স্বপ্ন ডাঙার তরী

স্বপ্ন ডাঙার তরী

সবুজের ধান ক্ষেতে ভরা আকাবাঁকা মেঠো পথের গা ঘেষে রহিম মিয়ার ছোট্ট বাড়ি।

বাড়ির অচিরেই মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে মস্ত বড় একটা আম বৃক্ষ।

নদীর বুক থেকে ভেসে আসা পানির মৃদু স্রোতের বাতাস এসে আচড়ে পড়ছে উঠান জুড়ে।

রহিম মিয়া পেশায় একজন কৃষক,ছোট থেকেই গ্রামের আলো-বাতাসের সংস্পর্শ পেয়ে বড় হয়েছে।

ছোট্ট একটা বাড়িতে তার একমাত্র মেয়ে ফুলিকে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার।মা’মরা মেয়েটাও যেন তার ঘরের লক্ষি হয়ে জন্মেছে।

বয়স কত হবে খুব বেশি হলেও ১২ বছর।

এই অল্প বয়সে ফুলি যেমন লক্ষি তেমনি সব কাজে পারদর্শীও বটে।

রহিম মিয়া নিজে কৃষক হলেও লেখাপড়ার মর্ম সম্পর্কে বেশটাই অবহিত, যার কারনে নিজে মাঠে রোদে পুড়ে হলেও তার

আদরের মেয়ে ফুলির পড়ালেখাটা কখনো বন্ধ করে নি।

আর ফুলিও মেধাবী ছাত্রী,প্রাইমারি স্কুল থেকে ১ম হয়ে এসেছে।

৫ম শ্রেনীতে বৃত্তিও পেয়েছে,রহিম মিয়ার বড় স্বপ্ন তার মেয়েকে ডাঃ বানাবে,মানুষের সেবা করাবে।

এই গ্রামে প্রতিবছর কত মানুষই না চিকিৎসার অভাবে মারা যাই,এমনকি তার সহধর্মিণীও টাকার অভাবে বিনাচিকিৎসাতে মারা

গেছে।

সময়ের বিবর্তনে দেখতে দেখতে বছর গুলিও তার নিজ গতিধারাতে বদলে গেলো,এদিকে ফুলি মাধ্যমিক শেষ করার সাথে সাথে

এইস এস সি তে ভালো রেজাল্ট করেছে।

এতদিনে রহিম মিয়া ফুলির পড়ালেখার খরচটা চালিয়ে গেলেও এখন আর তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরিরেও টান ধরেছে।

এখন পাঁচ মিনিট কোদাল দিয়ে মাটি কোপালে দশ মিনিট বিশ্রাম নিতে হয়।

এদিকে রহিম মিয়ার এতদিনের স্বপ্নটাও পূর্ণ হওয়ার সময় হয়েছে।

কারন এবার ফুলিকে শহরে যেতে হবে।
সেখানকার ভালো কলেজে পড়তে হবে।
কিন্তু সেতো অনেক টাকার দরকার।
ভাবতেই রহিম মিয়া একটা হতাশার নিঃস্বাস ছেড়ে বসে।

টাকার অভাবে কি তার ফুলির স্বপ্নটা পূরন হবে না।

বসত বাড়ি আর ক্ষেতের জমিটা বিক্রয় করলেও তো মনে হয় এত টাকা জোগাড় হবে নাহ্।

তবুও সে ফুলিকে ডাক্তার বানাবে,এটা তার স্বপ্ন।

রহিম মিয়া খোলা আকাশের নিচে বসে আছে, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অজস্র তারাগুলির দিকে।আর ভাবছে এত টাকা সে

কোথা থেকে জোগাড় করবে।এমন সময় তার মেয়ে কাধে হাত রেখে বললো।

>বাজান আমি আর পড়ুম না,অনেক পড়ে ফেলছি।

রহিম মিয়া ফুলির দিকে তাকিয়ে রইলো,ফুলির চোখেও জ্বল তবে এই জ্বল টা কিসের সেটা রহিম মিয়ার অজানা নয়।রহিম মিয়া

তার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারও টানা নিঃস্বাস ছাড়লো।

অবশেষে রহিম মিয়া আর তার মেয়ের স্বপ্ন পূরনের লক্ষে গ্রাম ছেড়ে শহরে রওনা দিলো।ব্যস্তময় শহরটির বুকে ফুলি একবারেই

নতুন।

শহরের আদব-কায়দা সবকিছুই তার অজানা।
ফুলির পূর্বের কোয়ালিফিকেশন দেখে ভর্তি হতে খুব একটা ঝামেলা হলো না।
ফুলি মেডিক্যাল কলেজে এডমিশন নিয়ে নিলো।
কিন্তু এখানে তো সব ধনিক শ্রেনীর সন্তান রা লেখাপড়া করে।
তাদের কাছে ফুলিকে একদম সম্পুর্ন নতুন লাগছে।।
দিন যাওয়ার সাথে সাথে ফুলিও তাদের সাথে নিজেকে খাপ খায়য়ে নিলো।
তার ব্যবহার আর ভালো ছাত্রী দেখে অনেকেই ফুলির সাথে বন্ধত্ব ও করে নিয়েছে।

কিন্তু ফুলির উদ্দ্যেশ্য একটাই,সে বড় ডাঃ হবে।
মানুষের সেবা করবে।
কিন্তু ডাক্তারি পড়ার জন্য অনেক খরচ,আর এতো টাকা তার বাবা কোথা থেকে জোগাড় করেছে সেটা তার অজানা।

কয়েকবার জানতে চায়লেও রহিম মিয়া কথাটি এড়িয়ে গেছে।

ফুলি তার বাবাকে তার সাথে শহরে থেকে যেতে বলেছিলো কিন্তু তার বাবা তাকে বুঝিয়ে গ্রামে চলে এসেছে।

ফুলি যখন ফোনে কথা বলে রহিম মিয়া কথার মাঝে মাঝে কাশি দেয়,ডাঃ এর কাছে থেকে ঔষুধ আনার কথা বললে বলে এনেছি।

বয়স হয়ছে তাই এমন টা হচ্ছে বলে বুঝিয়ে দেয়।

দেখতে দেখতে ফুলির ডাক্তারি পড়া প্রাই শেষ হয়ে এলো,এদিকে রহিম মিয়ার শরির এর অবস্থাও খারাপ থেকে খারাপ হতে

চলেছে।

এবার পরিক্ষা টা দিতে পারলেই ফুলির স্বপ্ন সার্থক হবে,আর তার সাথে তার বাবার ও।

ফুলি ডাক্তার এর ডিগ্রী নিয়ে তার নিজ গ্রামে ফিরে যাচ্ছে আজ,তার যোগ্যতা অনুযায়ী তাকে বাইরে পাঠাতে চেয়েছিলো কিন্তু

ফুলি তার নিজ গ্রামের মানু্ষের সেবা করতে চাই।

অসহায় মানুষদের পাশে থাকতে চাই।

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আজকে আবার সেই মেঠো পথের ধুলো ফুলির পা স্পর্শ করলো।

গ্রাম টাও আগের থেকে অনেক পাল্টিয়ে গেছে,গ্রামের কুড়ে ঘর গুলোর বদলে এখন বড় বড় ঘর তৈরি করা হয়ছে।

রাস্তাগুলোও পাকা হয়ে গেছে।

আকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে ফুলি তার বাড়ির দিকে রওনা দিলো।

তাকে বিহীন বাড়িটার করুন অবস্থা হয়ে আছে।

ঘর টা কেমন জানি অগোছালো,মরিচা ধরে যাওয়া টিনের চালটাও ভেঙ্গে পড়ার মতন অবস্থা।ঘরের চাল ভেদ করে সূর্যরশ্মি

ঘরের ভিতরে আলো ছড়াচ্ছে।

তার স্বপ্ন পূরনের জন্য তার বাবা কতই না কষ্ট করেছে,কিন্তু সেই মানুষ টা কোথায়।

বয়স হয়ে গেছে এখনো মাঠে যাওয়া ছাড়তে পারে নি,,

ফুলি তাড়াতাড়ি বাড়ির পাশে থাকা পুকুরটা কাছে গেলো,কারন এই সময় টাতে তার বাবা পুকুরঘাটে বসে থাকে।

কিন্তু পুকুর পাড়ে গিয়ে ফুলি তার বাবাকে কোথাও দেখতে পেলো না,চোখের সামনে দেখলো বাশের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা

কবর।
বেড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে অল্প কিছুদিনের ভিতরে এখানে কাওকে দাফন করা হয়েছে।।

কিন্তু তারা বাবা কোথায়,বাড়ির দিকে রওনা দিতে গিয়ে একটা বৃদ্ধ মহিলাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো তার বাবাকে কোথাও দেখেছে

কি না।

কিন্তু বৃদ্ধ মহিলাটা যেটা বললো,সেটা শোনার জন্য ফুলি মোটেও প্রস্তুত ছিলো না,তার বাবা নাকি দু মাস আগে মারা গেছে।

ফুলি নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না।

দু’মাস আগে মারা গেলে তার সাথে ফোনে কথা বলেছে কে এতদিন।

ফুলি দৌড়ে বাড়ির দিকে গেলো,ফুলিকে দেখে পাশের বাড়ির একটা চাচা এসে তার হাতে একটা চিরকুট দিয়ে গেলো।

ফুলি কাপাকাপা হাতে চিরকুট টা খুলে পড়তে শুরু করলো।

….আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি,তোকে মিথ্যা বলার জন্য।তুই তো জানতিস তোর বাবা কতটা গরিব,তবুও কখনো তোর কোনো

আবদার পূরনে অপুর্ণ রাখি নাই।আর তোকে ডাঃ বানানোটা আমার স্বপ্ন ছিলো আর সেটাকে অপুর্ণ রাখি কি করে।

আমার শেষ সম্বল জমিটুকু ও বিক্রি করে দিছিলাম তবুও তোর পড়ার খরচ জোগাড় করতে পারি নি,তাই নিজের একটা কিডনি

বিক্রি করে দিছিলাম।

আর তারপর থেকে আমি আর কাজ করতে পারতাম না,তুই অনেকবার জানতে চেয়েছিস এতটাকা কোথায় পেয়েছি কিন্তু আমি

বলি নি,কারন এটা জানলে তুই পড়া বাদ দিয়ে চলে আসতিস।।

তোর সাথে শেষবার কথা হবে মনে হয় আজকে আমার,খুব কষ্ট হচ্ছিলো কথা বলতে।
তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো,তবুও বলতে পারি নাই।
কারন তোর পরিক্ষা চলছিলো..

খুব কষ্ট হচ্ছে রে মা,আমি মনে হয় আর বাঁচবো না।তবে আমার একটা শেষ অনুরোধ তুই যখন ডাঃ পড়া শেষ করবি তখন তুই

গ্রামে একটা হাসপাতাল করে সেখানে গরিব অসহায় মানুষদের বিনা চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ্য করে তুলবি।

ক্ষমা করে দিস রে মা..

খুব ইচ্ছে ছিলো তোকে ডাক্তারি পোষাকে দেখবো কিন্তু সেটা মনে হয় আর হবে নাহ্।

ফুলি হাতে থাকা চিঠিটা চোখের পানি দিয়ে ভিজিয়ে ফেললো,দৌড়ে গিয়ে কবরের পাশে দাড়ালো।

চিৎকার করে কাদছে ফুলি,,

বাবা তোমার মেয়ে আজকে অনেক বড় ডাক্তার হয়েছে।তোমার স্বপ্ন পূরন করেছে।কিন্তু স্বপ্ন পূরনের জন্য যার এই ত্যাগ সেই

মানুষটাকেই আজকে খুশির দিনে পাশে পেলাম না।

বাবা আমি তোমার স্বপ্ন পূরন করবো,এই গ্রামে বড় হাসপাতাল করবো,আর সেখানে বিনাঅর্থে সেবা দিয়ে সুস্থ্য করে তুলবো

সবাইকে।।

ফুলি চোখের জ্বল মুৃছে নিয়ে পা বাড়ালো…তার বাবার কষ্ট করে বুনে আশা স্বপ্ন পূরনের লক্ষে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত