ঘটনাটা প্রায় চার কি পাঁচ বছর আগের। রাত বারোটার দিকে বন্ধুরা সব এক জায়গায় জরো হয়েছি। সন্ধ্যার দিকে প্লান হয়েছে মুরগি চুরি করে পিকনিক করা হবে। তাও আবার আমার ছোট মামার বাড়ির মুরগী। সে বাড়িতে নাকি মুরগির উৎপাত দিন দিন বেড়েই চলেছে। কমাতে হবে। মামা বেশ কয়েকবছর যাবৎ প্রবাসী। বাড়িতে শুধু মামি আর মামাতো ভাই থাকে। মামাতো ভাইয়ের বয়স এই, সাত বা আট বছর হবে। তাছাড়া দ্বিতীয় কোন পরিবার সে বাড়িতে সরিক নেই। কিছুদিন আগে অবশ্য মামির বাবা বাড়িতে এসে উঠেছে। ঝামেলাটা এখানেই…
.
বাড়ির সামানে বড় সুপারি বাগান। মাঝে মাঝে কিছু কাঁঠাল গাছও রয়েছে। এ কাঁঠালের বেশি ভাগই আমাদের পেটে যায়। ডান পাশে গ্রামের একমাত্র সরু চিপা রাস্তা। এ রাস্তা দিয়ে গ্রামের যাবতীয় ছোট ভ্যান, রিকশা, অটোরিকশা চলাচল করে। বাড়ির পিছনে যতদূর চোঁখ যায় মসুরের ক্ষেত। মসুরের ক্ষেত বললে অবশ্য একটু ভুল হবে , সব ধরনের ফসলি এখানে চাষ হয় তবে শীতের সময় বলে মসুরি বুনা হয়েছে। আমাদের টার্গেটও এই ক্ষেত ঘিরেই। অবস্থা খারাপ দেখলেই এই ক্ষেতে নেমে নাক বরাবর দৌড় দিবো। এতে ধরা খাওয়া চাঞ্জ ১০০ তে ০.০৯%। এতবড় ক্ষেতে কাউকে পাকড়াও করা চারটে খানেক কথা না।
.
ঘরের সামনেই বড় মুরগির খোপ। যদিও কিছুটা দূরে। তার বাম পাশেই বড় পুকুর। শরীফুল বললো- দোস্তো তুই, আমি, আক্তার আর তুহিন বাড়ির ভিতরে যাবো। আর বাকি সবাইকে বললো- তোরা সবাই রাস্তার এদিকটা খেয়াল রাখবি। কাউকে বাড়ির দিকে ঢুকতে দেখা মাত্র মিসকল দিবি। আমরা নিরাপদ জায়গায় অবস্থান নিবো।
.
যেই কথা সেই কাজ। সবাই মাথা নেড়ে যে যার অবস্থানে চলে গেলো। আমরা চারজন ঢুকলাম
বাড়ির ভিতরে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুই দেখা যায়না। কারেন্টটা সেই সন্ধ্যায় গেছে। এখনো আসেনি। তুহিন’কে বললাম- তুই গিয়ে দরজার শিলক বেধ দিয়ে আয়। যাতে মুরগি শব্দ করলেও কেউ সহজে বের হতে না পার। আর আক্তার’কে বললাম- তুই বাড়ির আশপাশটা খেয়াল রাখিস….
.
ওরা ঠিক আছে বলে চলে গেলো। আমি আর শরিফুল চুপিচুপি এগিয়ে গেলাম খোপের দিকে। খোপের কাছে যেতেই “ধপ” করে একটা শব্দ হলো। কেউ পা পিছলে পরে গেলে যেমনটা হয় তেমন শব্দ। ভাবলাম আক্তার মনে হয় পরে গেছে। মুখ টিপে দিলাম ঝাড়ি- ঐ হ্লা তোর বাপের বাড়ি পাইছোই? ধরা খাইলে বুঝবি। আস্তে হাট ফহিন্নি…
.
শরীফুল হালকা ভিজা গামছা মোড়ার মত বানিয়ে খোপে হাত ঢুকালো। ভিজা নরম গামছায় মুরগি আরাম পেয়ে টুপ করে বসে পরে। টেনে বের করলেও শব্দ করেনা। এটা শরীফুল থেকেই শিখা। ওহ আবার এতে ওস্তাদ। শরীফুল মুরগি একটা বের করে আমার হাতে দিলো। আমি মুরগির মুখ টিপে ধরে ঘুরে গিয়ে খোপের ওপাশটায় পুকুর পারের দিকে গেলাম কোন একটা আঁলো দেখে। গিয়ে দেখি আক্তার পুকুরের দিকে মুখ করে ঘাপটি মেরে বসে আছে। মাথা গরম হয়ে গেলো। ওরে পাঠালাম এপাশটায় পাহারা দিতে, আর ও কিনা এখানে বসে ঝিমাচ্ছে? এটা কোন কথা? ফিসফিস করে দিলাম ঝাড়ি- ঐ সালা তোরে এখানে বসে থাকতে পাঠাইছি? ধর সালা মুরগি ধর।
আমি আরো নিয়া আসতাছি…
.
আক্তার একটু নড়েচড়ে বসে কাশি দিলো। মাথা এবার পুরাই গরম হয়ে গেলো। সালা মুরগিও ধরছেনা। রাগের মাথায় দিলাম এক উষ্ঠা- দূর সালা তোরে আইনাই ভুল করছি, সর হালা মাতারি…
.
হালায় সাথে সাথে হুরমুরিয়ে গড়িয়ে পরলো পুকুরের দিকে। শুরু করলো চিৎকার- ওরে ধর ধর ধর চোর চোর চোর….
.
লও ঠেলা। এতো আক্তার না। আক্তারের গলা তো এত ভারী না। পরে বুঝলাম, আয় হায় এতো মামার শ্বশুর। বেচারা প্রস্রাব করতেছিলো। অমনি মুরগি ঠুরগি ফেলে দিলাম ঝেড়ে দৌড়- ওরে শরীফুল পালা পালা।
.
শরীফুলও সাথে সাথে দে দৌড়। মসুরি ক্ষেতের ভিতর দুজন দিয়ে ছিড়েমিড়ে দৌড়াতে শুরু করলাম। দৌড়াচ্ছি তো দৌড়াচ্ছিই। আক্তার তুহিন কোন দিকে দৌড়াচ্ছে হুদিশ নেই। কেউ একজন টচ লাইট নিয়ে আমাদের পিছনে লেগেছে। এ সালা আর পিছু ছাড়েনা। যতই ঘুড়ান্টি দেই কাজ হয় না। সুপার গ্লুর মত পিছে লেগেছে। ছাড়েনা তো, ছাড়েই না। আমরা যেদিকে যাই,
ঐটাও সেদিকেই আসে- লাইট জ্বালায় আর নিভাঁয়। কাটাকুটায় হাত পা ছিলে নাজেহাল অবস্থা। তবুও জীবনের মায়ায় দৌড়াচ্ছি। ধরা খেলে মানসম্মান লাটে উঠে যাবে…
.
এদিকে বেচারা শরীফুল লুঙ্গি নিয়ে পরেছে মহা যন্ত্রণায়। লুঙ্গি কোচা খুলে গেছে। একটু দৌড়াতে, না দৌড়াতেই ধাপ ধাপ করে পরছে তো আবার উঠে লুঙ্গি ধরে দৌড়াচ্ছে। আবার পরছে, আবার উঠছে। এ এক করুণ দূর অবস্থা। এক সময় লুঙ্গির সাথে পেরে না উঠে, বেচারা নতুন লুঙ্গি ফেলেই দে দৌড়। যেখানে জীবনের মায়া বলে কথা, সেখানে লুঙ্গিটা অবশ্য কোন ব্যাপার না। কপাল ভালো নিচে সর্ট প্যান্ট পরা ছিলো। নয়তো নিচের দোকানসহ কালাচাঁন মিয়া উকি মেরে বেড়িয়ে পরে বলতো- এরে আস্তে দৌড়া, ব্যথা পাইতো…
.
ওর অবস্থা দেখে না পারছি হাঁসতে, না পারছি কাঁদতে। এরকম পরিস্থিতে আর যাইহোক, হাঁসা যায় না। আগে বাঁচতে হবে। লোকটা এখনো পিছু ছাড়েনি। সালা আস্ত খবিশ একটা। এভাবে কুকুরের মত ঘ্রাণ শুকে পিছনে লাগার কোন মানে হয়? আমার জন্য না হোক, বেচারা শরীফুলের লুঙ্গির নাজেহাল অবস্থা দেখে অন্তত ছাড়া উচিৎ। কিন্তু না। সালা প্রতিজ্ঞা করেই ক্ষেতে নেমেছে- আজ আর ছাড়াছাড়ি নাই….
.
গলা শুকিয়ে তৃষ্ণার্ত কুকুরের মত জিহ্বা বেড়িয়ে লপ লপ করছে। পানি খাওয়া দরকার। কিন্তু পানি কই পাবো এখন? দৌড়ানো অবস্থায় শরীফুলকে বললাম- ঐ হালা অনেক হইছে। এইবার উল্টা কিছু করা লাগবে। সালা তো পিছন ছাড়ে না….
.
– কি করবি?
– আমরা দুইজন। আর ঐ হ্লা একলা। আয় দুইজনে ধইরা বানাই সালারে। আর দৌড়াইতে পারতেছিনা।
.
বলতে না বলতেই শরীফুল “ধপ” করে দাড়িয়ে পরলো। ও আবার মারামারিতে বেশ পটু। হাতে লাঠি একটা দিলে চার পাঁচটারে একাই শুয়িয়ে ফেলতে যথেষ্ট। ও বললো- এইডা তো আগে মাথায় আসেনাই। ধর সালারে আগে। ওর লাইগা আমার নতুন লুঙ্গি গেছে। আমি বললাম- তাইলে ধর। আমি ধরবো আর তুই ইচ্ছামত সালারে বানাবি। অনেক ভুগাইছে মাতারি। ও বললো- ধর তাইলে।
.
আমি আর শরীফুল টুপ করে মসুরের ভিতর মাথা ঢুবিয়ে বসে পরলাম। ঐ বেটা আসামাত্র হামলা হবে। কিছুক্ষণ পর পরই সোনার চানের দেখা মিললো। দেখি লাইট জ্বালিয়ে এদিক সেদিক খুজছে। কাছে আসতেই পিছন থেকে দিলাম সালারে লাত্থি। অমনি বেচারা ওরে মা,ওরে বাবারে বলে চিতকাইত হয়ে পরলো। আমিও গিয়ে ধরলাম সালারে চেপে- সালা এতক্ষণ অনেক ভুগাইছোস। এদিকে শরীফুল একের পর এক লাত্থি গুতা উস্টা দিয়েই চলছে- আইজ তরে মাইরাই ফালামু। তোর লাইগ আমার লুঙ্গি গেছে….
.
ঐ বেটা নিচ থেকে উম উম করে চিল্লাচ্ছে। আমি মুখ ঠেসে ধরে দিলাম ঝাড়ি- চুপ হারামি একদম চিল্লাবি না। এতক্ষণ পিছনে লাগার সময় মনে ছিলোনা ফহিন্নি?
.
এমন সময় ঐ বেটা হাতে দিলো কামড় বসিয়ে। আমিও ওরে বাবারে বলে দিলাম কনুই দিয়ে এক গুতা। অমনি ছেড়ে দিয়ে উম উম করে বললো- ওরে আমি আক্তার, আমি আক্তার। ছাড় আমায়, ছাইড়া দে….
.
কথাটা শুনা মাত্র শরীফুল আরো দুইটা উষ্ঠা মেরে দিলো। আমি ওরে ছেড়ে দিয়ে উঠে দেখি সত্যিই আক্তার। শরীফুল তো রাগে আগুন। বললো- সালা তোরে মাইরাই ফালামু। তুই লাইট পাইছোস কোথায়?
.
বেচারা আক্তার আধ মরা হয়ে গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বললো- লাইট তো আমার কোমড়ে ছিলো।
.
– তোর কাছে লাইট ছিলো তুই কইছোস সালা?
– এইডা আবার কওয়ার কি আছে?
– কওয়ার কিছু নাই? নাই কিছু?
.
এবার শরীফুলের আগে আমি একটা মেরে দিয়ে বললাম- সালা তুই লাইট নিয়া আমাগো পিছন পিছন দৌড়াইছোস, আর আমরা মনে করছি ঐ বাড়ির মানুষ পিছু নিছে। তাই ছিড়া ফাইরা দৌড়াইছি। দেখতো হাত পায়ে কাইটা কি হইছে। এমনকি শরীফুল বেচারার লুঙ্গিটাও তোর লাইগা হারাইছে….
.
ঠিক সেই মুহূর্তেই তুহিনের ফোন – দোস্তো তোরা কই?
.
– আমরা বড় মাঠের পাশের ক্ষেতে ভিতর আক্তাররে বানাই। তুই কই?
– আমি তো মাঠের কাছাকাছি। তয় আক্তাররে বানাস ক্যান?
– বিরাট ক্যাচাল লাগাইছে সালা। আয় মাঠে আয়। আমরা আইতাছি।
.
ফোন কেটে দিয়ে আক্তারকে ধরে নিয়ে মাঠে গেলাম। মাঠে গিয়ে বেচারার ঐ অভিশপ্ত লাইট শরীরে মেরে দেখি, ইস কপালে, মাথায়,গিরায় আলু আলু হয়ে গেছে। ওর অবস্থা দেখে না হেসে আর উপায় পেলাম না। বললাম- কিরে কেমন লাগলো? ভালো তো? আর কডা দিবো? খাবি?
আক্তার বললো- যাহ সালা এমনে কাউরে মারে? বাপরে, দেখতো কি করছোস? বেচারা লুঙ্গি কাতর শরীফুল বললো- কিছুই করিনাই। দোষ অনুযায়ী মাইর মিলা কম খাইছোস। কপাল ভালো আগে ভাগে নাম কইছোস। নইলে তোরে হাড্ডি সব গুড়া কইরা ফালাইতাম। সালা তোর লাইগা আমি আমার লুঙ্গি পর্যন্ত হারাইছি……