মনিকা আহমেদ ঘুমের মধ্যে কি যেন একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছেন না। অতঃপর মনিকা আহমেদের ঘোর কাটলো। তিনি এতক্ষণ স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলেন। এটা কি নিছক স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন? তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন না। একটা অস্বস্তি অনুভব করলেন। মনে হয় আর ঘুম আসবে না, তিনি এই ভেবে বিছানায় বসে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালালেন।টেবিল ল্যাম্পের উদ্ভাসিত আলোয় টেবিলে রাখা ফোটো ফ্রেমের দিকে তাকালেন। ছোট্ট মুখটির নিষ্পাপ সরল হাসি দেখতে দেখতে তার দুচোখ জলে ঝাপসা হয়ে এল। মনে পড়ে গেল ফেলে আসা দিন গুলির কথা।
মনিকা আহমেদের বিবাহিত জীবন বেশ সুখেরই ছিল।তিনি ছিলেন তার স্বামী – প্রাণাধিক প্রিয়।তারা ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। বিবাহিত জীবনের তিন বছরের মাথায় তাদের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। এই সন্তান ছিল তাদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ।সকালে সূর্যের জলমলে কিরনের মতো। তাই সন্তানের নাম রাখেন কিরন – যার অর্থ তাদের কাছে মূল্যেরও অধিক।কিরন ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগলো মা – বাবার স্নেহের ছত্র ছায়ায়। কিরন যেদিন প্রথম ‘মা’ শব্দটি উচ্চারণ করে, সেই দিন মনিকা আহমেদের মাতৃত্বের অন্তঃকরণ পরম তৃপ্তিতে পরিপূর্ণ হয়।
মনে পড়ে গেল কিরনের স্কুলে ভর্তির প্রথম দিনের কথা। সে কি কান্না ছেলের! সে একা কিছুতেই স্কুলে যাবে না, তার মা – বাবা দুজনকেই চাই একসাথে। অগত্যা বাবার অফিস ছুটি করতে হল। হাসি মুখে মা – বাবার সাথে কিরন প্রথম দিন স্কুলে গেল। নতুন বই খাতা, নতুন পরিবেশ ও সমবয়সী সহপাঠীদের পেয়ে স্কুলের প্রতি তার আকর্ষণ বাড়ল। পরবর্তী সময়ে কিরন তার সহপাঠীদের সঙ্গেই স্কুল বাসে করে স্কুলে যায়। ছোট্ট কিরন ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ও অধ্যবসায় তাকে এনে দিল শ্রেষ্ঠ ছাত্রের শিরোপা।
এমন করেই চলছিল তাদের জীবনের সুখতরী। কিন্তু এক দুর্যোগে সুখতরীর গতি হঠাৎ-ই থমকে গেল। মনিকা আহমেদের স্বামীর অফিস থেকে ফোন আসল। তিনি হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রান হারিয়েছেন। মনিকা আহমেদের চারপাশে নেমে এল ঘোর অন্ধকার।যার প্রতিটি সময় মানুষটি ছাড়া অচল, তাকে চিরদিনের মত হারিয়ে কি ভাবে বাঁচবেন? ক্রমশ এই অসহায়তাকে দূরে সরিয়ে, নিজেকে দৃঢ় করলেন। তার একমাত্র লক্ষ্য হল সন্তানকে মানুষ করা।সেই লক্ষ্যেই তিনি অগ্রসর হলেন। যোগ দিলেন স্বামীর চাকরিতে।শুরু হল সমাজের বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
স্কলারশিপ পেয়ে কিরন উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ পেল।যদিও কিরন তার মাকে ছেড়ে কিছুতেই বিদেশে যেতে চাইনি। কিন্তু মা তার কেবল স্নেহের অধিকারে কি করে ছেলের ভবিষ্যৎ জীবনের উন্নতির পথে অন্তরায় হবেন? তাই তিনি কিরনকে বিদেশে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করলেন। অতঃপর কিরন বিদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হল।
শুরু হল কিরনের নতুন জীবন। মায়ের কাছ থেকে দূরে এসে সে বড় একা হয়ে গেল। কিন্তু সময় যে পরিবর্তন ঘটাতে জানে। আর তার ব্যতিক্রম হলনা কিরনের জীবনেও। বিদেশে এসে অনেক নতুন বন্ধু হল। বুদ্ধিমান কিরন খুব সহজেই নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিল। প্রথম প্রথম পড়াশোনার ব্যস্ততার মাঝেও মায়ের সাথে নিয়মিত ফোনে কথা হত । প্রতিযোগীতা মূলক জীবন যাত্রায় সে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে, মায়ের সঙ্গে যোগসূত্রটাও ক্ষীণ হয়ে এল। অপর দিকে মায়ের দিন কাটে ছেলের ফোনের অপেক্ষায়। কখন তার কথা একটু শুনতে পাবে। মাঝে মাঝে তিনিও ছেলেকে ফোন করেন, কিন্তু কিরন ব্যস্ততার জন্য দু একটা কথা বলে ফোন রেখে দেয় । সন্তানের এই সুক্ষ পরিবর্তন মায়ের দৃষ্টি এড়ায় না।কিরনের ব্যস্ততার আরো একটি কারণ হল মিহি। যার সঙ্গে কিরনের প্রথমে বন্ধুত্ব ও পরে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। সে স্থির করে মিহিকেই সে জীবন সঙ্গিনী করবে। ঠিক যা ভেবেছিল তাই ঘটল তার জীবনে – সে পরীক্ষায় দুর্দান্ত রেজাল্ট করল। এবং সেখানেই এক নামী কোম্পানিতে চাকরির অফার পেল। মাকে ফোন করে কিরন তার ভালো রেজাল্ট ও নতুন চাকরির সুসংবাদ টা দেয়। মনিকা আহমেদ সংবাদটি শুনে অত্যন্ত খুশি হন ওছেলের জন্য মনে মনে গর্ব অনুভব করেন। ঠিক সেই মুহূর্তে কিরন মাকে জানায় তার ও মিহির সম্পর্কের কথা।এবং সে এটাও জানায় যে সে মিহিকেই বিয়ে করতে চায়। মনিকা আহমেদ কোনো দিনই সন্তানের কোনো কাজে বাধা দেননি, এ ক্ষেত্রেও তাই করলেন। নতুন চাকরির জন্য কিরন এই মুহূর্তে দেশে ফিরতে পারছে না। তাই সে মাকে বলে – ‘আমি তোমার জন্য টিকিট করে দিচ্ছি, এখানে আসার সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, তুমি অতি সত্বর আমার কাছে চলে আসো। তোমার এখানে কোনো অসুবিধা হবে না।’ মনিকা আহমেদ সন্তানের প্রতিটি কথা শুনে উপলব্ধি করলেন যে, কিরন আর সেই ছোট্ট টি নেই। সে তার জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত একাই নিতে শিখে গেছে। এটা ভেবে তিনি আশ্বস্ত হলেন। তিনি ক্ষীণ স্বরে কিরনকে জানান – ‘নারে বাবা, আমার তো এখন বয়স হয়েছে, আর শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। তুমি বরং মিহির বাবা – মা কে নিয়েই বিবাহ টা সেরে ফেল। এরপর যখন তুমি ছুটি পাবে, তখন না হয় এক সঙ্গে দুজনে এসো, আমি তখন আমার পুত্রবধূকে বরন করব।তবে যতদূরে থাকিনা কেন জেনো – তোমার মায়ের দুয়া সর্বদা তোমাদের সাথেই আছে।’এই বলে মনিকা আহমেদ ফোনটা রেখে দিলেন। তার দুচোখ জলে ঝাপসা হয়ে এল।
দেখতে দেখতে আরো দু ‘বছর কেটে গেছে।কিরন এখনো দেশে ফেরেনি।কর্তব্য হয়তো সে করেছে যেমন – মনি অর্ডারে টাকা পাঠানো ও ফোন করে মাঝে মধ্যে খোঁজ নেওয়া। এগুলিতেই যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছেন মনিকা আহমেদ। এখন শরীর ও মন রীতিমত ভগ্নপ্রায়। কেবল একটা ক্ষীণ আশা নিয়ে বেঁচে আছেন, কিরন একদিন ঠিক ফিরবে তার অভিমানী মায়ের কাছে। ইতিমধ্যেই কিরন ও মিহির একটি পুত্র সন্তান হয়। কিরন ফোন করে তার মাকে জানায় যে তিনি নাতি পেয়েছেন । সংবাদটি শুনে মনিকা আহমেদ ভীষণ খুশি হন। সাথে সাথে এটাও বলেন যে – ‘দুয়া করি তোমার সন্তানের যেন যথার্থ মূল্যবোধ হয়।’ এই প্রথম কিরন তার মায়ের অভিমানী গলাটা উপলব্ধি করতে পারে।
বেশ কিছু দিন পরে মনিকা আহমেদ কিরনকে ফোন করেন।অকস্মাৎ মায়ের ফোন অাসায় কিরন বিচলিত হয়ে পড়ে। ফোন রিসিভ করে প্রথমেই মাকে জিজ্ঞাসা করে ‘মা তুমি কেমন আছো?’ তখন মনিকা আহমেদ জানান তার খুব কিরনকে দেখতে ইচ্ছা করছে। এই কথাটা শোনার পর কিরনের মায়ের জন্য বুকটা হাহাকার করে ওঠে। ইদানিং সন্তানের সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত গুলোর মধ্যে সে যেন নিজের ছোটবেলাকে খুঁজে পায়।সে মর্মাহত হয় এই ভেবে-যে মাকে ঘিরে তার প্রতিটি মুহুর্ত কাটত, সেই মায়ের কাছে গত কয়েক বছরেও যাওয়া হয়নি।
কিরন সিদ্ধান্ত নিলএবার সে মায়ের কাছে ফিরবে।পরের দিন প্লেনের টিকিট কেটে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে রওনা দিল বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিরন এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যত বাড়ির কাছাকাছি আসতে লাগলো, ততই যেন তার মায়ের জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল। অবশেষে বাড়িতে পৌঁছে মায়ের ঘরে ঢুকল।সে যতটা আনন্দ ও উচ্ছ্বাস নিয়ে বাড়িতে এসেছিল তা এক নিমেষে ম্লান হয়ে গেল। তার দুচোখের কণা জলে ভরে এল। দেখল মায়ের শীর্ণকায় শরীর বিছানার সাথে মিশে আছে। শুধু শরীরের সজাগ দুটি চোখ জ্বল জ্বল করে তাকিয়ে আছে কিরনের দিকে।মায়ের এই করুণ অবস্থার জন্য কিরন নিজেকেই দায়ী মনে করল।
কিরন মা বলে ডেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল। মায়ের বুকে মাথা রেখে সে বলল – ‘মা তোমার এ কি অবস্থা হয়েছে শরীরের? আমি তোমাকে আর এক মুহুর্ত এখানে একা থাকতে দেব না। আমি তোমাকে আমাদের সাথে নিয়ে যাব।’ তখন মনিকা আহমেদ মৃদুস্বরে বললেন – ‘বাবা তুই যে বড্ড দেরী করে ফেলেছিস। আমি তো এতদিন এই দিনটার আশায় বেঁচে ছিলাম। কিন্তু এখন যে আমাকে তোর বাবার কাছে যেতে হবে। সেই তো একমাত্র আমার অভিমান বোঝে।’ এরপর মনিকা আহমেদের দুচোখে চির অন্ধকার নেমে এল।তার দেহটি নিস্তেজ হয়ে গেল। কিরন মা বলে চিৎকার করেও কোনো সাড়া পেল না।
কিরনের দুচোখ বেয়ে শুধু জল গড়িয়ে পড়ছে, আর সে মনে মনে বলছে – ‘মাগো তুমি যে বড্ড অভিমানী তা আমার বুঝতে অনেক দেরী হয়ে গেছে।আমাকে তুমি ক্ষমা করো।…. তোমার কিরনকে তুমি ক্ষমা কোরো।’
……………………………………..সমাপ্ত……………………………..
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প