অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি নয় যেন কান্না। গভীর কান্না। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটি কাঁঠাল গাছ। খুব বেশি ঝোপঝাড়
নেই। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একটি শালিক নিজেকে বৃষ্টি থেকে রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মুক্তা শালিকের এমন প্রতিকীরূপ, বৃষ্টির
সাথে সুর মিলিয়ে কাঁদছে আর কাঁদছে। ঘন্টা খানেক আগেই রহমান সাহেব মুক্তার বাবাকে ফোন করেছিল।
-হ্যালো।
-হারুন সাহেব বলছেন?
-জি, রহমান ভাই।
আর কোন নিয়মতান্ত্রিক ভদ্রতার আশ্রয় না নিয়ে রহমান সাহেব বলতে শুরু করলেন-
-আমার একটা স্ট্যাটাস আছে। আমি আমার একমাত্র ছেলেকে এমন মেয়েকে বিয়ে করাতে পারব না। তার উপর আপনার
ফ্যামিলির যা অবস্থা শুনেছি, আমি দুঃখিত।
মুক্তার বাবা হার্টের রোগী অনেক দিন থেকে। যা হওয়ার তাই হল। কাছের কয়েকজন আত্মীয় মিলে নিয়ে গেল চট্টগ্রাম
মেডিকেলে। পুরো আমুদে একটা বাড়িতে কিছুক্ষণের মধ্যে শোকের মাতম।
মুক্তা চট্টগ্রাম মহসিন কলেজে বাংলায় অনার্স ফাইনাল পড়ছে। জীবনের সাধটা মুক্তার কাছে একটু অন্যরকম। সোজাসোজি
বলতে গেলে একটা যুদ্ধক্ষেত্র। ভাইবোনদের মধ্যে তিন নম্বর হলেও বোনদের মধ্যেকার সবার বড়। তাই মুক্তার বিয়ে নিয়ে মহা
দুশ্চিন্তায় তার পরিবার। গায়ের রং আর গরিব পরিবারের মেয়ে এটাই মুক্তার বিয়ের বড় প্রতিবন্ধকতা।
কালো মেয়েরা মানসকভাবে একটু দূর্বল হয়। তার উপর যদি গরিব পরিবারের হয় তাহলে তো কথা নেই। ভোগে হীনমন্যতা
রোগে। পরিবার, সমাজ আর সহপাঠি সব জায়গায় নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চায়। ছোট খাটো তিরষ্কারও ওরা সহ্য করতে পারে
না। নীরবে কাঁদে। সুন্দরীদের সাথে থাকতে, চলতে চায় না। তবে শিক্ষিত বলে মুক্তা মানসিকভাবে কিছুটা উন্নত। যেমন –খুব
বেশি ভেঙে পড়ে না, সুন্দরীদের এড়িয়ে চলে তবে ঈর্ষা করে না। তবে মানুষের কালো বলে ঘৃণা করাটা মেনে নিতে পারে না। শুধু
নীরবে কাঁদে।
অন্যদের কথাতো বাদ নিজের খালাও আজকাল ছোট করে কথা বলে-আপা, তোমার মাইয়াটারতো বিয়ে অইবো না মনে হয়। কী
লাভ অইব এত লেখাপড়া করায়! আমাদের পাশের বাড়ির করিম ড্রাইভারও বিয়ে করবে কিনা সন্দেহ আছে”। মুক্তার মা এমন সব
কথায় কাঁদলেও মুক্তা খুব একটা মন খারাপ এখন আর করে না। এমনটাতো প্রতিদিন শুনে। হয় সহপাঠিরা নতুবা প্রতিবেশীরা।
সেটা নিয়ে মন খারাপ করার সময়বা কই? ইদানীং দারিদ্র্যতা ভর করেছে ক্ষুধার্ত রাহুর মত। মুক্তার বাবা যখন সরকারি চাকুরী
করত তখন ভালই ছিল সংসার। আর আট দশটা পরিবারের মত চাকচিক্যে চলত। কিন্তু মুক্তার বাবা ভবিষ্যৎ বলতে একতা কাল
আছে সেটা কভু ভেবে দেখেনি, ভেবে দেখেনি যে কালো মেয়েরা আমাদের সমাজে কতটা অবহেলিত। মাঝে মাঝে দুই-একটা
সম্বন্ধ উঁকি দেয়া যেন ছেলের সাথে বাপকে কেনার মত। গত বছরতো এক ছেলের বাবা পাঁচ লক্ষ টাকা যৌতুকসহ ফার্নিচার দাবি
করে। এসব শুনে অভিমানে মুক্তা মাঝে মাঝে আত্মহত্যার কথাও ভাবে।
পৃথিবীর প্রতি তিক্ত মুক্তা নিজেকে ব্যস্ত আর পরিবারের দারিদ্র্যতা লাগবে টিউশনি করছে সে বছর খানেক আগ থেকে। পাড়ার
এক বড় ভাইয়ের সহায়তায় কিন্ডার গার্টেনেও পড়াচ্ছে। মন ভাল করতে বিনোদন হিসাবে পরিচয় হয় ফেইসবুকের সাথে।
নিজের কষ্ট দূর করতে মাঝে মাঝে ফেইসবুকে ঢুকত। এক পর্যায়ে সেটা হয়ে উঠে নিয়ম মাফিক। ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখভরা
স্ট্যাটাসগুলো বন্ধুদের মাতিয়ে তুলত। একদিন স্ট্যাটাস দিল- “অসুন্দর না থাকলে জগতে, সুন্দরের মর্যাদা হত কিসে?” পরদিন
এক অপরিচিত ব্যক্তির ইনবক্সে ম্যাসেজ- “বাহ, অনেক ভাল লিখছেনতো দেখি”। সে থেকে নিয়মিত ইনবক্সে ম্যাসেজ দিত
সোহান ছেলেটা। জীবন যেখানে যুদ্ধ ক্ষেত্র সেখানে রস খোঁজার কোন মানে হয় না। মুক্তার কোন রিপ্লাই না পেয়ে সোহান
নিয়মিত ইনবক্স করত। ঝোঁকের বসে একদিন সোহানের প্রোপাইল ডেটা দেখে মুক্তা। মায়াভরা মুখখানি মুক্তাকে কেমন এক
শিহরন দিয়ে গেল। বাড়িও মুক্তার এলাকার। ‘কিন্তু মুক্তা যে কালো।
মুক্তার স্ট্যাটাসগুলো সোহানকে দিন দিন আরও দূর্বল করে ফেলল। রাত সম্ভবত সাড়ে এগারটা হবে মুক্তাকে লাইনে আবিষ্কার
করল সোহান। ম্যাসেজ দিল- মেয়ে না থাকলে, পুরুষের মর্যাদা হত কিসে?
মুক্তা হাসি চেপে রাখতে পারলনা। উত্তর করল-
-তাই? আমার স্ট্যাটাস নকল করে দিলেন?
সে থেকে শুরু চ্যাট। নিয়মিত চ্যট, ভালো লাগা ইত্যাদি।
মনের গভীরে মুক্তার কিন্তু একটাই ভয়- সোহানকে পাবার যোগ্যতা কি আছে তার? মুক্তার ভয়কে জয় করে সোহান প্রথম
দেখাতে বলল-“মানুষ তার মনেই সুন্দর দেহে নয়”। মুক্তা অবাক হয়। পৃথিবীতে মানুষে মানুষে কত ব্যবধান। ভালবাসার সাথে
শ্রদ্ধাবোধও বেড়ে গেল সোহানের প্রতি।
প্রাইভেট ফার্মে চাকুরি করা সোহান দুঃশ্চিন্তায় পরে তার বদমেজাজী বাবাকে নিয়ে। মাকে দিয়ে বাবাকে ম্যানেজ করার তদবির
শুরু করে। অনেক সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে বাবাকে রাজি করায় সোহান। মুক্তার বাবা হারুন সাহেব চাকুরির খাতিরে মানুষের সাথে
অনেক মিশেছেন তাই সহজে সোহানের আব্বুর সুনজরে পরে গেলেন। আক্দ দিয়ে পরে অনুষ্ঠান করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে
গেলেন সোহানের আব্বা রহমান সাহেব। ব্যস্ততায় সব ছেলের উপরই ছেড়ে দিলেন তিনি। মুক্তার বাবার যেন মস্ত বড় একটা
পাথর সরে গেল বুক থেকে। নিঃশ্বাস নিতে আজ কেমন জানি প্রশান্তি লাগছে। আজকের পৃথিবীটা কেমন জানি একটু
অচন্যরকম। কিন্তু সে প্রশান্তি একদিন পর নিভে গেল। অর্থের দাসত্ব এখানে সব। আবার জীবনের কাছে পরাজিত হল মুক্তা আর
বাবা।
অনেক ক্রোধ নিয়ে সোহানকে ফোন দিল মুক্তা। বার বার একই কথা- “এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা”।
ফেইসবুকে ঢুকল মুক্তা। সোহানের প্রোপাইলে লেখা- “ফেইসবুক ইউজার”।