ভোরবেলার আকাশটা দেখতে অনেক সুন্দর। এই আকাশের দিকে তাকিয়ে নির্বিঘ্নে অনেক মনের কথা বলা যায়। তার সাথে যোগ
দেয় নিরবতা। ভোরের নিরবতা বেজায় অদ্ভুত। হঠাৎ করেই নিরবতা ভঙ্গ করে, আবার ক্ষণিক পরেই আগের মতো হয়ে যায়।
সূর্যের ছোয়াটা লাগার সাথে সাথেই আস্তে আস্তে ভোরের আবছা আলো পরিপূর্ণতা লাভ করে। নতুন দিনের সূর্যটা গাছের পাতার
উপর এমনভাবে পড়ে যে এর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। গাছের পাতাগুলো মাথা চারা দিয়ে উঠে। পাখিরাসহ
প্রকৃতির সবকিছুই এই আলোর খেলায় মেতে উঠে। এ যেন কোন এক চমৎকারী আলো! যা সবকিছুকেই রাঙিয়ে দিয়ে যায়।
.
দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে সবার মাঝেই ব্যস্ততা চলে আসে। সবাই তার কাজের জন্য তৈরি হয়। ঠিক এরকমই রোজকার
মতই সকালবেলা ঘুম থেকে উঠল কহরত। গায়ের মধ্যে মাটি লেগে আছে। পড়নে ছেড়া একটা হাফ প্যান্ট আর গ্যাঞ্জি। কোনবা
কালে এই জামা-কাপড় পেয়েছিল! ময়লাতে একবারেই অবস্থা খারাপ। যাই হোক, কহরত এর বয়স ১১-১৩ হবে আর কি। ঘুম
থেকে উঠেই চারপাশে ছাগল আর গরুর ডাকাডাকির শব্দ শুনতে পেল। হ্যাঁ, এটা গোয়াল ঘর। ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে আসল
কহরত। দেখতে পেল রহিম চাচা উঠানে বসে তার নাতির সাথে খেলা করছে। তিনিই এই বাড়ির মালিক। রহিম চাচা কহরতকে
উদ্দেশ্য করে বলল,
– কী মহারাজের ঘুম হলো? না আরও সময় লাগবে?
– না, চাচা। আজ যথেষ্ট হয়েছে।
– এত বেলা করে উঠলে ঘুম তো হবেই! বলি এত কাজ যে আছে এগুলা কে করবে?
– আপনি চিন্তা করবেন না, আমি সব করে ফেলব।
– কথা তো খুব ভালই শিখেছো। ইদানিং তোমার কাজ-কর্মে তেমন তৃপ্তি পাই না। দেখ আমি সব পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি, আমার
এখানে থাকতে হলে সব কাজ সময় মত করতে হবে। না হলে আমি কাজ থেকে বহিস্কার করতে বাধ্য হব।
– এমনটা করবেন না, চাচা। আমি সব কাজ আপনাকে সময় মত করে দিব।
– এটাই যেন হয়। বাপ-মা তো মরছে, এখন আমার বোঝা হয়ে গেছে।
কথাটি বলে রহিম চাচা তার মত নাতির সাথে আবার খেলতে লাগল। রহিমের শেষ বাক্যটা শোনার পর কহরত অনেকটা থমকে
যায়। তার মনে অজানা কিছু কষ্ট হানা দিতে থাকে। অপলক দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল সে। তারপর
নলকূপ থেকে জল নিয়ে নিজের চোখ-মুখ পরিষ্কার করল। চোখে জল দেয়ার সময় সে টের পেল নলকূপের জল এর সাথে আরও
অন্য কোন জল চোখ দিয়ে ঝরছে। কিন্তু এ জল বাহির থেকে দেখা অসম্ভব। এ জল শুধু তার অন্তরই অনুভব করতে পারে।
চোখ-মুখ মুছে নিল কহরত। তারপর রান্নঘরের সামনে উপস্থিত হল কহরত। সুহা চাচী বলে হাঁক দিল। ভিতর থেকে একজন
মধ্যবয়স্কা মহিলা বাইরে বেড় হল। হাতে তার একটা থালা। থালাটা কহরত এর হাতে দিয়েই তিনি আবার রান্নাঘরের ভিতরে চলে
গেলেন। একটি কথাও বললেন না। কহরত থালার দিকে তাকালো, রোজকার মতই আজও তার কপালে পান্তা ভাতই জুটল। তবে
সে মনে মনে খুশি হল এই দেখে যে আজ পান্তার সাথে আলু ভর্তা আছে। তাই সে সময় নষ্ট না করে গপাগপ খেতে লাগল। খাওয়া
শেষ হলে সে থালাটা ধুয়ে এনে রান্নাঘরের সামনে রেখে দিল।
.
তারপর গোয়াল ঘরের দিকে চলে গেল। একটা একটা করে ৫টি গরু ঘরের বাইরে বেড় করে যাথাস্থানে বেঁধে রাখল। গরুগুলোও
রোজকার মতই তার সঙে নির্দিষ্ট স্থানে গেল। তারা কহরতকে অনেক ভাল ভাবেই চেনে। গত দুই বছর ধরেই কহরত তাদের
দেখাশুনা করছে। হয়তো তারাও কহরতের মনের দুঃখ গুলো বুঝে, তাই মাঝে মাঝে তাকে দেখলেই তারা অনেক নিরবতা পালন
করে। গরুগুলোকে নির্দিষ্ট স্থানে রেখেই কহরত তাদেরকে খাবার দিল। তারপর ২০টি ছাগল সঙ্গে নিয়ে সে খোলা মাঠের দিকে
রওনা দিল। সম্পূর্ণ বিস্তৃত মাঠ। চারিদিকে কত ব্যস্ততা! কহরত ছাগলগুলোকে একটি নদীর ধারে ছেড়ে দিল। অপলক দৃষ্টিতে
সে ছাগল গুলোর ঘাস খাওয়া দেখছে। চারিদিকে মানুষরা তাদের নিজ নিজ কাজ করছে। কহরত শুধু চেয়ে চেয়ে সবকিছু
দেখছে। এ তার নিয়মিত কাজ। দূরে সে দেখতে পেল পথ দিয়ে হেঁটে ছোট ছোট শিশুগুলো বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে সে
চোখে ঝাপসা দেখতে থাকে। তার চোখে জল চলে এসেছে। কী যেন ভাবছে সে। হয়তো তার বাবা-মা থাকলে সেও আজ বিদ্যালয়ে
পড়তে পারত। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কাছে তার ইচ্ছাটা অতি ছোট।
.
দুই বছর আগের কথা, কহরত এর বাবা রহিম চাচার বাড়িতে চাকরের কাজ করত। তার একটা বদ অভ্যাস ছিল। সেটা হল, তিনি
বিড়ি খেতেন। শেষ পর্যন্ত এই নেশায়ই তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। ফুসফুসে ক্যান্সার এর কারণে একদিন তিনি পরকালে পাড়ি দেন।
বাবার মৃত্যূর দুই দিন পর স্বামী হারানোর শোকে তার মাও মরে গেলেন। মাত্র দুই দিনে কহরত এর পুরো জীবন বদলে গেল।
লোক চক্ষুতে ভাল সাজার জন্য রহিম চাচা কহরতকে তার বাড়িতেই থাকতে দেয়। কিন্তু তাকে দিয়ে করিয়ে নেয়নি এমন কোন
কাজ আর বাকি নেই। সব কাজের মধ্যে কহরত এর প্রধান কাজ হল রাখালী করা। সে হয়ে গেল একজন রাখাল।
.
এই পুরনো কথাগুলো কহরতের মনকে প্রায়ই আন্দোলিত করে। মাঝে মাঝেই মনে হয় মায়ের কাছে সে কতই না রুপকথার গল্প
শুনেছিল। রুপকথার গল্পের রাখালের চরিত্র এর সাথে আজ সে নিজেক মিলিয়ে আর কোন হদিস পায় না। তার কাছে রুপকথার
গল্প আজ মূল্যহীন। চোখগুলো দিয়ে সে তার ভবিষ্যৎ দেখতে চায়, কিন্তু পারে না। পারবেই বা কী করে, নিজের ভবিষ্যৎ কী কেউ
কখনো দেখতে পায়! এটাতো অসম্ভব! দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে গেল অনেকখানি। দূরে কহরত কতগুলো পাখি উড়তে
দেখল। সে নিঃশব্দে পাখিগুলোকে দেখছে। তার মন যেন পাখিগুলোর কাছে কিছু একটা আবদার করছে। হয়তো সেও সেই
পাখির দলের সাথে উড়ে যেতে চায়। আস্তে আস্তে দুপুর হয়ে গেল। কহরত ছাগলগুলোকে ছায়ায় নিয়ে এলো। ক্ষণিকের জন্য
সেও গাছের তলায় জিড়িয়ে নেয়ার নিমিত্তে বসল। চোখদুটো বন্ধ করে সে স্বপ্নের দেশে পাড়ি দিতে চায়। কিন্তু তার যে অনেক
কাজ!
.
স্বপ্নের দেশে পাড়ি দিতে গেলে তার কাল্পনিক ডানাগুলো ভেঙ্গে যেতে পারে। তাই তার আর যাওয়া হয় না। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে
তার। কিন্তু খিদে পেলে তো হবে না, এই সময় খাবার পাবে কোথায়? রহিম চাচার বাড়িতে শুধু দুই বেলাই খাবার জোটে তার। সেটা
হল সকাল ও রাত। দুপুর বেলায় তাকে জল খেয়েই চালিয়ে নিতে হয়। আজও তাই খিদের চোটে নদীতে জল খেতে গেল সে।
নদীর জলগুলো দুপুরের খাড়া রোদে অনেক স্বচ্ছ দেখাচ্ছে। সে নদীর জলে নিজের পরিশ্রান্ত অবয়ব স্পষ্ট দেখতে পেল।
জলগুলোর মতই তার অন্তরটা পরিষ্কার। চোখ বন্ধ করে সে তার অবয়ব এ জলের ঝাপটা মারল। তারপর পেট পুরে ইচ্ছামতো
জল পান করল। আবার সে গাছতলায় ফিরে এলো। ঠিক শেষ বিকাল বেলায় সে ছাগলগুলোকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু এখনও
অনেক সময় বাকি আছে। পুরনো কথাগুলো ভাবছে সে। একদিন বাড়ি ফেরার পথে একটি ছাগলের পা গর্তে পড়ে যায়। ফলে
ছাগলটির পায়ে সামান্য চোঁট লাগে। সে এই কথা রহিম চাচাকে গিয়ে জানায়। রহিম এই কথা শোনার পর তাকে অনেক মারে
এবং সেই দিন রাতের ভাত বন্ধ করে দেয়। ফলে সেই রাত তাকে না খেয়েই কাটাতে হয়েছিল। আরও কতদিন যে এভাবে মার
খেতে হয়েছিল, কহরত এর কাছে হিসাব রাখাই দুষ্কর ব্যাপার।
.
আকাশের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝেই অবাক হয়ে যায় সে। মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন জাগে তার, ‘আকাশ এত বিশাল কেন?’ এর
উত্তর সে খুঁজে পায় না। আকাশের সাদা-নীল রঙ তার মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তার মন চায় আকাশটাকে একবার ছুয়ে
দেখতে, আকাশে ডানা মেলে উড়তে, আকাশের রঙে নতুন কোন রং ঢেলে দিতে। কিন্তু এ যে অসম্ভব! অসম্ভব এই স্বপ্নগুলো
নিয়েই তার জীবনে বেঁচে থাকা। দুপুরের ক্লান্ত ছায়া তার অবয়বে এসে পড়ে। ছায়াগুলোর মাঝে সে কোন অপূর্ণতাকে অনুভব
করে। প্রখর রোদগুলো যেন তার শত্রু। ছাগলগুলোও এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তারাও মাটিতে বসে পড়ে ঝিমোচ্ছে। দূর
আকাশে কহরত অল্প একটু মেঘ দেখতে পেল। আজ বৃষ্টি হতে পারে, তার মনের ভাবনা এটাই। মাঠে এখন কোন জনমানব নেই।
কেঊ তাদের বাড়ি গেছে আহার করতে আর কেউবা গাছের ছায়ায় বসে ঘুমাচ্ছে। কহরত এর কেন জানি দুপুরবেলায় ঘুম ধরে না।
তাই সে একাই এসব দৃশ্য উপভোগ করে। এসব দেখতে ভালই লাগে তার। তাই সে অনেক সময়ই আনন্দিত হয়ে উঠে।
.
কাকের কা কা ধ্বনিটাও দুপুরবেলা অনেক কম শুনতে পাওয়া যায়। অন্যসব পাখিগুলোও এই সময় নিরুদ্দেশ থাকে। সময়টা
যেন একেবারেই থমকে যায়। দুপুরবেলাটা সত্যিই অনেক বড় কহরত এর কাছে। ক্লান্ত দেহটা যেন আর কাজ করতেই চায় না,
কিন্তু তাকে কাজ যে করতেই হবে! তা না হলে খাবে কী? এসব ভাবতে ভাবতে সূর্যটা পশ্চিমের দিকে একটু ঢলে পড়ল। সকল
মানুষ আবার নতুন উদ্দমে কাজ শুরু করল। তারা তাদের কাজের গতি সকালের তুলনায় এখন অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ
তারা জানে দিনের আলো আর বেশিক্ষণ নেই। তাদের জীবন সংগ্রামে এগিয়ে যেতে হবে অনেক দ্রুত। তা না হলে এ দুনিয়ায় বেঁচে
থাকা অনেক দূর্বিষহ হয়ে যাবে। কহরত রোজই তাদের এ জীবন যুদ্ধ দেখে। তারা এটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা তাদের
কাজের মাঝেই আনন্দ খুঁজে নিয়েছে। তাই তারা শত দুঃখের মাঝে থাকলেও প্রাণ ভরে হাসতে পারে। কহরতও তাদের মধ্যেই
একজন। নিজের অদেখা ভবিষ্যৎ নিয়ে সে চিন্তিত নয়। সে আজকের দিনটাকে কীভাবে অতিবাহিত করবে এটা নিয়েই বেশি
চিন্তিত থাকে। সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, একদিন তারও ভাল সময় আসবে। সেও শান্তিতে থাকবে। এখন শুধু দরকার
অপেক্ষার। একদিন নিশ্চয়ই তার এ অপেক্ষার সুফল আসবে। আশাটা তার এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সূর্যের আলোর তাপটা ধীরে
ধীরে কমছে। এখন বিকালের আমেজটা পুরোপুরিভাবে ছেয়ে এসেছে।
.
বিকালের মৃদ্যূ বাতাস কহরতকে অনেক কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই বাতাসে কতই না ঘুড়ি উড়িয়েছে সে। একদিন এই জন্য
মায়ের হাতে মারও খেতে হয়েছিল তাকে। এই কথাগুলো ভাবলেই এখন তার চোখে জল চলে আসে। তাই সে চেষ্টা করে এই
কথাগুলো যতটা পারা যায় ভুলে থাকতে। বিকালের বাতাসটা কহরতকে অনেকখানি আনন্দও দেয় বটে। সে চোখ বন্ধ করে এই
বাতাসটাকে অনুভব করে। এই সময় সবার মাঝে ব্যস্ততা আরও দ্বিগুণ হয়ে যায়। কহরত এর ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। এই সময়ই সে
শত ব্যস্ততা থেকে খানিকটা মুক্তি পায়। বিকালের সূর্যটার মতোই এই সময় সেও অনেক নিস্তেজ। হয়তো কোন একদিন সে ডুবন্ত
সূর্যের মতই ডুবে যাবে। কিন্তু তার আগে সে অনেক অপূর্ণ স্বপ্নকে পূর্ণতা দান করতে চায়। সকল কষ্টগুলোকে জয় করার অদম্য
ইচ্ছা আছে তার মনে। বিকালের সূর্যের আলোতে নদীর জলগুলো অদ্ভুত এক ধরনের রঙ ধারণ করে। যার সৌন্দর্যটা অতি
মনোমুগ্ধকর। এসবকিছুই কহরত এর মনকে পুলকিত করে। তাই তো বিকালবেলাটা তার কাছে অনেক প্রিয়।
.
ছাগলগুলো এতক্ষণে পেট পুড়ে খেয়ে ফেলেছে। তারা এখন ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। কহরত মাঝে মাঝে ছাগলদের
জীবন দেখে অনেক আনন্দিত হয়। এদের কোন ভবিষ্যৎ এর চিন্তা নাই। এরা নিজের মতো খায় আর ঘুমায়। তাই কহরতও এদের
মতো জীবন কাটাতে চায়। বিকালের সূর্যটা একেবারেই পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। আকাশে লাল রেখা দেখা যাচ্ছে। এখন
মনে হচ্ছে যেন সূর্যের আলোয় পুরো আকাশটাই আলোড়িত হয়েছে। লাল আকাশ! কহরত এই বার উঠে দাঁড়াল। ছাগলগুলোকে
নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করল। সে দেখতে পেল সকল মানুষ মাঠ থেকে তাদের বাড়ি ফিরছে। সবার মাঝে ক্লান্তির ছাপ।
আবার কারও মুখে ব্যর্থতার ছাপ। হয়তো জীবন যুদ্ধে তারা আজ পিছিয়ে পরেছে। তাই তারা আজ ব্যর্থ। কহরত এর মাঝে এমন
কিছুই নেই। সে শুধুই একটু ক্লান্ত। সেটাও স্বাভাবিক। প্রতিদিনের মতই সে অভ্যস্ত। আস্তে আস্তে সে বাড়ির কাছে চলে এলো।
.
ছাগলগুলো একটা একটা করে গুণে ঘরের মধ্যে ঢুকাল। তারপর গরুগুলোকে ঘরে ঢুকাল। এরপর সে সব গরুগুলোকে খেতে
দিল। এখন সে সব ব্যস্ততা কাটিয়ে উঠেছে। সকল ব্যস্ততা শেষ করে সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। এরপর সে স্নান সেরে নিল।
এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের আমেজ চলে এসেছে। রোজকার মতোই তার কাছে রাতের খাবার চলে এসেছে। এই বার গরম ভাত।
আর তার সাথে আছে শুটকি ভর্তা আর সামান্য ডাল। কহরত এর কাছে এটাই তার প্রিয় খাদ্য। কতদিন ধরে যে ভালো খাবার খায়
না, সেটা বলাই বাহুল্য। শেষ সে রহিম চাচার মেয়ের বিয়েতে সাধ মিটিয়ে খেয়েছিল। তারপর থেকে সে আর কোন দিনও ভাল
খাবার খেতে পারে নি। তাই তার কাছে এটাই ভাল খাবার। খাওয়া শেষ করে সে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। তার বড়ই সাধ হয় যে সে
আকাশের চাঁদটাকে মন ভরে দেখবে, রাতের তারাগুলোকে গুণবে। কিন্তু তার কাছে এর সময় নাই। কারণ তাকে কাল সকালে
আবার খুব তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। তার যে অনেক কাজ! যদি ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয় তবে রহিম চাচা বাড়ি থেকে বেড় করে
দিবেন। তাই তার কাছে নিজের ইচ্ছার আর দাম নেই। পরের ইচ্ছার কাছে সে আজ পরাজিত।
.
রাতের নিস্তব্ধতাগুলো তার মনকে গ্রাস করে নিয়েছে। তাই সে নিরবে সব সহে নেয়। ঝিঁঝিঁপোকা এর ডাক তার কাছে অতি
সুরেলা গান মনে হয়। যা তার মা তাকে বলে ঘুম পাড়িয়েছিল। মা তো আর নেই, তাই তার কাছে এই ঝিঁঝিঁপোকাদের ডাকই মধুর
মনে হয়। সমস্ত ব্যর্থতাগুলোকে হারিয়ে দিয়ে সে রাতে চোখ বন্ধ করে জয়ী রুপে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। রাতের
সমস্ত অন্ধকারই তার কাছে নতুন আলোর পথের দিশা মনে হয়। সবকিছুই ভাবতে ভাবতে সে ঝিঁঝিঁপোকাদের ডাকে ঘুমিয়ে
পড়ে।
.
কাল আবার তাকে সেই নিত্যদিনের কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে। হতাশা, ক্লান্ততা এর কোনটাই তার মনে থাকা চলবে না।
সবকিছুকে এড়িয়ে চলে তাকে জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যেতে হবে। শত দুঃখের মাঝেও, হাসিমুখে বেঁচে থাকাটাই তার জীবনের মূল
চাওয়া।…
………………………………………..(সমাপ্ত)…………………………………..