(উৎসর্গঃ যাদের জন্য বাংলাদেশ আজ স্বাধীন)
মায়া, তোমাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম একাত্তুরের কোন একটা ভরদুপুরে। তুমি হয়তো মনে করতে পারছ না। পুকুরঘাট থেকে মাত্র গোসল করে ফিরছিলে তুমি।
চুল মুছতে মুছতে তুমি যখন আসছিলে, তখন মনে হচ্ছিল যেন সদ্য পাপড়ি ছড়িয়ে একটা পদ্য ফুল ফুটতে শুরু করেছে। বিশ্বাস করো, ৮ মাইল হেটে আসার ক্লান্তি
আমার এক নিমিষেই দূর হয়ে গিয়েছিল। আমার গোঁফ দেখে তুমি তোমার বোন ছায়াকে বলছিলে, আমাকে নাকি খান-সেনাদের মত লাগে। রাগে আমার পিত্তি জ্বলে
যাচ্ছিল। কিন্তু একটি প্রস্ফুটিত পদ্যের মায়ামেশানো ভুবনভোলানো সরল হাসি আমার রাগটা পানি করে দিল। তোমার মায়াময়ী মুখটা আমি কিছুতেই ভুলতে
পারছিলাম না। সেদিনই মনে হয়েছিল তোমাকে আমার চাই-ই চাই। সেকথাটা মাকে বলেছিলাম লজ্জার মাথা খেয়ে। দেশে তখন সবে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। মায়ের চাপে
বাবা বাধ্য হয়ে তোমাদের বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। তুমি দাড়িয়ে ছিলে পুকুর পারে। আমাকে দেখেই ছায়াকে বললে,’দেখেছিস খান সেনাটা আমাদের বাড়িতেই
আসছে’! মায়া তুমি হয়তো বুঝনি, তোমাকেই দেখতে আসছি। বড্ড ছেলেমানুষ ছিল তোমার মনটা। আমার সাথে এমন ভাবে কথা বলছিলে যেন কতদিনের পরিচিত
আমি। তোমার এই শিশুসুলভ সরলতাই আমাকে বন্দি করেছে তোমার ভালবাসার মায়াজালে। গণ্ডগোলের এই পরিস্থিতিতে তোমার বাবা বিয়ের অনুষ্ঠান করতে রাজি
হলেন না। পানচিনির পর ঠিক হল যুদ্ধ শেষ হলেই আমাদের বিয়ে হবে। শুরু হল তোমাকে নিয়ে আমার অপেক্ষা। বিধাতা বোধহয় আমার এই অপেক্ষা দেখে মুচকি
হেসেছিলেন। রাতেরবেলা হানাদারেরা আমাদের গ্রামে আগুন লাগিয়ে দিল। পুরো গ্রাম শ্মশান হয়ে গেল। আমি বৃদ্ধ বাবাকে ফেলে যেতে পারলাম না। ফজরের
আজানের আগেই তোমার বাড়িতে গিয়ে কয়লা ছাড়া আর কিছু পেলাম না। তোমার পানচিনির শাড়িটার পোড়া আঁচল দেখে বুকটা আমার ছ্যাঁত করে উঠল। শোকের
ষোলকলা পূর্ণ হল যখন শুনলাম তোমার মত একটা মেয়েকে গুলি করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে শুনে। আমি যেন একইসাথে বধির,কালা ও মূক হয়ে গেলাম।
নিজের ভেতর কেমন যেন অদ্ভুত পরিবর্তন টের পেলাম। হানাদারদের প্রতি সত্যিকার ঘৃণা অনুভব করলাম। পরের দিন ভোরেই ভারতের আগরতলায় যুদ্ধ প্রশিক্ষণ
ক্যাম্পে যোগ দিলাম।দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করলাম। মাঝে মাঝে যুদ্ধ করতে করতে হতাশ হলেই তোমার কথা ভাবতাম। তখন মনে হতো তোমার জন্য
হলেও ওই হানাদারদের হত্যা করতে হবে। ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় উল্লাসের মাঝেও মনটা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল। দেশের বিজয় হলেও আমার ভালবাসার তো
বিজয় হল না। যুদ্ধের পরে ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। কিছুতেই মন বসতো না। প্রতিটা মুখের ভেতরে তোমার মুখ খুজে বেড়াতাম। ৭৩ এর রোজার ঈদটা আমার জীবনটা
যে আবার ঘুরিয়ে দেবে তা আগে কখনও ভাবিনি। রেলস্টেশন থেকে গরুরগাড়িতে উঠতেই একজন বৃদ্ধের সাথের বোরকাওয়ালী মেয়ে একটা ঠিকানা লেখা কাগজ
আমার গাড়োয়ানকে দিল। মেয়ের চেহারা নেকাপের জন্য দেখা যাচ্ছিল না। গাড়োয়ান লেখাপড়া না জানায় কাগজটা আমার দিকেই বাড়িয়ে দিল। মেয়েটা আমাকে
দেখেই কেমন যেন চমকে গেল। কাগজে আমার বাড়ির ঠিকানা দেখে অবাক হলাম। তখন মেয়েটা চিৎকার করে বলল,’আপনি খানসাহেব না?’ তখনই বুঝতে পারলাম
এ আর কেউ নয়,এ আমার মায়া। ওইদিন রাতে মায়াদের বাড়িতে আগুন দেবার আগেই ওরা ভারত চলে গিয়েছিল। যাবার পথে হানাদারদের গুলিতে মায়ার বোন ছায়া
মারা যায়। ভারতে ওরা বনপারা শরণার্থী শিবিরে ছিল। দেশ স্বাধীন হবার ৪ মাস পর দেশে ফিরেছিল।
আমার বিয়ের ২৭ বছর হতে চলল। এখনও আমি যখন রেগে যাই, মায়া তখন সেই ভুবন-ভুলানো মোহিনী হাসি হেসে বলবে,’খান সাহেবের এতো রাগ কিসের?’ বিশ্বাস
করুন আমার রাগ মুহূর্তেই পানি হয়ে যায়।
মায়া, তুমি পারবেনা আমার বাকি জীবনের বাকি রাগ,অভিমানগুলো এমনভাবে পানি করে দিতে?
(এটি একজন প্রথিতযশা মুক্তিযোদ্ধার কাহিনি,)