ঘাতকের ঘর

ঘাতকের ঘর

আমি চেয়েছিলাম হারিয়ে যাবো এই লোকালয়, কোলাহল থেকে। আমি চেয়েছিলাম একাকি নিরবে নিভৃতে নির্জনে সাধনা তপস্যা

করবো। আমি চেয়েছিলাম এই দূষিত বায়ু নিয়ে যে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার থেকে মুক্ত হবো।

আমি চেয়েছিলাম গহীন অরণ্যে গিয়ে যুগের পর যুগ থেকে মহাপুরুষ হয়ে ফিরবো, তুমি হিংস্র প্রাণীকে লেলিয়ে দিয়েছো। আমি

চেয়েছিলাম অন্তহীন মরুভূমিকে নিবাস বানবো, চিক চিক করা বালীকে স্বপ্ন বানাবো তুমি সেখানে শকুনদের পাঠিয়ে আমার

উচ্ছেধ নিশ্চিত করলে।

আমি চেয়েছিলাম বিশাল পাহাড়ের অভিযাত্রী হয়ে সবুজ হলুদ বাদামি রূপালী জঙ্গলকে সাথী করে নিবো, তুমি পাহাড় ধসিয়ে

দিয়ে আমার অভিযাত্রাকে বন্ধুর করে দিয়েছো।

আমি সাধক হতে দুঃসাহসিক অভিযাত্রা করেছিলাম মহাসমুদ্রের বুক চিরে, পাল তোলা নৌকায় নয় গাছের বেলায় করে নীল

লবনাক্ত পানী আমার সুখ স্বর্গ বানাতে চেয়েছিলাম, তুমি তুফানকে আমন্ত্রণ জানালে।

আজ আমি তোমার হৃদয়ের বাসিন্দা। ঠিক ছিলো, মেনে নিয়েছি ভাগ্যকে। কিন্তু বিপর্যয় কেন ঘটালে? কেন এই সংসার ভেঙ্গে

দিয়ে আরেক দিগন্তে সূর্যদয় দেখার ইচ্ছে পোষণ করলে? নতুন স্বর্গ তৈরী না করেই কি করে সুখসাগরে তরী ভাসালে? আমি

ছিলাম রাখাল…..মনের সুখে বাঁশি বাজাতাম।

সে সুরে তোমার প্রণয় হলো। তুমি নতুন সালতানাত গড়ে রানী হলে। তুমি হেরেমের সজ্জা হয়ে আলোকিত করলে প্রাসাদ। আজ

হয়তো বলবে আমি তোমার গান শুনিনি, মাঝরাতে বাঁশির সুরে ঘর ছাড়িনি। অথচ তুমি প্রবঞ্চক।

সরস সুরে তোমাকে আহ্বান করেছি, তুমি গুরুগম্ভীর শব্দ দিয়ে বাগ্মিতা হয়ে উঠলে। সে সুর বুঝার ক্ষমতা আর আমার রইলো না।

তোমার গর্ব আর আত্মগরিমার কবলে পড়ে নতুন সমাধিস্তম্ভ তৈরী হয়েছে। তুমি সাধু দেবদূতও বলা যায়।

কোন সকরুণ আর্তি তোমার কর্ণে পৌঁছায়নি। বিভীষিকার চরম দৃষ্টান্ত দেখালে, ফাঁসি দিলে সত্য আর সুন্দরের। বানালে নতুন

বধ্যভূমি। আজ আমি দুঃখে অভিভূত। তৃপ্তির অনুভূতি মরে গিয়েছে। পাপ চেতনায় ভারাক্রান্ত। অনিবারণীয় ইচ্ছার ভাবমূর্তি

ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে, আর্তনাদ করছে।

ঐশ্বরিক বিধি নিয়েই আজ বেঁচে থাকা।

বিশ্বাসই মানুষকে শক্তি দেয়, অথচ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। নিবিড় আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে নিজেকে শাস্তি দিচ্ছি।

আমার বাগানটি ছিলো পরিমার্জিত, সুশোভিত, মনোহর, অনিন্দ্য সুন্দরের এক পরম ভালোলাগার বিশ্রামাগার। প্রাতরাশে

চিন্তাম্বিতভাবে পথ হাঁটতাম সে বাগানে। শীতার্ত ব্যাক্তিরা যেমন তপ্ত সূর্যলোককে অভ্যর্থনা জানায়, আমিও সব পথিককে

মুসাফিরের এই সরাইখানায় স্বাগতম জানাতম। তুমি তাদেরই একজন মুসাফির। যে আমাকে পথিক বানালে।

আমি উপত্যকায় ছাগল চরাতাম আর বাঁশি বাজাতাম। তুমি স্রষ্টার আশীর্বাদ মনে করতে এই সুরকে। আমাকে পাঠানো হয়েছে

তোমার আত্মার তৃপ্তির জন্য, আজ আমি নিজেই তোমার ভয়ের বস্তু।

এসব তোমার কাছে বাতুলতা, ঠাট্টাতামাসা, বিদ্রুপ। স্বতস্ফূর্ততার বিপরীতে তুমি বিরুদ্ধবাদী। নেকড়ে যেমন নেকড়ের মঙ্গল চায়

না, মানুষ হয়ে তুমি আমাকে চায়া মানব ভাবলে। কোন করুণা দেখালে না।

মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে বিদেহী আত্মার সুখ পৌঁছাতে। ভেবেছিলাম তোমার আশির্বাদ ধন্য হয়ে আমরা হবো আকাশের ফড়িং।

আহ! বস্তুকে ছেড়ে ছায়াকে ধরতে যাওয়ার মত এক বাতুলতা ছিলো এসব। এ দুঃখ ভোগের শেষ পরিণিতি কি? আমি জানি যা

কিছুই করি না কেন মৃত্যুতে শেষ পরিণিতি। মৃত্যুপুরীতে যেতে হবেই। তবুও ছুটেছি তোমার পিছু।

তুমি মনে প্রাণে সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক। প্রীতি নিও আমার। আমি কর্তব্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছি। সব কিছু ছায়া দেখেছি। আজ

চারপাশে শকুনিদের ভীড়, আনাগোনা। আমার আবাসস্থল এখন গুহা। আদিমকালের কুঁড়ে ঘরে নিবাস, যেন ঘাতকের ঘর।

অঙ্গগুলো পক্ষাঘাতগ্রস্ত। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা।

ইচ্ছে করে আলখাল্লা পরে চাদর মুড়ি দিয়ে এই শহর থেকে পালাই, যেন মুক্তি মিলে। সীমাহীন বিশ্ময় চোখে মুখে আমার। বুঝতে

পারছি দিনের আলোর প্রয়োজন নেই আমি নক্ষত্রের আলোতে মরবো। আমার মৃৃত্যু মনোবিজ্ঞানীকেও তাক লাগিয়ে দিবে।

 

আমি হবো প্রাচ্যের রূপকথার নায়ক। মর্মর প্রস্তরে গাঁথা এ সমাধি একদিন সাক্ষি দিবে। পৃথিবী অনাবিল আনন্দের আধারে

পরিণত হবে। আমিতো একটি কীট মাত্র, মানুষ নই। আমি বিভীষিকাময় আমি ক্ষমার অতীত। আজ আমার বিয়োগে তুমি

বিপ্লবীদের মত লাল ফিতা পরো।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত