জায়গাটা বড় ও সমান্তরাল। বড় বলতে প্রায় চল্লিশ বা পঞ্চাশ একর। পাশাপাশি অনেকগুলো ঘর গিঞ্জি করে গড়ে তোলা হয়েছে। সারিবদ্ধ ঘরগুলো একটির সাথে
অন্যটি লাগানো। ঘরগুলো থেকে কিছুটা দূরে নলকূপ লাগোয়া বাথরুম, তার সামনে ২ কিংবা ৩ জনের ক্রমাগত লাইন। দূর থেকে দেখে পরিবেশটা অসাস্থ্যকর মনে
হয়। দূর থেকে দেখে এও মনে হয় যে জায়গায়টা গরীবদের আবাসস্থল। আসলেই তাই, এক সময় এটা বস্তি ছিল। বিশালাকারারের সরকারী জমিতে বস্তিটি গড়ে ওঠে।
জায়গাটা ঢাকা নামক জেলার অন্তর্গত।
এক সময় বস্তি ছিল বললাম এই কারণে যে এখন আর এটা ঠিক বস্তি নেই। তারপরও হঠাৎ জনগণের কিংবা আমরা যারা গল্পটি এখন পড়ছি তাদের এই জায়গা নিয়ে
আগ্রহের কারণ হচ্ছে দুটি সার্ভে। এই সার্ভেগুলোর প্রথমটি করেছে আমেরিকার ইয়েল ইউনিভার্সিটির একদল ছাত্র। অন্যটি সিডনি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি
অধ্যয়নরত একজন ছাত্র, তাঁর গবেষণার কাজে। এবং সার্ভে দুটিই সারা বাংলাদেশ এমনকি গোটা বিশ্বেও অনেক জায়গায় হইচই ফেলে দিয়েছে।
সার্ভে দুটি বলেছে যে এই বস্তিটি অথবা বস্তি না জায়গাটির মানুষগুলোই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ! এই ছোট্ট খুপড়ি রকমের ঘরগুলোতে যারা থাকে, যারা প্রতি রাতে
এখানে ঘুমিয়ে পরদিন সকালে বাথরুমের লাইনে দাঁড়িয়ে দিন শুরু করে, তাদের মনে যেই প্রশান্তি তা নাকি বিশ্বের আর কোন অঞ্চলের মানুষের নেই। এত সুখী হওয়ার
একমাত্র কারণ তাদের অলোভী মনোভাব, উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীনতা এবং যা আছে তা নিয়ে তৃপ্তিবোধ। এসব কারণে এমনকি বিল গেটস অথবা বিশ্বের অন্যান্য ধনকুবের,
প্রেসিডেন্ট, প্রাইম বা নর্মাল মিনিস্টারদেরও মনে এত শান্তি নেই!
তাদের কথা শুনে অনেকেই তাচ্ছিল্য দেখিয়ে বলেছিল, আরে ধুর! কত শত শত সার্ভেই তো হয়, এর সবগুলো কি ঠিক? এরা সারা বিশ্বের কয় জন মানুষকেই বা
দেখেছে কিংবা কয়টা জায়গা ঘুরেছে? আন্দাজে এমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া থেকে উড়ে এসে বললেই হয় নাকি? তবে পরক্ষণেই তাদের মনে হয় এরা ইয়েল ও সিডনি
ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টস, সারা বিশ্বের প্রথম সারির কিছু মেধাবী ছাত্রছাত্রী। তাই তারা চুপসে যায়। আর অবাক হয়, এই বস্তির মানুষরা এত সুখী! সারা বিশ্বের সবচেয়ে
বেশি!
সার্ভে দুটির পরই আমাদের দেশের পত্রপত্রিকাগুলোতে শোরগোল উঠে। জনগণ উদ্ধেলিত হয় আনন্দে। বলে, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় এনেছি, আমরা তো এমন
হবই!
আলোচনা হয় ফেইসবুকেও। অসংখ্যা মানুষ স্ট্যাটাস দিতে শুরু করে। অনেক বাংলা পেইজের উর্বর মস্তিষ্কের এডমিনরা বস্তিটির ছবি দিয়ে পোস্ট দেয়ঃ এই সেই বস্তি।
ছবিটির জন্য কয়টি লাইক?
ব্লগগুলোর ইউজাররাও ক্লান্তিহীন পোস্ট দিয়ে গেল। তারপর একসময় আবার সবকিছু আগের মত হয়ে গেল। জায়গাটির মানুষেরা সকালে কাজে বেরিয়ে সন্ধ্যায়
আসে। তাদের জীবনযাত্রায় কোন পরিবর্তন হয় না। তারা থেকে যায় আগের মতই – বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষ হিসেবে।
একদিন সেই গিঞ্জিমত জায়গাটিতেই চোখ পড়ল আমাদের দেশের প্রথিতযশা এক ব্যবসায়ীর। একজন তিনি ব্যবসায়ী, কিন্তু তাঁর প্রভাব প্রায় আকাশ ছোঁয়া। অন্য সব
ব্যবসায়ীরা, বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা, এবং মাঝে মাঝে প্রধান নেতা-নেত্রীরাও তাঁর কথা ফেলতে পারেন না। লোকমুখে শোনা কথানুযায়ী দুইবারে দেশের অর্থনীতির
দর্পণ (অর্থাৎ শেয়ারবাজার) ভেঙ্গে চুরমার করার পরও তাঁকে কিছু করা হল না। পত্রপত্রিকায় শত শত কিংবা হাজার হাজার রিপোর্ট লিখেও তাঁর বিরুদ্ধে কিছুই করা
গেল না। বরং যারা তাঁর জুয়ার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছিল তাদেরকেই ফটকাবাজ বলা হল, পুলিশেরে প্যাদানিতে পড়ে তাদের কয়েকজনের মাথাও ফাটল, ২ জন করল
আত্নহত্যা। আমাদের বিশাল শ্মশ্রুমণ্ডিত ব্যবসায়ী এই ফাঁকে টিভি বা পত্রিকায় বিভিন্ন ইন্টারভিউ দিতে লাগলেন। বলতে লাগলেন শেয়ারবাজারকে ঠিক করতে কী কী
করতে হবে। তিনি কথার ফাঁকে অনর্গল ইন্ডিয়ান ইংরেজিও বলেন, যা দেশের অধিকাংশ অশিক্ষিত মানুষই বুঝে উঠতে পারে না।
আমাদের দেশের মানুষ সবসময়ই শান্ত দর্শক। আমরা দেশের কোটি কোটি মানুষ এসব কিছু অত্যন্ত শান্তভাবে দেখে গেছি। আর দোষ দিয়েছি রাজনৈতিকদের।
যাহোক, সুপারম্যানসম ক্ষমতাসম্পন্ন এই ব্যবসায়ীর নজর আমাদের সেই বস্তি বা বস্তি না জায়গাটিতে। তিনি সেখানে কারখানা গড়ে তুলবেন। কারখানা হবে একটা-
দুটা না, অন্তত নাকি পাঁচ-সাতটা। ঔষধ-গার্মেন্টস-সিরামিক-এনার্জি প্লান্ট সহ তাঁর আরও কিছু ব্যবসায়ের সম্প্রসারিত কারখানা সেখানে তৈরি করা হবে। তিনি যেটা
মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি ও জোর গলায় বললেন তা হল কর্মসংস্থানের কথা; এখানে কারখানাগুলো হয়ে গেলে কয়েক হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। তিনি প্রায় ২
হাজার কোটি টাকা খরচ করে জনগণের এই উপকার করবেন। তাঁর নিজের এতে কী উপকার হবে তা নিয়ে কিছু বললেন না একবারও।
শান্ত ও অসাস্থ্যকর কিন্তু সুখী মানুষদের গিঞ্জি এলাকার অস্তিত্ব নিয়েই শংকা দেখা দিল। কিন্তু করারও কিছু নেই। বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারল যে যেহেতু তিনি
করবেন বলেছেন, তার মানে করবেনই। তারপরও পত্রিকাগুলো এ নিয়ে বাগড়া বাঁধাতে চাইল। আমাদের ধর্মপ্রাণ, লম্বা ও সফেদ দাঁড়ির ব্যবসায়ীকে নিয়ে তারা অনেক
কিছু লিখতে শুরু করল। তাদের লেখালেখি আর টিভি মিডিয়ার রিপোর্টগুলোর কারণে একসময় সুখী মানুষরা জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করল। তাদের সাথে যুক্ত
হতে লাগল অনেক সাধারণ ও অসাধারণ মানুষেরাও।
কিন্তু সরকার বা বিরোধী দল কিছু বলল না। যারা আমাদের অধিকাংশ অভ্যন্তরীণ বিষয়েই মানবতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে, সেই হিউম্যান রাইটস ওয়াচও কোন
বার্তা প্রেরণ করল না। আর আমাদের সেই মহান ব্যবসায়ী অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে তিনি সবসময়ই জিরো টলারেন্স অবলম্বন করেন। কাজেই এই
কারখানাগুলোও তিনি অবশ্যই তৈরি করবেন। আর ৪ মাস পর হজ্ব। প্রতিবারের মত এবারও তিনি হজ্ব পালন করবেন। এবং এসেই শুরু করবেন কারখানার কাজ।
তারপর এই নিয়ে আরও বহু মাতামাতি হল। সেই এলাকার মানুষদের সংগঠন গড়ে ওঠেঃ আমিরখালি কলোনি রক্ষা কমিটি।
এতক্ষণে স্পষ্ট হলাম আমরা। এলাকাটা বস্তি না, হবে কলোনি।
এরপর মাস দুয়েক পর আবার সব শান্ত। আর এ নিয়ে কথাবার্তাই বন্ধ হয়ে গেল আরও দু মাস পর। হঠাৎ এক মাঝ রাতে, অর্থাৎ ৪ মাস পরের এক নিঝুম-শান্ত রাতে,
যখন আমিরখালী কলোনির সুখী লোকেরা তাদের ছোট্ট কক্ষগুলোতে ঘুমাচ্ছে, তখন হঠাৎ করেই মানুষের ভয়াবহ চিৎকার আর করুণ আর্তনাদ শুরু হল।
সেদিন রাতে সমস্ত কলোনি, যাকে নিয়ে আমরা দ্বিধাগ্রস্থ ছিলাম বস্তি নাকি অবস্তি, যেখানকার মানুষ ছিল পৃথিবীর সবচে’ সুখী, সেই কলোনিকে ৮ কিংবা ১০ টি
বুলডোজার দিয়ে সম্পূর্ণ গুঁড়ে দেয়া হল।
পরদিন সকালে আর বোঝা যায় না যে এখানে কোন কলোনি ছিল, ছিল বাচ্চাদের অব্যাহত কান্না কিংবা হইচই এর শব্দ, ঘরগুলোর সামনে গোল হয়ে মহিলাদের চুল
বাঁধতে বসার জায়গা ছিল এবং বোঝা এও যায় না যে টয়লেটের সামনে সকালে মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। তবে প্রায় কয়েক শ মানুষের ক্রমাগত আহাজারি শোনা
যায়, তাদের কান্নার শব্দ ঢাকা শহরের উন্মুক্ত আকাশে করুণ রাগিনীর মত মিলিয়ে যায়।
একসময় পুলিশ আসে। মোটা ডাণ্ডা দিয়ে পেটাতে পেটাতে তাদেরকে বলে, হারামজাদারা ভাগ এইখান থেকে!
পিটুনির ভয়ে তারা দৌড়াতে থাকে, সরে যায় ধীরে ধীরে এলাকা থেকে।
কয়েকজন নারী দৌড়ায় না, ভয়ে তটস্থ তাদের বাচ্চারা কেঁদে উঠে। তবু তারা কলোনি ছাড়বে না। পুলিশ একসময় তাদের পিঠেও ডাণ্ডাপিটুনি দেয়। চিৎকার করে বলে
উঠে, বেশ্যার দল! এত বছর সরকারের জায়গায় থাইকাও তুষ্টি নাই। মাগীরা আরও চায়!
এরপর ২ বা ৩ বছর কেঁটে যায়। সাবেক আমিরখালী কলোনিতে অনেকগুলো কলকারখানা গড়ে উঠে। আজ সেগুলোর উদ্বোধন। মিলাদ বা দোয়া মাহফিল শেষে
মিষ্টিমুখ করে সব শুরু হবে।
কারখানা চত্বরে বিশাল মসজিদ। তার ভেতরে প্রায় কয়েক শ মানুষ। হুজুর মোনাজাত ধরলেন, দরদ ভরা কণ্ঠে শুরু করলেনঃ রাব্বানা জালাম না আন ফুসানা ওয়া
ইল্লাম তাগফির লানা ওয়া তার হামনা নাকুনান্না মিনাল খাসিরিন। আল্লাহ আপনি জানেন, আপনার মেহেরবানিতে দীর্ঘ দুই বছর ধরে এই কারখানার কাজ চলেছে, আজ
তার উদ্বোধন; যেই মহান উদ্দেশ্য নিয়ে এই কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে তা যেন আল্লাহ সহিভাবে পূরণ হয়। হে আল্লাহ যিনি এই কারখানা, বড় বড় দালান তুলে
লোকজনের চাকরি দিয়েছেন, দেশের ব্যবসায়ে অবদান রাখছেন, তাকে মানুষের আরও খেদমত করার সুযোগ করে দিন…
আমাদের সেই কিংবদন্তীতুল্য ব্যবসায়ী যেন আরও খেদমত করার সুযোগ পান, সেজন্য আসুন, তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ অথবা সন্তান ও অন্যান্য বংশধররা এবং তাঁর প্রতিষ্ঠানের
আরও অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী; যারা এখানে উপস্থিত আছেন, তাদের সাথে আমরাও মোনাজাত ধরি।
এরপর উচ্চৈঃস্বরে একসাথে সবাই বলে উঠিঃ আমিন।