বুবার গোয়েন্দাগিরি

বুবার গোয়েন্দাগিরি

স্কুল ব্যাগটা অতটাও ভারী ঠেকছে না, কিন্তু তবু না চাইতেও ওটার প্রতি একটু বেশি মনোযোগ চলে যাচ্ছে বুবার। বুবা, ক্লাস নাইনের ছাত্রী। বাড়ি থেকে স্কুলের পথ হেঁটে ওই খুব বেশি পাঁচ মিনিট। কিন্তু ওই পাঁচ মিনিটটাই আজ একটু বেশি ঠেকছে। এর মধ্যেই খুব সাবধানে পিঠের ব্যাগটা কে দু-তিন বার আলতো হাতে যত্ন নিয়েছে, হাত বুলিয়ে সন্তর্পনে দেখে নিয়েছে মায়ের সবজি কাটার ছুরির মাথাটা ব্যাগে ঘষা খাচ্ছে নাতো ? যদিও ডবল পলিথিনে মোড়া তবু লঙ্কা গুঁড়োর প্যাকেটটা আবার খুলে বই খাতাকে জ্বালাচ্ছে নাতো? হঠাৎ খেয়াল হল, একটা টুপি পরা বড় গোঁফওয়ালা লোক কেমন যেন পিটপিট করে তার দিকেই তাকাতে তাকাতে চলে গেল, আচ্ছা এই লোকটাকে কি আগে কোনদিন দেখেছে, আচ্ছা ওই যে কম বয়সী এক পাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তার ওপর, ও কি সত্যি পাগল? কে যেন বলছিল CID এর লোকেরা নাকি ছদ্মবেশে থাকে, এ আবার ওরকম কেউ নয়তো? চোখের সামনে যা দেখছে সবেতেই যেন আজ রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে বুবা। উফফ বড্ড বেশি ভাবছে সে, সামনেই স্কুলের গেট, এবার তাকে স্বাভাবিক হতে হবে, চোখ যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে মুখে একটা আলতো হাসির আভা ধরে রাখার চেষ্টা করল। স্কুলে ঢুকতেই দেখতে পেল, সুমি চলে এসেছে। ওকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করলো, “এনেছিস তো”? সুমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো, তবে একটু ভয় পাওয়া মুখে জিজ্ঞেস করল, “আজ কি শিওর যাবি, না মানে ভাবছিলাম একবার বাড়িতে বললেও তো হত”। তৎক্ষণাৎ বুবা তীব্র ব্যাঙ্গের সঙ্গে বলে উঠলো, “তোকে নিয়ে আর পারা গেল না, ভীতুর ডিম একটা, বেশি কথা বাড়াশ না তো, আর মুখটাকেও অমন ফ্যাকাসে করে রাখিস না, ক্লাসে অন্যরা যেন ভুলেও কিছু টের না পায়”। প্রার্থনা শেষের পর অংকের ক্লাসে বসে বসে বুবার প্রথম দিন থেকে সব ঘটনা গুলো মনে পড়ছিল। প্রথম যেদিন টিফিন টাইমে ওরা দল বেঁধে হঠাৎ করে পৌঁছে গেল ওই জায়গাটায় সেদিন সবাই খুব খুশি হয়েছিল। স্কুলের এত কাছে এরকম এক সুন্দর জায়গা আছে ওরা এতদিন জানতোই না। একটা বিরাট বড় বট গাছ দাঁড়িয়ে আছে গ্রামের একেবারে এক প্রান্তে তার সমস্ত ঝুরি ছড়িয়ে দিয়ে, পাশেই এক বিশাল পুকুরে খেলে বেড়াচ্ছে হাঁসের দল, আর ঠিক তার পাড় থেকে শুরু হয়েছে পাশাপাশি দুই গ্রামের মাঝের অংশ, শুধুই ধানের জমি। ওদের সেই প্রথম প্রথম ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরার দিনে, সব্বাই মিলে হেসে, খেলে, লাফালাফি করে দারুন আনন্দে কাটছিলো। প্রথম দিনেই লক্ষে পড়েছিল কিন্তু দু-একদিন পরে ওরা একটু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করেছে, ওই বট গাছের একটু দুরেই আছে একটা পোড়ো বাড়ি। পুরোটা জায়গাটাই বেশ উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আর তার মধ্যে একটা ছোট্ট পানা পুকুর ছাড়াও আছে অনেক রকমের ফুলের গাছ আর প্রচুর কলা গাছ। প্রায় সবার কাছেই অচিরেই সে বাড়ি হয়ে উঠলো একটা হন্টেড হাউস। তাও ঠিক ছিল, কিন্তু তারপরেই হঠাৎ একদিন ও বাড়ির ভেতর থেকে শোনা গেল ছোট্ট বাচ্চার কান্নার শব্দ। ব্যাস তারপর থেকে ওরা প্রায় কেউই আর ওদিক বিশেষ যেত না, শুধু দুজন ছাড়া, বুবা আর তার বেস্ট ফ্রেন্ড সুমি। ম্যাথ টিচারের লাভক্ষতির বকুনিতে একবার চিন্তাতে ছেদ পড়লো। আবার বাংলার স্যার যখন ভাব সম্প্রসারন শুরু করলো সেও ভাবতে লাগলো, এর আগের যেদিন ওরা দুজনে গেছিল সেদিন ভালো করে খেয়াল করেছে, গেটের তালাটায় মরচে পড়ে গেছে তার মানে রেগুলার ভাবে ও বাড়িতে কেউ যাতায়াত করে না এটা নিশ্চিত। আর বাড়ির বাউন্ডারি ধরে ধরে ওরা পাঁচিলটাও দেখেছে, না কোথাও অন্য কোন গেটও নেই। আর সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের সেটা হল ওরা সব দেখেশুনে স্কুলের পথে পা বাড়িয়েছে, অমনি শুরু হয়েছিল সেই কান্নার শব্দ। প্রথম দিনে অনেকের উপস্থিতিতে ওরা শুনতে পেয়েছিল কিন্তু ওতো স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারে নি, কিন্তু আজ দুজনেই একটু সময় দাঁড়িয়ে থেকে নিশ্চিত হয়েছে কান্নাটা ওই বাড়ির মধ্যে থেকেই আসছে। ব্যাস আর দ্বিতীয় বার ভাবেনি বুবা, সুমির সঙ্গে ফিরতে ফিরতে প্ল্যান করে নিয়েছে কবে তারা এখানে আসবে আর কি কি সাথে নেবে আর এই কদিনে হাতের কাছে যে কটা ফেলুদা ছিল সব গুলোতেই একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েছে। আজ সেই দিন।
কোন রকম টিফিনের ঘন্টাটা পড়তেই ওরা চুপিসারে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে সোজা পৌঁছে গেল ওই বাড়ির গেটে। মাথার চুলের কাঁটা দিয়ে পুরোনো তালাটাকে একবার খোলার চেষ্টা করল বুবা কিন্তু না, কোনো ভাবেই খুললো না। সুমি তখন ফ্যাকাসে মুখ নিয়েই পাশে পড়ে থাকা এক অধলা ইঁটের দিকে দেখালো। ওতে অবশ্য কাজ হল, ইঁটের এক আলতো ঘায়েই সে তালা প্রায় চৌচির হওয়ার জোগাড়। আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে তারা গেট যতটা সম্ভব কম খুলে ভেতরে ঢুকলো। বুবা তো গেট পুরো বন্ধ করতে চাইছিল পাছে বাইরে থেকে কেউ সন্দেহ করে কিন্তু সুমি বললো যদি ছুটে বেরিয়ে আসতে হয় তখন একটু খোলা গেটটা অনেক হেল্প করবে। ঢুকেই দেখলো পাশের কলা বাগানের দুতিন টে ছোটছোট কলার গাছ প্রায় মাঝামাঝি থেকে কাটা এবং সেটা দুয়েক দিনের মধ্যেই হয়েছে, পাশের একটা জবা ফুলের গাছের দুটো কাঁচা ডাল ভেঙে পড়ে আছে। তার মানে এই বাড়িতে কারুর নয় কারুর রেগুলার যাতায়াত আছে ভাবলো বুবা। সুমি হঠাৎ বুবাকে ডেকে দেখালো ওই পানা পুকুরের পাড়ে আছে অনেক পায়ের ছাপ তার মানে ওরা যা ভাবছে ঠিক তাই। আজ কিন্তু কোন কান্নার শব্দ ওরা পায়নি বরং পেয়েছে এক অদ্ভুদ শব্দ, যেন ওপর থেকে হুড়মুড়িয়ে কিছু একটা নিচে পড়লো। ভয় যে একেবারেই লাগেনি তা নয় কিন্তু অদম্য কৌতুহল আর মাথায় ফেলুদা সে ভয়কে মোটেও থাবা বসাতে দেয়নি। ছুরিটা সুমির হাতে দিয়ে বুবা হাতে নিয়েছে এক ছোট্ট মোটা লোহার রড। রডটা দিয়েই বাড়ির তালা বন্ধ দরজা তে বেশ কয়েকবার আঘাত করল সে। না কোন সাড়া শব্দই বাড়ির থেকে এলো না। আর এই তালা এত বড় যে একে ভাঙতে অনেক কষ্ট করতে হবে, তারা পেছনের দিকে গেল, নিশ্চই অন্য কোন পথ আছে এর মধ্যে যাওয়ার। যা ভেবেছিল তাই, ওরা দেখলো বাড়ির পেছনের গ্রিলের জানালার একটা পাল্লা পুরো খোলা, তাতে যে কেউ খুব সহজেই সেখানে ঢুকতে পারে। ব্যাগ গুলোকে রেখে ওরা দুজনে ভালো করে শাড়ির আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে নিল। বুবার হাতে একটা টর্চ লাইট আর ওই মোটা লোহার রড আর সুমির হাতে রইল সবজি কাটা ছুরি আর হাফ গুঁড়ো লংকার প্যাকেট। গ্রিলের দরজা খুলে ঢুকতেই কেমন যেন একটা বোঁটকা গন্ধ ওদের ঘিরে ধরলো। এই ভর দুপুরেও বাড়ির মধ্যেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, ভাগ্যিস টর্চটা এনেছিল ভাবলো বুবা। টর্চের আলোটা ফেললে কি ছুটে আসবে এক ঝাঁক বাদুড় কিচমিচ করতে করতে, আলোতে কি হঠাৎ দেখতে পাবে বীভৎস কিছু, হঠাৎ করে কত কিছুই খেলে যাচ্ছে বুবার মাথায়। হোক যা হবার হোক ভেবে সে জ্বালিয়ে দিল টর্চ। একটা তীব্র আলো গোটা অন্ধকার ঘরটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো। ওরা দেখলো তিনটে ছোট বাচ্চা ছেলে মেয়ে হাত জড়ো করে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, এদিক ওদিক ছড়ানো আছে কিছু কলা গাছের কান্ড আর কিছু শুকনো জবা ফুল। ওরা চমকে গিয়ে তীব্র ভাবে চিৎকার করে উঠল, “কে তোরা? এখানে কি করছিস?” ওদের মধ্যে একজন বলে উঠলো কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠলো, “দিদি বলুন আগে আমাদের মারবেন না”। সুমি বলে উঠলো “ঠিক আছে তোরা আগে বাইরে চল তারপর সব শুনছি”। ওরা আগে বেরুল তার পিছুপিছু এরা দুজন। দিনের আলোতে স্পষ্ট হল দুটো খুব রোগা রোগা অর্ধনগ্ন ছেলে আর একটা ওরকমই মেয়ে। ওরা যা বললো তার মানে করলে দাঁড়ায়, ওদের পাশের গ্রামেই বাড়ি, খুব গরীব কোন রকমে সংসার চলে, তাই ওরা ভিক্ষা করে আর তার ফাঁকে দুপুর বেলা এখানে এসে খেলে। বাইরে পাঁচিলের গায়ে যে সরু ফাটল টুকু আছে ওরা তার মধ্যে দিয়েই গলে এখানে ঢুকে পড়তে পারে।
এক জনের হাতে একটু কাটা দেখে সুমি একটা ব্যান্ডেড লাগিয়ে দিল। বুবা তার টিফিন বক্সটা খুলে ওদের দিল। ওরা পড়িমরি করে খেতে লাগলো। এই ফাঁকেই বুবা কি যেন একটা ভেবে নিল, ওদের বললো “চল তোদের একটা জায়গায় নিয়ে যাই, সেখানে রোজ খেতে পাবি”। শুনে ওদেরও মুখটা বেশ হাসি হাসি হয়ে গেল। পাশের প্রাইমারি ইস্কুলটা খোলা ছিল, বুবা ছোট বেলা ওখানেই পড়েছে, সেখানে ওদের নিয়ে গিয়ে হেডমাস্টারকে ডেকে সব বললো। মাস্টারমশাইয়ের চোখটা আনন্দে চিকচিক করে উঠলো। উঠে আলমারি থেকে এন্ট্রি খাতা বের করতে গেল। বুবা ওদেরকে বললো, “মাঝে মাঝেই আমি কিন্তু দেখতে আসবো, আর পড়া ফেলে ওখানে খেলতে গেলেতো কথাই নেই, সেদিন কিন্তু সত্যি সত্যি পেটাব”।
ফেরার সময় বুবার খুব ভালো লাগছিল, কাল থেকে আবার সব্বাই মিলে এখানে ওরা খেলতে আস্তে পারবে, আর বাচ্চা গুলোও যতটুকুই পড়াশোনা করুক না কেন পেট ভরে দুপুরে খেতে তো পারবে। শুধু দুটো জিনিস একটু খটকা লাগছিল, এখন ওই পুরোনো ভাঙা তালাটার কি করা যায় এই ভেবে আর সুমির অল্প রাগী রাগী মুখটা দেখে। ” কি রে তোর আবার কি হল, অমন পেঁচার মত মুখ করে আছিস কেন ?” বুবা হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো। সুমি মুখ ফুলিয়ে বললো, “মাসী যে টিফিনে আমার ফেভারিট পাস্তা পাঠিয়েছিল সেটাতো তুই আগে বলিস নি ! ”
………………………………………………সমাপ্ত…………………………………………….

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত