রফিক সাহেব সরকারী ব্যাংকে ছোট একটা কেরানীর চাকরী করে। স্ত্রী আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তার অভাবের সংসার। ছেলে
বড় ক্লাস টেনে পড়ে আর মেয়ে এবার
ক্লাস সিক্সে উঠলো।কাল রাত থেকেই স্ত্রীর সাথে ঝগড়া। কারণ একটাই পাওনাদার। এক মাস আগে তিনি পাওনাদার দের কাছ
থেকে বারো হাজার টাকা ধার
নিয়েছিলেন। ছেলেমেয়ের বেতন,বই কেনা আর বাজার সদাই এর জন্য। ধার এখনো পরিশোধ না করায় রোজ রোজ পাওনাদাররা
এসে বাজে ভাষাতে কথা বলে যায়।
রফিক সাহেবের স্ত্রী এতে বিরক্ত। এদিকে বারিয়ালার ভাড়াও বাকী।
ছা পয়সার কেরানী এই অল্প বেতন দিয়ে ঢাকা শহরের মতো জায়গাতে কিভাবে থাকবে। সকাল থেকেই উনার মন মেজাজ
খারাপ। নাস্তা না করেই অফিসের উদ্দেশে
রওনা হয়। ঢাকা শহরে জ্যামের কারণে দেরী করে অফিসে ঢুকে। হাজিরা খাতাই নিজের নাম লিখার সময় বসের কাছে ঝারি।
বসঃ প্রতিদিন দেরী করে অফিসে ঢুকা আপনার মনে হয় স্বভাব হয়ে গেছে রফিক সাহেব।
রফিক সাহেবঃ না স্যার, আপনি তো জানেনই যে আজকাল রাস্তায় কতো জ্যাম থাকে।
বসঃ রোজ রোজ এক বাহানা। কই আমি তো ঠিক টাইমেই আসি। আমার তো সমস্যা হয় না। আসলে আপনাদের কে মাথায় তুলে
তুলে আজ এই অবস্থা। যতোসব। যান
কাল যে ফাইল টার কথা বলেছিলাম সেটা নিয়ে আসেন।
রফিক সাহেবঃ জী আচ্ছা স্যার।
রুম থেকে বের হয়ে, “শালা খাটাশ। তোরা এসি করা গাড়িতে ঘুরে বেড়াস। ট্রাফিকের কোন নিয়ম মানস না আর আমারে বলস
যতসব। তোর উপর আল্লাহর গজব
পড়ুক। আল্লাহ যেন করে তরে যেন একদিন আমার মতো লোকাল বাসে ধাক্কা খাইতে খাইতে আসতে হয়। তাইলে বুঝবি কেমনে
ঠিক টাইমে আসতে পারস।”
ডেস্কে বসতে না বসতেই কলিগরা খুঁচানো শুরু করলো বসের ঝাড়ি নিয়ে। রফিকের সাহেবের মেজাজ গেলো আরও বিগড়ে
অফিস করে বাসায় ফিরার সময় মনে হল আজকে আবার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া লাগবে। কিছু ভেবে পাইনা, একজন উপার্জন কারী
থাকলে যা সমস্যা। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ
রাস্তার ড্রেনের পাশে তার চোখ পরল। একটা মানি ব্যাগ তাতে আনুমানিক ৩৫ হাজার টাকা আর মালিকের কার্ড।
রফিক সাহেবের চোখ যেন জ্বল জ্বল করছে। তিনি চারপাশে ভালো ভাবে তাকিয়ে ব্যাগ টা আস্তে করে নিজের পকেটে নিয়ে
নিলেন। বাসে আসার সময় ভাবছিলো,
আজ আর স্ত্রী ঝগড়া করতে পারবে না। পাওনাদার দের মুখের উপর সব টাকা ফিরত দিবো। বাড়িভাড়াও পরিশোধ করবো।
আচ্ছা কাল তো শুক্রবার । কাল সকালে বাজার থেকে ১ টা মাছ কিনব। ছেলেমেয়েকে মাছ খাওয়াই না অনেকদিন। স্ত্রীর জন্য
১৫০০ টাকার মধ্যে একট শারীও কিনব।
ওকে যে শেষ কবে হাসতে দেখেছি মনে নেই। ওর কোন দোষ নেই এরকম অভাবের সংসারে চাইলেও কারো মন মেজাজ ঠিক
থাকেনা।
বাসায় এসে রফিক সাহেব হাতমুখ ধুয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিলো। কাল সবাইকে চমকে দিবে বিধাই কিছু বল্লনা। চুপচাপ শুয়ে
পরল। মাঝরাতে উনার ঘুম ভাঙলে
ওয়াশ রুমে গেলো। টয়লেট সেরে কল ছেড়ে হাতমুখ ধোয়। এমন সময় একটা কণ্ঠ বলে উঠলো , কাজ টা কি আপনে ঠিক
করলেন রফিক সাহেব?
তিনি চমকে উঠলেন। চারপাশে ভালোভাবে তাকালেন কেউ নেই। এমন সময় উনার চোখ আয়নাতে পরল। তিনি দেখতে পেলেন
আয়নার ভিতরে যে রফিক সাহেব সে
হাসছে।
আয়নাঃ জী আপনাকে বলছি। কাজ টা কি আপনি ঠিক করলেন?
রফিক সাহেবঃ আরে এটা তো আমি। এসব কি দেখছি। স্বপ্ন না তো?
আয়নাঃ জী না, স্বপ্ন না বাস্তব।
রফিক সাহেব চলে যেতে গেলে,
আয়নাঃ আরে দাঁড়ান কোথায় যাচ্ছেন? আমার কথা তো শেষ হলনা। রাস্তার পাশে যে মানি ব্যাগ
টা পেয়েছেন সেটা চুরি করা কি ঠিক হয়েছে।
রফিক সাহেবঃ চুরি। আমি কোন চুরি করিনি। সেটা আমি কুড়িয়ে পেয়েছি। আর আমার টাকার দরকার। মাস শেষে যা পাই সেটা
দিয়ে আমার চলেনা। যদি এই
টাকাটা আমার কাজে লাগে তাতে দোষের কি?
আয়নাঃ তাই বলে সামান্য কটা টাকার জন্য নিজের সততাকে বিক্রি করবেন?
রফিক সাহেবঃ সততা। কিসের সততা? এই সততা দিয়ে কি হবে যদি নিজের বউ বাচ্চার কোন ইচ্ছাই পুরন করতে না পারি।
যাদের সততা নেই কিন্তু টাকা আছে তারা
জীবনে অনেক বেশী সুখী। তাহলে এই সততা দিয়ে কি হবে?
আয়নাঃ আপনি ঠিক বলেছেন। তারা অনেক বেশী সুখী। কিন্তু তারা যে রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারে সেটা আপনি কিভাবে
জানলেন? তারা তো নিজেরাই নিজের কাছে
পরিষ্কার না। আপনার স্ত্রী-সন্তান যখন জানবেন যে আপনি কুড়ানো টাকা দিয়ে তাদের ইচ্ছা পূরণ করছেন তাদের কাছে ব্যাপার
টা কেমন লাগবে?
রফিক সাহেবঃ তুমি আমার ভ্রম। এসব কথাতে আমার কিছু যায় আসেনা। বিদায় হও। চলে যাও।
আয়নাঃ আমাকে না হয় তাড়িয়ে দিলেন কিন্তু নিজের ভিতরের এই পাপকে কিভাবে তাড়াবেন?
রফিক সাহেব বেরহয়ে এসে বিছানায় আবার শুয়ে পরলেন। বাকী সময় টুকু ঘুমালেন না শুধু এপাশ-ওপাশ করলেন।
পরদিন শুক্রবার বাজার করতে গেলেন। বাজারে বিশাল একটা কাতল মাছ দেখতে পেলেন দাম ২৫০০ টাকা। গতমাসে মেয়েটা
কাতল মাছ খেতে চেয়েছিল। মাছটা
দেখে রফিক সাহেবের বড্ড লোভ হল। ওই মানিব্যাগ থেকে ২৫০০ টাকা বের করবার সময় হঠাৎ তার চোখ পাশের কার্ডের দিকে
পরল। কি মনে করে শেষ পর্যন্ত উনি
মাছ টা কিনলেন না। গতকালের মতো ডাল, জালী কুমড়া আর গুড়া মাছ কিনলেন। যদিও কাতল মাছ টা শেষ পর্যন্ত কিনতে
পারেন নি, যদিও পাওনাদার কে টাকা টা
পরিশোধ করতে পারেন নি, যদিও বারিয়ালাকে ভাড়া টা দিতে পারেন নি, যদিও প্রিয়তম স্ত্রীকে ১৫০০ টাকার সেই কাপড়টি কিনে
দিতে পারেন নি তবু উনার মধ্যে
একধরনের প্রশান্তি ছিল সেই মানিব্যাগ টা মালিককে পৌছে দিয়ে।
কারন তাকে তার সততাকে বিক্রি করতে হয়নি।