আলোর পথের সঙ্কল্প

আলোর পথের সঙ্কল্প

কোর্টরুম থেকে এই মাত্র নিজের ডেস্কে এসে বসলেন এডভোকেট জাহিদ হাসান। নতুন জব, নতুন অফিস, সবকিছুই প্রায়

নতুন তাই নিজের হাতে বেশ পরিপাটি করে

রুম সাজিয়েছেন উনি। ঠিকঠাক যায়গায় দেয়ালঘড়ি, ক্যালিগ্রাফি, ফুলদানি এসব দিয়ে না সাজাতে পারলে একদম তার কাজে

মন বসেনা। এটা ওঁর ছোটবেলার

অভ্যাস; রুম মনের মতো করে সজ্জিত না থাকলে পড়াশুনায় মন বসত না।

জাহিদ সাহেব বেশ রুচিশীল মানুষ। গতকাল অফিসের পশ্চিম কোণায় একটা নীল রঙের হ্যাঙ্গার ঝুলিয়েছেন উনি; কোর্ট

থেকে ডেস্কে এসে কোট রাখবেন তাই। আজ

গায়ে জড়ানো কোটটা কিছুক্ষণ ধরেই অসহ্য লাগছে তাই আবার উঠে গিয়ে সেটা হ্যাঙ্গারে টাঙ্গিয়ে রাখলেন।হ্যঙ্গারটা ব্যবহার

করার জন্যই উনার মন আনচান

করছিলো। এরপর স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেই এসে বসতে যাবে তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো। ফিরে এসে খুলে দিল দরজা।

পিয়ন এসে একটা চিঠি দিয়ে গেলো।

দরজা থেকে একটু ভিতরে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খামটা দেখতে লাগলেন উনি। সাদারঙের প্লেইন পেপারের চিঠির খাম এটি।

খামটি যে পাঠিয়েছেন সেও যে অতি

উচ্চমানের রুচিশীল তা উনার চিঠিটির দিকে দৃষ্টি দিয়েই বুঝতে পেরেছেন এই দূরদর্শী আইনজীবী। চিঠির উপরের কোণে

তিনটে সজীব- সতেজ গোলাপের পাঁপড়ি

লাভ স্টাইলে স্টাপলার করা রয়েছে। উপরে প্রেরকের নাম নেই শুধু আছে প্রাপকের নাম; তাও লেখা শুধু ‘জাহিদ’। এজন্য

জাহিদ সাহেব ভাবলেন নিশ্চয় চিঠিটার

প্রেরক কোনো সিনিয়র ব্যক্তি। উনি খামটি ছিড়ে পড়তে লাগলেন লেখাগুলো। হাতের লেখাগুলো এতোটাই দৃষ্টিনন্দন যে তা

দেখামাত্রই বেদনায় জর্জরিত মন ও

একবিন্দু খুশির ঝলকে পুলকিত হবার জন্য যথেষ্ট। জাহিদ সাহেব পড়ছেন চিঠিটা। হঠাৎ উনার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে

উঠল আবার তা স্মিত হয়ে মিলিয়ে গেল;

সেখানে ফুঁটে উঠল কৌতূহল মিশ্রিত খণ্ডখণ্ড চিন্তার বুদবুদ। চিঠিটা এমন একজন লিখেছেন যার ছোট্ট একটি কথাও উনার

জন্য আদেশ হয়ে আসে, তবুও তিনি চিঠি

দিয়ে তাকে অনেক সম্মান করলেন। কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠলো। প্রেরক সম্পর্কে আগে থেকেই জাহিদ সাহেব খুবই ভালো

ধারণা পোষণ করতেন আজ থেকে তা

পরম হয়ে উঠলো।

সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের কার্যালয়। পরনে কুচকুচে কালো প্যান্ট আর গায়ে দুধসাদা রঙের সার্ট, জাহিদ সাহেব হেঁটে

যাচ্ছেন প্রশস্ত করিডোর দিয়ে। অল্পকিছু সময়

হাঁটার পর পৌঁছালেন কোর্টের ভি, আই, পি রেঞ্জে। এখানে প্রধান বিচারপতির অফিস রয়েছে। রয়েছে অন্যান্য সিনিয়র

বিচারপতিদের অফিসও পাশাপাশি। একটা

অফিস রুমের সামনে এসে দাঁড়ালেন জাহিদ সাহেব। এটা বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ পাঁচ বিচারপতির মধ্যে অন্যতম

ব্যক্তিত্ব বিচারপতি মোঃ হারুন- অর- রশিদ

চৌধূরীর কার্যালয়। ন্যায়পরায়ণ হিসেবে দেশব্যাপী উনার স্বচ্ছ ইমেজ। অল্প কথার এবং গুরুগম্ভীর প্রকৃতির মানুষ উনি; কিন্তু

ন্যায়ের ব্যাপারে আপোষহীন। জাহিদ

সাহেবের মনের মধ্যে উনার বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচিত হলে উনি বিনয়সহকারে রুমে প্রবেশ করলেন তারপর সালাম দিলেন।

বিচারপতি মহাদয়ের মুখখানা যেন

নিষ্পাপ, সরল শিশুর মতো। ঐ মুখে একচিলতে হাসি যেন অপূর্ব এক প্রাপ্তির কোমল প্রশান্তি ছড়িয়ে দেয় মনে। রুমের মধ্যে

প্রবেশ করার পর থেকেই রুমের

সুসজ্জিত পরিবেশ, ভেসে আসা স্মেইল আর বিশেষ করেই শতশত খ্যাতিমান আইনজ্ঞদের রচিত বইয়ের তাকের উপরে

আলাদা করে সযত্নে রাখা কোরআন

শরীফখানা দেখে ওঁর মন আন্দোলিত হয়ে উঠলো অকৃত্রিম আনন্দে।

কিছুসময় দুজনেই নীরব। কথাবলে উঠলেন বিচারপতি মহোদয়, ‘জাহিদ, তুমি আমার ছেলের বয়সী তাই তোমাকে আমি নাম

ধরে সম্বোধন করছি কিছু মনে করো না।’

জাহিদ সাহেব বললেন, ‘না না। কোনো সমস্যা নেই প্লিজ স্যার….।’

‘তোমাকে যেজন্য ডেকেছি, ‘উনি কথা শেষ করার আগেই বিচারপতি মহোদয় শুরু করলেন, তুমি কয়েকমাস হলো জবে

জয়েন করেছো। ইতোমধ্যে আমি খেয়াল

করেছি তোমার মাঝে কিছু এক্সেপশনাল কোয়ালিটি আছে যেগুলো আমাকে ভীষণরকমের মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে তোমার

আল কোরআন থেকে উদ্বৃতি,যুক্তি

দেবার গুণাবলিটা অনন্য। যদিও আমাদের সংবিধান হচ্ছে সেকুলার আইনে মানবরচিত সংবিধান তাই আইনগতভাবে

মহামূল্যবান ঐ আয়াতসমূহকে মূল্যায়ন করা

হয়না তবুও তোমার শেষ দিনের যুক্তি উপস্থাপন করাটা অসাধারণ ছিলো। তা এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। জানো, বিচার

কার্জ পরিচালনা করে আমি কখনওই সুখী

নই। আমি প্রত্যহ অফিসে আসার পর প্রথম কর্মসূচি হলো আল কোরআন তেলাওয়াত করা অথচ প্রতিনিয়ত

সাংবিধানিকভাবে যে রায় আমাকে ঘোষণা করতে হয় তা

হয় আল্লাহ প্রদত্ত সংবিধান বিরোধী। আমি এ বিষয়ে ভীষণরকমের অস্বস্তি অনুভব করি সমসময়।

যাইহোক, তোমার মূল্যবান সময়ক্ষেপণ করে ফেলছি। তোমাকে মূলত যেজন্য ডেকেছি তা হলো….।’ অনেক্ষণ যাবৎ কথা

বললেন দু’জনা। বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিচারপতি

মহোদয় মানুষটি অতি কঠোর। আসলে কঠোর নন ন্যায়পরায়ণতায় স্পাতকঠিন দৃঢ় অবস্থানে থাকেন তিনি। তাই মানুষটিকে

প্রথম দেখলে মনে হবে খুবই

রুক্ষপ্রকৃতির। আসলে এটা আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি যে, যখন কারও মতামত আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী হয় তখন

স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তিটিকে ঘিরে আমাদের বিরূপ

প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়; যদিওবা তার সিদ্ধান্ত হয় সঠিক। তেমনই একজন মানুষ উনি। বাইরে থেকে দেখতে যতটা রুক্ষমেজাজী

ভিতরথেকে ততটাই কোমল মনের মানুষ।

যদি কেউ উনার একান্ত সাহচর্য পায় তবে সে অনুধাবন করতে পারবে সেটা। কথায় কথায় উনার মনের কোণে জমে থাকা

কষ্টগুলো বের হয়ে আসলো চোখ বেয়ে নেমে

আসা নির্ঝরধারা হয়ে। জাহিদ সাহেব অবাক হয়ে গেলেন উনার শিশুসুলভ সরলতা, কোমলতা আর ন্যায়ের সৌধের চূড়ায়

আরোহণের অনুপম ব্যক্তিত্ব উপলব্ধি করে।

উনি জাহিদের কাছে কয়েকটি হৃদয় আন্দোলিত করা কষ্টের কথা শেয়ার করলেন এবং তা উত্তরণে ওর সাহায্য চাইলেন।

জাহিদ ও তাকে আশ্বস্ত করে রুম ত্যাগ

করলেন।

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি জেলার অন্যতম আসনের সংসদসদস্য হয়েছেন ফরিদ- উর- রশিদ চৌধূরী। ডাকনাম ফরিদ

চৌধূরী। এমনিতে সরল মনের মানুষ

হলেও তিনি মানুষের কাছে অত্যন্ত দাম্ভিক, অহংকারী এবং অত্যাচারী হিসেবে পরিচিত। সাধারণ মানুষ উনার আশ্রিত

মাফিয়াগোষ্ঠীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ। স্থানীয়

জনগণের কাছে ঘৃণ্য হিসেবে পরিচিত হওয়ার মতো এমন কোনো ন্যক্কারজনক কাজ বাকি নেই যার নেপথ্যে উনার নাম

জড়িত নেই। অথচ তিনি নিজে কখনওই এসব

করেন না বা করার প্লানে থাকেননি কিন্তু উনার চারপাশে দলীয় যেসমস্ত মানুষ আছে তারা এমপির নামে ক্ষমতার অপব্যবহার

করে লুটেপুটে খাচ্ছে আর তাদের আশ্রয়

এবং প্রশ্রয়দাতা হবার কারণে বোকা এমপি তার ভাবমূর্তি নষ্ট করে বসে আছেন। কিন্তু বিশাল অর্থের বদৌলতে উপরমহলে

তার ভালো লবিং থাকায় অযোগ্য এবং

জনগণের সমর্থন না থাকার পরও জনগণের সংসদীয় প্রতিনিধি হিসেবে তিনি একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছেন।

আজ সকাল থেকে বিকাল অবধী এমপি কার্যালয়ের সামনে লম্বা লাইন লেগেছিলো তাঁর ব্যক্তিগত সচিব (পি, এস) নির্বাচনের

জন্য। সাক্ষাৎকার সম্পন্ন হলো কিছুক্ষণ

আগে। এমপি সাহেবের পছন্দানুযায়ী সচিব হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে একটি অল্প বয়স্ক ছেলেকে। সুদর্শন যুবকটিকে পছন্দ

করেছেন উনি নিজেই। উনার যুক্তি হলো,

আগে দেখবিচারী পরে গুণবিচারী। অবশ্য গুণ বা যোগ্যতাতেও ছেলেটি কোনো অংশে কম নয়; আইনবিভাগ থেকে দেশের

সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত

করা উচ্চশিক্ষিত ছেলে সে। বহুমুখী যোগ্যতাবলেই চাকরিটা পেয়েছে ছেলেটা। তাকে ব্যক্তিগত পি, এস হিসেবে পেয়ে ভীষণ

খুশি ফরিদ চৌধূরী। কারণ মাঝেমাঝেই

উনি আইনি জটিলতায় জর্জরিত হন আজ তা থেকেও উত্তরণের সহজ একটি মাধ্যম পেয়ে গেলেন উনি।

সেদিন গল্পেগল্পে তিনি বলে ফেললেন কথাটা, যে, জাহিদ আইনের ছাত্র ছিলো তাই আইনি বিষয়টা নিয়ে ভাবনাটা কমে যাবে

আমার। একথা শুনে উনার একজন

শুভাকাঙ্খী জাহিদকে দেখিয়ে বলছিলেন,

– ‘এমপি সাহেব, ওতো আর উকিল টুকিল না যে আপনাকে আইনি ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটে সাহায্য করবে।’

তার কথাশুনে সিগারেট ধুম্র ছাড়তে ছাড়তে এমপি সাহেব বললেন,- ‘আরে ধুর! আমার কি বড়বড় উকিল- মোক্তারের অভাব

আছে? এই জেলার সকল সিনিয়র উকিল

আমার পকেটে থাকে। জাহিদ ছেলেটা বেশ ভালো। অফিসের সবকাজগুলো সুচারুরূপে করছে। ও আর কিছু পারুক বা, না

পারুক আইনের ছাত্র হিসেবে একটু আধটু

বুদ্ধি তো দিতে পারবে।’

‘তা আপনি ঠিকই বলেছেন। এক খরচে দুই কাজ আরকি। হা হা হা।’

এমপি সাহেব ও যোগ দিলেন সে হাসিতে।

কিছুদিন পরের কথা। ফরিদ চৌধূরী খেয়াল করলেন ইদানীং উনার অফিসের ছোটখাটো পরিবর্তন আসছে। প্রতিদিন নতুন

করে বদলে যাচ্ছে পরিবেশ। অফিসে আসার

পর কেমন যেন নতুন সাজে সজ্জিত মনে হয়।

উনার কার্যালয়ের গেটের পাশের ফুলগাছের টব থেকে শুরুকরে অফিস রুমের অভ্যন্তর পর্যন্ত পেয়েছে টুকটাক পরিবর্তনের

স্পর্শ।’

উনি খানিকটা চিন্তা ভাবনা করে এর উৎস খুঁজতে লাগলেন। মনে পড়লো এমন রূপান্তরের প্রথম দিনের কথা যেদিন উনার

ডেস্ক বরাবর সামনের দেয়ালে যেখানে

ওয়ালমেট হিসেবে মোনালিসার একটি দামী পেইন্টিং ছিলো সেটার বদলে একটা সুদৃশ্য মসজিদের পেইন্টিং দেখতে

পেয়েছিলেন। সেজন্য বেশ অবাক হয়েছিলেন

সেদিন। ভাবছিলেন এমনটা কে করল তার অনুমতি ছাড়া!

তাছাড়া ফরিদ সাহেব মনে করেন রাজনীতির মধ্যে ধর্মটেনে আনা ঠিক নয়। তাই এসব মসজিদ- মাদরাসা বাসায় মানায়,

অফিসে নয়। জনগণের নেতার অফিসের

সৌন্দর্যকরণে সর্বসাধারণের জন্য সমান অগ্রাধিকার থাকা উচিৎ। তাই এগুলো তার ভালো লাগেনা, এর মধ্যে কেমন

সাম্প্রদায়িকতার উৎকট গন্ধ খু্ঁজে পান উনি। আর

ফরিদ সাহেব মনে করেন ধর্মকর্ম তারা করবে যাদের কাজকাম নেই। অযথা সুস্ত শরীরকে ব্যস্ত করতে তার একদম ভালো

লাগেনা।

একথাটা জাহিদের সামনে বলার পর জাহিদ যুক্তি আর বাস্তবতা দিয়ে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলো যে, এটার মাধ্যমে

কোনভাবেই অন্যধর্মালম্বীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা

হয় না বরং নিজের জাতীয়তাকে সম্মান, শ্রদ্ধা করার অনুপম দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হয়। আর যে নিজের ধর্মকে সম্মান করে

মান্য করে, পালন করে অন্যান্য ধর্মালম্বীরা

কেবল তার কাছ থেকেই সুবিচার পেতে পারে। স্যার, যে নিজের ধর্মই মানেনা তার কাছ থেকে অন্য ধর্মালম্বীরা তার কাছে কি

আশা করতে পারে বলুন!’

‘আর ধর্মকর্ম বলতে আপনি বিশেষ করে নামাজের কথা বলছেন, তাই না স্যার?’ -সহাস্যমুখে বলেছিলো জাহিদ। এমপি সাহেব

মাথানেড়ে দিয়ে বলেছিলেন,-‘হ্যাঁ।’

– ‘আসলে স্যার, আপনি তো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন না সেজন্যই এমনটা বলছেন। আপনি সপ্তাহান্তে একদিন

জুম্মার নামাজ পড়েন। আমি খেয়াল করেছি

নামাজ শেষ না হতেই আপনি বের হয়ে যান তাই নামাজ কী তা বোঝেন না। আমি বলি কি স্যার, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়

করতে শুরু করুণ তখন খেয়াল করবেন

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখ আল্লাহ্ নামাজের মধ্যেই রেখেছেন। যখনই মন অনেকবেশি খারাপ হবে মনকে স্থির করে একাগ্রতার সাথে

নামাজে দাঁড়িয়ে যাবেন দেখবেন স্রষ্টা

আর সৃষ্টির অপূর্ব মিলনের মাঝে কষ্টের লেশমাত্র থাকবে না। সব মন খারাপ বিলীন হয়ে যাবে আর মন ভরে যাবে অনন্য

ভালোলাগার আবেশে।’ আরও কিছু বাস্তব্য

উদাহরণ আর যুক্তি দিয়েছিলো জাহিদ।

জাহিদের অখণ্ডনীয় যুক্তির উপর তিনি আর পাল্টা যুক্তি দাঁড় করাতে পারেননি।

তারপর দিনের কথা, সেদিন উনার মনটা বেশ ফুরফুরে ছিল। অফিসে বসেই পেইন্টিংটার দিকে খেয়াল গেলো। তিনদিক দিয়ে

সমুদ্রের নীল জল বেষ্টিত একটা স্থানে

একটা মসজিদ উঁচু উঁচু চারটে মিনার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন কতশত স্মৃতির সাক্ষ্যবহণ করছে; এই দৃশ্য অবলোকন করে

মনটা ভীষণ শান্ত, শীতল হয়ে গেলো। উনি

গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলেন, ওখানে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতে পারলে কি সত্যিই হৃদয় ঠাণ্ডা হয়ে যাবে? হয়ত যাবে,

জাহিদ যখন বলেছে তখন মিথ্যা নয়।

এবং আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, প্রথমবারের মতো তাঁর মনে হয়েছিলো মোনালিসার ঐ দামী পেইন্টিংটাতে কেমন একটা

একঘেয়েমিতার স্পর্শ মিশে ছিলো।

তারপর একে একে যতগুলো পরিবর্তন হয়েছে সবগুলোই অফিসের শ্রী বৃদ্ধি করছে। সবাই তার প্রশংসা করছেন। উনি

খোঁজনিয়ে জেনেছেন যে এগুলো সবই

জাহিদের কাজ। অন্যসময় হলে উনি হয়ত অগ্নিমূর্তি হতেন কিন্তু এসময় রাগ করতে পারছেন না বরং মিষ্টি ছেলেটার

সহাস্যমুখখানা ভেসে উঠতেই কেমন জানি

ভালোলাগা সৃষ্টি হলো মনে।

ব্যস্ততায় জাহিদের সাথে একান্ত কথাবলা হয়েছে খুব কমই কিন্তু যতটুকু কথা বলেছে ততটুকুতেই বুঝতে পেরেছেন এ কোনো

সাধারণ ছেলে নয়, অনেক সম্ভাবনা

লুকিয়ে আছে ওর মাঝে। তাছাড়া ছেলেটা খুবই ধার্মিক। আগে জাহিদ দেখতো বেশিরভাগ ধার্মিক মানুষেরা আনস্মার্ট হয় কিন্তু

ওঁর জীবনে দেখা দ্বিতীয় ব্যক্তি জাহিদ যে

ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও ওভারস্মার্ট ছেলে। জাহিদ এতো সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে যে উনি যতই শুনেন ততই শুনতে

ইচ্ছা করে। কাজেকর্মে ও নিঁখুত, আর

অন্যরকম স্বচ্ছতা রয়েছে তাই এমন সজ্জিতকরণে মনেমনে খচখচ করলেও উনি জাহিদকে আর কিছুই বলতে পারেননি।

কেমন যেন একটা দুর্বলতা এসেছে ছেলেটার প্রতি। এক অন্যরকম মায়াময় পবিত্র মুখাবয়ব তার। আর একটা বিষয় হলো ওর

মুখের দিকে তাকালে উনার শ্রদ্ধেয়

পিতার কথা মনে পড়ে যিনি দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়ার কারণে ফরিদ সাহেবের সাথে সুসম্পর্ক রাখেননি। পিতার ছাপ

দেখতে পায় বলেই ও আজ পর্যন্ত জাহিদের

সাথে শক্তস্বরে কথা বলেননি।

এরই মাঝেই ঘটেগেছে একটি অন্যরকম ঘটনা। সেদিন তুরস্কের অ্যাম্বাসেডর এসেছিলেন শহরে এবং ঘটনাক্রমে এমপির

কার্যালয়েও এসেছিলেন তিনি। ফিরে যাওয়ার

সময় একপর্যায় উনি বলেই ফেলেছেন যে, ইতোপূর্বে উনি বাংলাদেশের যতগুলো পার্লামেন্টারিয়ানের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন

এবং তাদের অফিসে যাওয়ার সৌভাগ্য

অর্জন করেছেন তার কোনোটিতেই এমন ইসলামিক সংস্কৃতবহুল করে মনোমুগ্ধকরভাবে সজ্জিত করা দেখিনি। অথচ এটি

ইসলামি বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ তাই

প্রতিটি অফিসকক্ষ এমনটাই প্রত্যাশিত। তাই এখানে এসে উনি পরিতৃপ্ত হয়েছেন বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

ঘরেবাইরে এ নিয়ে আলোচনা- সমালোচনা ও হচ্ছে কয়েকদিন ধরে। অনেকে বলছেন, যার কুকীর্তি ছাপতে ছাপতে

সাংবাদিকগণ ক্লান্ত আজ তারই ভূয়সী প্রশংসা

করলেন একজন প্রভাবশালী মুসলিম কূটনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রদূত।

কোনকোনো বিরোধী দলীয় নেতারা এ নিয়ে ঠাট্টা- মশকারা, ট্রল করলেও বৃহত্তর মুসলিম জনগণের মুখে ছিলো ভিন্ন কথা।

অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করার পরও তারা এই

ঘটনাটিকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। তারা মুখেমুখে বলতে আরম্ভ করেছেন যে, আল্লাহ্ হয়ত এমপি সাহবকে হেদায়েত

করেছেন। তার সুযোগ্য পিতার আদর্শের

পথে হয়ত তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন এবার। অনেকে আল্লাহর কাছে দোয়াও করছেন উনার জন্য। বিদেশী রাষ্ট্রদূতের এমন

মন্তব্য এবং জনগণের কথায় অশ্রুসিক্ত

হয়ে গেলেন তিনি। জাহিদের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হতে লাগলো অবচেতন অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ।

বেশকয়েকদিন পরের কথা। আজ সকাল থেকে এমপি সাহেব ভীষণ চিন্তিত এবং ক্রোধান্বিত। ভোর হতেই কয়েক জায়গা

থেকে ফোন এসেছিলো উনার কাছে।

সীমান্তবর্তী এলাকায় আধিপত্যবিস্তারকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাশীল পক্ষের লোকের সাথে বিরোধী পক্ষের তুমুলঝগড়া, গণ্ডগোল

হয়েছে। এতে এমপি গ্রুপের অনেক

মানুষ আহত হয়েছে। গুরুতর আহতাবস্থায় একজন প্রভাবশালী নেতা এমপি সাহেবের পি, এস এর কাছে ফোন দিয়ে অবস্থা

জানিয়ে দেয়। এও জানায় ওদের যে ওদের

গ্যাং এর সবাইকে খবর দেওয়া হয়েছে। অল্পকিছু সময়ের মধ্যে তারাও পৌঁছাবে স্পটে।

ওদের প্লান, প্রস্তুতি সবকিছু ঠিকই ছিলো। বিরোধীরাও নিজেদের প্রস্তুত করেছে পাল্টা জবাব দিতে। বিশাল একটি এলাকাজুড়ে বাঁজতে চলেছে গ্যাঞ্জাম মারামারি, শক্তি

প্রদর্শনীর দামামা, দুটি দল যখনই দ্বিতীয়বারের মতো মুখোমুখি সংঘর্ষে যাবে ঠিক সেই সময় একেবারে চূড়ান্ত মুহূর্তে মাত্র

একগাড়ি পুলিশ নিয়ে সেখানে হাজির হয়

জাহিদ। নিজেদের দলীয় লোকজনকে বোঝায় যে, এমপি সাহেবের অর্ডার যে, তার দলের একটি মানুষ ও যেন আর মারামারি

না করে। একথা শুনে সিংহভাগ লোকই

থেমে গেলো; নেতার রাগান্বিত মুখখানা কল্পনা করে আর সামনে এগোতে সাহস করলো না কেউ। অল্পকিছু মাফিয়া দলের

সদস্য এ কথা মানতে না চাইলেও জাহিদের

দৃঢ়তার কাছে হার মেনে ফিরে যেতে বাধ্য হয় ঘটনাস্থল থেকে। এদের প্রস্থান দেখে বিরোধীরাও আর এগোয়নি। তখন জাহিদ

সাথে কিছু মানুষ নিয়ে হতআহত

মানুষদেরকে ফাস্টএইড দিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে করে হসপিটালে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে থাকে।

এঘটনাটা নাড়িয়ে দিয়েছে পুরোদেশকে। প্রাথমিকভাবে ফরিদ-উর-রশিদ চৌধূরী তার দলীয় হাইকমাণ্ড থেকে অনেকচাপে

পড়েছিলেন জাহিদের নির্বুদ্ধিতার কারণে।

মারামারিতে তাদের দলের অনেক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়েছে আর সেজন্য জেলা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দরা এমপি সাহেবকে

দোষারোপ এবং তিরস্কার করেছে কেন্দ্রীয়

নেতাদের কাছে। বিশেষ করে এই সংসদীয় আসনের অন্যান্য যারা নমিনেশন প্রার্থী ছিলো কিন্তু মনোনীত হতে পারেনি তারা

সুযোগ পেয়ে তারা কুৎসা রটিয়ে বেড়াচ্ছে,

বলে বেড়াচ্ছে যে এমপি সাহেব নাকি তাদের মাথা হেট করে দিয়েছে। এখন থেকে সাধারণ জনগণ তাদের দলকে ভীতু,

ভিজেবিড়াল ভাববে।

সেজন্য শুধু জেলা নয় কেন্দ্র থেকে ও সমালোচনার ফিসফিসানি শুনতে পারছেন উনি। জবাবদিহিতা করতে বলা হয়েছে কেন

ক্ষমতাসীন দলের এমপি হয়েও শক্তি

প্রদর্শন করা হয়নি?

সেদিন সন্ধ্যার কথা। এখনো চলছে দলীয় কোন্দল। এর মাঝে কিছু অন্যরকম গুঞ্জনও ভেসে আসছে ফরিদ-উর-রশিদ

চৌধূরীর কানে। যাইহোক, উনি সবকিছু সত্ত্বেও

মাথাটা ঠাণ্ডা রেখেছেন। কিছুক্ষণ পর জাহিদের আসার কথা রয়েছে। ও আসলে সবকিছু জানা যাবে, ওর উপর উনার সীমাহীন

আস্থা রয়েছে। তাই উনি ওর আসার

অপেক্ষা করছেন।

আজ সারাদিন ও ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে যারা অসুস্থ হয়েছে তাদের সেবা, শুশ্রূষার ব্যাপারটা দেখতে। সারাদিনে ওর সাথে মাত্র

দুইবার কথা হয়েছে ফরিদ সাহেবের। তাও

শুধু এটা বলতে ফোন দিয়েছিলো যে উনি যেন ডাক্তারদের বলে দেন, রুগী যেই হোক সর্বোত্তম সেবা থেকে কেউ যেন বঞ্চিত

না হয়। সবার দায়িত্ব উনি নিবেন।

ফরিদ সাহেব জানেন যে আজ ছেলেটা অক্লান্ত পরিশ্রম করছে আর উনি যে চাপের মধ্যে রয়েছেন তার কিছুটা ওর উপর

দিয়েও যাচ্ছে। তবুও কথাবলার সময় ওর কণ্ঠে

বিন্দুমাত্র ক্লান্তি, ভয়ার্তভাব, অথবা অনুশোচনাবোধ কিছুই ছিলো না। ফরিদ সাহেব ভাবলেন ওর কণ্ঠে ভয়ার্ততা, অনুশোচনা

এগুলো থাকাটায় স্বাভাবিক ছিলো কিন্তু না

থাকাটার মাঝে কেমন যেন আশাতীত প্রাপ্তির লুকোচুরি আছে। উনি সবকিছু চুপচাপ দেখতে লাগলেন। অপেক্ষা করতে

লাগলেন চূড়ান্ত পরিণতির।

এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলো পরদিন সকালবেলা। এমপি ফরিদ-উর-রশিদ সাহেবের ঘুম ভাঙলো একজন মন্ত্রীর ফোনকলের

শব্দে। অভিনন্দন জানিয়ে কয়েকমিনিট

কথাবলার পর ফোন রাখলেন উনি। বিস্ময়ে থ হয়ে গেলেন ঘটনার আকস্মিকতায়। এক অদ্ভুত শিহরণ ঢেউখেলে গেলো

উনার শরীরে। কেমনে কি ঘটলো উনি এখনো

ভালোভাবে বুঝতে পারেননি। মন্ত্রী মহাদয় শুধু বললেন, ‘আজ আপনার বিচক্ষণতা এবং মহানুভবতায় সারাদেশে আমাদের

দলের ভাবমূর্তি অভাবনীয়ভাবে বৃদ্ধি

পেয়েছে। দ্যাটস গ্রেইট! কংগ্রাচুলেশনস!’

ফরিদ সাহেব তো সেইরকম অবাক হয়ে গেলেন। ভাবতে লাগলেন, এইতো গতরাত্রেও দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের মধ্যে

কয়েকজন ভৎসনা করলেন কিন্তু আজ স্বয়ং

একজন মিনিস্টার ঘুমথেকে জাগিয়ে অভিনন্দিত করছেন! কিন্তু ঘটলোটাই বা কি?’

ছোট্টছোট্ট পায়ে এগোতে লাগলেন ঝুলবারান্দার দিকে। ওদিক থেকে ভেসে আসা বাতাসের মাঝে যেন মৃদু কোলাহলের শব্দ

মিশে আছে। তাকালেন সেদিকে, দেখলেন

জেলার পরিচিত কিছু মুখ তার বাসভবনের দক্ষিণমুখী করিডোর দিয়ে হেঁটে আসছেন। তাদের সবার হাতে ফুলেরতোড়া।

গতকাল যারা তিরস্কার করেছিলো তাদের

মধ্যেও দুএকজনকে যেন দেখা যাচ্ছে সবার সাথে। এ যেন আরেকটি বিস্ময়। উনি এই উৎকণ্ঠা আর নিজের মধ্যে বেশিক্ষণ

চেপে রাখতে পারলেন না। হন্তদন্ত হয়ে

তাদের দিকে ছুটলেন আসল ঘটনা জানার অভিপ্রায়ে।

এমপি সাহেবের কার্যালয়। নিজের ডেস্কে মনমরা হয়ে বসে আছেন ফরিদ-উর-রশিদ চৌধূরী। উদাস দৃষ্টিতে মাঝেমাঝে ভেসে

উঠছে জাহিদের মুখখানা। তাই একটু

পরপর দেয়ালে টাঙানো ওয়ালমেটগুলোর দিকে তাকাচ্ছেন উনি। সেখানে লেগে আছে ওর স্মৃতি। খুববেশি মনে পড়ছে ওর

কথা। ছেলেটা কেমন যেন অদ্ভুতরকমের

ভালো। যেন আসলো, সবকিছু জয় করে নিয়ে চলে গেলো আর ফেলে রেখে গেলো অসংখ্য স্মৃতি।

আজ চারিদিক থেকে ভেসে আসছে এমপি সাহেবের জয়জয়কারধ্বনী কিন্তু এ জয়ের যে নায়ক সে নিজেই থেকে গেলো

পর্দার অন্তরালে।

একটা মারামারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটে গেছে মানুষের হৃদয় জয়ের বিপ্লব। কয়েকদিন আগেও যারা এমপি সাহেবকে ভয়

করত, গালি দিত, অত্যাচারী বলত আজ

তারাই তাঁর গুণগান করছে, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছে দোআ করছে উনার জন্য, উনার পিতার জন্য। দলীয়

হাইকমাণ্ডও এমন বিপ্লব ঘটাতে বিচক্ষণতার সাক্ষর

রাখার কারণে বাহবা দিচ্ছে তাঁকে। কিন্তু উনার কাছে এখন এগুলোকে অর্থহীন মনে হচ্ছে।

এমপি সাহেব আর জাহিদ ছাড়া পৃথিবীর কেউ জানেনা এ জয়ের সর্বাধীনায়ক ছিলো জাহিদ আর তাতে বিন্দু মাত্র প্রত্যক্ষ

অবদান ছিলোনা এমপি সাহেবের। তাই উনি

একাকী বসে বসে ভাবছেন যে কি ছিলো আর কি ঘটে গেল! সাধারণ মানুষ এতো অল্প ভালোবাসা পেলেও যে এতো খুশি হয় তা

উনি আজ রিয়ালাইজ করলেন।

আবার নতুন করে মনে পড়ল সেদিনের কথা যেদিন একজন মন্ত্রী ফোন করার পর বাসাভর্তী লোকজন, নেতাকর্মীরা এসে

শুভেচ্ছা অভিনন্দন এবং সংবর্ধনা জানাতে

এসেছিলো। ঘটনার বর্ণনা শুনে আকস্মিকতায় সাময়িকভাবে স্তব্ধ হয়ে গেছিলেন তিনি। প্রথমত তুরস্ককের সম্মানিত রাষ্ট্রদূত

এসে সাংবাদিকদের যে বার্তা দিয়েছিলেন

তাতে প্রথমবারের মতো জনমনে উনার সম্পর্কে একটা পজেটিভ ধারণা জন্মেছিলো এবং তার প্রতিক্রিয়ার তীব্র বিস্ফোরণ

ঘটেছিলো বিরোধী দলের সাথে মারামারি

বন্ধের জন্য অনবদ্য ভূমিকা রাখা এবং দলমত নির্বিশেষে সবাইকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায়। এমনকি সেদিন জাহিদ

নিজে এমপি সাহেবের ব্যক্তিগত গাড়িতে

করেও আহতদের হসপিটালে নিতে সাহায্য করে যার মধ্যে ছিলো বিরোধী দলীয় কয়েকজন মুমূর্ষু ব্যক্তিও।

সবচাইতে আলোচিত ঘটনা ঘটেছে হসপিটালে। এতোগুলো মানুষের মধ্যে ডাক্তাররা সরকারদলীয় লোকদের দেখে দেখে

চিকিৎসা দিচ্ছিলেন তখন জাহিদ এমপি

সাহেবকে অনুরোধ করেন যে উনি যেন ডাক্তারদের বলেন অসুস্থ রুগী যে বা যারাই হোক না কেন কারও যেন চিকিৎসা, সেবা

শুশ্রূষায় ত্রুটি না হয়। তাছাড়া কোথাও

যেন কোনোরূপ বৈষম্য সৃষ্টি না হয় সেদিকটা নিজে উপস্থিত থেকে সম্পাদন করেছে জাহিদ। কিন্তু দিনশেষে পরিশ্রান্তবদনে

বের হয়ে আসার সময় সাংবাদিকদের

প্রশ্নের জবাবে জাহিদ সব ক্রেডিট দিয়ে আসে এমপি ফরিদ-উর-রশিদ চৌধূরিকে।

এমপি সাহেবের এই মহানুভবতা দেখে চোখে জল চলে আসে বিরোধীদলীয় সকল মুমূর্ষু ব্যক্তিদের। কিন্তু এ বিষয়টা নিয়ে

প্রথমত জেলার সরকার দলীয় নেতৃবৃন্দ

ভ্রুকুটি আর ভৎসনা করেছিলো এমপি সাহেবকে। কেউ কেউ বলেছিলো দরদ যেন উতলে উঠছে। অবশেষে সবার ধারণা

বদলে যায় যখন হিংসা, স্বার্থপরতার যুগে

এমন মহানুভবতার কথাগুলো শান্ত বাতাসের সাথে ভেসে ভেসে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। সাধারণ মানুষের মুখে মুখে তখন

কিছুদিন থেকে লেগে ছিলো এমপি

সাহেবের সুনাম, সুখ্যাতি। সেসময় একদিন আগেই ফোড়ন কাটছিল যারা উল্টো তারাই উনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছিলো।

এলোমেলো ভাবনার সমাপ্ত হলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন উনি। তারপর একটা চিঠি বের করলেন ড্রয়ার থেকে। সযত্নে

তাতে হাত বুলাতে লাগলেন। জাহিদের

কথাগুলো এখন আরও বেশিবেশি মনে হতে লাগলো। ছেলেটা এভাবে পরিবর্তন করে দিয়ে হারিয়ে যাবে তা ভাবতেও পারেননি

উনি। এইসব ঘটার দু’দিন পরে এই

চিঠিটা আর একটা গিফট প্যাক উনার ডেস্কের উপরে রেখে কোথায় চলে গিয়েছে জাহিদ।

চিঠিতে ও লিখেছে, ”প্রিয় স্যার, আপনার উপস্থিতির সংবাদ শুনে গতকালের বিশাল জনসভা যেন জনসমুদ্রে পরিণত

হয়েছিলো। তো, সেখান থেকে ফেরার পথে

আপনি আমার কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন,- ‘জানো জাহিদ, এর আগে কখনো আমি আমার জনসভায় এতো লোক দেখিনি

আর তাদেরকে এতো উৎফুল্ল অবস্থায় দেখা

তো অনেক দূরের কথা। এ আমার জন্য বিশাল সৌভাগ্যের। আর এসবকিছুই তোমার বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতার জন্যই হয়েছে।’

সেদিন আমি আপনার প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারিনি। চুপ ছিলাম। আজ বলছি,- ‘সেদিন জনগণ আমার জন্য নয়,

এসেছিলো আপনার ভালোবাসার জবাব দিতে।

স্যার, মানুষের জন্য কিছু করলে, ভালোবাসলে, সুখে দুঃখে পাশে এসে দাঁড়ালে তা কখনো বৃথা হয় না বরং তাদের যতটুকু

দিবেন তার চেয়ে অনেকবেশি ফিরে আসবে

অকল্পনীয় প্রাপ্তি হয়ে। সেদিনের জনসভা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। তাছাড়া আপনি একজন জনপ্রতিনিধি আপনার জন্য তো

সর্বপ্রকার মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো ফরজে

আইন। যদি না দাঁড়ান তবে এর জন্য কঠিন কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার কাছে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে। প্রিয়,

আর একটা কথা, আপনার চারপাশে

যেসমস্ত ব্যক্তবর্গ থাকে তাদের পরামর্শ যদি আপনি বুদ্ধিদীপ্ততার সাথে যাচাই না করেই গ্রহণ করেন তবে জাহান্নামে যেতে

ওরাই আপনার সহায়ক হয়ে যাবে। তাই হয়

ওদের পরামর্শ যাচাই করা উচিৎ নয়ত আগে নিজেকে বদলে নিয়ে পরে ওদেরকেও আলোর পথ দেখাতে হবে। সেক্ষেত্রে

দ্বিতীয়টিই উত্তম।

আর আপনি একদিন সুখী হওয়ার সহজ উপায় জানতে চেয়েছিলেন। তার উত্তরটা পরে দিব বলেও আর বলা হয়নি, আজ তা

বলার প্রয়োজন অনুভব করছি। স্যার,

কোনো জনপ্রতিনিধির জন্য উচিৎ নয় নিজের জন্য সুখ কামনা করা। তাদের উচিৎ শান্তি কামনা করা। এমন উত্তরে অবাক

হচ্ছেন তাই না? হবারই কথা। আমি বলতে

চাচ্ছি যে, সুখ হচ্ছে ব্যক্তিগত চাওয়া। এর পরিধি ব্যক্তি থেকে সর্বোচ্চ হলে পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অল্প কথায় শুধু মাত্র

নিজেই অথবা পরিবার পরিজন নিয়ে ভালো

থাকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হওয়াকেই সুখ বলা হয়। আর শান্তি বলা হয় একটি এলাকা, জনপদ, অথবা সমাজের

সমষ্টিগতভাবে সকলের সুখে থাকা বা ভালো

থাকার সর্বোচ্চ পর্যায়কে।

কিন্তু একজন জনপ্রতিনিধির পরিবার বলতে শুধুই তাঁর আত্মীয়- স্বজনকে বোঝায় না বরং তার কেয়ারটেকার অঞ্চলের প্রতিটা

মানুষই তার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তাই

নিজের সুখ কামনা করলে বঞ্চিত করা হবে অন্যান্য সকল মানুষকে। তাই এমন বিশ্লেষণী চিন্তা ভাবনা অবশ্যই থাকতে হবে

একজন মুসলিমের মনে প্রাণে বিশেষ করে

আপনাদের মতো শাসক গোষ্ঠীর।

প্রিয় স্যার, আমি খুবই দুঃখিত এমন অগোছালো চিঠি লেখা আর অনুমতি ছাড়া চলে আসার জন্য। অনিবার্য কারণবসত আমি

আপনাকে বলে আসতে পারলাম না আর

এই অল্প কদিনে আপনার উপর যে মায়া জমেছে তা বিচ্ছিন্ন করে আপনাকে বিদায় দেওয়া আমার জন্য সহজ ছিলো না; এটা

আমার দুর্বলতা ছিলো সেজন্য দয়াকরে

ক্ষমা করবেন। তবে ইনশাআল্লাহ্‌ খুব শীঘ্রই আবার দেখা হবে যদি দেখি আমার প্রিয় মানুষটা আমার ভালোবাসার মূল্য

দিয়েছেন আমার অনুরোধগুলো রেখেছেন। তবে

আসব, হ্যাঁ আসব অন্য পরিচয়ে; অন্যভাবে আর আমার কাঙ্খিত অসমাপ্ত মিশনটা সমাপ্ত করতে।

আল্লাহ্ আপনাকে খলিফা হযরত ওমর (রা) -এর মতো ন্যায়, নিষ্ঠাবান শাসক হওয়ার তাওফিক দাণ করুণ। আমিন

ইতি
আপনার ছোট ভাই
জাহিদ”

এই চিঠিটার সাথে দৃষ্টিনন্দন একটা জায়নামাজ গিফট করেছে জাহিদ। আর জায়নামাজের সাথেও একটা চিরকুটে লিখেছে যে

ওকে কখনওই না খুঁজতে, সময় হলে ও

নিজেই আসবে। আর ও সবচাইতে খুশি হবে উপরন্তু কথাগুলোর বাস্তবায়নের সাথেসাথে তার দেওয়া ছোট্ট গিফটটির

সদ্ব্যবহার করলে।’

পড়াশেষ হয়েছে কতক্ষণ আগে। চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো ফরিদ সাহেবের। বাম হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছলেন জমে

থাকা পানিটুকু। উনার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে

একটা কথাই প্রতিধ্বনীত হতে লাগলো যে, কোনো স্বার্থ ছাড়াই একটা অচেনা, অজানা মানুষ এসে তাকে এমন পরিবর্তন করে

দিয়ে গেলো! আর বেঁধে রেখে গেলো

অদৃশ্য এক মায়ার বাঁধনে। সৃষ্টি করে রেখে গেলো এক অখণ্ডনীয় ধাঁধাঁ।

উনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। একবার প্রাণ ভরে শ্বাস নিলেন তারপর মখমলের তুলতুলে জায়নামাজটা হাতে নিয়ে

একবার আকাশপানে তাকিয়ে মনেমনে কিছু

একটা সঙ্কল্প করতে করতেই বাইরের দিকে পা বাড়ালেন। যা জানেন শুধু তিনি আর তার আল্লাহ্।

আলহামদুলিল্লাহ্‌ !!!
……………………………………………………সমাপ্ত…………………………………………………..

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত