জীবনের দুই প্রান্তে দাড়িয়ে থাকা দুজন

জীবনের দুই প্রান্তে দাড়িয়ে থাকা দুজন

-ছেলেটা…..
মেয়েটার সাথে আমার পরিচয় কলেজের ক্যাম্পাসে।আমি সাধারণত , ক্যাম্পাসে আড্ডা দেয় না কারণ, আড্ডা দেওয়ার মত সময় আমার হাতে নেই। আড্ডা দেওয়ার টাইম টায় একটা পার্টটাইম জব করি আর অবসরে দুইটা টিউশনি … এগুলা না করলে যে মেস ভারা আর খাওয়ার খরচ টা উঠবে না। আমি কি করি, কোথায় যাই, কই থাকি এটা আমার কাছের দুই বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানে না বা ও কাউকে জানানোর প্রয়োজন ও মনে করি না।
ভালই যাচ্ছিল আমার দিন গুলি। তবে একটা মেয়েই হয়ে উঠল সব যন্ত্রনার কারণ। একদিন হঠাত করে কোথা থেকে সামনে এসে দাড়ায় আর জিজ্ঞেস করে এই তুমি আমাদের ডিপার্টমেন্ট এর না?? আমি আস্তে করে বলি “হ্যা”। ও বলে তোমাকে ক্যাম্পাসে দেখি না কেন? এখন থেকে আমাদের সাথে আড্ডা দিবে। আমি মনে মনে হাসি কারণ যে মেয়ে ৩০ লক্ষ টাকা দামের গাড়িতে করে কলেজে আসে তার পক্ষে দুনিয়ার রঙ বুঝা সম্ভব না। তারপরও আমি বলি আচ্ছা।।
আমি আগের মত করেই চলছিলাম। হঠাত আরেকদিন মেয়েটা কোথা থেকে যেন উদয় হয় আর আমাকে এসে বলে এই তোমাকে না বলছিলাম আমাদের সাথে আড্ডা দিবা।। আমি কিছু না বলে হাসছিলাম। সেদিন মেয়েটা আমার নাম্বার নিয়ে যায়। যদিও অই দিনের পর আর আমাকে সে ক্যাম্পাসে আড্ডা দেওয়ার জন্য জোর করতো না। তারপর থেকে প্রায়ই ও আমাকে ফোন করতো। আমি কখনো ফোন দিতাম না ওই দিত। এর পর থেকে প্রায়ই ক্যাম্পাসে দেখা হয়ে যেত। আমি আসলে ইচ্ছা করেই ওর সামনে পড়তাম তবে কখনো যেচে কথা বলতে যেতাম না। এভাবেই চলছিল দিন গুলা। আমি ধীরে ধীরে ওকে পছন্দ করতে লাগলাম হয়ত ভাল ও বেসে ফেলেছিলাম। তবে কখনো বলার মত দুঃসাহস করতে পারি নি। এর কিছু কারণ ও আছে। প্রথমত ওর ফেমিলি আর আমার ফেমিলির মাঝে আকাশ পাতাল তফাত। আমার চিন্তা অনুযায়ী আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে ওকে পাওয়ার কথা ভাবাটা আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না কিংবা ব্যাপার টাকে বলা যায় বামন হয়ে চাদে হাত দেওয়া। দ্বিতীয় কারণ টা ছিল ওর পিছনে অনেক স্মার্ট টাকা ওয়ালা ছেলেরা ঘুরত। আমি ভাবতাম কোথায় ওরা আর কোথায় আমি এক হনু।
আমার দেখায় সব বড় লোকের মেয়েরা উশৃঙ্খল হয়। ওদের চালচলন কথাবার্তা হয় উড়নচণ্ডী টাইপের। তবে এই মেয়েটা একটু ভিন্ন ধরনের ছিল। পোশাক আশাকে আর দশটা নরমাল মেয়ের মতই। আর আচার ব্যবহারে একদম শান্তশিষ্ট। ওর এই ব্যাপার গুলা আমাকে অনেক মুগ্ধ করতো। যাই হোক আগের মতই চলছিল আমার দিন গুলা। আমি কখনো কোন কলেজ পার্টি তে যেতাম না। তবে সামনের ১৩ই জুন ওর জন্মদিন ছিল। অনেক বার করে বলেছে ওর বার্থডে পার্টিতে যাওয়ার জন্য তাই না বলার কোন সুযোগ নেই। আর আমি ভাবছিলাম ওকে ওর জন্মদিনে কি দেওয়া যায়… ওরা কত বড়লোক। কমদামী জিনিস দিলে খারাপ দেখায়। আর পকেটে তেমন টাকাও নেই। এগুলা ভাবতে ভাবতে হঠাত একটা বুদ্ধি আসে মাথায়। ভাবলাম একটা আর্ট পেপারে ওর নামটা রঙিন কালি দিয়ে লিখে মধ্যে একটা ধানের ছড়া রেখে ওটাকে রঙ করে কাচের ফ্রেমে বেধে দিব। যেই ভাবা সেই কাজ। দেখতে দেখতে ওর জন্মদিনের দিন উপস্থিত হল। সন্ধ্যায় ওর বাসায় পার্টি। আস্তে আস্তে ওর বাসার দিকে গেলাম। ওর বাড়িতে যখন ঢুকছিলাম ধীরে ধীরে অবাক হচ্ছিলাম। দোতালা একটা বাড়ি সম্পূর্ণ টাইলস করা। বাড়িতে ঢুকার দুইটা গেট। বাড়ির বাইরে দুইটা প্রাইভেট কার। আমি বাড়ির ভিতরে সন্তর্পনে হাটছিলাম। সবাই আমার দিকে কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছিল। আমাকে হয়ত এই পরিবেশ টায় বেমানান লাগছিল। আমার নিজের কাছেও অস্বস্তি লাগছিল। আমি ওখান থেকে বের হওয়ার জন্য সুযোগ খুজছিলাম। হঠাত ওকে দেখলাম সিড়ি দিয়ে নামতে। নীল রঙের ড্রেসটায় অসাধারণ লাগছিল ওকে। এর পর আমি একটু দুরে সরে আসলাম। ওর জন্য আনা উপহার টার উপর থেকে আমার নাম লিখা কার্ড টা তুলে ফেললাম। তারপর এটাকে অন্য উপহার রাখার জায়গায় রেখে চলে আসলাম। যাক একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে মেয়েটা জানবে না যে আমি এসেছিলাম। আর এত ভীড়ের মাঝে কি আর আমার কথা মনে আছে ওর ?? এগুলা দেখতে দেখতে চলে আসলাম ওখান থেকে। আসলে আমি যদি ওখানে আরো কিছুক্ষণ থাকতাম তাহলে আমি আরো গভীর ভাবে ওর প্রেমে পড়তাম যা আমার জন্য সুখকর হতো না। কিছু জিনিস বলতে নাই কিছু জিনিস পেতে নাই, এভাবেই হয়ত চলে মানুষের জীবন।
★★★
-মেয়েটা…..
ছেলেটাকে অনেকদিন থেকেই লক্ষ করছি ক্যাম্পাসে বসে না বা আড্ডা দেয় না। কারো সাথে তেমন একটা কথাও বলে না। ক্লাস শেষ হলে চুপচাপ চলে যায়। বেশ ভাব নেয়- ছেলেটা দেখতে ও তেমন আহামরি কিছু না, সাধারণ একটা ছেলে। একই কলেজে, একই ক্লাসে পড়ি। পরিচয় থাকবে না তা কি করে হয়। কলেজের কোন অনুষ্টানে বা পার্টিতে ওকে দেখতাম না। একদিন গেলাম ছেলেটার সামনে, আমাকে দেখে একদম সিটিয়ে গেল এমন ভাব যেন কোন মেয়ের সামনে দাড়িয়ে কথা বলে নাই কখনো।
জিজ্ঞেস করলাম কেন আমাদের সাথে আড্ডা দেয় না। ও কোন কথা না বলে মুচকি হাসে। বললাম এখন থেকে বসবা। ছেলেটা বলে শুধু -আচ্ছা। পরেও দেখি একই ঘটনা। আমাদের সাথে আড্ডা দেয় না। অনেক রাগ লাগল কেন এত ভাব নেয় ছেলেটা? সমস্যা কি ওর? পরে ওর সম্পর্কে খোজ নিয়ে জানতে পারলাম যে ও ক্লাস শেষে একটা প পার্টটাইম জব করে আর সন্ধ্যার পর টিউশনি করে। নিজে একটা মেসে থাকে। বাবা মারা গেছে অনেক আগেই ।ঘরে মা আর ছোট বোন আছে। ওদের খরচ তাকেই চালাতে হয়। সব শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। জীবনে কোন দিন অভাব দেখি নাই। কোন দিন গাড়ি ছাড়া বাসা থেকে বের হই নাই। সবকিছু জানার পর কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল।একদিন নাম্বার রাখলাম ওর থেকে। পরে মাঝে মাঝেই কথা হত। আস্তে আস্তে ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি, তবে কখনো ওকে বুঝতে দিতাম না কারণ ছেলেটা আমার সামনে এলে লজ্জায় লাল হয়ে থাকতো ঠিকমত কথা বলতো না।
আমার আশে পাশে অনেক হ্যান্ডসাম ছেলেরা ঘুরত তার পরেও কেন যেন আমার ওকেই ভাল লাগতো। কারণ টা এখনো অজানা। কিছু জিনিস না জানাই ভাল। নানা বাহানায় ওকে ফোন দিতাম যদিও সে কখনো দিত না। কিছুদিন পর আমার জন্মদিন ছিল সে কারণে সকলকে দাওয়াত করলাম। ওকে কয়েকবার বললাম আসতে।
আমার জন্মদিনের দিন সন্ধ্যায় আমি খুব ভাল করে সাজলাম। ওর পছন্দের নীল রঙের একটা ড্রেস পড়লাম। আমার বাসাটা ডুপ্লেক্স ।আমি দোতলা থেকে গেটে নজর রাখছিলাম যে ও কখন আসে। উফ অবশেষে ওকে দেখলাম, হাতে একটা প্যাকেট ছিল। মনটাই খারাপ হয়ে গেল ও কেন শুধু শুধু গিফট কিনে টাকা নষ্ট করলো। বোকাটা হাতে গিফট নিয়ে অসহায়ের মত ঘুরছে। শেষে গিফট টা অন্য গিফট রাখার স্থান্ব রাখল। রেখে এদিক ওদিক ঘুরছিল। আর আমি এখুনি নিচে নামব- সবার সাথে দেখা করব। বিশেষত ওর সাথে তারপর ওকে পাশে রেখে কেক কাটব। এগুলা ভাবতে ভাবতে নিচে নামছিলাম… নিচে নামার পর সবাইকে দেখলাম কিন্তু ওকে দেখছি না। ওয়াসরুমে গেল নাকি? না কোথাও দেখছি না ওকে। আমার খুব কান্না পাচ্ছে। সবাই কেক কাটতে বলছে। কিন্তু আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছি। বোকাটা বোধ হয় চলে গেছে। ফোন যে করব সে উপায়ও নেই, ফোন উপরে ফেলে এসেছি।অন্তরে কান্না করলেও হাসি মুখে কেক কাটলাম। সবাইকে বিদায় দেওয়ার পর গিফট দেখতে লাগলাম। অনেকে অনেক গিফট দিয়েছে কিন্তু বোকাটার গিফট টা খুজে পাচ্ছি না। হঠাত একটা গিফট হাতে আসলো যেটাতে নাম নেই। বুঝলাম এটাই বোকাটা দিয়েছে। আস্তে করে গিফট টা খুললাম। অসাধারণ একটা জিনিস। আমার নামটা খুব সুন্দর করে লিখে এটাকে আরট পেপারে করে একটা ফ্রেমে বাধানো। ফ্রেমটাও খুব সুন্দর। এটাতে আছে নিখাদ হাতের শ্রম আর একটু ভালবাসা। যার মূল্য টাকায় হয় না। আমি ফ্রেমটাকে আমার গালের সাথে লাগিয়ে কিছুক্ষণ ধরে রাখলাম। তারপর এটাকে পড়ার টেবিলে সাজিয়ে রাখলাম। বাব যখন প্রথম গাড়ি কিনে দিয়েছিল তখনো এতটা খুশী হইনি। রাত দুইটা, ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। আমি বারান্দায় দাড়িয়ে বৃষ্টি ধরছি। আর ভাবছি ইস আমরা যদি গরিব হতাম তাইলে কি এমন ক্ষতি হতো। কোন সংকোচ ছাড়াই ওর হাত ধরতে পারতাম, ছেলেটাও আমার হাত ধরতে সংকোচ করতো না। কিছু জিনিস চাইলেও করা যায় না সমাজের কারণে। ছেলেটার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছা করছে। আচ্ছা ছেলেটা কি এখন জেগে আছে? এত রাতে ফোন দিব? ভাবতে ভাবতে ফোন দিয়েই দিলাম। না…. রিসিভ করলো না….
★★★
হ্যা ছেলেটা জেগে আছে তবে ইচ্ছা করে না, অনিচ্ছাকৃত ভাবে সে ফোন ধরতে পারেনি।কারণ ছেলেটা যে মেচে থাকে সেখানে টিনের চালটা ফুটো হয়ে পানি পড়ছে চুয়িয়ে চুয়িয়ে ।সেই পানি যাতে বিছানায় না পড়ে তাই ছেলেটা পাত্র হাতে দাড়িয়ে আছে পানি পড়ার জায়গাটায়। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দে মোবাইলের রিং টা শুনা যায় না।।
গল্পটা অসমাপ্ত। কিছু কিছু গল্প অসমাপ্ত থাকাই ভাল। বাস্তবে অনুভুতি গুলার কোন দাম নেই। সমাজ এসব অনুভুতি কে গলা টিপে হত্যা করে। এর চেয়ে ভাল গল্পটা অসমাপ্তই থাক।
বিদ্র: গল্পে ভুলত্রুটি থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি তে দেখবেন। নতুন লেখক তো ভুল হতেই পারে। ধন্যবাদ সকলকে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত