অমাবশ্যার রাত। বাতাসের ছিটেফোঁটাও নেই কোথাও, কেমন যেন থমথমে এক পরিবেশ , বেশ কিছুদিন ধরেই লোডশেডিং এর অত্যাচার টা বেড়েই গেছে।
বাসার গা ঘেঁষেই বিশাল বড় এক গাব গাছ, লোকে এই গাছ নিয়ে নানা রকম কথা বললেও আমি এগুলোতে তেমন একটা বিশ্বাসী না।
পদার্থ বিজ্ঞানে চট্রগ্রাম বিশবিদ্যালয় থেকে অনার্স সবেমাত্র শেষ করেছি।
বাড়িটা পুরান, দাদার ও দাদার আমল থেকে চলে আসছে তবে চুন আর রঙ্গের তুলিতে ইট কাঠ পুরাতন হলেও দেখতে নতুনের মতোই মনে হয়।
বাড়ির চার পাশ ঘেষে উচুঁ উচুঁ নারিকেল আর সুপারি গাছ।
আমি, বাবা আর মা কে নিয়েই আমাদের সংসার। ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনে সেখানেই থাকা হয় সবার আর অনার্সের ৫ বছর চিটাগাং কাটিয়ে আমিও মানুষিক ভাবে ঢাকা থাকার জন্য প্রস্তুত।
তবে গ্রামের আর মানুষের মায়া মা, বাবা ছাড়তে পারেনা বলেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছুটে আসে মাটির টানে।
আমার খুব একটা আসা হয়না এখানে, তবে মা, বাবার মুখে বাড়ির গল্প শুনতে শুনতে এবার আমিও চলে এলাম মাটির গন্ধে।
আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে আগামী মাসের শুক্রবার, ছেলে ঢাকা মেডিকেল এর ডাক্তার, দেখতে শুনতে নাকি অনেক ভাল, বাবা, মায়ের পছন্দের ছেলে, বাবা ও বলল বিয়ের পর কখনো আসা হয় কিনা, এসব ভেবে গ্রামে আসার কথা ফাইনাল করলাম।
ভালোই চলছিলো সবকিছু এবং চলছে
ভোরে ঘুম থেকে উঠিনা কয়েকবছর কিন্তু এখানে এসে পাখির ডাকে ঘুম ভাংগে সত্যিকারে বলতে গেলে সপ্তাহ টা রুপকথার মতোই যাচ্ছিল।
নদীতে গোসল করা, বাসার সামনের পুকুর থেকে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা, গাছ থেকে বড়ই পেরে খাওয়া! কি বলব – মুখের ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।
ভোরের সূর্য যখন উদিত হয় কেমন যেন এক অপরুপ রুপে সাজে আকাশটা, আমার সমবয়সী মেয়েরা যখন কলসী ভরে পানি নিয়ে যায়, উলংগ শিশুরা যখন নৌকা থেকে লাফিয়ে পরে সাতার কাটে, আর গাছে যখন শিউলী ফুল ফোটে তখন শরীরে কেমন যেন এক ধাক্কা খেলে যায়।
ভিজা কাক যখন কাপড় নাড়ার তারে এসে বসে আড়চোখে তাকিয়ে থাকে তখন কাককেউ এতটা খারাপ দেখায় না।
তখন রুমে ঝিঝি পোকাদের সাথে খেলার সময় ঘার্মাক্ত দেহে, এলোমেলো চুলে বাবা রুমে এসে অন্যকোন কথা না বাড়িয়ে বললেন – কাল তোর বিয়ে!
– পরের মাসে হওয়ার কথা ছিল না বাবা?
– ছিল কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে
– মানে? তুমি বস, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
– সবকিছু আগের মতো নেই। তো কেমন দেখাবে?
আমি স্পর্ষ্ট খেয়াল করলাম বাতি গুলো কেমন নিভছে জলছে
কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না, স্বপ্ন দেখছি না তো?
– শুন মা, কাল বিয়ের লগ্ন দুইটা। ১ টা ৭ টায় আরেকটা ১ টায়। ছেলের বাসা এখান থেকে অনেক দূর, যদি আসতে লেইট হয়ে যায় তাহলে পরের লগ্নে বিয়ে হবে বলে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে চলে গেল
অনেক্ষণ দরজা ধাক্কালাম কারোরই কোন সাড়া শব্দ নেই। কিছুক্ষণ পর পর একটা পেচা ডেকে চলছে সেই গাব গাছ থেকে।
আমি শুরুতেই বলেছিলাম আমি এগুলোতে বিশ্বাসী না, কিন্তু বাবা হঠাৎ এমন আচরণ করল কেন, আর হঠাৎ করেই বিয়ে আর এমনই বা দেখাচ্ছিল কেন?
পরের দিন সকালে মা দরজা খুলল, কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল রেডি হো
– কোন সমস্যা হয়েছে মা?
– জানি না
– তাহলে হঠাৎ এমন করছ কেন?
– তাও জানি না, সব তোর বাবা জানে
আর তোর বাবা আমাকে বলে রাতে যে বের হলো এখনো ফেরে নি – বলেই বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে চলে গেল
দুপুর ১ টায় পাশের বাসার ২ বউদি সাজানোর
জিনিস নিয়ে আমাকে সাজাতে এসেছে।
জিজ্ঞেস করলাম হয়েছে টা কি
বলল জানি না – কাল তোমার বাবা এসে বলে গেল আজ তোমার বিয়ে।
আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
হঠাৎ রুমে তাকিয়ে দেখি বাবার গলা টেবিলে আর শরীর বিছানায় – চোখ কচলিয়ে দেখি কেউ নেই, উপরে তাকিয়ে দেখি বউদির মাথা ঝুলে আছে আর ফ্লোরে দেহ টা কাতরাচ্ছে। ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে দেখি কেউ নেই
আমার সাথে কি ঘটছে এসব কিছুই বুঝতে পারছি না, আমার কি হ্যালোসিয়েশন হচ্ছে? নানা রকম গল্প উপন্যাস পড়ার কারনে?
কিন্তু না – আমি তো বউয়ের মত সেজে আছি, মাথায় ঘোমটা, নাকে নোলক, কানে ঝুমকো, চিমটি দিয়ে দেখলাম সব ঠিক আছে।
হঠাৎ দরজা খুলে বাবা আমাকে টেনে, ফ্লোর দিয়ে আঁচড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিয়ের মন্ডপে দেখি সবাই – আমার ইউনিভার্সিটির বান্ধবীরা, বন্ধুরা, সব আত্মীয় – স্বজন, পুরোহিত এবং বিশাল বড় বিয়ের আয়োজন, কোনটার ই কমতি নেই। আমি কেবল অবাক থেকে অবাকতর হচ্ছি।
চাদেঁর কোন আলো দেখতে পাচ্ছি না, মনে হচ্ছিল আকাশে সাদা কাপড় পড়া এক বুড়ি, এক পিঁড়িতে বসে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। বাতাসের ছিটেফোঁটাও নেই তাও কেমন যেন গাব গাছটা দুলছে আর দুলছে
বিয়েতে সাজানো প্রত্যেকটি বাতি কেমন জ্বলছে আর নিভছে – কেউ কি কিছুই বুঝছে না? আমি কি স্বপ্নে বিভোর? না তো! এইযে তন্নি আমার সাথে কথা বলব, পিউ আমার দিকে এগুচ্ছে
হঠাৎ বাবা এসে বলল – তোর মার সাথে বাসায় যা, ছেলের আসতে লেইট হবে, জ্যামে আটকে আছে।
বাবার কথাটা বাবার কন্ঠের মনে হলো না, এক শক্তিশালী বৃদ্ধের কন্ঠ মনে হল।
মা আমাকে নিয়ে আমার রুমে আসলো, মাকে কেমন যেন অসহায় অসহায় মনে হচ্ছিলো, এক রাত্রে কি এমন হলো আমি তখনো বুঝতে পারছিলাম না।
রাত ২ টা, লগ্নের সময় ছিল ১ টা
মা আর আমি বিছানার দু প্রান্তে বসে ছিলাম হঠাৎ বাতি গুলো লাফাচ্ছিলো
বাবা রুমে ঢুকেই
শেষ সব শেষ। অনেক দিন পর তৃপ্তি মিটিয়ে
হাহাহাহাহা বলেই অজ্ঞান হয়ে পরে গেল। বন্ধ জানালা টা হঠাৎ করেই খুলে গেল। গাব গাছে পেচাটা ডাকতে শুরু করল। কাক গুলো রাতের অন্ধকারে কা কা শব্দ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
জানালার ফাক দিয়ে চাদটা সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছে, রাতটা বাবাকে সেবা করতে করতেই পার হয়ে যায়, ভীষণ জ্বর ছিল গায়ে, কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি নিজেও জানি না।
ভোরে চোখ খোলার আগে ভাবি, এটা যেন দুঃসপ্নই থেকে যায় কিন্তু চোখ খুলে দেখি গায়ে বিয়ের শাড়ি, মা বাবার মাথায় পানি ঢালছে
অবাক চোখে মার দিকে তাকাতেই বলল – ছেলেটা কাল গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেছে!!