রিয়াদ, অপু,নাহিদ,ইমন চারজন মিলে বান্দরবন জেলার একটি ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।তারা জঙ্গলের অনেকটা গভীরে চলে এসেছে,চারদিকে শুধু ঘন-উঁচু গাছপালা।
হঠাৎ নাহিদ বলে উঠল,
-এই এই,ঐ দিকে দেখ একটি দরজা দেখা যাচ্ছে।
রিয়াদ,অপু,ইমন তিনজনই তাকিয়ে দেখল আসলেই একটি দরজা।তারা ঐ দরজার কাছে এগিয়ে গেল।কিন্তু অবাকের বিষয় হল দরজাটি দুটো গাছের মধ্যে সংযুক্ত অবস্থায়। আর দরজাটি একাই অর্থাৎ এর পিছনে,সামনে,পাশে কিছুই নেই।
-আশ্চর্যজনক দরজা। (ইমন)
-হ্যা,গাছদুটোর সাথে এমনভাবে জড়িয়ে যেন জন্ম থেকেই এটি গাছের সাথে সংযুক্ত।(রিয়াদ)
-আশেপাশে তো কোন মানুষও দেখতে পাচ্ছি না।(অপু)
দরজাটি ঠেলে দিল রিয়াদ।তাদের অারো অবাক করে দরজার ভিতর থেকে আলো আসতে লাগল।এমনিতেই তাদের এইরকম রহস্যময় কিছুর প্রতি আগ্রহ বেশী।আর তাদের সাথে বাস্তবেই এইরকম কিছু ঘটছে সেটা তাদেরকে আরো আকর্ষন করে তুলল।
তারা একে একে দরজাটির ভিতরে প্রবেশ করল।
তারা লাল পাথরের প্রায় মরুভূমি মত জায়গায় দাড়িয়ে আছে।আশেপাশে কোন কিছুই নেই সম্পূর্ণ খালি।অনেক দূরে একটি উঁচু টিলার মত কিছু দেখা যাচ্ছে।তারা প্রায় হতভম্ব হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে।দরজাটি নেই!এখন তারা আবার চাইলেও ফিরে যেতে পারবে না।
চারজনে লাল পাথরের মরুভূমি এলাকায় হাটতে থাকে।সামনে গিয়ে দেখতে পেল উঁচু টিলার মত ঐটা একটা পাথরের স্তুপ।সেটা পার হয়ে অন্যপাশে এসে তারা বিচিত্র কিছু গাছপালা আবিষ্কার করল।রিয়াদ গাছগুলো পরীক্ষা করে নিচু গলায় বলল,
-এই রকম গাছপালা আমি কখনো দেখিনি।
-হ্যা,চল ফিরে যাই।আমার না ভয় করছে।(ইমন)
-কিভাবে ফিরব?যাওয়ার তো কোন পথ দেখছি না আর দরজাটাও নেই।(অপু)
-চলতো সামনে এগিয়ে দেখি,হয়তো কোন রাস্তা খুজে পাব।(নাহিদ)
চারজনে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাটতে শুরু করল।কিছুদূর এগিয়ে অপু দাড়িয়ে পড়ল।
-কি হল?(নাহিদ)
-মনে হচ্ছে আমাদের কেও অনুসরন করছে।
ইমন শুকনো গলায় বলল,
-আমারও তাই মনে হচ্ছে। দৌড় দিব নাকি!
-দৌড় দিব কেন?যদি…
রিয়াদের কথা শেষ হওয়ার আগেই বিপদ যেন তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ল।হঠাৎ করে চারদিক থেকে হইহই করে অসংখ্য মানুষ তাদের দিকে ছুটে আসে।
তারা হতবাক হয়ে দাড়িয়ে রইল।কারন যারা হইহই করে তাদের দিকে ছুটে আসছে সবাই মেয়ে স্বল্পবসনা এবং অনিন্দ্যসুন্দরী।কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই মেয়েগুলো তাদের ঘিরে ফেলল।নীল চোখ এবং সোনালী চুলের একটি মেয়ে যে দেখতে এতই সুন্দরী যে একবার চোখ পড়লে চোখ ফেরানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে সবার আগে কথা বলল।ভাষাটি খানিকটা ভিন্ন কিন্তু বুঝতে তবু অসুবিধা হল না।
মেয়েটি বলল, হায় ঈশ্বর!এতো দেখছি পুরুষ মানুষ!
কালো চুলের একটি মেয়ে বিস্মিত হয়ে বলল, কি রকম পরিবারের মানুষ যে পুরুষদের একা একা বের হতে দিয়েছে?
সোনালী চুলের মেয়েটি বলল, থাক থাক।কিছু বলে কাজ নেই,ভয় পেতে পারে।
রিয়াদরা এতক্ষনে নিজেদের সামলে নিয়েছে।কিন্তু এতগুলো সুন্দরী মেয়েদের একসাথে দেখে ইমন এখনো ঘোরের মধ্যে রয়েছে।সে কোন কিছু না বুঝেই বলে উঠল,
হ্যা সুন্দরীরা তোমাদের অভিন্দন!
সাথে সাথে সবগুলো মেয়ে বিস্মিত হতবাক হবার মত শব্দ করল।কমবয়সী একটি মেয়ে নিজের চোখ ঢাকতে ঢাকতে বলল,
কি রকম বেশরম দেখেছ?আমাদের সাথে কথা বলছে!
পোশকটা দেখেছ?সারা শরীর দেখা যাচ্ছে, লজ্জায় মরে যাই!
রিয়াদরা এবার খানিকটা হতচকিত হয়ে গেল,তাদের পুরুষ হওয়া নিয়ে এখানে কোন একটা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
ইমন আবার বলে উঠল,
তোমাদের সবার জন্য অভিবাদন।শুভ সকাল অথবা বিকাল যেটাই এখন হয়ে আছে।
মেয়েগুলো আবার একটা বিস্মিয়ধ্বনি দিয়ে একটু পিছিয়ে গেল।কমবয়সী আরেকটা মেয়ে একটু বিচলিত হয়ে নীল চোখের মেয়েটিকে বলল,
-ঐশি কিছু একটা করো।লজ্জায় মরে যাচ্ছি।
-চারটা চাদর দাও।
পিছনের মেয়েটা চারটি উজ্জল রঙের চাদর এগিয়ে দিল।ঐশি চাদরগুলো সাবধানে রিয়াদের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল,
-ভালো করে ঢেকে নাও।পুরুষ মানুষের শরীর দেখানো খুব লজ্জার ব্যাপার।
রিয়াদরা কিছুই বুঝতে পারছিল না,কিন্তু এখন সেটা নিয়ে তর্ক করে খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হল না।তারা উজ্জল রঙের চাদরগুলো দিয়ে নিজেদের ভালো করে ঢেকে নিল।নিজেদেরকে হঠাৎ তাদের বোকার মত মনে হতে থাকে।রিয়াদ খানিক্ষন ইতস্তত করে বলল,
-একটা কথা জিজ্ঞাস করতে পারি?
-পুরুষেরা কখনো অপরিচিত মেয়েদের সাথে কথা বলে না।সেটা ভারী লজ্জার ব্যাপার।
নাহিদ ঢোক গিলে বলল,
-তাহলে পুরুষেরা কার সাথে কথা বলে?
-অন্য পুরুষের সাথে,তাদের ঘরের বাইরে যাওয়ার কথা নয়।পুরুষদের সবসময় মেয়েদের সামনে পর্দা করতে হয়।
রিয়াদরা একজন আরেকজনের দিকে তাকালো।হঠাৎ করে তাদের কাছে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যায়।এটা একটা উল্টা জগৎ। এখানের নিয়মনীতি গুলোও উল্টা।যেখানে মেয়েরা ঘরের বাইরে থাকে আর পুরুষেরা অন্তঃপুরে বন্দি।
মেয়েদের দলটি তাদের হাটিয়ে সামনে নিতে থাকে।বয়স্ক লোকরা যেভাবে শিশুদের সাথে ব্যবহার করে,মেয়েরা তাদের সাথে ঠিক সেরকম ব্যবহার করছিল।এই জগত বা সমাজের পুরুষ মানুষেরা নিশ্চয়ই খুব কোমল প্রকৃতির।
হেটে হেটে তারা একটা লোকালয়ের কাছ পৌছাতেই অনেকে তাদের দিকে ছুটে এল,সবাই মেয়ে।কেও বালিকা,কেও কিশোরী,কেও তরুনী,কেও যুবতী,কেও কেও মধ্যবয়স্কা।সবাই কৌতহলী চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।কিশোরী এবং বখাটে কিছু তরুনী শিষ বাজিয়ে তাদের চাদর ধরে টান দেয়ার চেষ্টা করছিল।কিন্তু ঐশির প্রচন্ড ধমকে তারা পালিয়ে গেল।রিয়াদরা হাটতে হাটতে আবিষ্কার করে রাস্তার দুপাশে পাথরের ঘরের ভিতরে জানালার ফাক দিয়ে ঘোমটায় ঢাকা পুরুষ মানুষেরা উকি দেয়ার চেষ্টা করছে।
মেয়েদের দলটি রিয়াদদের নিয়ে একটা বড় বাসার সামনে হাজির হল।বাসাটি সম্ভবত ঐশির কারন অন্যসব মেয়েরা বাইরের বারান্দায় অপেক্ষা করতে লাগল।শুধু ঐশি তাদেরকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে যায়।সাথে সাথে ভিতর থেকে সুদর্শন কোমল চেহারার একজন পুরুষ মানুষ ঐশির দিকে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-ওগো সোনাইপাখি!তুমি ফিরে এসেছ!
ঐশি মাথা নাড়ল।পুরুষ মানুষটি নিশ্চয়ই ঐশির স্বামী। সে আদুরে বেড়ালের মতো ভঙ্গি করে বলল,
-ঐশি!সোনাইপাখি আমার,পথে কোন কষ্ট হয় নি তো?
-নাহ
-তোমায় একগ্লাস ঠান্ডা শরবত এনে দেই।
-না,লাগবে না।তুমি বরং এই পুরুষ মানুষদের দেখ।
ঐশির স্বামী কোমল চেহারার পুরুষটি এবার ঐশিকে ছেড়ে দিয়ে তাদের দিকে তাকালো।অবাক হয়ে বলল,
-এরা কারা?
-লাল পাহাড়ের কাছে পেয়েছি।একেবারে বেপর্দা হয়ে হাটাহাটি করছিল।
-ছি!ছি!ছি! (জিভে কামর দিয়ে)
-হ্যা,অত্যন্ত বেশরম পুরুষ।নিজ থেকে আমাদের সাথে কথা বলছিল।
-কি লজ্জা!কি লজ্জা!
-তুমি তাদের সাথে একটু কথা বলে দেখ,ব্যাপারটা কি?কোথায় থেকে এসেছে?কি কারনে?না জানি বেচারাদের স্ত্রীরা কোথায় কি দুঃশ্চিন্তা করছে!
ঐশির স্বামী মুখে একটা কপট রাগের ভান করে বলল,
-আমি বুঝতে পারি না কি রকম মেয়ে মানুষ।তাদের স্বামীদের এরকম একলা ছেড়ে দেয়।যদি কিছু হত?যদি তোমাদের সামনে না পড়ে কোন খারাপ মেয়েদের সামনে পড়ত?
রিয়াদেরা দেখল ঐশির কোমল চেহারার সুদর্শন স্বামী ব্যাপারটা চিন্তা করে আতঙ্কে কেমন জানি শিউরে ওঠে।
ঐশি চলে যাওয়ার পর তারা তাদের সারা শরীরে ঢাকা চাদরগুলো খুলে রাখল।
ঐশির স্বামী বিস্মিত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
-তোমরা কারা ভাই?একা একা কি করছ?তোমাদের স্ত্রীরা কই?তোমাদের একা ছেড়ে দিল কি করে?
-আমাদের স্ত্রী নেই।(অপু)
ঐশির স্বামীর মুখে হঠাৎ সমবেদনা ফুটে উঠল,
-আহা!বিয়ে হয়নি এখনো?কেনো কোন মেয়ে বুঝি পছন্দ করে নি?
-না মানে…(রিয়াদ)
-মেয়েদের মন জয় করতে হলে একটু চেষ্টা করতে হয়।সেজেগুজে থাকতে হয়, দাড়ি কামিয়ে চুল পরিপাটি করে আঁচড়ে শরীরে পারফিউম দিয়ে সুন্দর কাপড় পড়তে হয়।তোমাদের যেরকম রুক্ষ চেহারা,সাথে যেভাবে বেশরম কাপড় পড়েছ।কোনো ভদ্র পরিবারের মেয়ে তোমাদের পছন্দ করবে ভেবেছ?
-আসলে ব্যাপারটা তা নয়।আমরা যেখান থেকে এসেছি সেখানকার নিয়মকানুন অন্যরকম।(রিয়াদ)
-কোথায় থেকো এসেছ তোমরা?
-আমরা আসলে পৃথিবী থেকে।মানে বান্দরবন ঘুরতে এসেছিলাম।জঙ্গলে ঘুরার সময় একটা দরজা….
-থাক থাক আর বলতে হবে না।আমি ওসব বুঝি না।আমরা পুরুষ মানুষ ঘর-সংসার করি।কোথায় কি আছে, কোথায় ঘুরতে যেতে হয় এইগুলো জেনে আমরা কি করব?
তারা বিস্মিত হয়ে বলল,
-তোমরা শুধু ঘর সংসার কর?
ঐশির স্বামী অবাক হয়ে বলল,
-আর কি করব?একজন পুরুষ মানুষ যদি তার স্ত্রীকে খুশি রাখতে পারে তাহলে তার জীবনে আর কি চাইবার আছে?সারাদিন পরিশ্রম করে স্ত্রী ঘরে এলে তার জন্য রান্না করে খাবার দেয়া, পোশাক ধুয়ে রাখা,বাচ্চা মানুষ করা…
রিয়াদরা কেমন জানি ভয়ে ভয়ে ঐশির স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইল।ঠিক এসময় দরজা খুলে একজন তরুন এসে ঢুকল,তার চোখে পানি টলমল করছে।ঐশির স্বামী জিজ্ঞাস করল,
-কি হয়েছে তোমার?
-আমি আর বাইরে যাব না বাবা।কখনো যাব না।
-আবার বুঝি পাড়ার বখাটে মেয়েরা
-হ্যা,আমাকে দেখে শিষ দিয়ে এতখারাপ কথা বলেছে…
তরুনটা হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।ঐশির স্বামী তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-কাদিস নে বাবা।তোর মাকে বলব দেখি কিছু করতে পারে কিনা।
তরুনটি চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলে ঐশির স্বামী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-আগের যুগের সেই নিয়ম নীতি আর নেই।সবার মাঝে কেমন জানি ভোগ লালসায় ভরে গেছে।মাঝে মাঝে যখন বাইরে যাই বুঝতে পারি মেয়েরা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার শরীরের দিকে।মনে হয় চোখ দিয়ে সারা শরীরটাকে চেটে খাচ্ছে।
ঐশির স্বামীর সারা শরীর বিতৃষ্ণায় কেমন জানি শিউরে উঠল।
রিয়াদরা কিছুই বুঝতে পারছে না তারা কি করবে।আপাতত তাদের মনে হল এখানে থেকে পালাতে হবে।
তাই তারা ঐশির স্বামীর কাছে গিয়ে বলল,
-তোমাদের এখানে এসে আমাদের খুব ভালো লেগেছে,এখন আমরা যাব ভাই।
ঐশির স্বামী চোখ কপালে তুলে বলল,
-যাবে?কোথায় যাবে?
তারা বুঝতে পারছে না কি বলবে আর কিভাবেই ফিরবে তারা।তবু রিয়াদ বলল,
-যেখান থেকে এসেছি।
-কিন্তু তোমাদের খাওয়া হয় নি,বিশ্রামও হয় নি।
যদিও তাদের ক্লান্ত লাগছে আর প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছ।কিন্তু এখন তাদের সেদিকে খেয়াল নেই।
– না হোক।আমরা ফিরে গিয়ে খাব,বিশ্রাম নিব।(ইমন)
কোমল চেহারার সুদর্শন পুরুষটির চোখেমুখে দুঃশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল।বলল,
-ঠিক আছে,যেতে চাও যাবে।কিন্তু না খেয়ে যেতে পারবে না।
ঐশির স্বামীর গলার স্বরে একধরনের আন্তরিকতা ছিল তাই তারা আর না করতে পারলো না।খাবারের আয়োজন ছিল খুব সহজ,কিন্তু খুব সুন্দর করে টেবিলে সাজিয়ে দেয়া হয়েছিল।
তারা খুব তৃপ্তি সহকারে খেল।খাবার সেরে উঠতে গিয়ে হঠাৎ করে তাদের মাথা দুলে ওঠে,কোনমতে টেবিল ধরে নিজেদের সামলে নিল।
-তোমরা হাটাহাটি কর না,তোমাদের খাবারের সাথে ঘুমের ঔষুধ মিশিয়ে দিয়েছি।
-কি দিয়েছ!(নাহিদ)
-ঘুমের ঔষুধ।
রিয়াদ হঠাৎ করে একধরনের আতঙ্ক অুনভব করে।সত্যি সত্যি ঘুমে তাদের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।কোনমতে কষ্ট করে রিয়াদ বলল,
-কেন দিয়েছ?
-একা বাইরে গিয়ে কি বিপদে পড়বে।বাইরে শুধু দুষ্ট মেয়ে মানুষ আর নষ্ট মেয়ে মানুষ।তোমাদের মত সাদাসিধে পুরুষদের একা পেলে কি অবস্থা হবে জান?
তারা আরো কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু তার আগেই গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ে।
ঘুম থেকে উঠে অপু দেখল তার পাশে একজন অপরিচিত মানুষ শুয়ে আছে।অপু ভালো করে দেখে বুঝতে পারলো মানুষটি নাহিদ,কেউ একজন নাহিদের গোঁফ নিখুত ভাবে কেটে দিয়েছে বলতে চিনতে পারছে না।অপু ধরমর করে উঠে বসল,তার সবকিছু মনে পড়ে গেছে।পাশে রিয়াদ এবং ইমনের দিকে তাকিয়ে দেখল।ইমনের রাখা বড় দাড়ি এবং রিয়াদের খোচা দাড়ি নেই সেখানে শুধু চামরা চকচক করে দেখা যাচ্ছে।হঠাৎ তার নিজের কথা মনে হল।সে নিজের গালে হাত দিয়ে দেখে পুরো ক্লীন।সে মাথায় হাত দিয়ে বসতে গিয়ে আরো একটা ব্যাপার খেয়াল করে তার মাথায় চুল নেই অর্থাৎ পুরো ন্যাড়া।হায় হায়! একি!সে বাকিদের দিকে তাকিয়ে দেখে বাকিদের মাথারও চুল নেই।সবাইকে ন্যাড়া করে দিয়েছে।সে আগে এতবড় কারবারটা খেয়ালই করে নি।
তারা ছোট একটা পাথরের ঘরে শুয়ে আছে,বুক পর্যন্ত কম্বল দিয়ে ঢাকা।অপু কম্বল ছুড়ে ফেলে উঠে বসে রিয়াদদের ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে উঠানোর চেস্টা করল।রিয়াদ বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে পাশ ফিরে ঘুমানোর চেস্টা করছিল কিন্তু অপু আবার তাকে ধরে একটা ঝাকুনি দিল।এবার রিয়াদ চোখ খুলে তাকিয়ে বলল,
-কে?কি হয়েছে?
-আমি!
রিয়াদ চোখ বড় বড় করে বলল,
-অপু!তোর একি অবস্থা।চুল কোথায় তোর।
-…..!
-তোকে পুরো গবেটের মতো দেখাচ্ছে।চুল-দাড়ি কামিয়েছিস কেন?(হেসে)
-আমি কামায় নি।তোমাদের চুল-দাড়ি-গোফ যে কামিয়েছে, আমারটাও সে কামিয়েছে।
-গোফ!আমার গোফ?
নাহিদ লাফিয়ে উঠে বসে নাকের নিচে হাত দিয়ে হঠাৎ করে একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেল।ঐ জগতে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ছিল তার গোঁফ।
রিয়াদ নিজেকে পরগ করে নিশ্বাস ফেলে বলল,এখান থেকে যেভাবেই হোক আমাদের পালাতে হবে।
নাহিদ নির্জীব গলায় বলল,কিন্তু আমার গোফ!
-গোঁফ নিয়ে পড়ে চিন্তা করো আমাদের যে কিছুই নেই চুল-দাড়ি সবই তো ক্লীন।(অপু)
ইমন নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে।তার জঙ্গলের মতো চুল-দাড়ির কিছুই নেই, এখন শুধু মরুভূমি।
রিয়াদ মনমরা হয়ে উঠে দাড়িয়ে নিজেদের জিনিসপত্র খুজতে লাগল।তাদের ঘুমের মাঝে কেউ একজন তাদের পোশাক পাল্টিয়ে ঢলঢলে আলখেল্লার মতো কিছু একটা পড়িয়ে গেছে,কাপড় জামাগুলোও এঘরে নেই।
ঘরের মাঝে শব্দ শুনে খুট করে দরজা খোলে গেল।ঐশির স্বামী উকি দিয়ে বলল,
-তোমরা উঠে গেছ?
তারা কোন কথা না বলে চোখ পাকিয়ে ঐশির স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে।তাদের দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে ঐশির স্বামী বলল,
-তোমাদের জন্য একটা ভাল খবর আছে।
নাহিদ ক্রুদ্ধকন্ঠে বলল,
-ভালো খবরের কোন দরকার নেই। আমার গোঁফ কেন কেটেছ?
বেচারা গোঁফের মায়ায় হিতাহিত জ্ঞান ভুলে যাচ্ছে।
-সেটাইতো বলতে চাচ্ছিলাম।তোমাদের ভাল খবর কি শুনবে না?
-ভালো খবরের দরকার নেই।আমাদের জামা-কাপড় কি করেছ?(অপু)
-তোমাদের জামা-কাপড় ধুয়ে দিয়েছি,যা নোংরা হয়েছিল। তোমাদের ভালো খবরটা বলছি,তোমাদের বিয়ে ঠিক করেছি।
তারা হতবাক হয়ে যায়।
-বিয়ে ঠিক করেছ?(রিয়াদ)
-হ্যা,তোমরা যখন ঘুমাচ্ছিলে তখন তোমাদের দেখে পছন্দ করে গেছে।তবে তোমাদের মুখে নাকি বেশি চুল তাই কামিয়ে দিয়েছি।
রিয়াদ দাঁত কিড়মিড় করে বলল
-তাই কেটে কামিয়ে দিয়েছ!
-তোমাদের কারা পছন্দ করেছে শুনবে না?
রিয়াদ রেগে চিৎকার করে বলল,
-না আমার শোনার দরকার নেই।তুমি আমাদেরকে এখান থেকে যেতে দাও এখনি।
-একটু শুনে দেখলে হয় না! (ইমন)
রিয়াদ চোখ লাল করে ইমনের দিকে তাকাল এবং সেই দৃষ্টি দেখে ইমন কেমন যেন মিইয়ে গেল।
ঐশির স্বামী মুখে হাসি ধরে রেখে বলল,
-তোমাদের কোন আপনজন নেই,অভিভাবক নেই,ভারী ভাবনা হয় আমার।সে জন্যই তো খুজে খুজে চারজন মেয়ে বের করেছি।ঠিক মেয়ে নয়,মহিলাই বলা উচিত।মধ্যবয়স্কা মহিলা,খুব শক্ত ধরনের।
-মানে!আমরা কখন বললাম আমাদের আপনজন নেই,অভিভাবক নেই।
রিয়াদ আবার গর্জন করে কিছু বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন বাইরে থেকে নারী কন্ঠ শোনা গেল।ঐশির স্বামীর চোখমুখ হঠাৎ আনন্দে ঝলমল করে উঠে।সে মধুর ভঙ্গিতে হেসে বলল,
-আমার স্ত্রী তোমাদের সাথে যাদের বিয়ে হবে, তাদের নিয়ে এসেছে।বিয়ের আগে একটু পরিচয় হওয়া ভালো।তোমরা চাদর দিয়ে শরীর ঢেকে নাও।
রিয়াদরা চাদর দিয়ে শরীর ঢেকে নেবার কোনা আগ্রহ না দেখিয়ে ঐশির স্বামীকে একরকম ঠেলে ঘর থেকে বের হয়ে এল।বাইরে চারজন মধ্যবয়স্ক মহিলা ঐশির পিছনে দাড়িয়ে ছিল।তাদের চুল ছোট করে ছাটা,ক্রুদ্ধ দৃষ্টি এবয় মুখে সৈনিক সুলভ কাঠিন্য।তারা দেখে কেমন যেন আঁতকে উঠে।
রিয়াদ কঠোর কন্ঠে বলল,
-এসব কি হচ্ছে!কে তোমাদের, আমাদের চুল-দাড়ি-গোঁফে হাত দিতে বলেছে?কতবড় সাহস আমাদের খাবারে ঘুমের ঔষুধ দেয়।
ঐশি অবাক হয়ে বলে,
-ছি!ছি!পুরুষ মানুষ এভাবে কথা বলে কখনো?
-এখন তো শুধু কথা বলছি।যখন রদ্দা লাগানো শুরু করব তখন বুঝবে মজা।
ঐশি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে ছিল।মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা তার কঠিন মুখে কুটিল একটা হাসি ফুটিয়ে বলল,
-এক সপ্তাহের মধ্যে আমি ওকে সিধে করে নিব।আগে বিয়েটা হয়ে নিক।
অপু রিয়াদের হাত ধরে বলল,
-এখানে চেঁচামেচি করে লাভ নেই।চল আমরা পালাই।
-কোথায় পালাবি?
-যেখান থেকে এসেছি সেখানে যাব।
কেউ কিছু বলার আগে তারা ঘর থেকে বের হয়ে এল।তাদের পিছুপিছৃ মধ্যবয়স্ক মহিলারা বের হয়ে বলল,
-সে কী!কোথায় যাচ্ছ তোমরা?তোমাদের জন্য কত যৌতুক দিয়েছি জান?
রিয়াদরা যত দ্রুত সম্ভব দৌড়াতে শুরু করে দিল।
দেখা গেল মধ্যবয়স্ক মহিলা চারজন এত সহজে তাদের যৌতুক দেয়া স্বামীদেরর ছেড়ে দিতে রাজি না।তারাও পিছু পিছু ছুটতে লাগল।
রিয়াদরা পাহাড়ের দিকে ছুটতে লাগল,পিছুপিছু ধাওয়া করছে চারজন কঠিন চেহারার মহিলা।তাদের পিছুপিছু মজা দেখার জন্য আরো অসংখ্য শিশু,কিশোরী,তরুনী,মধ্যবয়স্কা মহিলা এবং বৃদ্ধা।পিছন থেকে এক-দুটো ঢিল এসে পড়ল তাদের গায়ে।তারা তখন উর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে শুরু করে দিল।
হঠাৎ রিয়াদ কিছু একটার সাথে খোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।আর মধ্যবয়স্কা একটা মহিলা এসে তাকে ধরে ঝাকাতে লাগল।
পরিশিষ্ট:
চোখ খুলে রিয়াদ দেখল তার মা তাকে ডাকছে।
-কি নবাবজাদা ঘুম থেকে উঠবি কখন?তারাতারি উঠে ফ্রেশ হয়ে বাজারে যা।
রিয়াদের বুঝতে কিছুটা সময় লাগল যে এতক্ষন সে স্বপ্নের মাঝে ছিল।ঘোর কাটল বিজয় দিবস নিয়ে বাইরের মাইকের আওয়াজে।
সে মনেমনে বলে উঠল,
হায় রে,বাঙালীর বিজয় দিবসের দিন সে কিনা দেখল পুরুষের পরাধীন নিয়ে স্বপ্ন ।স্বপ্নে তার ভাবী স্ত্রীকে মনে করে সে কেপে উঠল।
যদি এটা স্বপ্ন না হয়ে সত্যি হত…!