কালোদা যখন আমাদের বাড়িতে কাজ করতে আসে, আমরা তখন কুলটিতে থাকতাম। কালোদা দেখতে কীরকম বলছি। তার গায়ের রঙ আর মাথার চুলের মধ্যে কোনটা বেশি কালো বলা ভারি মুশকিল। চেহারায় বেশ লম্বা আর রোগা। মুখে কখনও হাসি দেখেছি মনে পড়ে না। শীত কি গরম সব সময় তার গায়ে একটা হাফহাতা গেঞ্জি, পরনে খাকি হাফপ্যান্ট। সম্পত্তি বলতে ছোট্ট একটা ফুল আঁকা টিনের বাক্স। তাতে ছুরি, সেফটিপিন থেকে রাজ্যের সব জিনিস আছে। আর একটা গুলতি। গুলতিতে কালোদা রোজ যত্ন করে তেল মাখাত। কাউকে ছুঁতে দিত না। আমাদের বাড়িতে যার যত জরুরি কাজ তার তত কালোদাকে দরকার।
মেজকাকুর জরুরি কাগজপত্র আসানসোলে উকিলবাবুর কাছে দিয়ে আসতে হবে—কালোকে ডাকো। ফুলদি, রাঙাদিরা ম্যাটিনিতে সিনেমা দেখতে যাবে, তার জন্য টিকিট চাই। কিন্তু বাবা বা কোনো কাকু যেন জানতে না পারে, কালোদাকে চাই। কালোদা একদিন বাজারে না গেলে মা-পিসিমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। সারাদিন ধরে বাজারের খুঁত বেরোবে। পিসিমার পুজোর ফুল আনা হয়েছে—বেলপাতা কম পড়েছে। এমন মাছ এসেছে যে, কাঁটার জন্য মুখে নেওয়া যাচ্ছে না। এ মা, সজনে ডাঁটা এনেছে, তার সঙ্গে মিষ্টি কুমড়ো আনেনি, এই রকম। আমি আমার কলমটা খুঁজে পাচ্ছি না। কিন্তু নির্মলবাবু স্যারের দেওয়া হোমটাস্ক এখনও বাকি। ফুলদিকে গিয়ে যদি বলি, তোমার কলমটা একটু দাও, ফুলদি অমনি জোরে জোরে বলতে থাকবে, সেদিন নতুন কলম কিনে দেওয়া হল, এর মধ্যে হারিয়ে ফেলেছিস! দাঁড়া। বাড়ির কারও জানতে বাকি থাকবে না। ইস, তোমার যেন আর কিছু হারায় না। সেদিন তোমার ঘড়ি হারিয়ে মুখ কলো করে বাড়ি ফেরনি? ফুলদিকে বলা যাবে না। কিন্তু কলমের কথা কালোদাকে বললে তার টিনের বাক্স থেকে মাথা-মোটা একটা কলম বের করে দেবে। আর কেউ তা জানতে পারবে না। কালোদাকে আমরা কোনওদিন কাঁদতেও দেখিনি। শুধু দুপুরের দিকে তাকে মাঝে-মাঝে দেখা যেত আমাদের বাড়ির পেছন দিকে গাছের নীচে চুপচাপ বসে আছে। বুদ্ধু বলত, ওই সময় মেদিনীপুরের মা-বাবার জন্য কালোদার মন খারাপ লাগে।
কালোদার সঙ্গে আমরা একদিন আসানসোলে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমরা মানে বুদ্ধু, পল্টু আর আমি। কুলটির চাইতে আসানসোল অনেক বড় জায়গা। কত ঘর বাড়ি, দোকান, বাজার। পল্টু জিজ্ঞেস করল, হোটেলে খাবি? আমারও অনেক-দিন থেকে হোটেলে খাওয়ার ইচ্ছে। কাচের বাক্সে ওরা কত কী রান্নাকরা ডিম, আলুরদম সাজিয়ে রাখে। দেখলেই খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বাবাদের সঙ্গে বেরলে ও সব ছোঁয়ার জো নেই। কালোদাকে জিজ্ঞেস করলাম, কালোদা, আমরা এই হোটেলে খাব? ও প্রথমে রাজি হল না। বলল, বাবুরা শুনলে রাগ করবে।
তারপর কী ভেবে বলল, আচ্ছা চলো। বাজারের কাছে একটা ভালো হোটেল আছে। আহ্ কলাপাতায় ভাত, মাটির গ্লাসে জল! আলাদা প্লেটে লেবু আর চাটনি। শুধু ডাল আর ছ্যাচড়া দিয়ে খেতেই যে কী ভাল লাগল। বাড়িতে অনেক ভাল ভাল জিনিসেও এত স্বাদ পাওয়া যায় না। বুদ্ধু দুবার চাটনি চেয়ে নিল। খাওয়া শেষ হলে আমরা বাজারে ঘুরতে লাগলাম। কত রকম জিনিস। কালোদা কী কী কেনাকাটা করল। এক জায়গায় গিয়ে দেখি, বন্দুকের টিপ পরীক্ষা হচ্ছে। একটা বোর্ডে কতগুলো বেলুন আটকানো আছে। একটা খেলনা-বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়ে বেলুন ফাটাতে হবে। একটা ফাটাতে পারলে আর একবার এমনি বন্দুক ছুঁড়তে দেওয়া হবে। পল্টু বলল, উইলিয়াম টেলের নাম শুনেছিস? উইলিয়াম টেলের তীর-ধনুকে দারুণ টিপ ছিল। বাঃ, শুনব না কেন? আমাদের গ্রীন রিডারেই তো উইলিয়াম টেলের গল্প আছে। হাফইয়ারলি পরীক্ষার আগেই আমাদের ওটা পড়ানো হয়ে গেছে। বুদ্ধু গম্ভীরভাবে বলল, ভেংকুভেলের নাম শুনেছিস? পল্টু শোনেনি, আমিও না। বুদ্ধু নিশ্চয় বানিয়ে বলছে।
ও এরকম সব বানিয়ে বলবে। একদিন বলেছিল, তোরা তো ফুটবল প্লেয়ার পেলের নাম শুনেছিস। আচ্ছা বল তো আয়োডেক্স কোন টিমে খেলে? কে না জানে আয়োডেক্স কোনো টিমেই খেলে না। খেলার পর অনেককে পায়ে আয়োডেক্স মালিশ করতে হয়। কথা বলতে-বলতে আমরা একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম। পল্টু হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, কালোদা কোথায় রে? পেছন ফিরে দেখি কালোদার সঙ্গে সেই টিপ পরীক্ষাওয়ালার কী নিয়ে তর্ক হচ্ছে। বেশ কিছু লোক জুটে গেছে। কী ব্যাপার? সামনে গিয়ে শুনি, কালোদা টিপ পরীক্ষার জন্য যে পয়সা দিতে হয়, দিয়ে বন্দুক নিয়েছিল। তারপর পরপর গুলি ছুঁড়ে লোকটার অর্ধেকের বেশি বেলুন ফাটিয়ে দিয়েছে। বেলুনওয়ালা বলছে, আমার বন্দুক ফেরত দাও। তোমাকে আর টিপ দেখাতে হবে না। আর কালোদা বলছে, নিয়ম মতো তাকে আবার বন্দুক ছুঁড়তে দিতে হবে। কালোদা ঠিকই বলছে। কিন্তু লোকটা কিছুতেই দেবে না। কালোদাও ছাড়বে না। যেসব লোক জড়ো হয়েছিল তাদের কেউ কালোদার পক্ষে, আবার কেউ বেলুনওয়ালার। আমরা চাইছিলাম, কালোদা আমাদের চোখের সামনে বাকি সব কটা বেলুন ফাটিয়ে দিক। সেই সময় মেজকাকুর উকিলবাবু কোত্থেকে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি সব শুনে কালোদাকে বুঝিয়ে বলতে লাগলেন, আরে বাপু, তোমার হাতে টিপ আছে, সে তো সবাই দেখেছে। বুঝছ না কেন তুমি বাকি সব বেলুন ফাটালে এ বেচারার ব্যবসা লাটে উঠবে।
কালোদা ওদের আর কিছু বলল না। শুধু আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, বাড়ি চলো। বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমরা বলাবলি করতে লাগলাম, উকিলবাবুর কাজটা ঠিক হয়নি। তাঁর উচিত ছিল, বেলুনওয়ালাকে বোঝানো। তবে বেলুন ফাটিয়ে কালোদা ঠিকই করেছে। ও কেন টিপ পরীক্ষা করতে এসেছিল? কিছুক্ষণ পর পল্টু বলল, উকিলবাবু যদি মেজকাকুকে সব বলে দেয়? তাই হল। আমাদের হোটেলে খাওয়া কথাটাও চাপা থাকল না। বুদ্ধুটা কখন বোকার মতো ফুলদিকে সব বলে ফেলেছিল। আর কোনোদিন যা হয়নি তাই হল। মেজকা, বাবা, পিসিমা সবাই মিলে কালোদাকে যা নয় তাই বলতে লাগলেন। আমরা ভাবলাম, কালোদা এবার রাগ করে দেশে চলে যাবে। কিন্তু কিছুই হল না। কালোদা একটা কথাও বলল না। সব আবার আগের মতো চলতে লাগল।
একবার কালোদার অসুখ হল। সাত আট দিনেও সারে না। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কালো, বাড়ি যাবি? কালোদা বলল, না। সবাই বলতে লাগল, আমাদের যেমন কালোদার ওপর মায়া পড়ে গেছে, ও আর-পাঁচজনের মতো আমাদের বাড়িরই কেউ। কালোদা যে বাইরে থেকে এসেছে, অন্য জায়গায় তার মা বাবা আছে, সবাই তা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। এর কিছুদিন পর রাঙাদি আর পিসিমা বেনারস যাবে। সঙ্গে ছোড়দার যাওয়ার কথা। কিন্তু ছোড়দা যেতে পারল না, বাবা বললেন, কালো যাক। আমাদের বাড়িতে আসার পর কালোদার সেই প্রথম বাইরে যাওয়া। আমারাও অ্যানুয়াল পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পিসিমারা যখন ফিরলেন আমাদের পরীক্ষা-টরীক্ষা সব শেষ হয়ে গেছে।
কয়েকদিন পর বেশ শীত পড়েছে। রবিবার। দুপুরেও আমরা চাদর মুড়ি দিয়ে ক্যারাম খেলছি। ফুলদি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, কালোদা একটা কাক মেরে ফেলেছে। ফুলদির কথা শেষ হতে না হতে পিসিমা প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, কী সর্বনাশ! কাক মারলে অকল্যাণ হয়। পিসিমাকে শান্ত করে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কেন মারল কালো? কী হয়েছিল? ফুলদি বলল, কালোদা গুলতি ছুঁড়ে কাকটা মিরেছে। আমারও মনে হতে লাগল, কালোদা এ কাজটা ঠিক করেনি। কালোদা কেন একটা কাক মারতে গেল? আমি শুনেছি, কাক মরে ভূত হয়ে যায়। বাবা বললেন, ডাক তো কালোকে। ফুলদি কালোদাকে ডাকতে ছুটে গেল, কিন্তু একটু পরেই ফিরে এসে বলল, এই তো বাগানে ছিল। এখন নেই। কালোদা কোথায় গেল? কিন্তু তাকে আর খুঁজতে হল না। কিছুক্ষণ পর কালোদা নিজেই এসে উপস্থিত হল। হাতে তার সেই ফুল আঁকা টিনের বাক্স। পায়ে জুতো। বাবা জিজ্ঞেস করতে বলল, সে ইচ্ছে করে কাকটাকে মারেনি। বাগানের রোদে আচার শুকোতে দিয়ে পিসিমা বলেছিলেন, কালো যেন একটু দেখে, কোনো পাখিটাখি মুখ না দেয়। কালোদা গুলতি হাতে পাহারা দিচ্ছিল। বারবার তাড়ালেও কতকগুলো কাক উড়ে উড়ে বসতে লাগল। কালোদা ভাবল, এমনি গুলতি ছুঁড়লে কাকগুলো ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে। কিন্তু গুলতি টুলতি হাতে নিলেই তার শরীরে যেন কিসে ভর করে। চেষ্টা করলেও তাক ফস্কায় না। ও মারতে চায়নি, কিন্তু আলগোছে গুলতি ছুঁড়তেই কী করে একটা কাকের গায়ে গিয়ে লাগল। কালোদা আর এখানে থাকবে না। গ্রামে, তার দেশের বাড়িতে চলে যাবে। বাবা কালোদাকে অনেক বোঝালেন, কিন্তু তার মুখে শুধু এক কধা, আমার ওপর শয়তানের দৃষ্টি আছে। আমি বাড়ি যাব।
যাবার আগে আমার পড়ার টেবিলের ওপর তার অত সাধের গুলতিটা রেখে কালোদা আমাকে বলল, আমি আর এ সব ছোঁবো না। এটা তোকে দিয়ে গেলাম। কালোদা চলে গেল। কিছুক্ষণ পর টেবিলের ওপর গুলতিটা চোখে পড়তে আমার কেন জানি গা ছমছম করে উঠল।