছে যেয়ে বললাম, দেখেন, মানুষ প্রেম করে সুন্দর চেহারা-সুরত দেখে।আপনার কালো ছেলের না রয়েছে চেহারা, না রয়েছে সুরত।
তোর দাদী আমার কথা কোন প্রকার বিচলিত না হয়ে হেসে বললেন,দেখ মা, তোমার বিয়ে হয়েছে বই-খাতা রেখে। আমার বিয়ে হয়েছিল পুতুল রেখে। সময় যত এগুবে মানুষ ততই নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিতে শিখবে। একসময় আসবে যখন ছেলে-মেয়েদের “ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে” হবে না, তাদের ইচ্ছানুযায়ী হবে।
আর আমার ছেলেটার গায়ের রঙ হয়তো কালো কিন্তু তার মনটা একদম সাদা। তোমার হয়তো ধারণা তোমাকে দেখে ও তোমাকে পছন্দ করেছে। কিন্তু না, বিয়ের আগ পর্যন্ত ও তোমাকে দেখেনি। দেখিও ও তোমার জীবনকে আলোকিত করবে। আলোর বাস আঁধারের সাথেই। আঁধার নেই, আলোও নেই। আবার আলো কেবল বৃক্ষের মত জীবন দানই করে না। পতঙ্গের মত জীবন কেড়েও নেয়। তাই তোমাকে সঠিক আলোটি বেছে নিতে হবে, ভিতরের আলো, মনের আলো।
তোর দাদীর হাস্যচ্ছলে বলা সেই দূরদর্শী কথাগুলোর গুরুত্ব আমি অনেক পরে বুঝেছি। পাশের ফ্ল্যাটের মিস্টার অ্যান্ড মিসেস রহমানদের দেখ,মিস্টার রহমান মিসেস রহমানকে ভালবেসেছিলেন, তার চেহারা দেখে, আর মিসেস রহমান ভালবেসে ছিলেন মিস্টার রহমানের টাকা দেখে। আজ বিয়ের ২০ বছর পরও তারা এক বিছানায় থাকেন না। ভালবাসানা থাকে চেহারায়, না থাকে অর্থ-প্রতিপত্তিতে, থাকে মনে-বিশ্বাসে।
রেহনুমা এবার কথা বলে, তারপরও তো চেহারা দিয়েই পৃথিবীতে চলছে। – দেখ, দৃষ্টি শক্তি ক্ষীণ হয়ে এলে পৃথিবীটাও ক্ষীণ হয়ে আসে, তার মানে এই নয় যে পৃথিবীটা ক্ষীণ হয়ে যায়।
-কিন্তু…
এসময় রেহনুমার বাবা ঘরে ঢুকেন, এখানে মা-মেয়ে মিলে কি খিচুড়ি পাকানো হচ্ছে? হুম? কি ব্যাপার আমার সুন্দরী রাজকন্যার মুখ ভার কেন?
রেহনুমা বলে,বাবা, আমি সুন্দরী এটা তোমাকে কে বলেছে?
-আমি বলেছি, তোর মা বলেছে।
-দেখ বাবা। দুই একজন বললেই কোন কথা সত্য হয়ে যায় না।সবাই যেটা বলে সেটাই সত্য। আমি সুন্দরী না। আমি কুৎ… বলতে গিয়ে রেহনুমা আবার কেঁদে ফেলে। রেহনুমার বাবা পুরো বিষয়টা সামলে নিয়ে বললেন, তোমাকে একটা গল্প বলি। এক পার্কে এক টেকো লোক পেপার পড়ছিলেন। এমন সময় তার মাথায় একটা মাছি বার বার বসছিল। শেষমেশ তিনি বিরক্ত হয়ে পেপারটা রোল করে নিজের মাথায় মেরে মাছিটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করলেন।
এতে মাছিটা তো দূর তো হচ্ছিলই না, উল্টো তিনি নিজের মাথায় ব্যথা পাচ্ছিলেন। একসময় তিনি ভাবলেন, আর একটা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, ছোট ছোট শত্রুর প্রতি মনোযোগ দিলে নিজেরই ক্ষতি হয় বেশি। তাই তিনি মাছি মারার চিন্তা বাদ দিয়ে পেপার পড়ায় মনোযোগ দিলেন।
এখন এই মাছিটা হল তুমি নিজের সম্পর্কে যা ভাব, পেপারটা হল তোমার চিন্তাধারা। তুমি তোমার চিন্তাধারাকে ঐ একটা বিষয়ে স্থির করে নিজেই নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ অথচ তা তোমার জীবনকে চালিত করছে না। তুমি কি,সেটা বিষয় না,বিষয় হল তুমি কি করছ।
রায়না বেগম বললেন, তুই আলোর সামনে বৃক্ষ হয়ে যা, পতঙ্গ হয়ে যাস না।নিজের উপর বিশ্বাস রাখ। কোন তালাই যেমন চাবি ছাড়া তৈরি হয় না, তেমনি পৃথিবীতে এমন কোন সমস্যা নেই যার কোন সমাধান নেই।
রেহনুমা চোখের জল মুছে বলল, আমি চেষ্টা করবো।
রেহনুমার বাবা বললেন, এই তো আমার লক্ষ্মী মেয়েটা নিজেকে বুঝতে পারছে। এখন চল বৃষ্টিতে ভিজি।
-কি বল বাবা! মানুষ কি বলবে?
-যখন তুমি কাঁদছিলে তখন কি মানুষ এসে চোখের জল মুছে দিল?নাকি নিজেই মুছলে?
-নিজেই।
-তাহলে মানুষকে নিয়ে ভাবার চিন্তা আপাতত বাদ।
এই কৃত্রিম শহরের মিস্টার অ্যান্ড মিসেস রহমানের মত কৃত্রিম মানুষরা তিনজন মানুষকে দেখল বৃষ্টি উৎসব করতে। তা দেখে চির যান্ত্রিক মনের মানুষের মনে অনেক হিংসা হল। কিছু মানুষ চিরকালই অন্যের সুখে ঈর্ষান্বিত হয়।
তবে হাজার ঈর্ষার মাঝে তিনটি প্রান ঠিকই সুখ খুঁজেনিচ্ছে অঝোর বৃষ্টিতে। রেহনুমার মনে নিজের কালো অনুভুতি নিয়ে এখন আর খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না,এখন সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে কেবল একটা অনুভূতিই সব অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হতে পারে না।যেমন কেবল নিজেকে নিয়ে বাঁচা যায় না, প্রয়োজন হয় আরেকজনকে, প্রয়োজন হয় আরেকটি পরিবারকে, আরেকটি সমাজকে। তবে এখনও কাঁচে বৃষ্টি নকশা আঁকছে, কিন্তু তাতে সময় ক্ষেপণ করার কোন কারণ নেই। কারণ, মস্তিষ্ক দিয়ে নয়, বিশ্বাস করতে হয় হৃদয় দিয়ে।