জোবেদ চৌধুরীর মন আজ বেশ খুশি খুশি। আজ তার একমাত্র ছেলে বাবুর সতেরো তম জন্মদিন। আজ প্রতিজ্ঞা করেছেন তিনি, তার মন আর মাথা রাখবেন সম্পুর্ণ ঠান্ডা আর ফ্রেশ। আজ তিনি কোনো ব্যাপারেই মাথা গরম করবেন না। সারাদিন খুশি খুশি ভাব করবেন। যেমনটা রাজারা করতেন রাজকুমারের জন্মদিনে। তিনি তো রাজাই, আর বাবুও রাজকুমার। জোবেদের এতো সম্পত্তি এতো অর্থ, এসব রাজার চেয়ে কমই বা কিসে। শুধু একটু কৃপণ তিনি। আর এমন কৃপনতা সবাই মাঝে মাঝে করে। ইশ!! আজ নিজেকে নিয়েও বাজে কিছু ভাববেন না তিনি, মেজাজ ও গরম করবেন না।
.
সুন্দর পরিপাটি হয়ে টাকা ভর্তি সুটকেস নিয়ে রহনা হয়েছেন ঢাকার নামকরা কার মার্টের দিকে। জন্মদিনে ছেলেকে আজ বেশ দামি একটা গাড়ি উপহার দিবেন তিনি। নিজে সি এন জি তে চলা ফেরা করেন তাতে কি? তিনি কিপটে বলে ছেলের বিলাসিতা থাকবে না তা কি হয়? সতেরো বছরের ছেলেকে গাড়ি উপহার দেয়া একটু বেশিই বিলাসিতার উদাহরণ হয়তো। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসেনা। ছেলের ইচ্ছে হয়েছে আর বাবারও টাকা আছে তাই কিনবে। তাতে কার বাবার কি?
.
“স্যার দুইডা টাকা দ্যান না”
সি এন জি তে উঠতে যাবেন এমন সময় পিচ্চি কন্ঠের এমন কথা শুনে জোবেদের মাথা গরম হয়ে গেলো। কঠোর ভাষায় বললেন “টাকা পাবি না, যা ভাগ!”
ছেলেটা যায় না। বার বার বলতে থাকে “স্যার দুইডা টাকা দ্যান না”। এক পর্যায়ে ছেলেটা জোবেদের হাত চেপে ধরে। মেজাজ আগুন গরম হওয়ার মতো অবস্থা। জোরে ধাক্কা মেরে বললেন “যা শালার পুত!।” কোর্টের হাতা হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন “ছোটলোক গুলোর জ্বালায় রাস্তায়ও শান্তি পাওয়া যায় না।”
আহা! না না মাথা গরম করা যাবে না আজ। কিন্তু কি আর করার, এগুলোর কারণে কি মাথা ঠিক থাকে? একটা সি এন জিতে উঠে চললেন ছেলের বলে দেয়া নির্দেশনা মতো কার মার্টের দিকে।
.
জোবেদ বাংলাদেশের বিখ্যাত মোবাইল কোম্পানি “এস এন টি” এর চীফ ডিরেক্টর। অর্থ, সম্পত্তি, ক্ষমতা সবই তার আছে। তবে লোকটা সামান্য কৃপণ। কৃপনতা ছাড়াও তার আরো বৈশিষ্ট্য আছে। তার অহংকার আকাশছোঁয়া। মনুষ্যত্বেরও অভাব আছে অনেক। টাকা পয়সা হলেই যে মনুষ্যত্ব লোপ পায়না তা জোবেদই ভুল প্রমান করে দিতে পারবেন। জোবেদ এর দুনিয়াতে সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে তার ছেলে বাবু। বাবুর সব ইচ্ছেই পূরণ করেন তিনি। তাতে যা হয় হোক, যত টাকা লাগে লাগুক। শুধু টাকা দিয়েই যে সব হয় না তা হয়তো জোবেদের অজানা।
.
সি এন জি থেকে নেমে দেখলেন রাস্তার ধারেই বিশাল একটা কার মার্ট। কার মার্টের নামটা অজানা নয়, “নীড ফর স্পীড”। বাবুকে প্রায় দেখা যায় এই নামের গেম খেলতে। আর সেকারণেই হয়তো এখান থেকে গাড়ি কিনতে বলেছে বাবু।
বেশ চড়া দাম দিয়ে বাবুর জন্য কালো রংয়ের ঝাকঁজমকপূর্ণ গাড়ি কিনে মনের সুখে চললেন অফিসের পথে। সন্ধ্যায় বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে। বাবু দেখলে হয়তো খুশিও হবে প্রচন্ড।
.
অফিসে পৌছেই চেয়ারে হেলান দিয়ে পড়লেন। অফিসের পিয়ন রেজাকে বললেন চা দিতে। রেজা চার বছর আগে ছয় হাজার টাকা বেতনে এ অফিসে পিয়নের চাকরি নিয়েছিলো। চাকরিজীবনের বয়স বাড়লেও তার বেতন বাড়েনি মোটেও। যতোবারই বসকে তার বেতন বাড়ানোর ব্যাপারে বলেছে ততবারই নানা অজুহাত বা বকাঝকা শুনতে হয়েছে। আজও একবার বলে দেখবে। তারপরও যদি কিছু না হয় তাহলে সামনের মাসেই চাকরি ছাড়বে সে। এভাবে আর কতদিন।
.
রেজা চা নিয়ে তার বসের রুমে ঢুকে টেবিলে চা রেখে টেবিলের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আর মনে মনে কথাটা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
জোবেদ টেবিল থেকে চা নিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। সামনে দাড়িয়ে থাকা তার পিয়নের দিকে ভ্রুক্ষেপ ও করছে না। যেনো সে দেখতেই পারছে না তার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। রেজা এখনো চুপচাপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ কি আবারো বলবে কথাটা, নাকি থাকবে। এ জন্তু তো এমনি এমনি টাকা ছাড়বে না। বলেই দেখা যাক।
:স্যার, একটা কথা বলার ছিলো।
:হুমমমম! বলে ফেল।
: আমার মাইনেটা যদি বাড়ানো হতো স্যার, তাহলে খুবই উপকার হয়।
:হুম, সে ব্যপারে ভেবেছি। আমার যখন মনে হবে মাইনে বাড়ানো দরকার তখনি বাড়িয়ে দেবো। তোর আর এ নিয়ে ভাবার দরকার নাই।
:কিন্তু স্যার এটা তো আগেও বলেছেন।
জোবেদ খানিকটা রেগে গিয়ে বললেন, “কি বললি? আবার বল।”
: স্যার একথা আপনি আগেও বলেছেন কিন্তু বেতন বাড়াননি। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম তো বাড়ছে। তাই এবার বেতন বাড়ানো উচিত।
: মুখে মুখে কথা বলিস বেয়াদবের বাচ্চা! থাপ্পড় দিয়ে দাত ফেলে দিবো। যা বাইরে যা।
কষ্ট আর হতাশা নিয়েই বেরিয়ে গেলো রেজা। এবার চাকরিটা ছাড়তেই হবে তার।
.
ছেলের জন্মদিনের কথা ভেবে আবারো মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করছেন। তবে মনে মনে রেজাকেও গালাগাল করছেন।
“রেজা বেয়াদবটা একটু বেশিই বেড়েছে। পিয়নের চাকরি করে আবার বেশি বেতন চায়। বেতন বাড়াবো বললাম তারপরেও মুখের উপরে কথা। শালা ছোটলোকের বাচ্চা! ”
এতো গালাগাল করলেও রেজাকে সে ছাড়বে না। বেতন বাড়াই বাড়াই করে আটকে রাখবে। এতো কম বেতনে এমন পিয়ন কোথাও পাওয়া যাবে না।
.
টেবিলে রাখা গাড়ির চাবিটার দিকে চোখ পড়তেই মনটা অন্যদিকে ঘুরে গেলো জোবেদের। “গাড়ির রংটা বাবুর পছন্দ হবে তো? যদি না হয় তাহলে যে জেদী ছেলে এই উপহারই গ্রহন করবে না হয়তো। নাহ নাহ, পছন্দ হবেই। আজকাল কালো রংই বেশি জনপ্রিয়।”
হঠাৎ কোনো পুরুষ গলার আর্তনাদে হকচকিয়ে উঠলেন জোবেদ। টেবিলে থাকা বেলটা প্রেস করে রেজাকে ডাকলেন।
: ইয়েস! স্যার।
: নিচে এতো হট্টগোল কিসের? কান্নার শব্দ মনে হচ্ছে।
: জানিনা স্যার, একবার নিচে গিয়ে দেখে আসি।
: হ্যা, তাড়াতাড়ি জানা।
রেজা একপ্রকার ছুটেই নিচে চলে গেলো। মিনিট দুয়েকের মধ্যে ফিরে আসলো।
:স্যার আসবো?
: হ্যা, কি হয়েছে নিচে?
: স্যার আমাদের শফিউল ভাই কান্নাকাটি করছে। হাতে পায়ে রক্তও দেখলাম।
: কোন শফিউল? বি সেকশনের ক্লার্ক শফিউল আলম?
: জ্বি স্যার, ওই যে ছেলেকে সাথে নিয়ে অফিস করে যে শফিউল ভাই।
: হ্যাঁ, তো কান্নাকাটি করছে কেন?
: জানিনা স্যার, আপনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে? তাকে কি আসতে বলবো?
: নাহ নাহ, এখানে হট্টগোল করার দরকার নেই। অফিসটা তো নষ্ট করছেই। বুঝলি, সব যতো টাকা ঝারার ধান্ধা। যত্তোসব!!!
.
প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে জোবেদ নিচতলায় গেলেন। অফিসের সবাই তার কর্মচারী শফিউলকে ঘিরে আছে। ওর আকাশী কালারের শার্ট অর্ধেকটাই তীব্র রক্তে লাল হয়ে আছে। শফিউল বারবার ম্যানেজারের কাছে আকুতি-মিনতি করে কিছু বলছে। জোবেদকে দেখেই শফিউল তার পায়ের কাছে হাটু গেড়ে হাতদুটো জোর করে বসে পড়লো। জোবেদ পিছনে সরে গিয়েই বললো,
: এই এই কি করছো?
: স্যার আমার ছেলেটাকে বাচাঁন, স্যার আপনার পায়ে পড়ি।
: কি হয়েছে তোমার ছেলের?
শফিউল ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে নিতে বললো,
:স্যার অফিসের সামনে একটা গাড়ি আমার ছেলেটাকে ধাক্কা মেরেছে।
জোবেদ বাহিরে তাকিয়ে দেখলো শফিউলের ছেলেকে বাহিরে শুইয়ে রাখা হয়েছে, দারোয়ান আর কয়েকজন কর্মচারী তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
: তুমি ওকে এখানে রেখেছো কেন? হসপিটালে নিয়ে যাও। টাকা লাগলে ঋন হিসেবে কিছু নিয়ে যাও অফিস থেকে।
পাশ থেকে ম্যানেজার বলে উঠলো,
“স্যার ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি দরকার। এম্বুলেন্স ফোন দেয়া হয়েছে, কিন্তু এম্বুলেন্স আসতে আসতে অনেক দেরী হয়ে যাবে।”
” রাস্তা থেকে কোনো গাড়ি ঠিক করে নাও, সিএনজি বা প্রাইভেট কার। ” বললেন জোবেদ।
: স্যার আমাদের অফিসটা হলো হাইওয়ের পাশে এখানে কিভাবে এসব পাওয়া যাবে? তাই স্যার যা করার এখনি করতে হবে।
.
ভেতরে জোবেদ তীব্র রাগে ফেটে যাচ্ছেন। ” এই শফিউলের জন্য আজ অফিসে কি উটকো ঝামেলাই না সৃষ্টি হয়েছে। মা মরা ছেলে বলেই কি অফিসে নিয়ে আসতে হবে। যত্তসব ঝামেলা।”
একটু সহানুভূতি হওয়ার অভিনয় করার চেষ্টা করে বললেন,” তাহলে অফিসের গাড়িটা নিয়ে যাও।”
” স্যার অফিসের দুটো গাড়িই কাল চট্টগ্রাম পাঠানো হয়েছে, পরশুর আগে আসবে না।” ম্যানেজার বললো। শফিউল তখনো কাদঁছে।
দারোয়ান বলে উঠলো, “স্যার গ্যারেজের কালো গাড়িটা যদি দেয়া যায় তাহলেও তো হয়।”
এবার শফিউল লাফিয়ে উঠলো, “স্যার তাহলে ওই গাড়িটাই দিন, আমার ছেলেটাকে বাচাঁতে হবে স্যার। নাহলে দেরী হতে হতে স্যার আমার ছেলেটা…..” আবার কাদঁতে শুরু করলো শফিউল।
জোবেদ সরাসরি বললো, “নাহ নাহ ওটা দেয়া যাবেনা।”
শফিউল এবার কাকুতি-মিনতি শুরু করলো।
“স্যার আপনার পায়ে পড়ি, আমার ছেলেটাকে বাচাঁন। গাড়িটা দিলে আমার ছেলেকে হাসপাতালে নিতে পারবো।”
ম্যানেজার,দারোয়ান অন্য সবাই তাদের বসকে অনুরোধ করতে লাগলো।
জোবেদ ওদের এমন অনুরোধের বিপরীতে একপ্রকার চেঁচিয়ে বললেন, “ওটা আমার ছেলের জন্মদিনের উপহার ওটা আমি কোনোভাবেই রক্তাক্ত করতে চাইনা। সাফ কথা আমি ওটা দিতে পারবো না। তোমরা অন্য ব্যবস্থা করো।”
“স্যার আপনার ছেলের জন্মদিনের উপহারে রক্তের দাগ লাগলে গাড়িটা নষ্ট হয়ে যাবেনা, কিন্তু আমার ছেলেটা বাচঁবে।” কাদঁতে কাদঁতে বললো শফিউল।
“না না, এ গাড়ি আমি দিতে পারবো না। তোমরা অন্য কোনো ব্যবস্থা করো।” বলেই চলে যেতে লাগলেন জোবেদ। তখনই শফিউল তার রক্ত মাখা হাত দিয়ে পিছন থেকে জোবেদের হাত চেপে ধরে কান্না করতে থাকে, জোবেদের আঠারো হাজার টাকার কোর্ট আর নয় হাজার টাকার শার্টে রক্ত লেগে গেলো। জোবেদ এবার প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে শফিউলের হাতটা ছুড়ে দিয়ে বললেন, “একবার বললাম না তোকে এ গাড়ি দেয়া যাবেনা, টাকা লাগলে নে। নাহলে অন্য ব্যবস্থা কর।” বলেই নিজের চেম্বারে চলে গেলেন। ম্যানেজার সহ বাকি অন্যরা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। কেউই কিছু বললো না, কারন এরা সবাই জানে এই জানোয়ারের মনে কোনো সহানুভূতি নেই।
_
চেয়ারে বসে টিস্যু দিয়ে শার্টে লাগা রক্তের দাগ মোছার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলেন জোবেদ। বাবুর জন্মদিন উপলক্ষে এতো দামের শার্ট আর কোর্ট কেনা হয়েছিলো। আর এগুলোই পুরো নষ্ট করে দিলো ওই শফিউল। কথাগুলো ভেবে মনে মনে ফুঁসছেন জোবেদ।
হঠাৎ জোবেদকে অবাক করে দিয়ে চেম্বারে প্রবেশ করলো বাবু।
: বাবা, গ্যারজের কালো গাড়িটা নিশ্চয় আমার জন্য?
: হ্যা, তোর পছন্দ হয়েছে
: হুম, মোটামুটি হয়েছে।
: আমিতো বলেছিলাম গাড়ি কিনবো, কিন্তু আজ কিনবো তা তো বলিনি। তুই একথা জানলি কিভাবে?
: মা বলেছে আমাকে। যাক অবশেষে তবে গাড়ি কিনলে তুমি?
কিছু না বলে মাথা নেড়ে হাসছেন জোবেদ।
: আচ্ছা বাবা একটা রিকুয়েস্ট করি?
: কি? বল।
: আমি গাড়িটা এখন নিয়ে যাই।
: এখনি? কি বলিস? এটা তোর জন্মদিনের উপহার, তাই সন্ধ্যায় পার্টিতে নিস।
: না না তার কোনো দরকার নেই। আমি এখনি নিয়ে যাবো।
জোবেদ জানেন এ ছেলের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়া যাবে না।তাই বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে, তবে ড্রাইভারকে ফোন করে আসতে বল।”
: তার দরকার নেই, তুমি জানো না আমি ড্রাইভ করতে পারি? গত মাসেই তো শিখলাম।
: তবুও সেফটির ব্যাপার আছে না। তুই দরকার হলে অফিসের ড্রাইভারকে নিয়ে যাস।
: আচ্ছা তা দেখা যাবে।
জোবেদকে কিছু বলার আগেই গাড়ির চাবিটা নিয়ে ছুটলো বাবু।
এই ছেলেটা কার মতো হয়েছে কে জানে। জোবেদের মতো তো মোটেও না। ওর মায়ের মতোই হবে, যে জেদ তার।” কথাগুলো ভেবে মনে মনে হাসছেন জোবেদ।
যাক গাড়ির রংটা নিয়ে কিছু বলেনি তাহলে বাবু। এ ব্যাপারে একটু চিন্তায় ছিলেন জোবেদ। ছেলের খুশিতে বাবার মনও খুশি হয়ে গেলো। মনে আনন্দের কারণে জোবেদের মনে ক্ষনিকের জন্য সহানুভূতি উঁকি দিলো। বেল প্রেস করে তার পিয়ন রেজাকে ডাকলেন।
: ইয়েস স্যার।
: শফিউলের ছেলের কি করলো?
: এম্বুলেন্স পৌঁছলো মাত্র। শফিউল ভাইয়ের ছেলেকে এম্বুলেন্সে ওঠানো হচ্ছে।
: যাক ঝামেলা মিটলো। শোন টাকা-পয়সা কিছু লাগলে দিস ওকে।
: স্যার, টাকা পয়সার চেয়ে গাড়িটা যদি দিতেন তাহলে খুব উপকার হতো। এম্বুলেন্স আসতে অনেক দেরী হয়ে গেছে। বলা যায় না ছেলেটা বাচেঁ কি না।
: এতো বেশি কথা বলিস কেনো? যা বাইরে যা।
রেজার আজকাল বেশিই কথা বেড়েছে। বেতন না বাড়ানোর জন্যই এসব দিক থেকে কথার ঝাল মেটাচ্ছে।
.
কম্পিউটারে অফিসের কাজে মনোযোগ দিলেন জোবেদ। কিছু ঝামেলা আছে এখানে। কয়েক কোটি টাকার হিসেব দিতে হবে সিইও কে। হিসেব দেয়ার জন্য বেশ ভালো বুদ্ধি আছে তার মাথায়। প্রতিটা ইনভেস্টমেন্ট এ টুয়েন্টি পার্সেন্ট বেশি খরচ দেখালেই হিসেব মিলে যায়। জোবেদের এতো অর্থ সব সৎ পথের উপার্জন না। বেশ কিছু কালো টাকাও আছে। হিসেবের প্রত্যেকটা ফাইল সংগ্রহ করে তা এডিট করে টাকার হিসেব মিলাতে লাগলো জোবেদ।
_
দুই ঘন্টা পর, চেয়ারে হেলান দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন জোবেদ। ছোটখাটো বেনামী হিসেব বসিয়ে পুরো হিসাবটাই মিলিয়ে নিয়েছেন তিনি। সিইও স্যারের ক্ষমতাই নেই তা বোঝার।
মনের স্বস্তিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছেন জোবেদ, কিছুটা তন্দ্রাও লেগে গেছে তার চোখে। এমন সময় ফোনের ভাইব্রেশনে তন্দ্রা কাটলো জোবেদের। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো বাবুর কল। এমন সময় কল দেয়ার কারণটা ঠিক বুঝতে পারলেন না জোবেদ। রিসিভ করে বললেন, “হ্যা, বাবু বল।”
ওপাশে কোনো অপরিচিত পুরুষ কন্ঠ একনাগাড়ে বললেন, ” হ্যালো,এখানে একটা ট্রাকের সাথে প্রাইভেট কারের এক্সিডেন্ট হয়েছে। ট্রাকটা পালিয়েছে। প্রাইভেট কারের ভিতরে থাকা লোকটার কাছে এই ফোনটা পাওয়া গেছে। এখানে “বাবা” নাম দিয়ে সেভ করা আপনার নাম্বারটা পাওয়া গেছে।”
জোবেদ হতভম্ব হয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যা এটা আমার ছেলের নাম্বার, কোথায় আছেন তাড়াতাড়ি বলুন ভাই। আমার ছেলে কোথায়?”
: আপনি জলদিই “এস এন টি” এরিয়ার তেরো নাম্বার রোডে চলে আসেন। গাড়ি পাওয়া যায়নি তাই ওনাকে এখনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়নি।
ফোনে লোকটার বলা ঠিকানা টা জোবেদের অফিসের পিছনের রোডেই। হেটে যেতে পাচঁ মিনিট লাগে। জোবেদ ফোনটা ফেলে দিয়েই পাগল প্রায় হয়ে ছুটলেন। যাবার সময় ম্যানেজার খুশি মুখে বললো, “স্যার শফিউলের ছেলে আল্লাহর রহমতে সুস্থ আছে।”
জোবেদের কানে সে কথা পৌছলো না। সে হন্যে হয়ে ছুটছেন। অফিসের সবাই তাদের কর্মকর্তাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
_
জোবেদ পৌছেই দেখলো তার অর্ধ কোটি টাকার গাড়িটা ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। পাশেই বাবুকে শুয়ে রাখা হয়েছে। বাবুর পুরো শরীরে রক্ত, খুব জোড়ে জোড়ে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছে। জোবেদের মনের মধ্যে দিয়ে রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। বাবুর হাত ধরে অস্পষ্ট গলায় বললেন “বাবা কিচ্ছু হবে না তোর, তোর বাবা আছে তোর পাশে।”
বাবু আর জোবেদকে ঘিরে রয়েছে অনেক মানুষ। জোবেদ অসহায় মেষশাবকের মতো তাদের দিকে তাকিয়ে বলছে, কেউ দয়া করে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করুন না, প্লিজ।
“এই হাইওয়ে তো কোথায় গাড়ি পাওয়া যাবে বলুন। আমরা গাড়ি থামানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু লাভ হয়নি।” ভিড়ের সামনে থাকা একজন বলে উঠলো।
:তাহলে এম্বুলেন্স ডাকুন না ভাই।
: ভাই তা করেছি, এম্বুলেন্স জ্যামে আটকে আছে। আসতে দেরী হবে।
জোবেদ চেঁচিয়ে বলছে, “দেরী হলে আমার ছেলেটা মারা যাবে, কেউ একটু সাহায্য করুন। ভাই যতো টাকা লাগবে আমি দিবো। আল্লাহর দোহাই লাগে।”
কেউ এগোলো না। জোবেদ নিরুপায় হয়ে ছেলেকে কাধে তুলে নিয়ে ছুটলেন হাইওয়ে রোডের পাশে। একা একা হাত নাড়িয়ে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছেন। ভিড়ের মধ্যে থেকে দুইজন এসেও হাত নাড়িয়ে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছে। কোনো গাড়িই থামছেনা।
_
জোবেদের আঠারো হাজার টাকার কোর্ট আর নয় হাজার টাকার শার্ট পুরোটাই রক্তে লাল হয়ে একাকার হয়ে গেছে। কোনটা শফিউলের ছেলের রক্ত কোনটা নিজের ছেলের রক্ত তা আলাদা করা যাচ্ছে না, আর কেউ পারবেও না তা আলাদা করতে।
জোবেদ কাদঁছে আর বলছে, ” ও ভাই গাড়ি থামান ভাই। আমার ছেলেটাকে বাচাঁন। আল্লাহর দোহাই লাগে।” ব্যস্ত সড়কের কোনো গাড়ি চালকের কানেই এই আর্তনাদ পৌঁছচ্ছেনা।
.
ঢাকার অন্যতম এক ব্যস্ত সড়কের সকল গাড়িচালক একজন লোককে এড়িয়ে চলছে।
কোর্ট-টাই পরা একজন লোক এক রক্তাক্ত কিশোরের দেহ কাধে নিয়ে হাত নাড়াচ্ছে আর বলছে, ” ও ভাই গাড়ি থামান না ভাই। আল্লাহর দোহাই লাগে। আপনার গাড়িতে সামান্য রক্তই লাগবে কিন্তু আমার ছেলেটা বাচঁবে। আমার ছেলেটাকে বাচাঁন ভাই। ও ভাই আল্লাহর দোহাই লাগে, ভাই। আমার ছেলেটাকে বাচাঁন।”
…………………………………(সমাপ্ত)………………………………..
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প