অনেক অনেক দিন আগে, অনেক দূরের এক দেশে থাকত এক রাজা। তার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালএ ঘোড়া এই সবকিছুই
ছিল। কোষাগারে সোনারুপো থইথই। শুধু একটাই জিনিসের অভাব। রাজপ্রাসাদে একটা রানি নেই। তেমন ভালো একটা
রাজকন্যা না পেলে রাজার বিয়েতে মনও উঠছিল না। এইসব নিয়ে বসে বসে রাজা ভাবছেন এমন সময় দেখেন রাস্তা দিয়ে এক
ভিনদেশি সওদাগর যাচ্ছে। দেখেই রাজার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। ভিনদেশি সওদাগররা দুনিয়া ঘোরে। তাদের কাছে ভালো
রাজকন্যার খবর মিললেও মিলতে পারে। অতএব পেয়াদা তলব নিয়ে গেল সওদাগরের কাছে। সে খানিক বাদে এসে প্রণাম করে
দাঁড়াল।
খানিক বাদে রাজার মুখে সব শুনে সে ভুরুটুরু কুঁচকে বলে, আছে বটে এক রাজকন্যা। রূপ বটে তার! তার ছটায় সূর্যও অন্ধকার
ঠেকে। তার নাম হেলেনা। থাকে অনেক দূরের বুজান নামের এক দ্বীপে।”
“কোথায় সে দ্বীপ?বলো শিগগির।” রাজা বললেন।
“এত ঘুরে বেড়াই! কোথায় সে দ্বীপ সে পথ কি আর মনে আছে রাজা? তবে হ্যাঁ এখান থেকে সে দ্বীপ সমুদ্রে দশ বছরের পথ। আর
তাছাড়া সে মেয়েকে তুমি বিয়ে করতেও পারবে বলে তো মনে হচ্ছে না।” সওদাগর বলল।
“কী ? এতবড়ো কথা? জানিস আমি কে?” রাজা ভীষণ রেগে উঠে বলল। সওদাগর হেসে বলে, “রাগ করো কেন রাজা? ভেবে
দেখ। সে দ্বীপ যেতে আসতে বিশ বছর। কন্যেকে নিতে আজ রওনা দিলে কন্যে এসে পৌঁছুবে বিশ বছর বাদে। তদ্দিনে সে বুড়ি
হয়ে যাবে। তুমিও বুড়ো হয়ে যাবে। বিয়ে হবে কেমন করে?”
শুনে রাজা মাথা নেড়ে বলল, “সে ঠিক। সে ঠিক। খবরটার জন্যে ধন্যবাদ। তুমি এখন যেতে পারো।”
সওদাগর তো চলে গেল। এদিকে রাজার তো কনের চিন্তায় মাথার ঠিক নেই। কী করে কী করে ভাবতে ভাবতেই একদিন রাজা
বেরিয়েছে ঘুরতে।
শিকার খেলতেখেলতে অনেক দূরে এসে দেখে একটা চমৎকার গ্রাম। সেখানে ক্ষেতে ক্ষেতে সোনার মত ফসল।
“কার খেত রে এগুলো? এত ভালো ফসল হয়েছে? আমার দেশে এমন ভালো চাষী কে? গিয়ে তাদের ডেকে আন তো!” আদেশ
দিল রাজা।
অমনি পাইক পেয়াদারা দৌড়ে গিয়ে ধরে আনল সাতটা একরকম দেখতে লোককে।
তারা এসে প্রণাম করে দাঁড়াল রাজার সামনে।
“এই ফসল তোমরা ফলিয়েছ?” রাজা জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ মহারাজ,” একসঙ্গে মাথা নাড়ল সাতজন।
“তোমাদের পরিচয়?”
“আমরা হলাম সাত ভাই সাত সিমোন,” তারা জবাব দিল, “আমাদের বাপ মা আমাদের সবাইকে একটাই বাড়ি দিয়েছে, সেখানে
আমরা একসাথে থাকি, একটাই জমি দিয়েছে, সেখানে আমরা একসঙ্গে চাষ করি আর একটাই নাম দিয়েছে, আমরা তাই সবাই
সিমোন।”
“অ্যাঁ? সে কী হে? তোমাদের আলাদা আলাদা কিছুই নেই নাকি?” রাজা হেসে বললেন।
“আজ্ঞে মহারাজ আছে। আমাদের সাতজনের সাতটা আলাদা গুণ আছে” তারা বলল।
“কী কী গুণ?”
তখন তারা যা বলল তা হল এই-
এক ভাই আকাশছোঁয়া মিনার গড়তে জানে। দু নম্বর সে মিনারে চড়ে আকাশে পৌঁছোতে পারে। সেখান থেকে সে দুনিয়াসশুদ্ধু
দেখতে পায়। তিন নম্বর এমন জাহাজ গড়তে পারে যা এক বছরের রাস্তা এক সপ্তাহে যায়। চার নম্বর ভাই আবার সে জাহাজ
ঝড়ে পড়োলে তাকে জলের তলায় ডুবিয়ে ডুবো জাহাজ বানিয়ে ধাইতে পারে। পাঁচ নম্বর বানাতে পারে জাহাজের জন্য
অটোমেটিক কামান। দুনিয়ায় কেউ তার গোলা থেকে বাঁচতে পায় না। ছ নম্বর, সেই কামানের গোলায় ঘা খাওয়া শিকার মাটি
ছোঁবার আগে তাকে ছোঁ মেরে ধরে আনতে পারে।
আর সবচেয়ে ছোটো যে সিমোন সে মুচকি হেসে বলল, “আমি খুব ভালো চুরি করতে পারি। সেরা দুর্গের সেরা জিনিসও এমন চুরি
করে আনব যে কেউ টেরই পাবে না!” শুনে রাজা রেগে গিয়ে বলে, “এই কে আছিস, এটাকে শেকল বেঁধে নিয়ে চল। আর শোনো
হে বাকি সিমোনেরা। তোমরাও চল রাজধানীতে। আমি তোমাদের পরীক্ষা নেব।”
এমনিভাবে সাত সিমোন রাজধানীতে এল। এক সিমোন রইল জেল-এ আর অন্য সিমোনরা কাজে লাগল। তৈরি হল বিরাট
মিনার। তাই চেপে আকাশে উঠে আরেক সিমোন দুনিয়ার সব দেশের খবর দিল রাজাকে। তিন নম্বর বানিয়ে ফেলল তার আশ্চর্য
জাহাজ। সে জাহাজ জলের ওপর তিরের মত ছুটে যেতেই চার নম্বর তাকে নিয়ে ডুব দিল সাগরের তলায়। ফের ভেসে উঠতে সে
রাজাকে উপহার দিল গভীর সাগর থেকে তুলে আনা একটা বিরাট স্টার্জন মাছ। রাজা তাই দিয়ে কুলিবিওকা বানিয়ে যখন খেতে
বসেছে তখন পাঁচ নম্বর সিমোন তার তৈরি কামান নিয়ে এসে দূর আকাশে ভাসতে থাকা একটা ঈগলকে তাক করে সেটা ছুঁড়ল।
একটুকরো পাথরের মত ঈগলটা মাটির কাছাকাছি নেমে আসতেই ছ নম্বর সিমোন বিদ্যুতের মত একটা থালা নিয়ে ধেয়ে গিয়ে
ঈগলটা মাটিতে পড়ার আগেই তাকে থালায় ধরে নিয়ে রাজার সামনে এসে নামিয়ে রাখল।
“বাহবা হে ছয় সিমোন,” রাজা বেজায় খুশি হয়ে বলল, “যাও, এবারে খানিক বিশ্রাম করো গে।”
পরদিন সকালে সভা বসেছে। ছয় সিমোন সেখানে আসতেই রাজা বলেন “ওহে দু’নম্বর। মিনারে চড়ে দেখো দেখি দূরে সমুদ্রের
বুকে বুজান দ্বীপটা দেখতে পাও নাকি? খুঁজে পেলে সেখানে দেখো তো হেলেনা নামে এক বেজায় রূপসী রাজকন্যা ঘোরাঘুরি
করছে কি না?”
দু নম্বর সিমোন অমনি দৌড়ে গিয়ে মিনারের মাথায় উঠে বসল। খানিক বাদে নেমে এসে সে রাজাকে বলে, “পেয়েছি মহারাজ।
তবে ওখানকার রাজা দেখলাম বেজায় কড়া। শুধু বলে যাচ্ছে, আমার মেয়ে হেলেনা দুনিয়ার সেরা সুন্দরী। তার যুগ্যি বর কেউ
নেই। কোন রাজার ব্যাটা যদি তাকে বিয়ে করতে আসে তাহলে আমি তাকে যুদ্ধ করে শেষ করে ফেলব।”
“তা রাজার সৈন্যসামন্ত কেমন দেখলে? আর জায়গাটা কেমন দূর হবে?”
“আজ্ঞে সাধারণ জাহাজে দশ বছরের রাস্তা হবে বলেই তো মনে হল। আর রাজার সৈন্য যা দেখলাম তাতে লাখ দশেকের কমতো
নয়ই। খানিক বেশিই হবে।”
শুনে তিন নম্বর সিমোন বলে, “রাজামশাই , চিন্তা কী? আমার জাহাজে বসলে দশ হপ্তায় বুজান পৌঁছে যাবেন তো। তারপর যুদ্ধ
করলেই হল।”
তখন সেনাপতি উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, “রক্ষে করুন মহারাজ। আমাদের কুল্লে দু’লাখ সেনা। দশ লাখের সঙ্গে লড়তে গেলে
একজনও বেঁচে ফিরবে না যে।”
শুনে রাজার ভাঁড় হঠাৎ একটা ডিগবাজি খেয়ে বলে, “মহারাজ, যুদ্ধটুদ্ধের কী দরকার? এদের সাত নম্বরকে জেল থেকে বের
করে ওখানে পাঠিয়ে দিন। সে দুনিয়ার সবকিছু চুরি করতে পারে। রাজকন্যা চুরি করা তো তার বাঁহাতের খেল। তারপর রাজকন্যা
নিয়ে পালিয়ে এলেই হল। ও দেশের রাজার এদেশে আক্রমণ করতে আসতে আসতেই দশ বছর লেগে যাবে। তদ্দিনে রাজকন্যাও
বুড়ি, আপনিও বুড়ো , আর রাজকন্যার বাবা মরে ভূত। কেমন, ভালো বুদ্ধি নয়?”
শুনে রাজা বেজায় খুশি। ছোটো সিমোনকে জেল থেকে বের করে এনে বলে, “কীরে, আমার জন্য হেলেনাকে চুরি করে আনতে
পারবি? তাহলে তোর সব দোষ মাপ।”
“পারব না কেন মহারাজ?” সে হেসে বলল, “এ তো বেজায় সহজ কাজ। শুধু জাহাজভর্তি কার্পেট, রেশম এইসব নিন আর তিন
থেকে ছ নম্বর সিমোনকে সাথে দিন। আমি রাজকন্যা চুরি করে নিয়ে আসছি।”
যেমন কথা তেমনি কাজ। পরদিন সকালে দেশের বন্দর থেকে সমুদ্রে ভেসে গেল সেই আশ্চর্য জাহাজ। তারপর পাল উড়িয়ে
বিদ্যুতের ঝলকের মত ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল সমুদ্রের বুকে। দশ সপ্তাহের মধ্যে তারা বুজানের কাছে গিয়ে পৌঁছে গেল। দেখে
সমুদ্রের ধারে হাজার হাজার কামান তাক করে পাহারাদাররা বসে আছে। কোন জাহাজ কাছে এলেই গোলা ছুঁড়বে।
তাদের জাহাজকে আসতে দেখেই কামানওলারা কামানে গোলা ভরতে লেগেছে। তাদের মধ্যে একজন চিৎকার করে বলল, “কে
তোরা? এগোলেই গোলা খাবি বলে দিলাম।”
সাত নম্বর সিমোন জাহাজ থেকে হেঁকে জবাব দিল, “আমরা সওদাগর গো, সওদাগর। রাজা আর রাজকন্যার জন্য সওগাত নিয়ে
এসেছি। আমাদের পাড়ে আসতে দাও।”
“আয় তবে,” বলল গোলন্দাজকের দল। তখন জাহাজ থেকে দামি দামি কার্পেট টার্পেট দিয়ে বোঝাই নৌকা ভাসল জলে। নৌকো
বেয়ে পাঁচ সিমোন চলল বুজানের দেশে।
সেরা সুন্দরী হেলেনা বসে ছিল তার প্রাসাদে। সেখান থেকে রাস্তায় পাঁচ নতুন লোক দেখে দাসীদের ডেকে বলল, “দেখে আয় তো
কারা আসছে আমাদের প্রাসাদে?”
দাসীরা পথে এসে দাঁড়াতেই সাত নম্বর সিমোন বলল, “আমরা সওদাগর। রাজা আর রাজকন্যার জন্য আজবতাজ্জব সব উপহার
নিয়ে এসেছি।”
শুনতে পেয়েই হেলেনা তো তাদের ভেতরে ডাকিয়ে আনল। তাদের কার্পেট, রেশম, হিরেমাণিকের পসরা দেখে রাজকন্যা বেজায়
খুশি। দেখে ছোটো সিমোন বলে, “রাজকন্যা, এসব সাধারণ জিনিস তো তোমার দাসীদের জন্যে এনেছি আমরা। ওদের দিয়ে দাও
এসব। আসল জিনিস আছে আমাদের জাহাজে। সেসব নামিয়ে আনতে ভরোসা করি না। চাইলে গিয়ে দেখতে পারো।”
শুনে হেলেনা তার বাবাকে গিয়ে বলে, “ও বাবা। এরা বেজায় বড়োলোক। দাসীদের হিরেমাণিক দিল। বলছে আসল দামি জিনিস
জাহাজে আছে। গিয়ে একবারটি দেখে আসি?”
শুনে রাজা বলে, “তুই যদি তাই চাস তবে তাই হবে মা। ওহে আমার যুদ্ধজাহাজ সাজাও। গোলন্দাজদের তৈরি হতে বলো। হেলেনা
সওদাগরের জাহাজে ঘুরতে যাবে। তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাও।”
একটু বাদে রাজার জাহাজ জলে ভাসল। গিয়ে লাগল সিমোনদের জাহাজের গায়ে। রাজার লোক কামান তাক করে রইল
সেদিকে। বেচাল দেখলেই গোলা দাগবে। হেলেনা তো নেমে এল সিমোনদের জাহাজে। তার সঙ্গে কেবিনের ভেতরে সাত নম্বর
যখন কথা বলছে তখন চার নম্বর সিমোন হঠাৎ জাহাজের হাল ধরে দিয়েছে এক মোচড়, আর অমনি জাহাজ সটান নেমে গেছে
সমুদ্রের একেবারে গভীরে। তাই দেখে সবাই ভাবল, হেলেনাকে নিয়ে জাহাজটা ডুবেই গেল বুঝি। খবর পেয়ে রাজা মাথা চাপড়ে
কাঁদলেন। কিন্তু তাতে কী লাভ। সমুদ্র যাকে নিয়েছে, তাকে আর ফেরত আনবে কে?
তারপর আর কী? জলের তলা দিয়ে শোঁ সশোঁ করে দশ হপ্তায় দশ বহরের পথ পেরিয়ে এল তারা। রাজা তখন প্রাসাদের মাথায়
বসেঅস্থির চোখে সমুদ্র দেখছেন। সময় যে হয়ে এল। এখনো জাহাজ আসে না কেন তবে?
ঠিক তক্ষুণি দিগন্তের কাছে জল ফুঁড়ে মাথা জাগাল একটা মাস্তুল। তারপর চোখের পলকে গোটা জাহাজটা ভেসে উঠে তিরের
মত ছুটে এল পাড়ের দিকে। তার ডেকের ওপর দাঁড়িয়েছিল দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী রাজকন্যা হেলেনা। দেখে দেখে রাজা বেজায়
খুশি হয়ে নেচে উঠতে যাবেন, এমন সময় হঠাৎ তার ডেক থেকে রাজকন্যা একটা প্রকাণ্ড সাদা পাখি হয়ে আকাশের দিকে
তিরের মতন উড়ে গেল।বিশাল ডানা ঝাপটে সে বুজানের দিকে ফেরার পথ ধরল।
কিন্তু যাবার কি জো আছে? পাঁচ নম্বর সিমোন অমনি তার কামান তাক করেছে পাখির ডানার দিকে। এমন নিখুঁত নিশানা তার যে
গোলা লেগেছে পাখির ডানার মাথায়। একফোঁটা রক্ত বেরোয়নি, শুধু ডানাটা অকেজো হয়ে পাখি আছড়ে পড়তে গেছে জলের
ভেতর। কিন্তু জলে পড়বার আগেই বিদ্যুতের মত সেদিকে উড়ে গিয়ে তাকে কোলে করে ধরেছে ছ নম্বর সিমোন। তারপর তাকে
ফের জাহাজে তুলে আনতেই পাখি রূপ বদলে রাজকন্যা হয়ে গেল ফের। মুক্তোর মত দাঁতে একগাল হেসে বলল, “এমন যার
সেপাই সে রাজা না জানি কেমন হবে। আমি তাঁকে বিয়ে করতে একদম রাজি।”
খানিক জাহাজ এসে পাড়ে ভিড়তে এগিয়ে এল এক সোনার মই। তাতে পা দিয়ে হেলেনা নামলেন রাজার দেশের মাটিতে।
তারপর একদিন ধুমধাম করে রাজার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে গেল। আমাদের গল্পও ফুরুল।