নীলচরের ভূত

নীলচরের ভূত

বিলের নাম নীলচর।

এলাকার মানুষজনের ভাষায় নীলচর বিল।

জমির মানচিত্রের ভাষায় এর নাম নীলের চর মৌজা।

কিশোর মুন্না এটাকে বলে নীলবিল। মাঝেমাঝে ছন্দ মিলিয়ে বলে, নীলের চর বিল মাছের কিলবিল।

এলাকারলোকজন এই বিলে মাছ ধরতে যায়না। কারন, নীলচরের বিলে রয়েছে ভূতের উৎপাত। কেউ যদি মাছ ধরতে যায় তাহলে নাকি ভূতেরা দূর থেকে ঢিল ছোঁড়ে। কাদা পানি তে জ্যান্ত পুঁতে ফেলে। নাকানি-চুবানি দিয়ে মেরে ফেলে, চড়-থাপ্পর দিয়ে কানা-বোবা করে দেয়।

এ-সবের পরেও কেউ আর মাছ ধরতে যাবে? কেউ না গেলেও মুন্না সেখানে যাবেই। মাছ ধরা মুন্নার অন্যতম শখ, শখ নয় বলা যায় তুমুল নেশা। তাই ভূতে ঢিল ছুঁড়ুক আর জ্যান্ত পুঁতে ফেলুক এ-সবে ভয় পায়না মুন্না। ভয় পায়না মাঘ মাসের কুয়াশামাখা প্রচণ্ড শীতকেও। সবকিছুকে উপেক্ষা করেই নীলচরের বিলে যায় ও প্রতিদিন আর ধরে নিয়ে আসে এত্তো এত্তো মাছ।

মুন্না দিব্যি মাছ ধরে নিয়ে আসে,ভূতেরা তাকে কিছু বলেনা অথচ অন্যরা মাছ ধরতে গেলেই ভূতদের পোয়াবারো।ফাজলামো বেড়ে যায়।এই নিয়ে শোকে তাপে হিংসায় জ্বলে-পুড়ে খাক হচ্ছে এলাকার কেউ  কেউ। বিশেষ করে মুন্নার সমবয়েসী বন্ধুরা তো ভেবেই কূল পায়না।

আজ মিঝিবাড়ির উত্তরে খড়ের গাদায় বসে এই নিয়ে আক্ষেপ করছে তারা।

ফাজিল ভূত মুন্নাকে কিছুই বলছেনা? দলের একজন নয়ন প্রশ্ন করল দিলুকে। কি জানি রে !! আমার মনে হয় ওই ব্যাটা মুন্না নিজেই একটা ভূত, তাই ভূতেরা ওকে কিছু বলেনা, দিলুর সহজ উত্তর।

তুই ঠিকই বলেছিস, ভূত বলেই তো ওর গায়ে একটু শীতও লাগেনা। অবশ্য এ-কথাও সত্য পাজিটার বেজায় সাহস। আমি শুনেছি ভূতেরা সাহসী লোকেদের ভয় পায়। হয়তো এই জন্যেই ভূতেরা ওকে কিছু বলেনা। মুন্নার প্রতি নিজের ধারণা প্রকাশ করল আরেক বন্ধু রাসেল।

আমিও ঐসব ফালতু ভূতটুত কে ভয় পাইনা। দিলু বুক ফুলিয়ে নিজের বীরত্ব প্রকাশ করতে চাইল।

উফ্‌ যা! তুই কতটা বাহাদুর সে পরশু মাছ ধরতে গিয়েই টের পেয়েছি। জাল-ডুলা রেখে যেভাবে দৌড় দিলি ভাবলে এখনো আমার হাসি পায়। হাটে হাড়ি ভাঙ্গলো বিন্দু।

তুই কি বুঝবি? বিলের মাঝে গেলেই না বুঝতে পারতিস !

মাত্র আমি জালের খ্যাপ দিয়েছি, তখনি কোত্থেকে যে এক্টার পর একটা ঢিল পড়তে শুরু করল, আল্লাহ মালুম। আত্মপক্ষ সমর্থন করে দিলু যুক্তি তুলে ধরল।

তাই-তো জাল-ডুলা রেখে তুই দৌড় দিয়েছিস। এরপরেও বলছিস ভূতকে তুই ভয় পাসনে। তুই কিন্তু সেমসাইড টক করছিস। নয়ন দিলুকে বলল।

এই একটু আধটু ভয় পেতেই পারি। যাক্‌, কথা সেটা না, ‌মুন্না কেন ভয় পায়না বা মুন্নাকে ভূতেরা কেন কিছু বলেনা, বিষয় সেটা। অন্য প্যাঁচাল বাদ দে।

দিলুর কথায় সায় দিয়ে নয়ন বলল, একটা কাজ করলে কেমন হয়?

কি কাজ আগে তো বল, রাসেল জানতে উদ্গ্রীব হল।

মুন্না যখন মাছ ধরতে নীলের চর বিলে যাবে সেসময় আমরাও যাবো।

কিন্তু মুন্না কি আমাদের বলে যাবে ! ও তো চুপচাপ একা একা মাছ ধরতে যায়। ও তো না তোয়াক্কা করে ভূতকে না শীতকে, বিন্দু বলল।

কষ্ট হলেও আমাদের উচিত হবে ওকে দু-একদিন খেয়ালে রাখা, দিলু বলল।

হ্যাঁ, তুই ঠিকই বলেছিস, তাহলে এই কথাই রইল। এখন থেকে ওর সাথেই মাছ ধরতে যাবো, বিন্দু বলল।

দিলুর কথায় সবাই সায় দিল।

 

সেই থেকে জাল-ডুলা নিয়ে দিলুরা আড়ে আড়ে থাকে কখন মুন্না মাছ ধরতে যায়।নীলের চর যাবার প্রধান রাস্তার কিনারে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে।কিন্তু ঘাপটি মেরে থেকেও মুন্নার নীলের চরে মাছ ধরতে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু বুঝতে পারেনা।শুধু দেখে সকাল-বিকাল মুন্না ডুলা ভরে মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরছে।শুধু শুধু তারা অপেক্ষায় থেকেছে ডুলা আর জাল নিয়ে।

আসলে দিলুদের গোয়েন্দাগিরি কি করে যেন টের পেয়ে গেছে মুন্না। তাই সে মাছ ধরতে যায় খুব সতর্কভাবে। নীলের চর বিলে যাওয়ার রাস্তা বাড়ির পূবদিকে হলেও, মুন্না ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পশ্চিমদিকের পুকুড়পার ধরে সন্তর্পণে চলে যায়। এতে ওর একটু বেশী হাঁটতে হয়, তাতে ওর আপত্তি নেই।

কেননা ওর সাথে মাছ ধরতে গিয়ে দিলুদের একবার যদি ভূতের ভয় কেটে যায়, তাহলে নীলচর বিলের  মাছ ধরার একক কর্তৃত্ব ও কৃতিত্ব কোনটাই থাকবেনা। ভয় কেটে গেলে একে একে মাছ মারতে ছুটবে সবাই। এটা হতে দেওয়া যাবেনা, কোনোভাবেই না। সে চায় দিলুদের মতন এলাকার সবার মনে ভূতের ভয়টা জিইয়ে থাকুক। কিন্তু কিভাবে এই ভয়টাকে জিইয়ে রাখা যায়?

পুরোনো একটা প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করতে হবে, দিলুরা যখন মাছ ধরতে যাবে তখনি পুরোনো চালটা  খাটাতে হবে।

মুন্নাকে তারা বাড়ির কাছে কোনোভাবেই আটকাতে পারলনা, তাই এবার সিদ্ধান্ত নিল নীলের চরের কাছাকাছি কোথাও তারা লুকিয়ে থাকবে।

এবার দেখব ও কিভাবে আমাদের ফাঁকি দেয়, নয়ন বলল।

ঘাপটি মারবি কোথায়? দিলু জানতে চাইল।

গোরস্থানের কাছে, গোরস্থানের রাস্তা বাদ দিয়ে তো আর যেতে পারবেনা। ওখানেই ওকে আটকাবো। যাতে ওর পেছনে পেছনে আমরাও মাছ ধরতে যেতে পারি। ওর সাথে গেলে ভূতেরা আমাদের কিছু বলবেনা।

গুড আইডিয়া, তুই ঠিকই বলেছিস, ওখানেই ঘাপটি মারতে হবে।রাসেল তুই আবার ভয় পাসনে। ভূত আমাদের সবাইকে একসাথে এটাক করতে সাহস পাবেনা। দিলু রাসেলকে অভয় দিল।

ভয় পেলেও ঐ ব্যাটার সাথেই যেতে হবে,মাছ না খেতে খেতে আমি নিজেই নিরামিষ হয়ে গেছি। যে কোরেই হোক, মাছ ধরতেই হবে।

এইতো বীরের মতন কথা। একেই বলে বাপের ব্যাটা সাদ্দাম, দেখব এবার তোর উদ্দাম।

দেখিস দেখিস।

 

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠল মুন্না। আজ একটু আগে আগে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আসলে ওকে কখনো ঘুম থেকে জাগাতে হয়না, মাছের নেশায় প্রতিদিন ওর এমনি এমনিই ঘুম ভেঙ্গে যায়। আজ ও তেমনি ঘুম ভেঙ্গে গেল। শরীর থেকে কাঁথা সরিয়ে উঠে বসল।চোখ মুছতে মুছতে জাল-ডুলা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।

ঘরের পেছন দিক দিয়ে পশ্চিমের রাস্তায় পা বাড়ালো মুন্না। পূবের রাস্তায় গেলে যদি বজ্জাতগুলো দেখে ফেলে !

সতর্ক দৃষ্টি ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে।

বাড়ি থেকে নীলের চর বিল প্রায় এক কিলোমিটার পথ।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে নীলের চরের কাছাকাছি পৌঁছে গেল। সামনের কবরস্থানটা পার হলেই বিল। কিন্তু কবরস্থানের দিকে তাকিয়েই হঠাত থেমে গেল মুন্না। কবরস্থানের কাছেই মানুষজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে যেন কারা হতে পারে? বজ্জাতগুলো নয়তো আবার! আবছা অন্ধকারে পুরোপুরি ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছেনা।

মুন্না একটা গাছের আড়ালে দাঁড়ালো এবং তার গতিপথ ঘুরিয়ে দিল। কুয়াশাভেজা সর্ষেক্ষেতের  মাঝামাঝি দিয়ে কবরস্থানের পেছনের দিকে পা বাড়ালো। কুয়াশায় ভিজে পা হিম হয়ে গেলেও সেদিকে খেয়াল নেই। তার লক্ষ্য মানুষগুলোকে চেনা।

চুপিসারে কবরস্থানের পেছনদিকে গিয়ে দাঁড়াল। এখান থেকে দিলুদের কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

আজ আর আমাদের ফাঁকি দিতে পারবেনা, দিলু বলল।

ও এখনো আসছেনা কেন? ঠাণ্ডায় আমার পা বরফ হয়ে যাচ্ছে। তোদের জন্যে সারারাত আজ ঘুমোতে পারিনি, এতো আগে আসার কি দরকার ছিল? আরেকটু পরে এলেই তো হত, নয়ন বলল।

বোকার মতন কথা বলিসনা, এমনিতেই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। তুই একাই কি কষ্ট করছিস? আমাদের ও তো একই অবস্থা। একদিন কষ্ট করে ওর সাথে মাছ ধরতে পারলেই আর কোন ঝামেলা নেই। ভূতেরা তখন আমাদের ও ভয় পাবে। বিন্দু বলল।

এতদিন ভয় পেলনা, অথছ আজ থেকে কেন ভয় পাবে? রাসেল জানতে চাইল।

ভূতেরা মনে করবে আমরা মুন্নার বন্ধু, মুন্নার মতন আমাদের ও সাহস আছে। তাইতো ওর সাথে মাছ ধরতে এসেছি, বিন্দু বিজ্ঞের মতন বলল।

কিন্তু ভূতেরা যদি এখনি চলে আসে, দিলু এদিক-ওদিক তাকিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করল।

আরে না-না, ভূতেরা কবরস্থানের কাছে আসেনা, কবরস্থানকে ভয় পায়। বিন্দু সাহস দিল বন্ধুদের।

তাতে কেউ সাহসী হতে পারল কিনা বোঝার আগেই কাদামাটির একটা ঢিল রাসেলের শরীরে এসে আছড়ে পড়ল।

এই কে কে??? ভয়েতে দিলুকে জড়িয়ে ধরল রাসেল।

এরপর কবরস্থানের পেছন দিক থেকে একের পর এক ঢিল ছুটে আসতে শুরু করল ওদের দিকে। সেই সাথে ভয়ঙ্কর শব্দ।

তোঁদেঁর খুঁব সাঁহঁস নাঁ ?……আমাঁরঁ এঁলাঁকায় এঁসেঁছিঁস……এঁক্ষুঁণিঁ সঁরেঁ পঁরঁ বঁলঁছিঁ……নয়ঁতঁ তোঁদেঁরঁ সঁবঁকঁটাঁরঁ ঘাঁড়ঁ মঁটঁকাঁবোঁ…………

ভূতমামা তোর পায়ে পড়ি আমাদের মারিসনা, আমরা এক্ষুনি বাড়ি চলে যাচ্ছি, বিন্দু বলল।

ঠিঁকঁ আঁছেঁ এঁকঁ দৌঁড়েঁ যেঁ যাঁরঁ বাঁড়িঁ চঁলেঁ যাঁ।

হ্যাঁ যাচ্ছি।

বিন্দুরা ভয় পেয়ে গেল, কোন কথা না বলে যে যার বাড়ির দিকে দৌড় দিল।

মুন্নার পথ পরিষ্কার হয়ে গেল। সে জাল-ডুলা নিয়ে বিলের দিকে এগিয়ে গেল। যেতে যেতে মনে মনে বলল, যাক, এবার ও বজ্জাতগুলোকে ভূততাড়া করা গেছে। মনে হয় তার সাথে পাল্লা দিয়ে আর কেউ মাছ ধরতে আসবেনা এই নীলচরের বিলে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত