মাঝরাতে হঠাৎ সমস্তকিছু আবছা আলোতে ঝাপসা দেখেন সাঈদ আলী।শরীরটা কেঁপেছিল এতক্ষণ। সারা শরীরে ঘাম জমে
শীতশীত করছে। মনের গভীরে আতঙ্কিত ভয়ানক শব্দ হায়নার মত হানা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।তীব্র ভয় আর অনুতাপ তাকে
কান্নাখেকো তৈরি করে দিয়ছে। পাশে শুয়ে থাকা রাহেলা বেগম চমকে উঠেই আগ্রহের চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলেন, সেই
একই স্বপ্ন আবার দেখেছো?তাই না! মাথা নাড়িয়ে
-হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন সাঈদ আলী। রাহেলা বেগম এখন শান্ত গলায় বলেন, পানি দিবো? হ্যাঁ দাও! তাদের পাশেই রান্নাঘর।
সেখান থেকে পানি নিয়ে এসে রাহেলা বেগম বলেন,
-এই নাও পানি? সাঈদ আলী, কয়েক সেকেন্ডে পুরো পানিটা পান করে নিলেন। এরপর একটু শান্ত হয়ে বলেন,
-এখন ঠিক আছি। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো? সকালে উঠে কারখানায় যেতে হবে।
-আচ্ছা তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো। হুম। পরের দিন সকালে সাঈদ আলী পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কারখানার দিকে নিত্য দিন গুলোর মত
কাজে চলে গেলেন। গ্রামের একটা পাট কলে কাজ করেন এই সাঈদ আলী। পরিবারের ভরণপোষণ করা সব তার এই কাজের
টাকায় চলে। খুব টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে সংসার চলতে হয়। স্ত্রী রেহানা বেগম দুই অন্ধ নাতনী নিয়ে এদের সংসার। কোথাও
গিয়ে কাজ করতে চাইলেও সেটা হয়ে উঠে না রেহানা বেগমের । যে নাতনী তারা দু’জনই অন্ধ। নাতনী দু’টা জন্মান্ধ
যমজ,সবরকমের দুর্গম পরিস্থিতি মোকাবিলা করতেই বুঝি তারা পৃথিবীতে এসেছে। বৃদ্ধা সাঈদ আলী বয়সের ভারে কাবু হয়ে
পড়ছেন।দুর্বল হয়ে পড়েছে তার মস্তিষ্ক। তাও নিজের সংসারের হাল নিজেকে কষ্ট করে চালিয়ে নিতে হচ্ছে প্রানপণ চেষ্টা করে।
ওদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার অন্তঃ নেই সাঈদ আলীর। নিজেই ভাবেন,
জন্মান্ধ মেয়েকে কেউ বিয়ে করে? আর বিয়ে করলে সংসার করবে কি করে? সাথে তো আর কাজের লোক যাবে না।
তাদের বাড়ির লোকেরা সেটা নিয়ে কানাকানি করলেও তারা এ তে কান দেন না।সাঈদ আলী সন্তানের মত নাতনীর জন্য
যাথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। স্বপ্ন ছিলো সন্তানদের মত নাতনীদের লেখা-পড়া শিখিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন।সেটা আর
হয়ে উঠেনি। সব স্বপ্ন কি আর সাবার পূরণ হয়!তারপরেও হাল ছাড়ছেন না সাঈদ আলী।
.
ওহ হ,আসল পরিচয়টাই তো এখনো দেয়া হলো না। কি অবাক কান্ড! কিছুক্ষন আগে ভুলেই গিয়েছিলাম। এই সাঈদ আলী চাচা
আমাদের বীর সন্তান। একজন মুক্তিযুদ্ধা।
আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। তার আবার এতে গর্ব বা অহংকার করার কিছু নেই বলে মনে করেন। দারিদ্র্যতার কৃষ্ট পাথরে
দিশেহারা হয়ে আজ নিজের পরিচয়টাও চাপা পড়ে গেছে। দেশের জন্য জীবন বাজি রাখতে গিয়ে জীবনের সুন্দরতম পথ সাঈদ
আলীর বিপরীতে অবস্থান করছে।
এবার আমার ব্যাপারে বলি, আমি ফটোগ্রাফার নাদিম। ভাগ্যক্রমে মহান এই মুক্তিযুদ্ধা সাঈদ আলী চাচার সাথে দেখা হয়ে যায়।
ঢাকাতে এক সাথে পড়া লেখা করতে আসা নাজিমের সাথে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।তার গ্রামের বাড়ি সিলেট জেলার কোন এক
গ্রামে। গ্রামের নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। তার সাথে এত ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠায় গ্রাম দেখতে যাওয়ার আগ্রহটা অনেক বেড়ে
যায়। সাথে আমার ফটোগ্রাফের কাজ ও হয়ে যাবে। সেই আগ্রহ থেকে নাজিমের সাথে তার গ্রামের বাড়িতে গত গ্রীষ্মের ছুটিতে
ঘুরতে যাই।খুব সুন্দর একটা গ্রাম। প্রাকৃতিক লীলাভূমিতে ভরপুর।যে দিকে চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। পাখ-পাখালির
কিচিরমিচির,পাশ দিয়য়ে বহমান নদীর ঢেউয়ে রোদের ঝিলিক,সাড়ি সাড়ি গাছের মনোরম দৃশ্য ইত্যাদিতে পরিপাটি গ্রামটা।
আমার জন্য উল্লাসের একটা জায়গা। যা আগে কখনো দেখিনি!দেখবোই বা কি করে!শহরের ইট,পাথর আর বড় দালানে তো সব
ঢেকে নিয়েছে! নাজিমের গ্রামে যাওয়ার পরের দিন তাকে নিয়ে ছবি তোলার পাশাপাশি পুরো গ্রামটা ঘুরে দেখবো বলে ঠিক করি।
সকাল নয়টার দিকে গ্রামের উত্তর দিক দেখার জন্য দুই বন্ধু রওনা দেই। ছবি তুলতে তুলতে এক সময় একজন বৃদ্ধ লোকের সাথে
আমার ধাক্কা লাগে। আমার বেখেয়ালিতে লোকটা হুচট খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। খুব খারাপ লাগে! পিছন ফিরে দ্রুত তাকে ধরে
দাঁড় করিয়ে নেই। এরপরে আমি বললাম,
-চাচা মাফ করে দিবেন আমাকে? আমার বেখায়ালির জন্য আপনাকে সকাল বেলায় এমন কষ্ট পেতে হয়েছে?দয়া করে মনে কষ্ট
নিবেন না?
-না বাবা ঠিক আছে। এমন কষ্ট আর নতুন কি? আমাদের তো প্রতিনিয়ত কষ্টের সাথে যুদ্ধ করেই চলতে হয়।হঠাৎ যেন মনে
একটা ধাক্কা লাগে কথাটা শুনার পর।এই বয়সে বৃদ্ধা মানুষটাকে কষ্ট দেন স্রষ্টা?এতটুকু ভাবার মাঝে চাচা নিজ পথ ধরে চলতে
লাগলেন। হঠাৎ খেয়াল করলাম,
-কি ব্যাপার?চাচা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন? পেছন থেকে দৌঁড়ে আমি আর নাজিম উনার কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, —
-আপনার পায়ে কি হয়েছে চাচা? এই ভাবে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন কেন? এ সমস্যাটা কি আপনার জন্মগত? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলেন,না বাবা এই সমস্যা আমার জন্মগত না। সে এক হৃদয় বিদারক ঘটনার ফল।যার কারনে,এই পঙ্গুত্ব
হয়ে আজ চলতে হচ্ছে আমাকে। কথা গুলা শুনে আমার আর নাজিমের মাঝে আগ্রহটা ক্রমশ বেড়ে চললো। কৌতুহলী দৃষ্টি
দিয়ে আমি আর নাজিম বৃদ্ধ চাচার দিকে তাকালাম। তিনি আমাদের দিকে না চেয়ে ঝিমোনোর মতো ভঙ্গিতে মাটির দিকে
তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম,কি হয়েছে চাচা?এত গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যে? তখন নাজিমও বলে,
-চাচা কি সমস্যা আপনার? যদি কোন কষ্ট থেকে থাকে তাহলে ছেলে ভেবে সেটা ভাগ করতে পারেন আমাদের সাথে।আমরা সব
কথা শুনতে তৈরি আছি।তখনও চুপচাপ রইলেন। এই পর্যন্ত ওনার নামটাও জানা হয়নি আমাদের। নাজিমকে ইশারা দিয়ে
বললাম,
-চল সামনের ঐ বট গাছের নিচে বসি গিয়ে? আর চাচাকেও সাথে নিবো। খুব জোরজবরদস্তি করার পর চাচা রাজি হলেন
আমাদের সাথে উনার ভেতরে জ্বলে থাকা আগুনের স্ফুলিঙ্গ ভাগ করে নিতে।
আমি,চাচা তাহলে চলুন ঐ যে বট গাছ আছে,সেখানের ছায়ায় বসে গল্প করবো আপনার সাথে।
-চলো!
চাচাকে আমার আর নাজিমের মাঝখানে বসিয়ে দিলাম।চাচা এখন তাহলে শুরু করে দিন।
তিনি মুখমন্ডলে কষ্টের রেখাপাত এঁকে বলতে শুরু করলেন,
-আমি সাঈদ আলী।গ্রামের আটদশটা যুবকের মতই সত্যবাদী, সাহসী ছিলাম।তখন “১৯৭১ সাল”!যখন মুক্তি যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ
চলাকালীন সময় আমার স্ত্রী গর্ভবতী ছিল। সম্ভবত তিন থেকে চার মাসের গর্ভ । আমরা একাই ছিলাম।আত্বীয় স্বজন
বলতে,আমার স্ত্রীর মা ছিলেন একমাত্র অভিভাবক বা আপনজন । ওনি আমার আপন খালা ছিলেন। আমার মায়ের মৃত্যুর আগে
শেষ চাওয়ামতো খালাতো বোনকেই বিয়ে করি। তার নাম আফিয়া খাতুন। সে আমার প্রথম স্ত্রী। খুব ধার্মিক ছিল। ভালোই
চলছিলো আমাদের সংসার। এর মধ্যেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বিবেক সম্পন্ন মানুষ হয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে
থাকতে পারিনি। চারদিকে হায়নাদের দাবানল পুরো দেশটাতে রক্তের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। শুনে সহ্য হচ্ছিল না। তাই স্ত্রী আর
শ্বাশুরীকে একটা নিরাপদ জায়গায় রেখে গিয়েছিলাম। বিদায় লগ্নে বলেছিলাম,যদি মেয়ে হয় তবে জয়া রেখো । আর যদি আমার
সন্তান ছেলে হয়,তবে বিজয় রেখো। চোখ দিয়ে পানি ঝরে যাচ্ছে আফিয়ার।আমার সহ্য করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। সান্ত্বনা দিয়ে
মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করতে যাই। এক বার দূর থেকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি,সেই একই জায়গায় নির্বাক চোখ দিয়ে পথ
চেয়ে আছে আফিয়া। তারপর আর দেখা হয়নি। দীর্ঘ তিনমাস পর দলের ক্যাপ্টেনকে বলে এক পলক দেখা করতে আসি খুব কষ্ট
করে। এই দেখা করাটা যে আমার জীবনের করুণ নিয়তি হবে সেটা জানা ছিলো না। আফিয়ার সাথে দেখা করে আমি রাতের
আধাঁরে আমাদের গোপন আস্তানায় ফিরে আসতে শুরু করছি, ঠিক তখনই রমিজ মিয়া আমাকে ধরিয়ে দেয় পাকিস্তানী সৈন্য
বাহিনীর হাতে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার উপর পাষাণ্ডের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে একদল হানাদার জানোয়ারেরা। খুব
মারধর করে। আর রমিজ মিয়া উচ্চস্বরে বলে,
_মার দো এ বাঙালি মুক্তিকা বাচ্চারে? ছুর না নেহি স্যার..
আবার বলে,
__এছে নেহি মারেগি। চলতে হে হামারা ক্যাম্পে স্যার। সেখানে গিয়ে মারতে মারতে মুক্তিবাহিনীর আস্তানা জেনে নিয়ে সবাইকে
ধরতে সুবিধা হবে। আমি শুনে রমিজ বেঈমানকে বলি,আমাকে মেরে ফেললেও কিছু বলবো না শয়তানের বাচ্চা।তোর লজ্জা
করে না? নিজের দেশ,মা, মাটির সাথে বেঈমানি করছিস? আল্লাহ তোকে মাফ করবে না মনে রাখিস। প্রাণটা তখন আল্লাহর
হাতে সপে দিলাম। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে এসেছে।অজ্ঞান হয়েছি কি না বুঝতে পারছিলাম না! একসময় চোখ খুঁলে দেখি আমার
পা উপরের দিকে বাধাঁ আর আমার মাথা নিচের দিকে ঝুলানো। চারদিকে আলোর লেশমাত্র পাচ্ছি না। তবে একটু দূরে হালকা
রোদ ঘরের কোন এক ফাঁকে উঁকি দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে এখন দিনের বেলা। পুরো শরীরে প্রচুর আঘাত। তার উপরে খুব তৃষ্ণার্থ
আমি। সারা দিন এই অবস্থায় যায়। খুব কষ্টে চিৎকার দিয়ে বলি,আমাকে ধুকে ধুকে না মেরে একে বারে শেষ করে দে বাঙালির
শত্রুরা। কেন বাঁচিয়ে রাখলি এভাবে ? একটা পাষন্ড হানাদার বাহিনীর সদস্য এসে আমাকে বন্ধুক দিয়ে জোরে পেটে আঘাত
করে কয়েকবার। খুব কষ্ট হয়। চোখ দিয়ে পানি অনবরত ঝরে পরছে। মা গো বলে কয়েকবার চিৎকারও দিয়েছি। হারামীদের এই
চিৎকারে মজা পেতো।
তারা বলতো, বল..তোদের গোপন আস্তানা কোথায়? বল মুক্তিকা বাচ্চারা কাহাহে? এরকম অনেক বাজে বকা দিতো। এভাবে দুই
দিন টানা আমাকে মারধর করে। তিন দিন পরে..
দেখলাম অনেক গুলা মেয়ে মানুষকে লাইন ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আমি চোখ মেলে ভালো করে তাকিয়ে দেখার মত
শক্তিটাও পাচ্ছিলাম না। দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও হারিঁয়ে ফেলছি। বেশ কয়েকবার মাটিতে পরে গড়াগড়িও খেয়েছি। একটা
পাকিস্তানি সৈনিক আমাকে কায়েকবার লাথিও মেরেছে। কিছু বলারও শক্তিটুকুও নেই।তবে কানের মাঝে অনেক গুলা মহিলার
আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি। তারমাঝে একটা পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে আসছে। মনে হলো যেনো আফিয়ার কন্ঠের মত কারো কন্ঠস্বর
আমার হৃৎপিন্ড পর্যন্ত ধাক্কা দিলো। চমকে উঠি। সাথে আরো শিশুদের কাঁন্নার শব্দও কানে এসে ধাক্কা লাগছে। এরপর দেখলাম
অনেক গুলা মহিলাকে নদীর পাড় দিয়ে ঠিক সন্ধ্যায়, সূর্য পুরোটা অস্তমিত হয়ে গেছে পশ্চিম আকাশে। বিবস্ত্র মহিলা গুলাকে
দাঁড় করে আমাকে তাদের সামনে নিয়ে যায়। আবছা চোখে কিছু দেখতেও পারছিনা।তারপরে খুব কষ্ট করে তাদের দিকে
একপলক চেয়ে আর তাকাইনি। সেখানে রমিজ মিয়া রাজাকার আমার পাশেই ছিলো। লাথি মেরে আমাকে বলে, –দেখ তোর
বউকেও ধরে নিয়ে এসেছি। ভালোয় ভালোয় বলে দে, তোদের মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প কোথায়? অনেক মারধর করে আমাকে।
কিন্তু, আমিও আর একটা শব্দ বের করছি না। যা বলার বলুক, কিন্তু, রাজাকারের এ বাচ্চাদেরকে কিছু বলবো না। এক পর্যায়
একটা গর্ভবতী মহিলাকে গুলি করে দেয়।পরে চোখ খুলে দেখি আমার স্ত্রীকে মেরে ফেলছে।মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হলো না!
পুরো শরীরটা আমার অবশ হয়ে গেলো। পাশের মহিলা গুলোর মাঝে আতংক শুরু হয়ে গেছে। আমাকে কয়েকটা হারামিরা
অবিরত অত্যাচার করে যাচ্ছে।শেষ পর্যায় আমার হাতে বন্ধুক ধরিয়ে দিয়ে আমাকে দিয়েই আমার দেশের মা,বোনদের হত্যা
করালো।আমি কল্পনা করিনি।ওরা এতটা কঠিন মনের অমানবিক কাজটা করিয়ে দিলো! আমার দুই পা তখন ভেঙে দেয় ওরা।
আর সবার শেষে বাঁ পায়ের মাঝে একটা গুলি করে। আমি সেই মুহুর্তে সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে থাকি। এরপর আর
কিছুই বলতে পারিনা। কখন যে ভোর হলো সেটাও বুঝতে পারিনি। পরে আমি সেদিন ভোরে আমার রক্তাক্ত দেহটাকে ঠেনে নিয়ে
আফিয়ার লাশ খুঁজতে থাকি।কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু ও পেলাম না। চোখের জল আর শরীরের রক্ত মিশে একাকার হয়ে
গেছে। বাঁচার জন্য গড়িয়ে গড়িয়ে একটা জঙ্গলে প্রবেশ করি।এরপর আমার কোন রকমনই শক্তি হয়ে উঠেনি যুদ্ধ করার । স্ত্রী
সন্তানকে হারিঁয়ে প্রায় পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। বাঁ পাটা আমার পুরোপুরি ভালো হয়নি।সেই থেকে এখনো আমি খুঁরা হয়ে
হাঁটছি। যুদ্ধে আমাদের জয় হলো। যুদ্ধের প্রায় দশ-বারো বছর পর আবারো বিয়ে করলাম। বিয়ের পর হতে এই ঘটনাটা আমাকে
একটা রাত ও শান্তিতে ঘুমোতে দেয় না।বৃদ্ধ হয়ে গেছি এরপরো হৃদয়ের মাঝে দাগ কেটে যাওয়া। সেই ঘটনাটা দুঃস্বপ্নে কঠিন
দেয়াল হয়ে আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে বেলায় অবেলায়। আজো সেই যন্ত্রণার পাহাড় সমান আর্তনাদ আমাকে বার বার অদৃষ্ট
করে তুলছে। রেহানা প্রথম প্রথম এমন উদ্ভট আচরণে মন খারাপ করতো। তবে মুখ খুঁলে কিছু বলতো না। চেহারার আকৃতিতে
ঠিক বুঝে নিতাম রেহানার ও কষ্ট হয়। দ্বিতীয় বিয়ের এক বছর পর একটা কন্যা সন্তান রেহানার কোল জুড়ে আলো করে
আমাদের মাঝে আসে। কে জানতো এই মেয়েটা অন্ধ হয়ে জন্ম গ্রহণ করবে! তাও মনে নিলাম ওটা আমার নিয়তি ছিলো। হঠাৎ
মনে হয় লাইনে দাঁড় করানো একটা মহিলাও আমার প্রথম স্ত্রী আফিয়ার মত গর্ভবতী ছিলো। আমি না দেখে চোখ বুজে থাকি।
তখন রাজাকারের বাচ্চারা জোর করে আমাকে দিয়ে সব মা বোনদের উপর নির্মম ভাবে গুলি বর্ষণ করায়। এতে ঐ মহিলার
চোখে আর পেটে কয়েকটা গুলি লাগে। মনে হয় ওদের অভিশাপের ফলে আমার এই অন্ধ মেয়ে। এরপরেও ভাগ্যকে মেনে
নিলাম। খুব কষ্ট করে মেয়েকে বড় করি।আবার খুব কষ্ট করে বিয়ে দেই। ছেলেটা ছিলো রিক্সা চালক।তাও নগদ বিশ হাজার টাকা
যৌতুক হিসেবে যোগার করে দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দেই। বিয়ের কয়েক মাস পর মেয়েকে আবারো টাকার জন্য নির্মম ভাবে
মারপিট করে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়।সেই থেকে আজ অবধি কোন খবর নেয়নি ছেলেটা। অন্তঃসত্ত্বা হয়ে মেয়েটা বাবার বাড়ি
ফিরে আসে। সন্তান হওয়ার সময় আমার কলিজারটুকরা মেয়ে মারা যায়!
.
এতটুকু বলে আবারো লম্বা একটা হতাশার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন সাঈদ চাচা। চোখ গুলো দিয়ে যেন কষ্টের বৃষ্টি আপনাআপনি
ঝরে পড়ছে অনবরত!আমার ভেতরটাও কেমন মুচড়ে যায়।চোখের সামনে এমন হৃদয়হীনা কথা শুনলে যে কারো চোখের পানি
ধরে রাখা এক দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ন্যায়। সাঈদ চাচা তখন হাতের উল্টোপিট দিয়ে চোখের পানও মুছে নিয়ে
বাকীটা বলতে আবার শুরু করেন, সেও জন্ম দেয় দু’টা মেয়ে সন্তান! এখন দুইটাই জন্মান্ধ। আমরা দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আমাদের
সন্তানের মত তাদের লালনপালন করে যাচ্ছি। এই বয়সেও তাদের মুখে আহার জুটাতে গ্রামের পাট কলে হাড় ভাঙা পরিশ্রম
করি। এর পেছনে দায়ী আমার ভাগ্য আর সাথে ঐ রাজাকারের বাচ্চা রমিজ মিয়া। শুনেছি সে নাকি ঢাকাতে গিয়া মুক্তিযুদ্ধার
খাতায় নাম লিখিয়ে এখন দেশের মন্ত্রীদের দালাল হয়েছে। দিব্যি তার সময়টা যেনো সুখে ভরপুর! অন্যদিকে আমার এই একটা
ঘটনা আমৃত্যু দুঃস্বপ্নের বিষাদ সিন্ধু হয়ে আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে নিবে। কখনো ভুলিনি এবং কোন সময় “দুঃস্বপ্নের
এই ৭১” কে ভুলবো না!
.
এই বলে,সেই মুহুর্তে আমাদের মধ্যখান থেকে সাঈদ চাচা উঠে বাড়ির পথে রওনা দেন। সেদিন আর পাট কলে যাওয়া হয় না।
সারা দিন গিয়ে কখন যে সন্ধ্যা নেমে আসলো আমি আর নাজিম সেটা টেরও পেলাম না। বাকরুদ্ধ হয়ে যায় আমাদের দু’বন্ধুর
কন্ঠস্বর। শুধু কান পেতে শুনেছি,আর অপলক চেয়ে চেয়ে নির্মমতার দৃশ্যপট চোখের সামনে প্রতিচ্ছবির মত হয়ে ভেসেছে ।
এত আত্মত্যাগের বিনিময় এই সাঈদ চাচা কি পেয়েছেন দেশের জন্য যুদ্ধ করে?বলতে পারবো না। এমন হাজারো সাঈদ চাচা
আছেন যাদের জীবনের শেষ ফল হয়, এই বেদনা বিভোর “দুঃস্বপ্নের ৭১”! কেন এমন হলো?চাইলেই তো পারতো সাঈদ চাচা
নিজের জীবনকে বাকি বেঈমান রাজারদের চেয়েও উন্নত করে গড়ে তুলতেন? উত্তরহীন প্রশ্ন আজীবন আমাদের মনের
অন্তরালে রয়ে যাবে!