জেলে আর জেলেনি

জেলে আর জেলেনি

(দ্য ব্রাদার্স গ্রিম মানে জেকব এবং উইহেল্ম গ্রিমÑ এ দু’ভাই। জেকব বড় আর উইলহেল্ম ছোট ভাই। ওরা জার্মান লেখক।

একাধারে শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ, অভিধান সংকলক। লোককাহিনী সংগ্রহ ও প্রকশনার জন্য তাঁরা বিশেষভাবে সুখ্যাত। তাঁদের এ

যৌথ অবদান লোককাহিনীর ভান্ডারকে করেছে আরো সুসমৃদ্ধ। তাঁদের রূপকথার গল্প দ্য ফিসারম্যান এন্ড হিজ ওয়াইফ গল্পটির

ভাষান্তর এটি। এ গল্পের ধারায় আরো অনেক গল্প রয়েছে। এদের মধ্যে আধুনিক রুশ সাহিত্যের পথিকৃৎ আলেকজান্ডার পুশকিন

এর পদ্যে রচিত গল্প দ্য টেল ওফ দ্য ফিসারম্যান এন্ড দি ফিস এবং ভ­াদিমির প্রপ’র গল্প দ্য গ্রিডি ওল্ড ওয়াইফ অন্যতম।)

একদেশে ছিল এক জেলে। তার সোহাগী বৌ জেলেনিকে নিয়ে সে বাস করতো সাগর পাড়ে, একখানা জীর্ণ কুঁড়ে ঘরে। তাদের

মাথা গুঁজবার ঠাঁই ঐ এক খানা চালাঘরই তাদের একমাত্র সম্বল। তাও আবার ছেঁড়া-খোঁড়া। নোংরা পর্ণ কুটির। ঘরতো নয় যেন

পাখির বাসাÑ দীনহীনের ঝুপড়ি । সহায় নেই, সাপদ নেই। তারা খুবই গরীব। বিত্ত-বেসাত, জমি-জিরাত কিচ্ছু নেই। জোটেনা

দু’বেলা খাবার। মাছ শিকারই জেলের একমাত্র পেশা। মাছ পেলে খাওয়া জোটে। না পেলে উপোস। জেলে সারা দিনমান সাগর

পাড়ে পড়ে থাকে। পানিতে বঁড়শি ফেলে বসে থাকে দিনভর। অপেক্ষার পালা শেষ হয়না। কখন টোপ গিলবে একটা মাছ!

এভাবেই দিন কাটে এই গরীব জেলে আর জেলেনির।

একদিনের কথা। সেদিন সাগর জলে বঁড়শি ফেলে জেলে।  অপেক্ষায় থাকে কখন মাছ টোপ গিলবে। সাগরের ঢেউ গুনে সময়

পাড় করে। স্বচ্ছ ফকফকা পানির দিকে স্থির তাকিয়ে থাকে। চোখের দু’পাতা এক করেনা। বসে আছেতো বসেই আছে। হঠাৎ

বঁড়শির সূতোয় হেঁচকা টান। ফাতনাটা জলের তলায় দ্রুত ডুবে যায়। ছিপে এমন জোরে টান পড়েÑযেন জেলেকে শুদ্ধ টেনে

নিয়ে যাবে সাগর তলায়। জেলে বুঝতে পারে নিশ্চয়ই বিরাট একটা মাছ টোপ গিলেছে। ছিপ ধরে দেয় টান। বাতাস কেটে শব্দ

হয়Ñ ‘শোওয়াং’। একটানে বঁড়শিতে গাঁথা মাছটাকে পাড়ে টেনে তোলে জেলে। বিরাট মাছ। এত্তো বড় মাছ সে জীবনেও কোনদিন

দেখেনি। আনন্দে আটখানা জেলে।

এর পরের কা- আরো অবাক করার মতো। মাছটা কথা বলছে। ঠিক মানুষের মত। মানুষের গলায়, মানুষের ভাষায়। তাজ্জব

ব্যপার তো! জেলের চোখ ছানাবড়া। মাছের এমন কান্ড দেখে হকচকিয়ে যায় জেলে।

শোন ভাই জেলে! আমাকে মেরোনা। বাঁচতে দাও। আমি কোন সাধারন মাছ না। আমি আসলে একজন রাজপুত্র। এক ডাইনী

তার জাদুবলে আমাকে মাছ বানিয়ে সাগরে ফেলে দিয়েছে। এখন তুমিই বলো, আমাকে মারা কি তোমার উচিৎ হবে? তাছাড়া

আমিতো মাছই নই যে তুমি আমাকে খেয়ে স্বাদ পাবে। তারচে আমাকে আবার জলে ছেড়ে দাও। আমি সাগরের জলে সাঁতার

কাটতে কাটতে চলে যাই দূরে বহুদূরে।

মাছের এ মিনতি শুনে জেলে বলে, ঠিক আছে, ঠিক আছে। এ নিয়ে আর অত শত কথা বলার দরকার হবে না। যে মাছ মানুষের

মত কথা বলে, সে মাছ নিয়ে আমার কাজ নেই। তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি। যাও, যাও। যেখানে খুশি চলে যাও। মনের সুখে সাঁতরে

বেড়াও। যত্তো সব উটেকো ঝামেলা।  এ বলে জেলে মাছটাকে ছেড়ে দেয় স্বচ্ছ জলে। মাছটাও সোজা ডুবে যায়। হারিয়ে যায়

গভীর জলের দেশে। চলে যায় দৃষ্টির আড়ালে। তবে পেছনে রেখে যায় রক্তচিহ্নের সরু রেখা। ঝুপড়িতে খালি হাতে ফিরে আসে

জেলে। বৌকে সব কথা খুলে বলে। ‘কথা বলতে পারা মাছ’ এর অবাক কাহিনী শুনে জেলেনি বলে, আরে! তুমি দেখছি একটা হদ্দ

বোকা। ‘কথা বলা মাছ’টাকে ছেড়ে দেয়ার আগে তুমি তার কাছে কিছু চাইলেনা?  না। কিছু চাইনিতো! কি চাইবো! ওর কাছে

আবার কিছু চাইবার আছে নাকি!  জেলের জবাব শুনে বিরক্ত হয় জেলেনি। বলে, নোংরা বিচ্ছিরি এমন একচালা ঝুপড়িতে

বসবাস করা যায়? নিঃশ্বাস নেয়া যায় এমন দুর্গন্ধে। মাথা গোঁজা যায় এমন জীর্ণ কুঁড়ে ঘরে? এটাকি ঘর! এতো জন্তু-জানোয়ারের

খোয়াড়ের চেয়েও অধম। আর তুমি এমনই বোকা মাছটাকে এমনিতেই ছেড়ে দিলে! আরে বাপু তার কাছে অন্তত: একখানা

ছিমছাম কুটিরতো চাইতে পারতে। যাও এক্ষুনি যাও। সাগর পাড়ে গিয়ে তাকে ডেকে আন। বলো আমরা অন্তত: একখানা সুন্দর

ছোট বাসযোগ্য কুঁড়েঘর চাই। সে নিশ্চয়ই এতে রাজি হবে। যাও, যাও। শীগগিরই যাও। ওঠে পড়। আর দেরী করোনা।

বৌ- যতই তাগিদ দেয়, জেলে রাজি হয়না। বলে, কি বলছো তুমি! আমি ওর কাছে কিছু চাইতে যাব কেন? তা হয়না। আমি যেতে

পারবনা।

জেলের আপত্তি শুনে জেলেনি তাকে বুঝিয়ে বলে। শোন, তুমি ওকে ধরেছো। ঠিক কিনা? এর পর তুমি ওকে জলে ছেড়ে দিয়েছো

ওরই অনুনয়ে। ঠিক কিনা? তুমি ওর জন্যে যা করেছ তার বিনিময়ে সে আমাদের সামান্য এটুকু উপকার করবেনা? আমি হলফ

করে বলতে পারি এটুকু সে করবেই করবে। যাও। ওঠ, ওঠ। আর সময় নষ্ট করোনা। রওয়ানা করো এক্ষুনি।  জেলের পা-যে এগোয়

না। যেতে মন চায়না। কারো কাছে কিছু চাওয়াটা তার মোটেই পছন্দ না। কিন্তু বৌ-যে নাছোড়বান্দা। অগত্যা বৌ-এর তাড়ায়

জেলেকে আবারো যেতে হয় সাগর পাড়ে। গিয়ে দেখে সাগরের জল আগের মত স্বচ্ছ নেই। কেমন হলদেটে আর সবুজ হয়ে

ওঠেছে। সাগর পাড়ে দাঁড়িয়ে জেলে মাছটাকে ডাকেঃ

সাগর দুলাল সাগর দুলাল বারেক শুনে যাও, আমার বৌ-এর ইচ্ছেটুকু পূরণ করে দাও।   কষ্টে আছি, কষ্টে বাঁচি, দিন-যে কাটে

দুঃখে,  তোমার দয়ার একটি বরে বাঁচবো পরম সুখে।

জেলের ডাকে ছুটে আসে মাছটা। বলে, তোমার বৌ কি চায়?  আমার বৌ ছেঁড়া-খোঁড়া নোংরা একচালার ঝুপড়িতে আর থাকতে

পারছেনা। বেচারীর খুবই কষ্ট। সে একটা ছোট্ট সুন্দর ছিমছাম কুঁড়েঘরে চাইছে তোমার কাছে। এর বেশি কিছু না।  ও! এই কথা!

যাও। বাড়ি ফিরে যাও। তোমার বৌ একখানা চমৎকার কুঁড়েঘর এরি মধ্যেই পেয়ে গেছে। জেলে তার ডেরায় ফিরে আসে। দেখে

আজব কান্ড। কোথায় সেই জরাজীর্ণ একচালা ঝুপড়ি! সুন্দর ঝকঝকে একখানা  কুঁড়েঘরের দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে তার বৌ

ইলসেবিল। মুখে উজ্জ্বল হাসির ছটা।  জেলেকে দেখে অভ্যর্থনা জানায় জেলেনি। বলে, এসো, এসো, ভেতরে এসো! দেখো কী

সুন্দর ঘর হয়েছে আমাদের! এই যে দেখো আমাদের সামনের উঠোন। আর ঐ যে একখানা সাজানো গোছানো বৈঠকখানা। এ

দিকটায় এসো। দেখ। এটা আমাদের শোবার ঘর। আর ঐ যে, ওখানটায় আমাদের রান্নাঘর, খাবার কোঠা। সব কিছু সুন্দর

পরিপাটি। রূপো আর পিতলের তৈরী সব থালা বাসন। যথাস্থানে যথানিয়মে যুৎসই আসবাবপত্রে সজ্জিত সারাটা বাড়ি। বাড়ির

পেছন দিকটায় আসো। এই যে দেখো কি সুন্দর বাগান। সুস্বাদু ফল গাছে ভরা। সুশোভিত ফুলের সমাহার। বাগানভরা নানা

তরিতরকারী, শাকসব্জী। আঙ্গিনাটার দিকে তাকাও। দেখেছো কতো হাঁস-মুরগী ঘুরে বেড়াচ্ছে ওঠোন জুড়ে। কী! কী বুঝলে?

কেমন হলো ব্যাপার খানা!  জেলেনির আনন্দের সঙ্গে জেলেও উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। বলে, সত্যিই চমৎকার। যথেষ্ট পেয়েছি।

আর কিচ্ছু চাইনা। এ নিয়ে আমাদের জীবনটা সুখেই কেটে যাবে।  জেলেনি বলে, ও নিয়ে পরে ভাবা যাবে খন।  এরপর খাওয়া-

দাওয়া সেড়ে তারা আয়েশে ঘুমোতে যায়। এভাবে দু’এক হপ্তা ভালভাবেই কাটে। তারপর জেলেনি একদিন তার স্বামীকে বলে,

দেখ মিয়া, এ কুটীরখানা খুবই ছোট। জায়গা তেমন বেশি নেই। দেখলে ফুঁসকে ফুঁসকে লাগে। তাছাড়া উঠোন, আঙ্গিনা বাগান

সবই কেমন খুদে খুদে। ঘরগুলো কেমন খুপড়ি খুপড়ি, আঁট-সাঁট। একটু খোলা-মেলা না হলে কেমন করে চলবে বলো! ঐ জাদুর

মাছটা ইচ্ছে করলেই কিন্তু আমাদেরকে আরো খানিকটা বড়-সড় বাড়ি দিতে পারে। যাও। মাছটাকে গিয়ে বলো, আমি পাথরের

তৈরী কেল্লার মতো বাড়ি চাই। রাজপ্রাসাদের মত বিশাল। নইলে-যে আমার মনে শান্তি পাবো না। কিছুতেই মনের কষ্ট দূর হবে না।

জেলেনির কথাটা পছন্দ হয়না জেলের। বলে, দেখ গিন্নি; আমি আর মাছের কাছে যেতে চাইনা। আমাদের যা দিয়েছে, সেটাই

অনেক। তা নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকা ভালো। দু’হপ্তার মাথায় আবারও কিছু চাইতে গেলে হয়তো সে রেগেও যেতে পারে।

জেলের কথা শুনে তেলে-বেগুনে জলে ওঠে জেলেনি। বলে, রাগবে কেন? তার যেহেতু দেবার ক্ষমতা আছে, দেবে। এতে রাগ-

টাগের কি আছে বাপু! দাঁত খ্যাঁচিয়ে বলে, এক্ষুনি যাও। একটুও দেরী করোনা। কী, এখনো ওঠলেনা! জেলে যেতে চায়না। মনে

মনে বলে, এটা ভারী অন্যায়। মোটেই ঠিক হচ্ছেনা এমন চাওয়া।  ইচ্ছা না থাকলেও শেষতক যেতে বাধ্য হয় জেলে। সাগর পাড়ে

গিয়ে দাঁড়ায়। সাগরের জলের দিকে তাকিয়ে জেলে হতবাক। এ কি সৃষ্টিছাড়া কান্ড! স্বচ্ছ সুনীল জলের এ কী বেহাল অবস্থা!

পানির বেগুনী, ঘোলাটে, লোনা, হলদেটে বাদামী ভাব। ভারী হরিৎ ফ্যাকাশে হয়ে আছে সাগরের জল। দেখলেই কেমন ঘেন্না

ঘেন্না লাগে। সে জলের ধারে দাঁড়িয়েই জেলে বলেঃ

সাগর দুলাল সাগর দুলাল বারেক শুনে যাও, আমার বৌ-এর ইচ্ছেটুকু পূরণ করে দাও।   কষ্টে আছি, কষ্টে বাঁচি, দিন-যে কাটে

দুঃখে,  তোমার দয়ার একটি বরে বাঁচবো পরম সুখে। সাঁতার কাটতে কাটতে মাছটা আবার সাগর কুলে আসে। সাড়া দেয় জেলের

ডাকে । বলে, তোমার বৌ আবার কি বায়না ধরেছে হে?

আমতা আমতা করে জেলে। দুঃখী-দুঃখী কন্ঠে বলে, আমার বৌ চায় পাথরে গড়া বড়-সড় কেল্লা ।  মাছ বলে, তবে তা-ই হোক।

যাও বাড়ি যাও। দেখ গিয়ে, এরি  মধ্যে তোমার বৌ একটা শানদার কেল্লার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।  জেলে বাড়ির পথে পা বাড়ায়।

বাড়ির কাছে গিয়ে দেখে হ্যাঁ, তাইতো! কী অবাক কান্ড! মাছ যেমনটা বলেছিল, ঠিক তাই! পাথরের তৈরী বিশাল কেল্লা। প্রধান

ফটকে দাঁড়িয়ে জেলেনি। পরনে রাজরাণীর সাজ। স্বামীকে বরণ করার জন্য পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে রানীরূপী ইসেবিল

জেলেনি। সিঁড়ির গোড়া থেকে স্বামীকে এগিয়ে নিয়ে যায় জেলেনি। বৌ’র সাথে জেলে কেল্লার ভেতরটা ঘুরে ঘুরে দেখে। প্রথমেই

রয়েছে বিশাল হলঘর। মার্বেল পাথরে গড়া এর মেঝে। খিলান দেয়া ফটকটা তাদের জন্যে খুলে দেয় কয়েকজন চাকর-বাকর।

সারি সারি দাস-দাসী সেবায় রত। শাদা দেয়ালগুলো কারুকাজের পর্দায় ঢাকা। কক্ষের ভেতরে রয়েছে চেয়ার টেবিল আর খাঁটি

সোনায় গড়া মহামূল্যবান আসবাবপত্র। স্ফটিক স্বচ্ছ বর্ণালী আলোক ছটায় উজ্জ্বল ঝাড়বাতি। যেন ছড়িয়ে দিচ্ছে আলোর বন্যা।

প্রতিটি কক্ষের মেঝে গালিচায় মোড়ানো । টেবিলে টেবিলে থরে থরে সাজানো পৃথিবীর সেরা খাদ্য-পানীয়। সুপেয় পানীয়ের ভারে

টেবিলগুলো যেনো ভেঙ্গে পড়বে এক্ষুণি। কেল্লার পেছনটায় নানা স্বাদের ফল আর নানা রঙের ফুলে ভরা বিরাট বাহারী বাগান।

গা ঘেসেই উপবন। যেন বির্স্তীণ বনবীথি। মোটের উপর দৈর্ঘ্যে আধা মাইলের কমতো নয়ই। গাছ-গাছালিতে ভরা বনানীতে চড়ে

বেড়াচ্ছে, হরিণ, খরগোশসহ আরো কতোকতো বনের প্রাণী। জেলেনি আনন্দে আটখানা। খুশি যেন উছলে পড়ছে। বলে, দেখ

দেখি! কেমন চমৎকার হয়েছে সব, তাইনা?  জেলে বলে, হ্যাঁ। খুউব সুন্দর। সুরম্য অট্টালিকা। সুসজ্জিত রাজপ্রসাদ। এ নিয়েই

আমরা পরম সন্তুষ্ট থাকবো। বাকী জীবনটা সুখে শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারবো।

জেলেনি বলে, হ্যাঁ হয়তো তাই। ভেবে দেখবো। আগেতো রাতটা কাটাই। তারপর বুঝবো কতটা সুখী হয়েছি।  জেলে আর জেলেনি

ঘুমোতে যায়। নরম তুলতুলে বিছানা বালিশ। আহাঃ কী আরামের ঘুম।

পরদিন অনেক বেলা করেই জেলেনি ঘুম থেকে ওঠে। আয়েশের ঘুমের রেশÑ যে কাটতে চায়না। তবুও সে জেলের আগেই

জেগেছে। তখন সূর্যের তাপ তেতে উঠেছে। চারদিক রোদে ঝলমল করছে। এমন মনোরম দৃশ্যপট এর আগে কখনো দেখার

সৌভাগ্য হয়নি তাদের। জেলেনির কনুইর গুঁতো খেয়ে হতচকিত হয়ে যায় জেলে। হুড়মুড় করে ওঠে পড়ে ঘুম থেকে। জেলেনি

কর্কশ স্বরে বলে, ওঠ, ওঠ। কত আর পড়ে পড়ে ঘুমোবে? বেলা যে অনেক হলো! ঘুম ঝেড়ে ফেলো! জানালা দিয়ে বাইরে তাকাও।

ভেবে দেখেতোÑ আমরা কি এ রাজ্যের রাজা হতে পারিনা?

বৌ’র কথায় বিরক্ত হয় জেলে। বলে, আরে, আমরা কেন রাজা হতে চাইবো? আমাদের কিসের অভাব? আমি বাপু রাজা-টাজা

হতে চাই না।

জেলেনী রেগে যায়। বলে, তুমি রাজা হতে চাওনাÑ তা বেশ। আমার কিন্তু রাণী হবার ভীষণ ইচ্ছে।

না, না গিন্নী! দোহাই লাগে। এমন বায়না ধরোনা। তুমি কেমন করে রানী হবে? আমি আর মাছের কাছে কিচ্ছু চাইতে যাবো না।

জেলের বৌ’র ধনুক ভাঙ্গা পণ। তার যে রাণী হওয়া চাই-ই চাই। বলে, কথা বাড়িও না তো। ঝটপট তৈরী হয়ে নাও। জাদুর মাছটাকে

গিয়ে বলোÑ আমার রাণী হবার ভীষণ ইচ্ছে। আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাই না। রাণী না হওয়া অবধি আমার সুখ নেই। বিছানা

ছেড়ে ওঠে পড়ো। এক্ষুনি রওয়ানা হয়ে যাও। আর দেরী করো না। বৌ’র চাপাচাপিতে বেচারা জেলের ঘুমের শেষ আমেজটুকু

পর্যন্ত কেটে যায়। চট-জলদি তৈরী হয়ে নেয়। আর কোন উপায় না পেয়ে অগত্যা সাগরের পথে পা বাড়ায়। মনে মনে বলে,

কাজটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না। এটা সত্যিই ভারী অন্যায়।  দুঃখিত মনে যাত্রা করে জেলে। এক পা দু’পা করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে

এগিয়ে যায়। শেষতক পৌছে যায় সমুদ্রের কুলে। চোখ মেলে তাকায় সাগরের অথৈ জলের দিকে। হায়! এ কি বিচ্ছিরি অবস্থা

সাগরের সুনীল স্বচ্ছ জলের। এখন জল ভারী ধূসর, ঘোলাটে। অশান্ত ঢেউয়ের দোলায় যেন ফুঁসে উঠছে সাগরের জল। জল যেন

শৈবাল ধাম। জলের পঁচা গন্ধে দম নেয়া ভার। তবুও অতি কষ্টে সাগর পাড়ে দাঁড়িয়ে জেলে মাছটাকে ডেকে বলেঃ

সাগর দুলাল সাগর দুলাল বারেক শুনে যাও, আমার বৌ-এর ইচ্ছেটুকু পূরণ করে দাও।   কষ্টে আছি, কষ্টে বাঁচি, দিন-যে কাটে

দুঃখে,  তোমার দয়ার একটি বরে বাঁচবো পরম সুখে।

‘কথা বলা’ সেই মাছটা সাঁতরে এসে হাজির হয় জেলের ডাকে সাড়া দিয়ে। বলে, এখন আর তোমাদের কিসের কষ্টহে! তোমার বৌ

আবার কি নতুন বায়না ধরেছে? জেলের গলায় মিনতির সুর। বলে, আমার বৌ’র মনে সুখ নেই। সে এখন রাজ-রাণী হতে চায়।

রাণী না হওয়া পর্যন্ত ওর কষ্ট দূর হবেনা। মাছ বলে, ও। এই কথা! বেশ বেশ। যাও। বাড়ি গিয়ে দেখো তোমার বৌ এতক্ষণে রাণী

হয়েই বসে আছে। বাড়ির পথে পা বাড়ায় জেলে। কেল্লার কাছাকাছি এসে দেখে আজব কান্ড। কেল্লার এলাকাটা আরো অনেক

বড় হয়েছে। দৈর্ঘ্য প্রস্থে সীমাহীন বিস্তার। বিশাল এলাকা জুড়ে সুরম্য প্রাসাদ-দুর্গ। প্রাসাদের আকাশ ছোঁয়া চূড়া। জাঁকালো

সাজসজ্জা। জাঁকজমকপূর্ণ রাজকীয় সাজগোজ। প্রাসাদের বাইরে উর্দীপরা দ্বাররক্ষীদল। সৈন্য সামন্ত টহলে রতঃ। বাজছে ঢাক-

ঢোলক, কারা-নাকারা। জেলেকে আসতে দেখে বেজে উঠলো জয় ডংকা। অভ্যর্থনা জানায় রাজকীয় কায়দায়। বেজে ওঠে জয়-

ভেরী। জেলেকে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানায় চৌকস সুসজ্জিত সেনাদল। রাজপ্রসাদে ঢুকে জেলে দেখে এলাহি কান্ড।

বিরাজ করছে রাজকীয় চাকচিক্য। সবকিছু খাঁটি মার্বেলে তৈরী। কিংবা নিখাদ কাঁচা সোনার কারুকাজে খচিত। ঝলমল মখমলে

আবৃত । আবার কোন কোনটা সোনালী রেশমী আবরনে ঢাকা। তারপরই বিশাল হল ঘরের সিংহদ্বার। এ পথ ধরে সামনে এগুলেই

রাজদরবার। এ দরবারেই সুউচ্চ বেদীতে রাজার সিংহাসন। সেই সোনা-রতœ-হিরে খচিত রাজ সিংহাসনে বসে আছে জেলেনি

রাণী ইসেবিল। তার মাথায় ঝকঝকে সোনার মুকুট। হাতে কাঁচা সোনা আর মহামূল্যবান পাথর-খচিত রাজদন্ড। রাণীর দু’পাশে

সার দিয়ে পাহারায় রতঃ সুন্দরী সহচরী দল। তাদেরকে সারিবদ্ধ করা হয়েছে উচ্চতার ক্রমানুসারে।

তাহলে গিন্নী, তুমি সত্যি সত্যিই রাণী হলে? হ্যাঁ! আমি এখন রাণীই বটে।

বৌ’র দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে জেলে। চোখের পলক আর পড়ে না। তাকিয়ে  আছেতো তাকিয়েই আছে। চোখ যেন

সরতে চায়না। পরিতৃপ্ত দৃষ্টি। বলে, রাজা-রাণী হওয়া বড়ই সুখের, তাই না বৌ? এখন আমাদের আর কিচ্ছু চাইবার নেই। একে

একে আমাদের সব ইচ্ছাই পূরণ হয়েছে। আর কি চাই?   না, না বাপু! অস্থির হয়ে জবাব দেয় জেলেনি। রাণী হয়ে আমি ক্লান্তিকর

সময় কাটাচ্ছি। রাণী হওয়াটাই যথেষ্ট না। আমাদের হতে হবে,  মহারাজা-মহারাণী, সম্রাট-সম্রাজ্ঞী ।

বলো কি বৌ? কেন তুমি সম্রাজ্ঞী হতে চাও? আমরাতো অনেক পেয়েছি। আরাম আয়েসের কোনইতো কমতি নেই। মহাসুখেইতো

কাটছে আমাদের জীবন।   না, না! আমি কিচ্ছু শুনতে চাইনা। কিচ্ছু মানবো না আমি। আমাকে-যে সম্রাজ্ঞী হতেই হবে। আর

বেশি কথা বলোনা, আর বাজে বকোনা। এক্ষুনি আবার মাছের কাছে যাও। দেরী করোনা। স্বামীকে তাগাদা দেয় জেলেনি।

শোন গিন্নী! মাছ তোমাকে সম্রাজ্ঞী বানাতে পারবেনা। তাছাড়া মাছের কাছে আর কিছু চাওয়াটা বোধ করি ঠিকও হবে না। তার

কাছে আর কিছু চাইতে আমার বাঁধো বাঁধো ঠেকছে। তাছাড়া একটা সাম্রাজ্যে একজনইতো সম্রাট থাকে, তাইনা? মাছ

আমাদেরকে সম্রাট- সম্রাজ্ঞী বানাতে পারবে না। কারন এটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। জেলের কথা শুনে ক্ষেপে যায় জেলেনি। কী

বললে? তুমি মাছের কাছে যেতে পারবে না? শোন, আমি রাণী। আর তুমি আমার অধীন। দাসতুল্য। আমি আদেশ করছি, এক্ষুণি

তুমি মাছের কাছে যাবে। এর অন্যথা করো না। আমার নির্দেশ তামিল করো। অনর্থক তর্ক করো না। আর বিলম্ব সয় না আমার।

মাছটাকে গিয়ে আমার ইচ্ছের কথা জানাও।   শেষতক বাধ্য হয় বেচারা জেলে। যেতে যেতে আপন মনে ভাবতে থাকে, এ

অবাস্তব বর চেয়ে কোন লাভ নেই। এর ফল ভাল হবে না। সম্রাট- সম্রাজ্ঞী হতে চাওয়াটা বড্ড লজ্জার ব্যাপার। একের পর এক এ

ভাবে বর চাইতে থাকলে মাছটা শেষ পর্যন্ত -বিরক্ত হয়ে পড়বে। এমনকি আমাদের উপর রেগেও যেতে পারে সে।  এ রকম সাত-

পাঁচ ভাবতে ভাবতে পথ চলে জেলে। শেষে এসে হাজির হয় সাগর সৈকতে। সাগরের দিকে চোখ মেলে তাকায়। জলের অবস্থা

দেখে অবাক হয়ে যায়। সাগরের জলের রঙ কুচকুচে কালো হয়ে গেছে। ঘোলাটে গাঢ় জল। প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে উত্তাল সাগর। যেন

উত্তাপে ফুলে ফেঁপে উঠছে। জল জমে ঘণীভূত হয়ে আছড়ে পড়ছে ঢেউয়ের আঘাতে। জলের হতচ্ছারা অবস্থা। ভয়Ñদ্বিধা-

সংকোচে কাঁপা স্বরে জেলে মাছটাকে ডাকে:

সাগর দুলাল সাগর দুলাল বারেক শুনে যাও, আমার বৌ-এর ইচ্ছেটুকু পূরণ করে দাও।   কষ্টে আছি, কষ্টে বাঁচি দিন-যে কাটে

দুঃখে,  তোমার দয়ার একটি বরে বাঁচবো পরম সুখে।

জেলের  ডাকে সারা দেয় মাছটা। এসে হাজির হয় জেলের কাছাকাছি। বলে, কি হে? আবার কেন ডাকাডাকি? কিসের কষ্ট

তোমাদের? এখনতো তোমাদের আর কোন দুঃখ থাকবারই কথা নয়।  না মানে, তেমন কিছু নয়। জেলের মুখে যেন কথা ফোটে

না। আমার গিন্নীর মনে খানিকটা কষ্ট আর কি! আর কি চায় সে?  মাছের গলার স্বর যেন খানিকটা গম্ভীর। জেলে আমতা আমতা

করে। মুখ কাচু-মাচু করে নরম সুরে এবার আসল কথাটা বলেঃ  আমার গিন্নী সম্রাজ্ঞী হতে চায়। আচ্ছা। ঠিক আছে। তুমি বাড়ি

যাও। দেখ গিয়ে তোমার বৌ এখন সম্রাজ্ঞী।  জেলে বাড়ি ফিরে আসে। ও বাবা!  এ যে আজব ব্যাপার! কী বিরাট রাজপ্রাসাদ! এর

কোনা-কানছি পর্যন্ত মসৃণ মার্বেলে তৈরী। এখানে ওখানে মর্মর পাথরে গড়া ভাস্কর্য। মর্মর মূর্তি। কাঁচা সোনার বর্ণিল অলংকারে

সজ্জিত সিংহদ্বার। এর বাইরে জাঁকালো পোশাকে সুসজ্জিত সেনাদল। চৌকস, কেতাদুরস্ত। কুচকাওয়াজ করে জোড়কদম

এগিয়ে আসছে বাম-ডান, বাম-ডান। জেলেকে সামরিক কায়দায় জানায় সশ্রদ্ধ সালাম, সমবেত অভিবাদন। বিনা মেঘে

বজ্রপাতের মত বেজে উঠে কাড়া-নাকাড়া। আকাশ কাঁপানো শব্দ। বাজছে ঢাক-ঢোল। বেজে উঠে জয়ভেরী, জয়ডংকা। সদর

ভবনে ঘুরে বেড়াচ্ছে কত ব্যরন, কাউন্ট, ডিউক, নাইট। যেন দাস দাসী, চাকর-নকর। জেলেকে দেখে খুলে দেওয়া হলো

স্বর্ণদ্বারের খিলান। জেলে ধীর পদে এগিয়ে যায় সম্রাটের দরবারের দিকটায়। দেখে, সিংহাসনে উপবিষ্ট তার স্ত্রী সম্রাজ্ঞী ইসেবিল।

নিখাদ সোনার একটি মাত্র অখন্ড টুকরায় তৈরী এ সিংহাসন। এত উঁচু বেদীতে সে সিংহাসন যেন এর উচ্চতা মাইল দুয়েকের কম

নয়। তার মাথায় মহামূল্যবান মহামুকুট। আকারে যেমন বড়, সৌন্দর্যে তেমন অতুল্য। স্বর্ণের তৈরী রাজমূকুট। লম্বায় তিন গজ।

হীরা, জহরত, মণি, মানিক্য আর দামী দামী পাথর বসানো হয়ে মুকুটে। যাকে বলা যায় মানিক খচিত মুকুট। সম্রাজ্ঞীর এক হাতে

ঝলমলে রাজদন্ড। আরেক হাতে সূর্য অংকিত রাজগোলক। চকচকে রাজনির্দশন। দেহরক্ষীরা তার দুপাশে দু’সারে দাঁড়িয়ে।

এদের একজন অন্যজনের চেয়ে সমান মাপে ছোট। উচ্চতার ক্রমানুসারে সারিবদ্ধ এ রক্ষীদল। শুরুতে যে দাঁড়ানো সে দৈত্যের

মত লম্বা। আর সারির সর্বশেষ রক্ষীটি এক্কেবারে খাট্টাখোট্টা। সম্রাজ্ঞীর সামনে বিনম্র বিনয়ী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে অগুনতি

রাজপুত্র, ডিউক, রাজা, উজির, পাইক-পেয়াদা। জেলে এগিয়ে যায়। জেলেনিকে বলে, গিন্নী, তাহলে তুমি সত্যি সত্যিই সম্রাজ্ঞী

হলে!  হ্যাঁ! হলামতো। এখন আমি সত্যিই সম্রাজ্ঞী।  জেলে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জেলেনির দিকে। চোখের পলক ফেলেনা।

খানিক বাদে বলে, সম্রাট-সম্রাজ্ঞী হওয়া সত্যিই খুব সুখের, তাই না গিন্নী?  হ্যাঁ তবে আমরা সম্রাট-সম্রাজ্ঞী হয়েই থাকব কেন?

আমরা আরো বড় হবো, আরো বড়। বৌ’র কথা শুনে জেলেরতো আক্কেল গুড়–ম। বলে কি জেলেনি! অবাক হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে

থাকে জেলে। বাকরুদ্ধ হয়ে আসে। শেষে নিজকে খানিকটা সামলে নেয়। বলে, আর কি হতে চাও তুমি? সম্রাট-সম্রাজ্ঞীর চেয়ে

বড় আর কি আছে হে?  আছে, আছে। আলবৎ আছে। পোপ, আমি পোপ হতে চাই।  কি আবোল-তাবোল বকছো তুমি গিন্নী!

পাগল নাকি? কি বলছো তুমি? তুমি কেমন করে পোপ হবে? গোটা খ্রীষ্টান জগতে এক সময়ে মাত্র একজনই পোপ থাকেন। না,

না গিন্নী! এমন বায়না করোনা। তাছাড়া মাছ তোমাকে পোপ বানাতে পারবে না। পোপের আসনে বসেন পুরুষ ধর্মজাজক। তুমি

তো মেয়ে মানুষ।  জেলের কথা শুনে ক্ষেপে যায় জেলেনি। বলে, অতোশতো বুঝিনা বাপু। আমি পোপ হবো, বাস্। যাও। মাছকে

গিয়ে বলো। আমাকে পোপ বানাতেই হবে। যাও, যাও। আমার ইচ্ছাটা মাছকে জানাও। আজকের মধ্যেই আমি পোপ হতে চাই।

আর দেরি করো না। রওয়ানা কর শীগগির।  না গিন্নী। আমি মাছের কাছে এমন বর চাইতে পারব না। আর এটা উচিতও নয়। এতে

হিতে বিপরীত হতে পারে। এটা একদম বাড়াবড়ি।  আর এ কথা কেন বুঝতে চাও না যে, মাছ তোমাকে পোপ করতে পারবে না।

জেলের কথা শুনে আরো রেগে যায় জেলেনি। বলে, কী আবেল-তাবোল বলছো তুমি? বাজে বকবে না বলছি। বোকার হদ্দ। আরে,

যে কিনা সম্রাজ্ঞী  বানাতে পারে, সে পোপ বানাতে পারবেনাÑ  এটা কি একটা কাজের কথা হলো? যাও, যাও। আর অযথা তর্ক

করো না। আমার ইচ্ছার কথাটা মাছকে গিয়ে বলোইনা। দেখ কি হয়! জেলে বেচারা নিরূপায়। তার মনে ভয়। অজানা শংকা।

অস্বস্তিতে ভুগছে জেলে। কেমন যেন অসুস্থতা অনুভব করছে। দু’হাঁটু ভয়ে কাঁপছে। দু’পা টলছে। সাগর পাড়ে গিয়ে জলের

দিকে তাকায়। প্রবল ঝড়ো বাতাসে সাগরের জল ফুঁসে উঠছে। যেন ফুটন্ত জলের মাতাল ফোয়ারা। সন্ধ্যার গহন অন্ধকারে

আচ্ছন্ন চারিদিক। ঘন কালো মেঘ বাতাসে তাড়া খেয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে তীব্র বেগে। গাছের পাতারা ঝড়ের তান্ডবে ছিন্নভিন্ন হয়ে

ঝরে পড়ছে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে উত্তাল অশান্ত উন্মত্ত সাগর। সাগরের গভীর গর্জনে কানে তালা লেগে যায়। ফুটন্ত জলের ঢেউয়ের

ফণা যেন সাগর পাড়ে আছাড় খেয়ে পড়ে। এভাবেই চলে উত্তাল ঢেউয়ের ভাঙ্গা-গড়া। ঐ দূরে বিরাট বিরাট ঢেউয়ের চূড়ায়

জাহাজগুলো যেন এই ডোবে, এই ভাসে। নিভু-নিভু আলোর কণার মতো দেখা যাচ্ছে জাহাজগুলোকে। এমন ভয়ংকর অবস্থায়

পড়ে ওরা পাঠাচ্ছে মহাবিপদ সংকেত। সারা আকাশ ভয়াল কালো মেঘে ঢাকা। আকাশের মাঝখানটায় শুধু একটু খানি নীল দেখা

যায়। বাদ বাকী সব দিক পরিনত হয়েছে লালে। অদ্ভুত রকমের লালচে আভায় ছেয়ে গেছে চারদিক, যেন ভয়ংকর কোন ঝড়

ধেয়ে আসছে। ঝড় যেন আজ আগুনের লাল লেলিহান শিখার মতো প্রলয় ঘটাবে। যেন দৈত্য দানোর লংকা কান্ড। এমন ভয়াল

অবস্থায় হতাশার সুরে জেলে গলা ফাটিয়ে বলতে থাকেঃ

সাগর দুলাল সাগর দুলাল বারেক শুনে যাও, আমার বৌ-এর ইচ্ছেটুকু পূরণ করে দাও।   কষ্টে আছি, কষ্টে বাঁচি দিন-যে কাটে

দুঃখে,  তোমার দয়ার একটি বরে বাঁচবো পরম সুখে।

এবারও মাছ এল। বলে, কি হে! আবার কি হলো। এখনো তোমাদের কিসের কষ্ট? যা চেয়েছো, সবইতো পেয়েছো। তাহলে আর

কিসের কষ্ট? আচ্ছা বলতো, তোমার বৌ আর কি চায়?  কাঁপা কাঁপা স্বরে জেলে বলে, আমার বৌ পোপ হতে চায়।  মাছ বলে,

তথাস্তু! যাও, বাড়ি যাও! গিয়ে দেখ, তোমার বৌ এতক্ষণে পোপ হয়ে গেছে। জেলে বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ির কাছে এসে দেখে

 

অবিশ্বাস্য ব্যাপার। বিরাট এক সুউচ্চ গীর্জা। সুরম্য দালান-কোঠায় পরিবেষ্টিত।  কোন রকমে ভীড়-ভাট্টা ঠেলে জেলে খানিকটা

পথ করে নেয়। তারপর ভেতরে ঢুকবার সুযোগ পায়। গীর্জার ভেতরকার দৃশ্য বর্ণনার অতীত। বর্ণালী আলোকচ্ছটায় ঝলমল

পুরো এলাকা। হাজার হাজার রঙীন বাতির উজ্জ্বল আলোয় ঝকমক চারদিক। এরি মধ্যে জেলে তার গিন্নীকে দেখতে পায়

পোপের বেশে। নিখাদ সোনালী সূতোয় বোনা পোষাকে সুসজ্জিত। গীর্জার অনেক উচ্চ বেদীতে স্থাপিত স্বর্ণ সিংহাসনে বসে

আছে জেলেনি পোপ। মাথায় শোভা পাচ্ছে তিনখানা বিশাল আকারের সোনার মুকুট। তাকে ঘিরে রেখেছে গীর্জার নানা পদের

নানা পদবীর পাদ্রী, যাজকেরা। তার হাতের কাছেই রাখা আছে মোমবাতি, দুই সারে। নানা আকারের, নানা শোভার অসংখ্য

বাতিদানি। সবচে বড়টাকে দেখতে মনে হয় একটা বিরাট উঁচু টাওয়ার। আর সবচেয়ে ছোটটা সেজবাতির সলতের আলোর মত

মিটি মিটি জ্বলছে। রাজা-মহারাজা, মহামান্য সম্রাট সকলেই সামনে মাটিতে হাঁটু গেড়ে পোপকে জানাচ্ছে সশ্রদ্ধ বিনম্র

অভিবাদন । তার চপ্পলে চুমু খাচ্ছে পরম ভক্তিভরে।  পোপকে ঘিরে এত জাঁকজমক, এত চাকচিক্য দেখে জেলেতো হতবাক।

জেলেনির দিকে প্রসন্ন দৃষ্টি মেলে বলে, গিন্নী, তাহলে তুমি এখন পোপ?  আভিজাত্যে ভরা গম্ভীর কন্ঠে জেলেনি জবাব দেয়, হ্যাঁ,

হলামতো! আমি এখন পোপ।  জেলে তার জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকায় জেলেনির দিকে। যেন সে

তাকিয়ে আছে কোন এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের দিকে। অবাক হয়ে খানিকক্ষন জেলেনির দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, পোপ হওয়া

খুবই সুখের ব্যাপার, তাই না গিন্নী! এখন তুমি নিশ্চয়ই খুব খুশী। পোপের পদের চেয়ে বড় পদতো আর নেই এই পৃথিবীতে। তুমি

নিশ্চয়ই খুব খুশী! নিশ্চয়ই তোমার আর কোন চাওয়াই অপূর্ণ রইল না, তাইনা গিন্নি?  জেলেনি কথা বলে না। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে

থাকে। যেন অচল-অটল ছবি। বৃক্ষের মতো অনড় স্থবির হয়ে থাকে। বলে, আচছা, সে ভেবে দেখা যাবে খন। এখন চলো। খাওয়া

-দাওয়া সেড়ে ঘুমুতে যাই।  জেলে জেলেনি দু’জনে শুয়ে পড়ে। তুলতুলে বিছানায় শুয়ে বালিশে মাথা রাখতে না রাখতেই জেলের

গভীর ঘুম। এমনিতেই বেচারার উপর দিয়ে দারুন ধকল গেছে সারাটা দিন। শরীর ক্লান্ত, অবসন্ন। তাই শোওয়া মাত্রই চোখ জুড়ে

নেমে আসে রাজ্যের ঘুম।  কিন্তু জেলেনির চোখে ঘুম নেই। কারন তার এখনো অতৃপ্তি। এখনো সে পূর্ণাঙ্গ সুখি বলে নিজেকে

ভাবতে পারে না। বিছানায় শুয়ে কেবলই এ পাশ-ওপাশ করতে থাকে। আরো বড় কিছু পাবার ইচ্ছে তার মনে কাঁটা হয়ে বিঁধতে

থাকে। সারা রাত তার একটাই ভাবনা, এর পর আর কি হওয়া যায়? কিন্তু নির্দিষ্ট কিছুই ভেবে পায়না। জেলেনির রাত কাটে নির্ঘুুম।

এরই মাঝে ভোরের আলো  ফোটে। পূব আকাশে উঁকি দেয় সূর্য। ছড়িয়ে দেয় অরুণিম লালিমা।  হুড়মুড়  করে জেলেনি শোওয়া

থেকে ওঠে বসে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। দেখে লাল থালার মত জ্বলজ্বল করছে সকালের উদিত সূর্যটা। আর যায় কোথায়!

জেলেনি তার ইচ্ছের খোঁজ পেয়ে যায়। ভাবে, আহা! আমি কি চাঁদ-সূর্যের উদয় অস্তের ক্ষমতা পেতে পারিনা? আমাার আদেশে

ওরা উঠবে, ডুববে। এরা থাকবে আমার ইচ্ছের অধীন। ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে উঠে জেলেনি। কনুইয়ের এক গুঁতোতে

জাগিয়ে তোলে জেলেকে। বলে, ওঠ ওঠ, আর ঘুমোতে হবে না। অনেক ঘুমিয়েছ। যাও, এক্ষুনি যাও মাছের কাছে। আমি ইশ্বর

হতে চাই। বেচারা জেলের তখনো গভীর ঘুমের আমেজ কাটেনি। বৌ’র ধাক্কা খেয়ে হকচকিয়ে যায়। হঠাৎ গভীর ঘুম থেকে

চমকে উঠে বেচারা। খাট থেকে নাবতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে যায় খাটের নীচে। ভাবে, গিন্নির সঙ্গে তার কোন ভুলবোঝাবুঝি

হলো নাকি! ঘুম জড়ানো দুচোখ রগড়াতে রগড়াতে বলে, কি হয়েছে গিন্নী। কোন সমস্যা?  জেলেনি রুক্ষ স্বরে বলে, শোন বাপু!

আমি যখন দেখি আমার আদেশ ছাড়াই চাঁদ-সূর্য উঠছে, অস্ত যাচ্ছেÑ তখন আমি তা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিনা। রাগে

আমার গা জ্বলে যায়। এটা আমার কাছে বড়ই অশান্তি আর অস্বস্তির ব্যাপার। এর একটা বিহীত করা চাই-ই চাই। শীগগির যাও মাছের কাছে। বলো, আমি চাই আমার কথা মত চাঁদ-সূর্যের উদয়-অস্ত ঘটবে। গজ গজ করতে করতে জেলেনি বিরক্ত-

বিতৃষ্ণাকর দৃষ্টিতে জেলের দিকে তাকায়। আর বৌ’র এমন ভয়ংকর মূর্তি দেখে থর থর করে কাঁপতে থাকে বেচারা জেলে। দৈত্য-

দানোর মত দাঁত খট্মট্ করে জেলেনি রুঢ় স্বরে বলে, যাও, মাছের কাছে যাও। আর কুঁড়েমি করো না। অকম্মার ঢেঁকি। আমি

ঐশ্বরিক শক্তি চাই, বুঝলে হাদারাম! বৌ’র সর্বনাশা ইচ্ছের বিবরণ শুনে বাক রুদ্ধ হয়ে যায় জেলে। জেলেনির পায়ের কাছে

 

ধপাস করে বসে পড়ে। করুণ মিনতি করে বলে, মাছ এ বর কিছুতেই দেবে না গিন্নী। একটু বোঝার চেষ্টা কর। শান্ত হয়ে শোন!

মাছ তোমাকে ঈশ্বর বানাতে পারবেনা। ও তোমাকে রানী, সম্রাজ্ঞী, পোপÑসব বানিয়েছে। খানিকটা বোঝার চেষ্টা কর। তোমার

কাছে হাত জোড় করছি। দয়া করে তুষ্ট থাক। তৃপ্ত হও। খুশী মনে পোপগিরি করো। সারাটা জীবন এমন সুখে কাটাতে পারলে

আর কি চাই? দয়া করে অতটা অবুঝ হয়ো না গিন্নী! জেলের সান্ত্বনা বাণী বিফলে যায়। জেলেনি বরং আরো অশান্ত হয়ে উঠে।

রাগ আরো চড়ে যায়। দু’হাত দিয়ে টেনে চুল ছিঁড়তে শুরু করে। রাগের তোড়ে কটা কটা হয়ে যায় আলুথালু চুল। টেনে হিঁচড়ে

গায়ের কাপড়-চোপড় ছিঁড়তে থাকে। যেন বদ্দ পাগল। জেলেকে বাম পায়ের এক ঘা বসিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে,

অসহ্য! অসহ্য! আমার আর সহ্য হচ্ছে না। মানতে পারছিনা আমি। আমি কিচ্ছু শুনবনা। এক্ষুনি যাও মাছের কাছে। ঈশ্বর যে

আমাকে হতেই হবে।  বেড়ে চলে জেলেনির পাগলামো। এটা ছুঁড়ে মারে তো ওটা ভেঙ্গে ফেলে। এটা ছেঁড়ে, ওটা চুরমার করে।

অগত্যা বেচারা জেলে কোন রকম তৈরী হয়ে নেয়। সোজা দৌড়োতে থাকে পাগলের মতো। সে যখন সাগর পাড়ে পৌঁছুলো তখন

সেখানে চলছে প্রকৃতির মহাতান্ডব। সমুদ্রে তখন তুমুল ঝড়। তীব্র বেগে বইছে ঝড়ো বাতাস। পা টেকান দায়। দমকা বাতাসের

ঝাপটায় পা টলছে। গাছ-পালা ওপড়ে ফেলছে সমুদ্র ঝড়। ঘর-বাড়ি উড়িয়ে নিচ্ছে তুলোর মতো। পাহাড়-পর্বত থর থর করে

কাঁপছে। ধসে পড়ছে ঝড়ের আঘাতে। বড় বড় পাথর খন্ডগুলো ঢেউয়ের আঘাতে ঝপাং ঝপাং করে গড়িয়ে পড়ছে সাগরে।

আকাশ আলকাতরার মতো কালো। চারদিকে ঘোর অন্ধকার। মাঝে মাঝে শোনা যায় মেঘের গুরু গর্জন। বজ্রপাতের বিকট শব্দ।

থেকে থেকে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ। সমুদ্রের জল কালির চেয়েও কালো। ঢেউগুলো পাহাড়ের মত উঁচু। যখন ধেয়ে আসে তখন মনে

হয় গীর্জার ঐ উচুঁ টাওয়ারটাকে ছোঁবে। পাহাড়- চূড়া ছুঁই ছুঁই ঢেউ। এদের মাথায় মাথায় সাদা ফেনা যেন  গিরি চূঁড়ার শুভ্র বরফ।

এ ভয়াল দিনেই যেন ঘটতে যাচ্ছে মহাপ্রলয়। তবুও কাঁপা গলায় জেলে ডেকে বলেঃ

সাগর দুলাল সাগর দুলাল বারেক শুনে যাও, আমার বৌ-এর ইচ্ছেটুকু পূরণ করে দাও।   কষ্টে আছি, কষ্টে বাঁচি দিন-যে কাটে

দুঃখে,  তোমার দয়ার একটি বরে বাঁচবো পরম সুখে।  বিশাল এক ঢেউয়ের চূঁড়ায় চেপে মাছ এসে হাজির। বলে, আরে, এখনো

তোমাদের কিসের দুঃখ? আর কি চায় তোমার বৌ।

দ্বিধা আর ভয় জড়ানো কন্ঠে জেলে বলে, আমার বৌ ঈশ্বরের মতো হতে চায়। চাঁদ আর সূর্যকে আমার সে তার ইচ্ছা মাফিক

উঠানো আর ডোবানোর ক্ষমতা চায়। চাঁদ-সূর্যকে সে তার বশে রাখতে চায়।  ও তাই? মাছ বলে, যাও, বাড়ি যাও। গিয়ে দেখো,

ইতোমধ্যে তোমার বৌটা তোমাদের আগের সেই ছেঁড়া-খোঁড়া বিচ্ছিরি ঝুপড়িটাতেই বসে আছে।  জেলে বাড়ি ফিরে আসে। দেখে,

মাছের কথাই সত্য।   সেই পুরনো ময়লা-মলিন নড়বড়ে একচালা ঝুপড়ি কুঁড়েঘরে ছেঁড়া নোংরা কাপড়ে দীনহীন বেশে মুখ

কালো করে বসে আছে জেলেনি।   জেলে আর জেলেনি এ অবস্থায় বসে আছে এমন কি আজ অবদি।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত