আমি মা

আমি মা

বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। রাত ন’টা বেজে গেছে কিন্তু সাকিব এখমও আসছে না কেন বুঝতে পারছি না।
অন্যান্য দিন তো ৭ টার দিকেই চলে আসে। তার মধ্যে ফোনও অফ। দুশ্চিন্তায় হাত-পা জমে আসছে।
কোনো বিপদ হলো না তো!!
বাবাকে জানানোর জন্য ফোনটা হাতে নিতেই কলিংবেল বেজে উঠল। হন্তদন্ত দিয়ে দরজা খুলতে গেলাম। মানুষটা এসেছে বোধয়…।
.
দরজা খুলে যা দেখলাম, সেটা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
প্রায় ভেজা একটা কাপড়ে মোড়ানো একটা সদ্যজাত শিশু।
ও শুধু চোখে ইশারায় চুপ থাকতে বলে ঘর প্রবেশ করল। সাকুর গা বেয়ে টুপটুপ করে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পরছে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি এখনও নিশ্চুপ হয়ে আছি। কৌতুহলী চোখে একবার ওর আবার বাচ্চাটার দিকে তাকাচ্ছি।
‘ওভাবে তাকিয়ে না থেকে দুটো শুকনো তোয়ালে আনো সানা।’ সাকিবের কথা শুনে সাত-পাঁচ না ভেবে ভেতরের ঘর থেকে তোয়ালে এনে দিলাম।
ভালো করে তোয়ালে’তে মুড়িয়ে বাচ্চাটাকে পাজাকোলে আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে সাকিব বলল, আফসানা আজ থেকে এর মা হতে পারবে না?
-‘কি বলছো তুমি এসব?’ দু পা পিছিয়ে চলে গেলাম।
‘না বুঝার মত কিছুই বলি নি। আর ওকে আমি কোথায় পেয়েছি, সব বলবো। আর তুমি যদি এখন আমার পাশে না থাকো, তবে সেটা আমার দুর্ভাগ্য।’ বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে শেষ করলো সাকিব।
আমি অন্য ঘরে চলে এসেছি। পাশের ঘর থেকে অনেক্ষন ধরে বাচ্চাটার কান্নার শব্দ আসছে। কেন কাদছে! বড্ড মায়া লাগছে বাচ্চাটার জন্য।
আমি কত নির্দয়! ছি ছি!!
নিশ্চয়ই বাবুটার খিদে পেয়েছে। কি বাবা হয়েছে ও? মনে মনে সাকিবকে কোষে গালি দিলাম।
ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে গরম করে নিলাম। কিন্তু খাওয়াবো কিভাবে! ঘরে তো ফিডার নেই। যাক সমস্যা নেই, আজ রাতটা কেবল চামচ দিয়ে কাজ চালিয়ে নিলেই চলবে। কাল সকালে ওকে দিয়ে সব কিনাতে হবে।
এই যে মিস্টার সাকিব ওরফে বাবুর আব্বু.. বাবুকে না খাইয়ে খালি কোলে নিয়ে বসে থাকতেই চলবে? ওকে তো খাওয়াতে হবে।
আমার কথা শুনে সাকিবের মুখ খুশি উজ্জল হয়ে গেল। কিছু বলতে যাবে তখনই আবার বললাম, ‘আমার বাবুটাকে এবার আমার কোলে দাও তো। ভিজে গায়ে বাবুকে কোলে নিয়ে বসে আছো!! ওর যদি ঠান্ডা লাগে?’ বলেই ছো মেরে বাবুটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছি।
আশ্চর্যের বিষয় হলো বাচ্চাটা আমার কোলে এসে আর একটুও কাদছে না। বরং তার ছোট ছোট চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আবার পিটপিট করছে।
কি মায়া ভরা পাপমুক্ত ছোট্ট একট মানুষ! দেখে মনে হচ্ছে পাঁচ-ছয় দিনের বেশি হবে না ওর জন্মের। তাহলে এত ছোট শিশুকে কেন ফেলে দিলো ওর বাবা-মা! নাকি ও কারো পাপের ফসল!
এমনও তো হতে পারে, শিশুটা হয়ত দুজন মানুষের ভালবাসার স্মৃতি চিহ্ন! হয়ত ওরা শিশুটিকে বিপদে পড়ে ফেলে গেছে।
.
‘কি ভাবছো? বাচ্চাটার পরিচয়?’ ফিসফিস করে বলে উঠল সাকিব।
-হ্যা।
বিছানার এক কোণে বসতে বসতে সাবু বলল, আমার বন্ধু মিশু আর ওর প্রেমিকার কথা তোমার মনে আছে সানা?
-ঐ যে তোমার কলেজ ফ্রেন্ড মিশু ভাই? হু, মনে আছে। ওনার সাথে বাবুর কি সম্পর্ক?
‘বাচ্চাটা ওদের’ই।’
অনেকটা চমকে উঠলাম কথাটা শুনে। বিয়ের আগেই…..
-‘না, ওরা কোর্ট ম্যারেজ করেছে আমাদের বিয়ের আগেই। আর এখন ওদের বিয়েটা মিশুর বাবা মানছেন না। এই দিকে মিশুর স্ত্রী রিমা সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়ে। আর এখন ওরা এই বাচ্চা কারো কাছেই রাখতে পারবে না। বাচ্চা একটা হাসপাতালে পাঁচদিন আগে ডেলিভারী হয়।
মিশু আর রিমা তো ভেবেছিল কোনো এক ডাস্টবিনে ফেলে দিবে। এরা যে আসলেই বাবা-মা ভাবতেই আমার ঘেন্না লাগছিল তখন। কোনো উপায় না পেয়ে আমি ওকে এখানে নিয়ে এসেছি। আফসানা আমি এই নিরপরাধ ছোট্ট ছেলেটাকে একটু ঠাই দিতে চেয়ে কি খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি?’ একটানা কথাগুলো বলে ও এবার আমার হাত ধরে বলল।
ওর চোখ ভিজে গেছে। কখন আমারও যে চোখের কোণে জল জমেছে টের পাই নি।
ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম, ‘না। তুমি অনেক ভালো কাজ করেছো। আজ থেকে আমরা ওর বাবা-মা। ও আমাদেরই সন্তান। আর বাবুর নাম আমাদের দুজনের নামের সাথে মিলিয়ে হলো.. উমম… সাদাফ হি হি।
.
এখন আমার ছেলের বয়স ৬ মাস সাত দিন। ওর পাঁচটা দাঁত উঠেছে। যখন অস্পষ্টভাবে আম্মু বলতে গিয়ে আমু বলে, তখন মনে হয় পৃথিবীতে আমি একমাত্র সুখী ব্যক্তি। সাদাফ আমার চোখের মনি। আমরা মা-ছেলে এক মুহুর্ত কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারি না।
আমার বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ির কেউ কখনও সাদাফকে নিয়ে কটু কথা বলি নি। বরং সাদাফের দুষ্টোমীতে সবাই ওকে চোখে হারায়।
.
কিন্তু আমাদের এই সুখ আর বেশি দিন ছিল না। সাদাফের আব্বু আজ দু’দিন ধরে কেমন যেন উদাসী হয়ে থাকে। কিছু জিজ্ঞেস করলেও তেমনি কিছু বলছে না।
এইত আজ সকালে অফিসে যাওয়ার আগে নাশতাও করে বের হয় নি। কিছুই বুঝতে পারছি না।
.
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আজ কেমন যেন খুূব অস্থির লাগছে। সাকিবকে এতবার ফোন দিলাম তাও ওর কোনো খবর নেই। আমার ছেলেটাও আজ অন্যদিনের মত ছটফট করছে না। কোলেই বসে আছে।
কলিংবেল বেজে উঠল। মনে হয় সাকিব এসেছে। সাদাফকে কোলে নিয়েই দরজা খুলে দেখি, হ্যা সাকিব ই এসেছে। বাবাকে দেখে সাদাফ পাপা বলে ঝাঁপিয়ে কোলে গেল।
ওমা! ওর সাথে আরো দুজন কেউ এসেছে। প্রথমে চিনতে না পারলেও ওদের চিনতে খুব একটা সময় লাগল না।
মিশুভাই আর তার স্ত্রী। দরজা থেকে সরে তাদের ঘরে আসতে বললাম। ভেতরে না ধুকেই রিমা বলল, আমরা বসতে আসি নি।
বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল আমার। কিছু না বলেই সাকিবের কোল থেকে সাদাফকে ছো দিয়ে নিয়ে বললাম, তাহলে কেন এসেছে?
সামনে এগিয়ে এসে রিমা সাদাফের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ও… এটা বুঝি আমার ছেলেটা?
সাদাফকে দু হাতে বুকে আকড়ে ধরে চিৎকার করে বললাম, না!! ও আমার ছেলে। ওর মা শুধু আমিই।
রিমা দাঁত কিড়মিড় করে বলতে থাকল, আমি পুলিশের কাছে যাব। ভালোয় ভালো আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিন আপনারা। মিশু তুমি কিছু বলছ না কেন? আর এই যে সাকিব ভাই, আপনি তো তখন বলেছিন আমাদের ছেলেকে দিয়ে দিবেন। তাহলে এখন এত নাটক কিসের?
-কিহ! সাকিব তুমি ওদের এই কথা বলেছ? চুপ থাকবে না একদম। জবাব দাও।
মাথা নিচু করে সাবিক কেবল হু বলে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
উচ্চস্বরে কথা শুনে এইদিকে আমার ছেলে ভয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে।
আমার কলিজের টুকরাটাকে আমি কখনও এইভাবে কাদতে দি নি। এবার আমি বলেই ফেললাম, আপনি কিসের ভিত্তিতে ওকে নিজের স ন্তান বলে দাবি করছেন? জন্মের পর তো ঠিকই এই শিশুটাকে ডাস্টবিনে ফেলে মহৎ জননীর পরিচয় দিচ্ছিলেন। আপনি কিসের মা? আপনি ওর জন্য কত রাত জেগে সেবা করেছেন? যখন ও বিছানা নোংরা করত, কতদিন সেসব পরিষ্কার করেছেন? এখন তো ও বড় হয়ে গেছে, এখন আর সেই সব ঝামেলা নেই। তাই এখন ওকে নিতে এসেছেন?
আর সাকিব আপনাদের কি বলেছে তা আমার জানার বিষয় না। ও কেবল ছোট্ট একটা নবজাতক আমার কোলে তুলে দিয়েছিল। ও তো একা এই শিশুটা এত বড় করে নি। তাহলে ওর একার কথায়ও আমি আমার ছেলেকে কেনো আরেক জনের কাছে দিতে যাবো? আর হ্যা, আপনি পুলিশের কাছে যাবেন বলছিলেন তাই না? যেখানে ইচ্ছা আপনি যান। কথাগুলো শেষ করে আমি সাদাফকে নিয়ে ভেতরের ঘরে এসে দরজা লক করে বসে রইলাম। মা ছেলে দুজনেই অঝরে কাদছি।
পাশে ঘর থেকে আর আওয়াজ আছসে না। বোধয় চলে গেছে ওরা। যাক, আমিও আর এখানে থাকব না। কাল ভোর হলেই আমার ছেলেকে দূরে চলে যাব। অনেক দূরে। সাকিবকেও বলে যাব না। সাকিবও ওদের দলে।
.
একটু পর সাকিব দরজায় টোকা দিল, দরজা খোল আফসানা। আর ছেলে মানুষি করো না। আমার কথা একবার শোনো। প্লিজ।
দরজা খুলে দেখলাম ওরা এখনও যায় নি। আর একরকম জোড় করে সাদাফকে আমার থেকে কেড়ে নিয়ে গেছিল সেদিন। আর ফিরিয়ে দেয় নি। আমার ছেলেটাকে আর দিল না হা হা হা।।
.
হাত তালি দিয়ে হাসছেন মেন্টাল হাসপাতালের বৃদ্ধাটি নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কথা বলে। শুনেছি ওনার স্বামী বেশ ক’বছর আগেই মারা গেছেন। হাহ!! মানুষের জীবন বড়’ই বিচিত্র।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত