আফজাল সাহেব বারান্দার চেয়ারটায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন।
“তুমি এহানে আর আমি তুমারে ঘরে খুঁজতাছি”।
রাবেয়া খাতুনের কথায় আফজাল সাহেব চোখ মেলে তাকালেন। রাবেয়া খাতুন পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
“চল ঘরে চল, ঘরে গিয়া শুইয়া একটু আরাম করবা”।
আফজাল সাহেব কিছু বললেন না। তার এখানেই বসে থাকতে ভালো লাগছে। শীতের আলসে দুপুর। হালকা মৃদু হীম বাতাসের
সাথে রৌদ্রের উষ্ণতা শরীরে বেশ আরাম লাগছে। মাঝে মাঝে বারান্দার মেঝেতে গাছের পাতার ছায়া পড়ছে, ছায়া গুলো খেলা
করছে। আফজাল সাহেব এতখন মেঝেতে তাকিয়ে আলো ছায়ার খেলা দেখছিলো হঠাৎ চোখ লেগে যায়। আর রাবেয়া খাতুন
এসে আফজাল সাহেবকে জাগিয়ে দেয়।
রাবেয়া খাতুন আফজাল সাহেবের স্ত্রী। আফজাল সাহেবের দুই ছেলে আর এক মেয়ে। দুই ছেলেই শহরে থাকে। তারা এখন
শহরমুখী হয়ে গেছে, গ্রামে এলে তাদের অনেক সমস্যা হয়ে যায়। গ্রাম তাদের ভালো লাগে না। গ্রামে শহরের মতো রাস্তাঘাট,
দালানকোঠা নেই, গ্রামে শহরের মতো কি যেনো বলে ইন্টানের(ইন্টারনেট) না যেন কি সেইটা ভালো চলে না। তাদের কাজকর্মের
সমস্যা হয়। যে কারণে বড় বউমা আসতেই চায় না, তার মোবাইল চলে না। মায়ের সাথে দেখে দেখে কথাও বলতে পারে না। ছোট
ছেলেটা তো বাহিরে যাওয়ার জন্য ছুটাছুটি করছে। তার কি সব কাগজপত্র করতে হবে তা নিয়ে মহা ব্যস্ত। আর মেয়েটাকে
পাশের গ্রামেই বিয়ে দিয়েছে। স্বামী সংসার নিয়ে মেয়েটি ব্যস্ত দু-দন্ড ফুসরত পায় না। মাঝেমধ্যে একটু এসে দেখে যায় বুড়ো
বুড়ি দুটো কি করে।
জীবনের তিন ভাগ চলে গেছে এক ভাগ বা শেষ সময়ে এসে দুজন ভীষণ একা হয়ে গেছে।
“রাবেয়া………”
“হুম বলো”।
“আমি চলে গেলে তুমি কি একা থাকবা এই বাড়িতে”?
“কি সব আবোল তাবোল বলো? তুমি কই যাইবা”?
“বয়স তো আর কম হইলো না, শরীলডাও বেশি ভালা না, যদি কিছু হইয়া যায়”।
“এসব অলুক্ষুণে কথা আর কইবা না”।
কথাটা বলতে বলতে রাবেয়া খাতুনের চোখ দুটো অশ্রুজলে টলমল হয়ে উঠে, মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। নিজেকে সামলে নেয় তবুও বাঁধ
ভেঙ্গে গাল বেয়ে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ে। আফজাল সাহেব এখনো চোখ বন্ধ করেই আছে। নইলে এই মমতাময়ী নারীর চোখ দুটি
যে অশ্রুজলে ভরে উঠেছে আর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তা দেখতে পেতো।
আফজাল সাহেব মুচকি হেসে বলল,
“তুমি সেই আগের লাহানই আছো। কত বছর পার হইয়া গেল। চুলে সাদা কালা রং ধরলো, গতরের চামড়া ঢিলা হইলো, চক্ষুর
যতিও কইমা গেলো, তয় তুমি কিন্তু পাল্টাও নাই। চক্ষু বন্ধ করলে তুমারে সেই আগের লাহানই দেহি। ছোডো একখান মাইয়া,
চোখে গাঢ় কাজল, পায়ে আলতা, মুখটা কি মায়াবী। রাবেয়া……… ও রাবেয়া”।
রাবেয়া খাতুনের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আফজাল সাহেব চোখ মেলে তাকায়। দেখে রাবেয়া খাতুন পাশে নেই। আফজাল
সাহেব আবারো মুচকি হাসে। সে জানে রাবেয়া ঘরে চলে গেছে। বিছানার এক কোণায় বসে এখন কাঁদবে। বিয়ের পর থেকে দেখে
আসছে আফজাল। মন খারাপ হলেই রাবেয়া বিছানার সেই একটা কোণা, যে পাশটায় আফজাল ঘুমায় সেই পাশটায় বসে কাঁদে।
দখিনার জানালা দিয়া বাতাস আসে তার চোখের পানি শুকায় দেয়। আবারো গাল বেয়ে পানি পড়ে আবারো শুকায় দেয়। এই বুঝি
মান অভিমানের খেলা একজন অভিমান করে কাঁদে আর প্রকৃতি অভিমান ভাঙ্গিয়ে চোখের জল মুছে। প্রকৃতির কি অপরুপ
খেলা।
কিছুক্ষণ পরে ঘর থেকে রাবেয়া ফোন হাতে ছুটে আসে আফজাল সাহেবের কাছে। ক্ষীণ স্বরে বলে, “আরমানের ফোন তুমারে
চায়”।
আরমান আফজাল সাহেবের বড় ছেলে।
আফজাল সাহেব ফোন হাতে নিয়ে উঠানের সামনে এগিয়ে যায়। বাড়ির ভিতরে কথা শুনতে আর বুঝতে পারে না। আফজাল
সাহেব ফোন কানে ধরতেই আরমান বলে,
“বাবা তুমি এখনো জমিটা বিক্রি করো নাই? তোমাকে তো বললামই ইমরান বাহিরে গিয়ে টাকা পাঠালেই আবার তোমাকে জমি
কিনে দিবো। আর তুমি জমি জমা দিয়ে কি করবে? এখন কি আর সেই বয়স আছে? যে জমি জমায় খেতি করবে”?
“বাবা তুমারে তো বললামই ওই জমিডা তুমার দাদার, ওইডা বেচা আর আমারে জ্যান্ত কবর দেয়া একই কথা”।
“তার মানে তুমি এই জমি বিক্রি করবে না”?
“বাবা………”
“বাবা আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না তুমি হ্যাঁ অথবা না যেকোন একটা বলো”।
আফজাল সাহেব চুপ করে রইলেন। আরমান বাবার উত্তরের আশায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে লাইনটা কেটে দিলো।
আফজাল সাহেব উঠানে দাঁড়িয়ে, তার চোখ দুটি ছলছল করছে। পিছনে ফিরে দেখে রাবেয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আফজাল
সাহেব তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি মুখে রাবেয়ার দিকে এগিয়ে গেলেন। রাবেয়া কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভিতরে চলে
গেল। আফজাল সাহেব পুনরায় বারান্দার চেয়ারে বসলেন। ফোনটা টেবিলে রাখতে রাখতে আবার ফোন বেজে উঠলো। ফোন
ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ইমরানের কন্ঠ ভেসে এলো।
“বাবা তুমি কি চাওনা আমি বাহিরে যাই? বাহিরে গিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ি। ও তুমাকে বলে কি লাভ তুমি তো নিজের ভবিষ্যৎই
গড়তে পারোনি অন্যেরটা কি বুঝবে? সারা জীবন করেছো টা কি? টাকা-পয়সা, ব্যাংক-ব্যালেন্স যদি করতে তাহলে তোমাকে
এখন আর জমি বিক্রি করতে বলতাম না। ধ্যাত্ তোমাকে বলে কি, মা কোথায়? মাকে দাও ফোন”।
আফজাল সাহেব উঠে গিয়ে রাবেয়ার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে চলে আসে।
বাড়ির পিছনে আফজাল সাহেব একটা বাগান করেছে। বাগানে অনেক ধরনের গাছ লাগিয়েছে। গাছ গুলো বেশ বড়সর হয়ে
উঠেছে বছর দুয়েক গেলেই বিক্রি করার মতো হয়ে যাবে। বাগানে ফুলের গাছও আছে। প্রতিদিন অনেক ফুল ফুটে। অনেকেই
এসে পূজার জন্য ফুল নিয়ে যায়। আবার অনেকে বিয়ের কনের জন্যও ফুল নিতে আসে। আফজাল সাহেব সব ফুল বিনা পয়সায়
দেন, কারো কাছ থেকে এক পয়সাও নেন না। আফজাল সাহেব বাগানে হাঁটছেন। গাছ পালা গুলো সন্তানের মতোই আদর যত্নে
বেড়ে উঠছে। আফজাল সাহেব নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে মানুষের মতো কি প্রকৃতিও স্বার্থপর হয়? প্রকৃতি কি মানব জাতির
সাথে স্বার্থপরতা করে? এই যে এত আদর যত্নে তাদের বড় করে তুলছে এক সময় কি প্রকৃতি সব ভুলে যাবে? নাকি মনে রাখবে?
বিকেলের আযান পড়ে গেল। দূর থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। আফজাল সাহেব নামাজের জন্য তৈরী হবেন তাই বাসার
দিকে পা বাড়ালেন।
নামাজ শেষে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলেন যদিও বিকেলে নামাজের পর আফজাল সাহেব আর বিছানায় শুয়ে থাকে না বাহিরে বের
হন হাঁটতে। তবে আজ তার পুরো উল্টো হলো। রাবেয়া খাতুন আফজাল সাহেবকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে
পাশে বসলেন। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন,
“শরীলডা কি বেশি খারাপ লাগতাছে”?
“নাহ”
“তাইলে এহন যে শুইলা”?
“এমনি”।
রাবেয়া খাতুন ক্ষীণ স্বরে বলল,
“পুলাডায় তো টেকার লাইগা বার বার ফোন করতাছে। কি কমু? আমারে কয় যেন তুমারে বুঝাইয়া কই”।
আফজাল সাহেব একটু কেশে বলল,
“আইচ্ছা বুঝাও”।
রাবেয়া খাতুন ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল। সে কি বুঝাবে সেটাই তো জানে না।
“রাবেয়া”
“হুম বলো”।
“সারা জীবন এত আয় রোজগার করে কি করলাম”?
“হঠাৎ এই কথা”?
“বলোনা”।
“আয় রোজগার করে তো সংসার চালাইলা। পোলাপাইনের লেহাপড়া, ভরণপোষণ সব চালাইলা। নিজের বইলা তো দুই টেকা এক
জায়গায় রাখলা না”।
“ভুল হয়তো এখানেই। যদি সঞ্চয় করতাম নিজের বইলা। তাইলে আইজ আর কাউরে কথা শুনাইতে দিতাম না”।
“কেউ কিছু কইছে”?
“নাহ……রাবেয়া এই বাড়িডা আর জমিডাই আমার বাপের শেষ সম্বল। একটা পোলাই আছিলাম। বাপে জমিজমার কাজকর্ম
করতো। কম টেকায় জমি পাইলেই কিনা রাখতো। একটা পোলা আদর যত্নের কোন কমতি আছিলোনা। শুধু আছিলো মায়ের
অভাব। জন্মের পরই মইরা গেল, দেখলামও না মা কি চিনলামও না। বড় হইলাম………”
“তুমি এসব কথা আবার কেন………”
রাবেয়াকে থামিয়ে দিয়ে আফজাল আবার বলা শুরু করল,
“আইজ বাপের কথা মনে পড়তাছে ভীষণ। আমার বাপে কত কিছুই রাইখা গেছিল। সব একে একে বেচলাম। সন্তানগো ভালা
ভালা ইস্কুলে পড়াইলাম। নিজে পড়ি নাই তাই বইলা কি আমার সন্তানগো ও পড়ামু না? তাগোরে বড় করলাম তারা এহন……”
“ডাক্তাররে কি ডাকমু”?
“ডাক্তার ডাকবা কেন? আমার তো কিছুই হয় নাই। মনের কথা গুলা কইতাছি। তুমার শুনতে অসুবিধা হইলে আর কমুনা”।
“না না অসুবিধা নাই। তয় ডাক্তার যদি তুমারে দেইখা যাইতো তাইলে ভালা হইতো”।
“শুনো রাবেয়ার মা”।
“কি কইলা”?
“হাহাহা…………”
আফজাল জোরে হেসে উঠে। রাবেয়া ভ্রু কুচকে বলে,
“আবার হাসো”?
“তুমি কিন্তু আগের মতোই আছো”।
“এক কথা আর কত বার কইবা”?
“রাবেয়া…… আমার নতুন পাঞ্জাবিডা একটু বাইর করো”।
“কেন নতুন পাঞ্জাবি দিয়া কি করবা”?
“কাম আছে একটু বাইর হমু”।
নতুন পাঞ্জাবি পড়ে রাবেয়ার হাতে বানানো একটা খিলি পান মুখে পুরে আফজাল সাহেব বেড়িয়ে পড়লেন। বাড়িতে ফিরলেন
অনেক রাতে। রাবেয়া ভয় পেয়ে গেছিলো ভীষণ। কারণ আফজাল সাহেব কোথায় যাচ্ছেন, কি করছেন কিছুই বলে যাননি।
আফজাল সাহেব রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ল।
কয়েকদিন পর আফজাল সাহেব হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। শুকনো কাশি, সাথে শ্বাসকষ্ট। ডাক্তার এসে দেখে যায় আফজাল
সাহেবকে আর কিছু ঔষুধপত্র দিয়ে যান। সব সন্তানকে খবর পাঠানো হয়। তারা সময় করে এসে দেখে যাবে জানায়।
তার ঠিক দু’দিন পর দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে আফজাল সাহেব বারান্দায় এসে বসে। শ্বাসকষ্টটা ঠান্ডায় আরো বেড়ে গেছে। সে
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঝেতে। রাবেয়াকে ডাকার শক্তি টুকুও পাচ্ছে না। প্রকৃতির আলো ছায়ার খেলায় বারান্দার মেঝে
মুখরিত। কেবল চেয়ারে বসে থাকা মানুষটিই দেখতে পারছে না প্রকৃতির খেলা। চারিপাশে লোকের আহাজারি তার কান অব্দি
পৌঁচ্ছছে না। সে যেন পরম শান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।
আফজাল সাহেবের মৃত্যুর কিছু দিন পর তাদের পুরনো উকিল আসেন বাসায় রাবেয়ার সই নিতে। রাবেয়ার পাশে বসা মেয়ে
ঝুমা। কিছু কাগজপত্র এগিয়ে দেয় বড় ছেলের হাতে। ছোট একটা চিরকুট দেয় রাবেয়ার হাতে। রাবেয়া পড়তে পারে না মেয়ে
পড়ে শুনায়। আফজাল সাহেব সবার অগোচরে ব্যাংক ব্যালেন্স করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর সেই টাকা পাবে। সে সঞ্চয়
করেছিলেন ছেলে মেয়ে আর নিজের প্রিয় মানুষ রাবেয়ার জন্য। তবে অনুরোধ করেছে তার বাবার শেষ সম্বল দুটি যেন কেউ নষ্ট
না করে। তিনি চান জমিতে গরিব কেউ চাষাবাদ করুক। আর বাড়িটা যেন রাবেয়া বেঁচে থেকে বৃদ্ধাশ্রম বানিয়ে যায়। যেখানে
তাদের মতো বুড়ো বুড়ি থাকবে। যারা সন্তানদের সঞ্চয় মনে করে নিজেদের সর্বত্র দিয়ে বড় করে তুলে। ভাবে সন্তানরাই তো
দেখবে বুড়ো বয়সে। যারা এই মিথ্যে আশায় বুক বাঁধে তাদের জন্য। আর সন্তানেরা নিজেদের সঞ্চয়ের জন্য বাবা মাকে পথে
নামিয়ে দেয়। আহা প্রকৃতির কি নিয়ম। বাড়ির পিছনের বাগানটার দেখা শুনাও করতে বলেছে, কারণ বছর দুই যেতেই সেখানে
সঞ্চয় হিসেবে অনেক গাছ পাবে। আর উকিল সাহেবের কাছ থেকে যে টাকা গুলো পাবে সেই টাকা গুলো যেন সমান ভাগ করে
ছেলে মেয়েদের দেয়া হয় আর নিজের জন্যও রাখে। যাতে কেউ না বলে, কেউ আঙ্গুল না তুলে। সঞ্চয় করোনি কেন? কিছু রাখনি
কেন? সারা জীবন কি করেছ?
প্রকৃতি……প্রকৃতি বড় নিষ্ঠুর মানুষকে সঞ্চয়ী করে তুলতে বাধ্য করে।