এক বনে বাস করত এক লোভী ও হিংস্র বাঘ। সে এতটা হিংস্র ও লোভী যে তার জ্বালায় বনের অন্য পশু-পাখিরা সবসময় ভয়ে
আতঙ্কিত থাকত, কেউ বাচ্চা রেখে কোথায় চলে গেলেই হয়, সুযোগ সন্ধানী বাঘটা অমনি সুযোগ বুঝে কচি কচি বাচ্চাগুলোকে
ঘাড় মটকে দিত আর মজা করে খেত। দিনে দিনে সে এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল যে তার বিরম্নদ্ধে কেউ কথা বলা তো দূরে থাক,
কেউ তার পথ আগলে দাঁড়ানোরও সাহস পায় না। এই তো সেদিনের ঘটনা, বনের সবচেয়ে নিরীহ আর সুন্দর প্রাণী হরিণ
এসেছিল ওই গাছের নিচে সবুজ ঘাস খেতে আর ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা লোভী বাঘটা হঠাৎ করে আক্রমণ করে বসে
হরিণের ওপর।
এরপর রক্ত-মাংস খেয়ে বনজুড়ে সে কি হিংস্রভাবে ডাকাডাকি!
ভয়ে আঁতকে ওঠার মতো এক ভয়ানক কা–কারখানা।
এভাবে দিনের পর দিন বনজুড়ে রাজত্ব করে চলছে লোভী বাঘ, দেখার যেন কেউ নেই।
যখন যা ইচ্ছে মনের খুশিতে তাই করে চলছে সে। দিনে দিনে বনজুড়ে কেমন যেন শূন্যতা তৈরি হলো।
পশু-পাখিরা যে যার মতো করে পারে এই বন থেকে অন্য বনে পালিয়ে চলে যেতে লাগল।
যদিও ওদের মনে খুব কষ্ট হচ্ছিল এই বনটা ছেড়ে চলে যেতে। তবে কি আর করার, জীবনের মায়া কার না আছে?
দেখতে দেখতে বনের সব পশু আর পাখিরা যে যার মতো করে চলে গেল এই বন থেকে।
শুধু শিয়াল মামা বন থেকে চলে গেল না, সে মনে সাহস রাখল আর সিদ্ধান্ত্ম নিল যে করেই হোক এই বনে সে আবার শান্ত্মি
ফিরিয়ে আনবে, পশু-পাখির ডাকে আবার মুখরিত থাকবে এই বন।
সে বাঘের সঙ্গে দেখা করার মোক্ষম সুযোগ খুঁজতে লাগল।
আর মনে মনে ফন্দি করল লোভী ও হিংস্র বাঘকে উচিত শিক্ষা দেয়ার যাতে আর কোনোদিন এই বনে সে আর ফিরে আসতে না
পারে।
সব পশু-পাখি বন ছেড়ে চলে যাওয়ায় দিনের পর দিন ভালো খাবার না খাইতে পেরে লোভী বাঘ দুর্বল হয়ে গেল, অবশ্য একটু
দূরে আর একটা বন আছে, তবে প্রতিদিন বিশাল বড় নদী সাঁতরে পার হতে হয় বলে লোভী বাঘটা ওই বনে তেমন একটা যায় না,
তা ছাড়া ওই বনের রাজা হলো সিংহ, সে যদি কখনো জানতে পারে যে এই বনে লোভী বাঘ এসেছে তবে তার আর রক্ষা নেই।
গাছের নিচে ক্লান্ত্ম হয়ে বসে আছে বাঘ, বাঘকে এমন ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে শিয়াল মনে মনে ভাবে এটাই তার সঙ্গে কথা
বলার জন্য সঠিক সময়।
শিয়াল আস্ত্মে আস্ত্মে সেই গাছের নিচে গেল এরপর বাঘকে দেখে মনে মনে ভাবল, লোভী বেটা আবার ভাব ধরে আছে না
তো তাকেও শিকার করার জন্য!
তাই নিজেকে রক্ষা করে গাছে উঠে বসল শিয়াল এরপর বাঘকে ডাকল এই যে হালুম বাঘ এভাবে এখানে শুয়ে আছ ক্যান?
শিয়ালের কথা শুনে বাঘ দাঁত কড়মড় করে চিৎকার করে বলে কি-তোমার এত বড় সাহস আমাকে হালুম বাঘ বলে ডাকো?
দাঁড়াও দাঁড়াও পুচকে শিয়াল আজ তোমাকে আমি উচিত শিক্ষা দেবো।
কতদিন ধরে রক্ত-মাংস খাইনারে আজ তোমাকে খেয়ে আমার পেটের ক্ষুদার জ্বালা মিটাব।
বাঘের কথা শুনে শিয়াল বাঘকে বলে, আরে বাঘমামা তুমি এত ক্ষিপ্ত হলে ক্যান আমার ওপর?
আমাকে যদি তুমি খাও তা হলে এই বনে তুমি খুব একা হয়ে যাবে। এর চেয়ে বরং চলো তুমি আর আমি- আমরা দুজনে বন্ধু হয়ে
যাই আর দুজন মিলেই আহার খুঁজবো।
বাঘ বলল, ওকে ঠিক আছে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব আজকের জন্য, তবে আমার একটা শর্ত আছে আর তাহলো
তোমাকে আমার জন্য প্রতিদিন খাবার জোগাড় করতে হবে।
আমি কখনো আমার খাবার খুঁজতে যাব না, একদিন যদি আমার খাবার না আনো তাহলে সেদিনই আমি তোমাকে ঘাড় মটকাব
ঠিক আছে?
বলো শিয়াল তুমি আমার শর্তে রাজি আছ তো!
শিয়াল বাঘের কথা শুনে বলে ওকে বাঘমামা ঠিক আছে তোমার কথা আমি রাখব।
পরের দিন এক বিশাল বড়
বটগাছের নিচে এসে দাঁড়াল শিয়ালও বাঘ।
এরপর শিয়াল লোভী বাঘকে বলে বাঘমামা বাঘমামা ওই যে গাছের ডালে একটা বড় হাঁড়ি দেখা যাচ্ছে ওই হাঁড়ি ভরা মধু আছে,
তবে সাবধানে গাছে উঠিও কিছুতেই যেন ডাল নড়ে না ওঠে, ডাল নড়ে উঠলে কিন্তু হাঁড়ি মাটিতে পড়ে যাবে, আর তখন সব মধু
নিচে পড়বে মাটির সাতে মিশে যাবে।
এই কথা বলেই শিয়াল বলে বাঘমামা তুমি তাহলে শান্ত্মি করে মধু খাও আমি আবার খাবার খুঁজতে গেলাম।
এই কথা বলেই গাছের আড়াল হয়ে শিয়াল ওই জায়গা থেকে দিল এক ভোঁ দৌড়।
আর বাঘ যখন গাছে উঠে হাঁড়িতে মুখ দিছে মধু খাবার জন্য অমনি হাঁড়ির ভিতরে থাকা ভেমরম্নল ভন ভন করে বাইরে এসে হুল
বসিয়ে দিল বাঘের সব শরীরে।
ভেমরম্নলের কামড় খেয়ে ধপাত করে মাটিতে পড়ে গেল বাঘ এরপর ব্যথার জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠল বাঘ, বাঘের সব শরীরের
ছাল-চামড়া উঠে পিঠে ঘাঁ হয়ে গেল।
মনের কষ্টে বাঘ এক নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে ছিল, চলতে চলতে একেবারে নদীর শেষ প্রান্ত্মে এসে দেখে বিশাল বড় একটা
বিছানার মতো কি যেন বিচানো আছে।
বাঘ ভাবলো যাক তাহলে ওই বিছানায় শুয়ে একটু বিশ্রাম নেয়া যাক!
আর এই কথা বলে যেই বিছানায় শুইতে গেছে অমনি শুনতে পায় গাছের ডালে বসে এক সাধু বাবা বলছে, এই কে রে তুমি?
তোমার এত বড় সাহস! আমাকে না জানিয়ে তুমি এই বিছানায় বিশ্রাম নিতে চাও!
তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। এরপর সাধু বাবা বাঘকে বলে এই পচা দুর্গন্ধযুক্ত শরীর নিয়ে এখান থেকে এক্ষনি
তুমি চলে যাও, একটুও গা দেবে না এই কারেন্টযুক্ত ব্যথা নিরাময় বিছানায়।
কারণ এই বিছানায় আমাদের মাজারের প্রধান রোজ এসে গড়াগড়ি করে তার শরীরের বিষ-ব্যথা দূর করে।
বাঘ কিছুতেই বুঝতে পারল না সাধুর বেশে শিয়ালের কৌশল।
তাই সে অনেক অনুরোধ করল একটাবার ওই কারেন্ট বিছানায় গড়াগড়ি করতে। সাধু বাবাকে খুলে বলল তার সব ঘটনার কথা।
বাঘ বলল, তার শরীর সব সময় জ্বালাপোড়া করে, ভেমরম্নলের কামড় খেয়ে অনেক অনেক কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে।
সে অনেক বুঝিয়ে বলার পর সাধুর বেশে শিয়ালের হিংস্র বাঘের প্রতি মায়া হলো, সে বাঘকে বিছানায় গড়াগড়ি করার অনুমতি
দিলো।
তবে তিনবারের বেশি গড়াগড়ি দেয়া যাবে না এই শর্তও দেয়া হলো বাঘকে।
বোকা ও লোভী বাঘ যেই মনের আনন্দে মাকড়াসার জালকে কারেন্ট জাল মনে করে গা এলিয়ে দিয়েছে অমনি সঙ্গে সঙ্গে ধাপ
করে জাল ছিঁড়ে নিচে পড়ে গেছে।
আসলে ওটা ছিল অনেক আগের একটা পরিত্যক্ত কুয়া, আর তার মুখের ওপর জাল পেতে ছিল কিছু মাকড়াসা।
যেই হিংস্র বাঘ কুয়ার ভিতর পড়ে গেছে,
অমনি সাধুর বেশ খুলে এসে, চালাক শিয়াল কুয়ার সামনে বলে কি হলো হালুম বাঘ? এবার বোঝ অন্যর ক্ষতি করার পরিণাম
কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
এই কথা বলেই খুশিতে হাসতে হাসতে বনের ভিতর চলে এলো শিয়াল।
এরপর আবার সব পশু-পাখি বনের ভিতর চলে এলো সবাই হাসি-খুশি মন নিয়ে শান্ত্মিতে বসবাস করতে লাগল।
রোজ বিকালে মা হরিণ তার বাচ্চাদের নিয়ে সবুজ ঘাস খায় আর বনজুড়ে মনের খুশিতে ঘুরে বেড়ায়।
সকাল হলে কিচিরমিচির শব্দ করে পাখিরা। বুলবুলিও মনের সুখে গান ধরে, নাম না জানা কি যেন এক গাছে বাসা বেঁধে পালা
করে ডিমে তা দেয় ঘুঘু পাখির জোড়া। বেশ চলছে এভাবে এখন ওই বনের পশু-পাখির সময়গুলো।
নিজের সাহস আর মেধার কারণে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত্ম নিলো এই বনের রাজা আজ থেকে এই চালাক শিয়াল, শিয়াল সম্মানের
সঙ্গে গ্রহণ করে নিলো তার দায়িত্ব।
আর এদিকে বোকা লোভী হিংস্র বাঘ দিনের পর দিন অন্ধকার, ময়লা পানিযুক্ত কুয়ায় কিছু না খাইতে পেরে দুর্বল হয়ে মারা গেল।
আর মারা যাওয়ার আগে হিংস্র বাঘ চিৎকার করে বলল হে আমার জাতি ভাইরা তোমরা কেউ আমার মতো করে গায়ের জোরে
অন্যর ওপর অত্যাচার করো না।
তোমরা যদি কেউ নিরীহ জাতির প্রতি এমন অত্যাচার করো তবে জেনে রাখ আমার মতো করে তোমাদেরও একদিন মরতে হবে।