‘দেখিস মা, নিজের শরীরের রক্ত বিক্রি করে হলেও তোকে পড়ালেখা করাবো। তুই একদিন অনেক বড় হবি দেখিস। আমি তোকে সকলের মতোন বড় মানুষ করব’
মা বিমর্ষ চেহারা নিয়ে কথাগুলো বলে গেলো। আমি শুধু তাকিয়ে আছি মানুষটার দিকে। বাবার বেতনটাও অনেক কম। ঢাকা শহরে ভালোভাবে জীবনযাপনের জন্য যে পরিমাণ টাকা দরকার,আমাদের কাছে তা অতি সামান্য। কিন্তু আমার তখন আর কত ই বা ছিলো বয়স? আমি তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। কোনোরকম একটা স্কুলে পড়তাম। বাসায় কোনো শিক্ষক ছিলোনা, পড়ানোর মতোন কোনো লোক ছিলোনা। স্কুলে স্যারদের কথা শুনতাম আর নিজের চেষ্টায় নিজে নিজে যা পারতাম তা ই পড়তাম। ছোটো থেকে কষ্টের মাঝেই ছিলো বেড়ে ওঠা। জীবনে নাকি সুখ-দুঃখ ক্রমান্বয়ে আসে। কিন্তু কারও জীবনে সুখ টা বেশি, আবার কারও বা কম। কারও দুঃখ টা বেশি, আবার কারও বা কম। কিন্তু বড় হবার সাথে সাথে একটা কথা বুঝতে লাগলাম যে- ‘আমার জীবনে দুঃখটা ই হয়তো বেশি’।
.
আমি মালিহা ইয়াসমিন অধরা। ঢাকা শহরের কোনো এক অলিগলির মাঝে ছোট একটি বাড়িতে মা-বাবা, ছোট ভাইকে নিয়ে আমাদের পরিবার। মা গৃহিণী। ছোটো ভাইটার বয়স মাত্র ৫ বছর। নাম নাহিয়ান আহমেদ রিফাত। আর আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়া একজন ছাত্রী। সংসারে বাবা ই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। কিন্তু তার আয় অতি সামান্য। খেয়ে পড়ে কোনোভাবে দিন কেটে যায় আমাদের। বাবা একটু বদমেজাজি স্বভাবের। মায়ের সাথে প্রায় ই সে রাগারাগি করে, চেঁচামেচি করে। আশেপাশের লোকজন শুনতে পায়। এ ব্যাপারগুলো মায়ের খুব খারাপ লাগে। তাই সে অনেক কান্না করে। বাবা যখন চেঁচামেচি করে আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। আমার প্রচন্ডরকমের ভয় করে। কিন্তু বাবা কখনোও মা কিংবা আমাদের কারও ওপর হাত তোলেনি। বাবা মায়ের সাথেই অযথা রাগারাগি করতো। আবার নিজে নিজেই একটা সময় ঠিক হয়ে যেতেন। কিন্তু আমাদের ওপর কখনো সে রাগারাগি করেনি। বাবা-মা দুজনের আমাকে নিয়ে স্বপ্ন ছিলো। আমি একদিন লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হব। তাদের সকল কষ্ট দূর করবো।
.
আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীতে উঠেছি। তেমন কিছুই বুঝতাম না বললেই চলে। শুধু এটা বুঝতাম যে,আমার মায়ের মনের এক পাশে অনেক কষ্ট আর অন্যপাশে আমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। আমাকে মা কষ্টগুলো থেকে দূরে রাখতে চাইতো। কিন্তু আমিও সময়ের সাথে বড় হতে লাগলাম, অনেক কিছু দেখতে লাগলাম, জানতে লাগলাম, শিখতে লাগলাম। একদিন দেখলাম মা ভাইয়াকে সুজি খাওয়াচ্ছে। ভাইয়া পুরোটা খাচ্ছিলো না সেদিন। মা বললো ও খাবেনা হয়তো, ফেলে দিয়ে লাভ কি? তুই খেয়ে নে অধরা। আমি বললাম আচ্ছা। আমি বাটিতে নিয়ে খেতে শুরু করলাম। এক চামচ মুখে নিয়ে অনুভব করলাম সুজির স্বাদটা আমার ভালো লাগছেনা। কেমন যেনো একটা পানসে স্বাদ। আমিও আর খেলাম না। আমি মা কে জিজ্ঞাসা করলাম-‘আচ্ছা মা, সুজি কি দিয়ে রান্না করো?’ মা আমাকে বললো- ‘সবাই তো দুধ দিয়ে রান্না করে রে মা,আমরা রোজ দুধ পাবো কোথায়? তাই পানি দিয়েই রান্না করে তোর ভাইকে খাওয়াই।’ আমি শুধু ভাইয়াটির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম- এইটুকু একটি ছোটো ছেলে, তাকেও খাবারের কষ্টটা অনুভব করতে হচ্ছে! সেদিন হয়তো প্রকৃত বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়নি আমাকে। তবুও কষ্ট নামের জিনিসটাকে শুধু অনুভব করতে লাগলাম আর মনের মাঝে গেঁথে রাখলাম। একদিন অনাবিল সুখ দিয়ে এ কষ্ট নামটা দূর করবো আমাদের জীবন থেকে।
.
অন্য আর সকলের থেকে আমাদের জীবনধারা ছিলো অনেকটা ভিন্ন ধরনের। স্কুলের ছেলেমেয়েরা যখন টিফিনের সময় পছন্দের খাবার খেতো,আমি তখন স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতাম। প্রচন্ড ক্ষুধা পেলে পানি ছাড়া সে ক্ষুধা নিবারণ করার মতো ক্ষমতা আমার ছিলোনা। মানুষ দিন শেষে যখন রাতে ঘুমোতে যায়, সকলের মনে একটাই প্রার্থনা থাকে। পরের দিনটি যেনো কোনো সুসংবাদ কিংবা কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। আমিও প্রার্থনা করতাম। কিন্তু প্রতিটি সকাল আমাকে উপহার দিতো নতুন নতুন কষ্ট। আমি সকালে ঘুম থেকেই উঠে আগে মায়ের মুখটা দেখতাম। কিন্তু মায়ের মুখে হাসি দেখে সকাল শুরু করার মতো সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমি প্রতিদিন সকালে উঠে মায়ের মলিন মুখ দেখতাম। আমাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখলেই মা মলিন মুখ নিয়ে আমাকে বলতো- ‘কি খাবি রে মা সকালে?’ আমি তখন বুঝতাম,খাবারের সংকটে মায়ের মুখটা আজ মলিন হয়ে আছে। আমি মুচকি হাসি দিয়ে বলতাম- ‘যা আছে তা ই দিয়ে দিয়ে দাও।’
আর মনে মনে বলতাম- ‘হে আল্লাহ, আমি খাবারের জন্য আর কখনো মায়ের মুখটা বিমর্ষ দেখতে চাইনা।’
.
এভাবে আমাদের অনেক কষ্ট আর মায়ের মনের হাজারও স্বপ্ন নিয়ে কাটতে লাগলো জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দিন। আমিও দশম শ্রেণীতে উঠলাম। কিছুদিন পর আমার এসএসসি পরীক্ষার সময় এসে গেলো। এসএসসি পরীক্ষার ঠিক ২ দিন আগে বাবা মায়ের সাথে রাগারাগি করেন,ঝগড়া করেন। মা আমার সামনে এসে অনেক কাঁদতে লাগলো। আমি জানিনা সেদিনের মতো এতোটা কষ্ট আমার কখনোও হয়েছে কিনা। আমার পরীক্ষার মাত্র আর ১ দিন বাকি। আর আমার মা আমার সামনে বসে অঝোরে কাঁদছে।একদিকে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো আর
অন্যদিকে আমি পড়ছিলাম। কারণ আমাকে যে পড়তে হবে, আমাকে পড়ালেখা করে ভালোকিছু করে মায়ের সব স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। তাহলেই হয়তো আমার মায়ের কান্না আমাকে আর এভাবে অসহায়ের মতো দেখতে হবেনা। আমার বান্ধবিদের কাছ থেকে শুনতাম ওদের নাকি এক বিষয়ের জন্য এক একজন করে শিক্ষক আছে,ওদের বাবা-মা ওদেরকে দামী দামী পুষ্টিকর খাবার,দুধ-ডিম খেতে দেয়। আর আমি এমন একজন মেয়ে যে কিনা নিজের চেষ্টাতে ভালোভাবে পড়ছি। যখন যা থাকে তা দিয়েই পেটটা চালিয়ে নেই আর মনটাকে সান্তনা দিয়ে থাকি। আমার মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে,কিন্তু আমি পারিনা। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে,রোজ ডাল ভাত খেয়ে আজ ভীষণ ইচ্ছে করে একটু ভালো খাবার খেতে। আমারও যে ইচ্ছে করে সবার মতো বড় মাছের টুকরো টা খেতে। কিন্তু এগুলোও যে আমার কাছে শুধুই স্বপ্ন। যেমনটা স্বপ্ন দেখে মা আমাকে নিয়ে…
.
এসএসসি পরীক্ষার দিন সকালে বাবা হোটেল থেকে নাস্তা এনে দিলো। আমি অনেক খুশি হলাম অনেক দিন পর ভালো খাবার পেয়ে। দুপুরেও আমার জন্য মুরগির মাংস,ভাত রান্না করা হলো। সেদিনও আমি খুব কেঁদেছিলাম খাবারগুলো দেখে। শুধু মনে মনে একটি কথা ই ভেবেছি- ‘এমনও দিন হবে যেদিন আমি আমার ইচ্ছে মতো এসব ভালো খাবার খেতে পারবো, হয়তো এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। রোজ এরকম ভালো খাবার খেয়ে দিন কাটাতে পারলে হয়তো জীবনে আর কোনো অপূর্ণতা ই থাকবেনা!’ আমি স্বপ্ন দেখি সেই রকম একটি দিনের। আর এভাবেই স্বপ্ন দেখার মাঝে আমার বেড়ে ওঠা। কিন্তু হাজারও প্রতিকূলতার মাঝেও আমি হেরে যাইনি কখনোও। আমি এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলাম। এ গ্রেড পেয়েছি কিন্তু এ+ পেতে পারিনী শুধু অল্পের জন্য। সবাই খুব খুশি হয়েছিলো কিন্তু এ+ পাইনি বলে হয়তো একটু মন খারাপ হয়েছিলো। হয়তো কেউ আমার দিকটা বুঝবেনা, কিন্তু শুধু আমি ই বুঝতে পারছি একটা সাধারণ স্কুলে পড়েও কোনো প্রাইভেট না পড়ে এই ফলাফল টা ই আমার জন্য অনেক। কিন্তু ওই যে সবার কপালে সুখ সয়না। আমারও হয়েছে তেমনটা ই।
.
এসএসসি পরীক্ষার পর সকলে যেখানে ব্যস্ত সময় পার করছে কে কোন কলেজে ভর্তি হবে, তখন আমার মা আমাকে এসে বললেন- ‘ অনেক দূর এসেছিস। আর পড়ানোর মতো সামর্থ্য নেই। এখন তোর ভাইয়াটা স্কুলে পড়ে। এতো খরচ কিভাবে চালাবো? আর হয়তো তোর পড়ালেখা করা হবেনা।’ আমি সেদিন সকলের আড়ালে খুব কেঁদেছিলাম। শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম আমাকে পড়বার মতো একটা উপায় বের করে দাও। আমি আগের মতোন ই না খেয়ে দিন কাটাবো,পড়বো। তবুও শুধু আমি একটু পড়তে চাই। আমি মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। আমি লেখাপড়া শেষ করে একদিন অনেক বড় হতে চাই। সারারাত কেঁদেছি আর ভেবেছি,আমার স্বপ্নগুলো হয়তো এখানেই শেষ হয়ে গেলো!
.
যেই স্কুল থেকে আমি এসএসসি পাস করলাম সেই স্কুলে কলেজ ছিলো। ভর্তি হতে খুব বেশি টাকা লাগেনি, তাই মায়ের জমানো টাকা একত্রে করে সাথে ধার করে কিছু টাকা নিয়ে আমার কলেজের ভর্তির কাজ সম্পন্ন হলো। শুরু হলো আমার নতুন স্বপ্ন, আমি এগুতে লাগলাম আমার স্বপ্নের পথে। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে আমি একটি টিউশনি পেলাম। টাকা টা ছিলো অতি সামান্য কিন্তু সে সময়ে আমার জন্য সেই টাকাটা ই ছিলো অনেক। কারণ আমার উপার্জনের টাকা দিয়ে আমার কলেজের অর্ধেকের বেশি খরচ চলতো। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে টিফিনও খেতে পারতাম, মনের মাঝে ভালোলাগার এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতো। আস্তে আস্তে আমার টিউশনি বাড়তে লাগলো। নিজের পড়ালেখার পাশাপাশি পরিবারেও টাকা দিতে লাগলাম। ছোটো ভাইটাও পড়ালেখা করতে লাগলো ভালোভাবে। কলেজের দুটি বছর যেনো দেখতে দেখতে ই শেষ হয়ে গেলো। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করলাম আমি। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাতে মোটামোটি একটা ভালো রেজাল্ট করলাম। কিন্তু এবারও আমি এ+ পেতে পারিনী। কিন্তু এতে কারও মন খারাপ দেখতে পাইনি।
.
আমার বাবা যখন টিভি দেখতেন তখন আমি প্রতিবার লক্ষ করতাম, টিভিতে যখন দেখাতো যে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল দিতো,বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়েরা খুশিতে বলতো যে তারা জিপিএ-৫ পেয়েছে,তখন বাবা তা দেখে হাসতেন,অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকতেন। হয়তো স্বপ্ন দেখতেন একদিন আমিও এ+ পাবো। কিন্তু আমি বাবার এ স্বপ্নটা পূরণ করতে পারিনী। কিন্তু থেমে যাইনি জীবনের মাঝ পথে। নিজের মতো করে এগিয়ে চলতে লাগলাম কারণ একটি এ+ মানেই জীবনের সব নয়। নিজের চেষ্টায় আজ এতোটা পথ এসেছি, আমি সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাবো। আমি হারবো না কিছুতেই। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ভার্সিটি পরীক্ষা দিলাম। সরকারি একটি কলেজেও চান্স পেলাম আল্লাহর রহমতে। দিনে ২/৩ টা টিউশনি করতাম আর রাতে নিজের পড়া পড়তাম। টিউশনির টাকা সবটাই মায়ের হাতে দিতাম। আমার যা লাগতো খরচ করতাম আর বাকি টাকা সংসারে আর ভাইয়ার পড়ার খরচে কাজে লাগতো। এভাবেই চলছিলো আমার জীবনের দিনগুলি
.
একদিন টিউশনি থেকে ফেরার পথে আমার জুতোজোড়া ছিঁড়ে গেলো। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে ছিলাম তখন। বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। সাথে টাকা ও নেই যে জুতো সেলাই করে নিবো, কিন্তু জুতোজোড়া ফেলে দিলেই বা কি পড়ে বের হবো ঘর থেকে? অনেক কষ্টে সেদিন সেই জুতোজোড়া পড়ে
হেঁটে বাড়িতে এসেছিলাম। জুতোটা এমনভাবে ছিঁড়েছিলো যে আমি হাঁটার সময় পড়ে যেতে লাগলাম অনেকবার। রাস্তার সবাই আমার দিকে কেমন করে যেনো তাকিয়ে ছিলো। অনেকে হাসছিলো ও। আমি বার বার মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম-‘হে আল্লাহ, আমি যেনো বাড়িতে পৌঁছাতে পারি সে ক্ষমতাটুকু আমাকে দাও।’ বাড়িতে এসে মাকে বললাম যে জুতোজোড়া ছিঁড়ে গেছে,নতুন জুতো কিনতে হবে। মা বললো হাতে তো টাকা পয়সা নাই রে মা। ঘরে তরকারি শেষ, তেল নাই। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মা আমাকে বললো একটা কাজ কর- ‘আমিতো বাইরে যাইনা,আমার জুতো তো আছেই। তুই বাইরে গেলে আমার জুতোটা পড়ে যাইস মা।’ আমি অবাক হয়ে অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলাম। মায়ের জুতোটা ও যে খুব ভালো সেটা ও নয়। ৩ বার সেটাই করে এখন ব্যবহার করেন। আমি মা কে বললাম-‘তোমার জুতোটা ও ছিঁড়ে গেলে বা আমি নিলে তুমি বাইরে যাবে কিভাবে?’ মা বললো- ‘আমার তো তেমন দরকার হয়না রে বাইরে যাওয়ার। তুই নে। আর তুই যখন বড় চাকুরী করবি তখন আমারে অনেক ভালো দেখে একজোড়া জুতো কিনে দিস মা’ আমি নির্বাকশ্রোতার মতোন দু’ফোটা চোখের জল ফেলে চলে আসলাম মায়ের সামনে থেকে।
.
দিন যাচ্ছে, সময় পার হচ্ছে, দেখতে দেখতে আমার অনার্সটা কোনোরকমে শেষ হলো। ভাইয়াও এসএসসি পরীক্ষার্থী। বাবা মায়ের ও বয়স হয়েছে,বাবা এখনোও অনেক কষ্টে চাকুরী করে যাচ্ছে। বাবা মায়ের চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দুজনের মুখটা কেমন যেনো শুকনো হয়ে আছে। একদিন রাতে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য উঠলাম। বাবা মায়ের রুম থেকে কথার শব্দ শোনা যাচ্ছে। রাত তখন প্রায় ৩ টা বাজে। এতো রাতে তো বাবা মায়ের জেগে থাকার কথা নয়, কি নিয়ে তারা কথা বলছে? কোনো সমস্যা হয়েছে কি? আমি দরজার পাশে এসে দাঁড়ালাম, কথাগুলো শুনার চেষ্টা করছি। মা বাবাকে বলছিলো-
– মেয়ের বয়স তো আর কম হলোনা, বয়স বেশি হয়ে গেলেও তো আর বিয়ের জন্য ভালো ছেলে পাবোনা। তাছাড়া আশেপাশের লোকজন ও বলাবলি করে মেয়েদের বয়স হলেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত। অনেকে আবার বলে মেয়ের কোনো সমস্যা আছে তাই নাকি বিয়ে দিচ্ছিনা।
– হ্যাঁ কথা তো ঠিক ই। কিন্তু কি করবো বলো? ভালো ছেলে পেতে হলেতো নিজেদের অবস্থাটা ও ভালো থাকা দরকার। আমাদের যা অবস্থা,সংসার চালানো টা ই তো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় হঠাৎ করে কখন যেনো মরে যাই!
– ছিঃ এসব বাজে কথা আর বলোনা তো এখন। কপালে যা আছে তা ই হবে, রিযিকের মালিক আল্লাহ, আল্লাহ ই যা ভালো মনে করেন করবেন।
.
বাকি রাতটা আমার নির্ঘুমভাবেই কেটে গেলো। বার বার নিজের কাছে একটি কথা জানতে ইচ্ছে করছে-
‘আমার অপরাধ কি? আমার কি মেয়ে হয়ে জন্মানোটা ভুল ছিলো? কেনো আমাকে এতো শাস্তি পেতে হচ্ছে?’
এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আজ আমার জানা নেই। কিন্তু একদিন আমি এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করবো। সেদিন ই খুঁজে পাবো যেদিন হবে আমার স্বপ্ন পূরণ।
আমি আজও লড়াই করে যাচ্ছি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে। আমি আজও কষ্ট করে যাচ্ছি আমার সুখের দিনটি ফিরে পাওয়ার জন্য। ছোটো ভাইটা আল্লাহর রহমতে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করলো। আমার টিউশনি থেকে অল্প অল্প করে এতোদিন কিছু টাকা জমিয়েছি, আজ অনেকগুলো টাকা হয়েছে। এই টাকাগুলো দিয়ে ভাইয়াকে ভালো কলেজে ভর্তি করবো বলে ভেবে রেখেছি। দুই মাস পর ভাইয়ার এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল দিলো। দিনটি ছিলো মঙ্গলবার। বাবার অফিস থাকা সত্বেও বাবা সেদিন অফিসে যায়নি ভাইয়ার ফলাফল দেখবে বলে। দুপুর ১:৩০ বেজে গেলো। আর কিছুক্ষণের মাঝেই ফলাফল দিবে। বাবা ঝটপট গেলো মোবাইলে টাকা রিচার্জ করতে। সবাইকে ফলাফল জানাতে হবে সে জন্য। দুপুর বেলায় প্রায় বেশিরভাগ দোকান ই ছিলো বন্ধ। তাই বড় রাস্তার ওপারে বাবা টাকা রিচার্জ করতে গেলো। ফেরার পথে রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি বড় ট্রাক এসে বাবাকে চাপা দিয়ে চলে গেলো। আমার বাবার মাথাটা গাড়ির চাকার নিচে পড়ে শরীর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো
.
আমার ভাইয়া স্কুলে গেলো ফলাফল জানতে। অন্যদিকে বাবা এখনোও বাড়িতে আসেনি বলে মা চিন্তা করছিলো। কিছুক্ষণ পর ভাইয়া দৌড়ে বাড়িতে ছুটে আসলো। আর হাঁপাতে হাঁপাতে বললো- ‘মা আমি এ +পেয়েছি, আপু আমি এ+পেয়েছি।’ আমি বোঝাতে পারবোনা তখন আমার কতটা আনন্দ হচ্ছিলো। আমি খুশিতে কান্না করে দিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিলো আমার এতোদিনের কষ্ট, রাত জাগা পরিশ্রম সব আজ সফল হয়েছে। ঠিক তখন ই পাশের বাড়ির দুজন খালু এসে বললো-‘ অধরা রে,তোর বাবা বড় রাস্তায় গাড়ি চাপায় মারা গেছে!’ পুরো বাড়ি থমকে গেলো হঠাৎ। আমার আর মায়ের চোখে সুখের কান্নার জল তখনও শুকিয়ে যায়নি। মা এ কথা শুনেই ‘আল্লাহ রে’ বলে জোরে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালো,আমি মাটিতে বসে পড়লাম। একটু পর লোকজন মিলে বাড়ির আঙিনায় বাবার লাশ নিয়ে আসলো। আমি,মা দুজনেই নির্বাক হয়ে রইলাম। মানুষ নাকি বেশি কষ্ট পেলে পাথর হয়ে যায়। সে কথাটি আজ প্রমাণ হয়েছে। নিজেকে সত্যি আজ একটা পাথর মনে হচ্ছে। বাবা শব্দটা দুটি অক্ষর দিয়ে তৈরি। কিন্তু বাবা মানেই আমাদের মাথার ওপরের ছাদ আর পায়ের নিচের মাটি। বাবা মানেই শক্তিশালী ঝড়েও নিরাপদ আশ্রয়ের ঠিকানা। বাবা মানেই তো আমাদের একটা পৃথিবী।
.
বাবাকে যখন সবাই মিলে দাফন করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলো,তখন সবাই বললো শেষ বারের মতো বাবাকে একবার দেখে নিতে। তখনই আমি আর মা কান্নায় ভেঙে পড়লাম। বাবার কাছে গিয়ে বসলাম। বাবা চিরদিনের মতো শুয়ে আছে। আর কখনোও বাবা মায়ের সাথে চেঁচামেচি করবেনা, মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না, আর কখনোও বাবা কথা বলবেনা আমাদের কারও সাথে! ভাবতেই বুকটা ফেটে যাচ্ছে আজ আমার। আমি বাবার কাছে গিয়ে শেষবারের মতোন একটি কথাই বললাম। ‘বাবা,তোমার ছেলে এ+ পেয়েছে বাবা। অথচ কি ভাগ্য আমাদের, তোমার অনেক দিনের শখ ছিলো তোমার ছেলে মেয়েও এ+ পাবে। টিভিতে শুধু দেখে নয়,তুমিও সকলের মতোন আনন্দ করতে পারবে। আজ তোমার স্বপ্ন পূরণ হলো কিন্তু আজ আর তুমি পৃথিবীতে নেই।’ বাবাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হলো।
.
বাবার মৃত্যুর পর শুরু হলো আমাদের অতি কষ্টকর দিন। খুব দ্রুত আমি চাকুরীর জন্য বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করতে লাগলাম। কিন্তু নাহ, কোথাও ই যেনো কিছু হচ্ছিলো না। কোনোরকম ভাবে দু’ এক বেলা খেয়ে চলছিলো আমাদের দিন। বাবার মৃত্যুর সময় অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে যায়। কিন্তু বাবার স্বপ্নগুলো তো আমাকে পূরণ করতেই হবে। ভাইয়া ভালো রেজাল্ট করায় কলেজে অর্ধেক টাকাতেই ভর্তি করাতে পারলাম। বাবা মারা যাওয়ার দুই মাস পেরিয়ে গেলো। বাড়ি ভাড়াও জমে গেছে। আর একমাসের মাঝে বাড়ি ভাড়ার টাকা দিতে না পারলে নাকি আমাদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হবে। মা এসব চিন্তায় খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে প্রায়। মা কে সান্তনা দেওয়ার মতো ভাষা আমার জানা নেই। তবুও যতটা পারি চিন্তামুক্ত রাখতে চাই। আমি দিনরাত এক করে শুধু ছুটে চলেছি,একটি চাকুরীর আশায়। একটি স্বপ্ন পূরণের আশায়। ছুটে চলেছি আমার স্বপ্নের পথে।
ছুটে চলছি মায়ের আর ভাইয়ের মুখের হাসি ফোটানোর জন্য। ছুটে চলেছি একটি সুখের স্বর্গ গড়ে তোলার আশায়।
.
প্রায় তিন মাস ধরে যখন অনেক জায়গায় চাকুরীর জন্য আবেদন করেছি, দিনরাত এক করে ছুটে চলেছি, তখন একদিন বিকেলে একটি কল আসলো আমার নাম্বারে। ভদ্রলোক জানালেন দুই সপ্তাহ আগে আমি যেই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জবের জন্য আবেদন করেছিলাম তারা আমাকে ইন্টারভিউ এর জন্য যেতে বলেছে। আমি খুশিতে দিশেহারা হয়ে গেলাম। মাকে জলদি খুশির খবরটা জানালাম। মা আমার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলল। কারণ এতোগুলো বছরে আমাকে ঘিরে মায়ের যে স্বপ্ন ছিলো তা এবার পূরণ হওয়ার পথে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা কারও সাথে ভালোভাবে কথা বলতো না,খাওয়া দাওয়া করতো না। আজ এই খবরটা শুনে মায়ের মুখে একটু হাসি ফুটে উঠলো। মায়ের মুখের এই হাসিটা দেখে নিমিষেই আমার অন্তরটা শীতল হয়ে গেলো। সেদিন রাতে আমার ঘুম হলোনা ঠিকমতো। অনেক চিন্তা আর আশা নিয়ে রাতটা পার হলো। সকালে ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। সবকিছু ঠিকভাবে শেষ হবার পর তারা জানালো তারা আমাকে নিয়োগ দিচ্ছেন। সবকিছু কেমন যেনো স্বপ্নের মতো মনে হতে লাগলো। আসলেই তো, এটাইতো ছিলো আমার এতোদিনের স্বপ্ন! আমাদের আর কোনো বাধা রইলো না। এবার ধীরে ধীরে বাড়িভাড়া দিতে পারবো, মাকে নতুন একজোড়া জুতো কিনে দিতে পারবো। আমাকে আর কখনো ছিঁড়া জুতো নিয়ে সমস্ত পথ হেঁটে যেতে হবেনা, আমাকে কখনোও আর ক্ষুধার্ত পেটের যন্ত্রণা অনুভব করতে হবেনা, আমার ভাইকে কখনোও আর দুধ ছাড়া সুজি খাওয়ার মতো কষ্ট করতে হবেনা।
.
চাকুরীটা বেশ ভালোভাবে করতে লাগলাম। বেতন ও অনেক ভালো। ৩৫ হাজার টাকা। এতো টাকা কখনোও একসাথে দেখিনী। এবার থেকে জীবনটা হবে শুধু সুখময়। চাকুরীর প্রায় ১ মাস অতিক্রম হয়ে গেলো। মাসটা শেষ হলেই বেতন পাবো, ভাবতেই মনের মাঝে অন্যরকম এক অনুভূতি হতে লাগলো। আর কোনো অপূর্ণতা থাকবেনা কখনোও আমাদের জীবনে।
পরের মাসে বেতনটা ঠিকভাবেই হাতে পেলাম। রাতে বাড়ি ফেরার পথে মায়ের জন্য একটা কাপড় আর একজোড়া নতুন জুতো কিনে নিয়ে গেলাম, আর ভাইয়ার জন্যও জামা কিনেছি। অনেকদিনের স্বপ্নটা আজ অবশেষে পূরণ হলো। বাড়িতে ফিরেই দেখলাম ঘরের সামনে অনেক মানুষের ভিড়। কিছু বুঝতে পারলাম না কি হয়েছে! ভেতরে যেতেই দেখি আমার মা মেঝেতে শুয়ে আছে। নাহ,খনিকের জন্য নয়, বাবার মতো চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে আজ মা। সন্ধ্যায় নাকি মা ব্রেন স্ট্রোক করেছেন। ভাইয়া আশেপাশের সবাইকে ডেকে হাসপাতালে নিয়েছিলো। ডাক্তার বললেন মা মারা গেছেন! নাহ, আমি মায়ের দিকে না, আমি আমার হাতে থাকা মায়ের কাপড় আর জুতোজোড়ার দিকে একটিবার তাকালাম। এই সেই দামী কাপড়, যেটা পড়ার জন্য আমার মা রোজ স্বপ্ন দেখতেন আমি কবে বড় হবো। এই সেই জুতোজোড়া যেটা কিনার মতোন একদিন আমাদের সামর্থ্য ছিলোনা বলে মায়ের জুতো নিয়ে বাইরে গিয়েছি আর মা বলেছিলো- ‘তুই যখন বড় চাকুরী করবি তখন আমাকে জুতো কিনে দিস রে মা।’
আমি মায়ের কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম আর বলতে লাগলাম – ‘ আজ আমি তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করেছি মা, শুধু নিজের চোখে আজ দেখলেনা তোমার এতোদিনের স্বপ্নের বাস্তবায়ন আর সুখের ছোঁয়াটুকু আজ তুমি পেলেনা!
.
৩ বছর পর…..
বাবা-মা কে হারানোর পর মানসিকভাবে অনেক ভেঙে পড়েছিলাম। এই দুর্বলতা ঠিক করার জন্য আত্মীয়স্বজনরা মিলে আমাকে বিয়ে
দিয়ে দিলেন। ছোটো ভাইটাও আমার বিয়ের পর আমার সাথেই থাকে। যদিও আজ সে অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছে কিন্তু আমার চোখে তো ও আজও সেই ছোটো ই। আমিও চাকুরী করছি। আমার স্বামী রিয়াজুল করিম খুব ই ভালো একজন মানুষ। নিজের স্বামী বলে নয়, একজন মানুষ হিসেবে আসলেই সে অত্যন্ত ভালো। বাবা-মা দুজনেই মারা গেলেন,কিন্তু আজ তাদের সব স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। অভাব নামের জিনিসটি আজ আর নিজেকে ছুঁতে পারেনা,কিন্তু যারা আমাকে এতো কষ্ট করে আজ এ পর্যন্ত এনেছেন সেই বাবা-মা ই সুখটা উপভোগ করতে পারলেন না। কিন্তু আজও আমি থেমে নেই আর থেমে নেই আমার স্বপ্ন দেখা।
.
আজ আমার স্বপ্ন ছোটো ভাইয়াটাকে আরও বড় করবো। ও এমন কিছু করবে যাতে করে দেশের সকলে ওকে এক নামে চিনবে। আর সে সাথে আমার দেহের মাঝে বেড়ে উঠছে একটি ছোট্ট প্রাণ। হাজারও স্বপ্ন আছে আজ আমার সকলকে ঘিরে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে বাবা- মায়ের মতো হয়তো একদিন আমিও চলে যাবো, রয়ে যাবে শুধু আমার স্বপ্নগুলো। হয়তো একদিন আমার স্বপ্নগুলোও পূরণ হবে, হয়তো সেদিন পৃথিবীর বুকে আমি থাকবো,নয়তো থাকবোনা! আমার ছেলেমেয়েরা তাদের মতো আবার নতুনকরে স্বপ্ন দেখবে। সময়ের পরিবর্তনে এভাবেই হারিয়ে যায় আপনজনরা। কিন্তু সময় কখনো থেমে থাকেনা, আর থেমে থাকেনা স্বপ্ন। প্রত্যেকের জীবনেই একটি স্বপ্ন থাকে। কখনোও সে স্বপ্ন পূরণ হয়, কখনো বা হয়না। কখনোও দেখার সৌভাগ্য হয় কখনো বা হয়না! কিন্তু মানুষের জীবনে স্বপ্ন থাকবেই। আর সেই ‘স্বপ্নকে’ ঘিরেই আমাদের বেঁচে থাকা।