অন্তর্জ্বালা

অন্তর্জ্বালা

দিনে তেমন একটা শীত নেই। মধ্যরাত পর্যন্ত শীতের মাত্রা অনেকটাই কম। শেষ রাতে শীতের তীব্রতা একটু বেড়েছে। শুভ্রা তাই কাঁথাটা ফেলে লেপটা গায়ে দিয়ে এপাশ-ওপাশ করে নিল। রাতের শেষ লগ্নে প্রকৃতিতে শীতের আমেজ।

সবাই ঘুমিয়ে। শুভ্রা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। পাশেই শুয়ে আছে শাহেদ। শৈশবকাল থেকে শাহেদের ঘুম একটু গভীর। ঘুমিয়ে থাকা আবস্থায় তাকে সন্তর্পণে তিন মাইল দূরে নিয়ে গেলেও সে টের পেতো এমনটা মনে হতো না। কিন্তু এখন তার আর রাতে ঘুম হয় না, রাতের পর রাত কাটে বিনিদ্রভাবে।

এইতো তিন বছর হলো তাদের বিয়ে হয়েছে। তাদের কোলজুড়ে ফুটফুটে বাচ্চাও এসেছে বছর দেড়েক আগে। নাম দুমকি। শুভ্রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেছে। স্বামী ব্যাংকার শাহেদও অপর একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করেছে।

শুভ্রার চেহারার উদ্দীপ্ততা উচ্চকিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্লাসমেট রায়হানের সঙ্গে প্রথমে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব, আস্তে আস্তে তা ভালোবাসা ও প্রেম পর্যন্ত গড়ায়। ক্যাম্পাসে অজস্র সময় ডেটিংয়ে কেটেছে তাদের। একে-অপরকেও তারা প্রচন্ড ভালোবাসতো। বন্ধুরা কেউ কেউ তাদেরকে খুব রোমান্টিক জুটি হিসেবেই জানতো। ক্লাস রুম থেকে শুরু করে রাত আটটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত সময়টুকু বাদে একসাথে আঠার মতো লেগে থাকতো তারা।

শাহেদ নিপাট বিনয়ী ও ভদ্র ছেলে। সংসারের কুটিলতা বা প্যাঁচগোচ একেবারে তার মাঝে নেই বললেই চলে।

শুভ্রা এখন শাহেদের আর কোন কথাই সহ্য করতে পারে না। শাহেদ একটা কথা বললেই ঠিক তার উল্টো আচরণটা করে সে। সংসারের পথ পরিক্রমাই শাহেদের জীবনটা কেমন জানি অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। জুন মাস এলেই শাহেদের অফিসে ব্যস্ততা কয়েকটি দিন বেশি বেড়ে যায়। ওই সময় বাৎসরিক হিসাব-নিকাশ সমাপ্ত করতে হয়। এই সময়টায় শাহেদের বাসাতে ফিরতে হয় একটু রাত করে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততায় সে খুবই কাতর।

রাত সাড়ে নয়টার দিকে বাসায় ফেরার সাথে সাথে শুভ্রা বললো,‘বাসায় তরি-তরকারি শেষ হয়ে গেছে, বাজারে যাও, জিনিস-পত্র কিনে নিয়ে আসো।’

‘কাছেই মার্কেট, তুমিতো কাঁচা তরি-তরকারিগুলো নিজেই কিনে নিয়ে আসতে পারো’-শাহেদের অসহায় উত্তর।

শুভ্রার প্রতিনিয়ত উদ্ভট আচরণে শাহেদ বিচলিত। এভাবে চলতে চলতে তিল তিল করে শাহেদের মনে চাপা ক্ষোভ-প্রক্ষোভ সৃষ্টি হয়। কর্মস্থলে, বাসায়-সব জায়গাতেই শাহেদ যেন কেমন মন বসাতে পারে না। বুকের ভেতর কেমন একটি কষ্ট সব সময় মোচড় দেয়। সে ভাবে জীবনটা কেমন যেন অন্য রকম। স্বাভাবিক জীবন প্রকৃতি তার কেমন হওয়া উচিত ছিল, আর বাস্তবে কি হচ্ছে! এভাবেই শাহেদের কষ্টমাখা জীবনখানি এগিয়ে চলছিল। ইদানীং শাহেদের অফিসের কাজ-কর্মগুলোও গতিহীন হয়ে পড়েছে।

অফিসে তার পাশের চেয়ারে বসেন কাকলী সরকার। স্মার্ট মহিলা। টিকাটুলী ব্রাঞ্চ থেকে গত মাসে এই ব্রাঞ্চে বদলি হয়ে এসেছেন। শাহেদের মনমরা ভাব দেখে প্রথম প্রথম কিছু না বললেও কয়েকদিন যাওয়ার পর ঘনিষ্ঠতা একটু বৃদ্ধি পেলে আস্তে আস্তে সে তার কষ্টের কারণগুলো জানতে অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠেন। শাহেদ প্রথম প্রথম এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল নিলেও কষ্টের অধ্যায়গুলোকে খুব বেশিদিন গোপন রাখতে পারেননি। সবই বলে ফেলেছেন কাকলী সরকারকে। কাকলীও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে দু’বছর হলো ব্যাংকে জয়েন করেছেন। বিয়ের পিঁড়িতে বসেননি এখনও তিনি।

কাকলী সহকর্মী শাহেদের সংসার জীবনের কষ্টগুলো কেমন যেন নিজের মতো করে অনুভব করতে শুরু করেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি শাহেদকে কেমন জানি সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেন। শাহেদও এটা গভীর অনুভূতি দিয়ে বোঝে।

শাহেদ শৈশব থেকে শুরু করে ছাত্রজীবন শেষ করা পর্যন্ত কোনদিন কোন প্রকার নেশা বা নেশার জগতে প্রবেশ করেননি। কিন্তু এখন তিনি অফিস থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যার পর বারে যান। মদের চরম তৃপ্তি গ্রহণ করে এখন তিনি গভীর রাতে বাড়ি ফেরেন।

শুভ্রার সাথে ভালো কোন কথা বললেও সে তার স্বামীর সাথে খারাপ আচরণ করে, আর খারাপ করলে তো কোন কথাই নেই। চিৎকার হৈ চৈ করে বাসা মাথায় তোলে।

গভীর রাতে দুমকিকে বুকে জড়িয়ে শাহেদ আনমনা হয়ে জগতের সব ভাবনা ভাবে। শুভ্রা তো তার সাথে কথাই বলে না। একপর্যায়ে শুভ্রা দুমকিকেও তার সাথে স্বাভাবিকভাবে মিশতে দিতে চায় না। শিক্ষিত মানুষ ও পারিবারিক বন্ধন এবং মর্যাদার কারণে শাহেদ তার স্ত্রীকে কিছু বলতে পারে না- আবার সহ্যও করতে পারে না। অন্তর্জ্বালায় তার জীবন যেন ভস্ম হতে চলেছে।

কাকলী সরকার নিত্যদিনকার খবর রেখে চলেছেন শাহেদের। কাকলীও কেমন জানি শাহেদের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছেন। অফিসের অন্য কলিগরা ইতিমধ্যেই এনিয়ে সেখানে কানাঘুসা শুরু করেছে।

শাহেদ রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবে সে প্রতিবাদী হয়ে উঠবে। সমস্ত অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাবে। সে শুভ্রাকে বলবে- তার জীবনকে তিল তিল করে ধ্বংস করার অধিকার তার নেই। মাঝে মাঝে শাহেদ যৌক্তিকভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টাও করে। কিন্তু সব সময়ই বিফলে যায় সে উদ্যোগ।

কাজকর্ম শেষ করে শাহেদ অফিস থেকে বেরিয়ে আসছেন। পেছন থেকে কাকলী সরকারও বেরিয়ে আসলেন। কাকলী তাকে প্রস্তাব দিলেন- চলুন আমরা রমনা রেস্টুরেন্টে যাই। শাহেদ বললেন, ‘বাসায় যাবো।’ কাকলী পীড়াপীড়ি করাতে তিনি রাজি হলেন। রমনা রেস্টুরেন্টে একই টেবিলে মুখোমুখি দু’জন। জগতের সব ভাবনা যেন শাহেদের চোখে-মুখে।

কাকলী বললেন, ‘শাহেদ ভাই, আপনি নতুন করে কী কিছু ভাবছেন?’

শাহেদ, ‘আমি আপনার কথা আসলে কিছু বুঝতে পারছি না’। এ সময় অন্যমনস্ক হয়ে শাহেদ ফুটফুটে সন্তান দুমকির কথা কল্পনা করে। সন্তানের চেহারা চোখের সামনে আসা মাত্রই কেমন যেন নিষ্পাপ চাহনী দেখা যায় শাহেদের নিষ্পলক চোখে। চোখে পানি ছল-ছল করছে।

শুভ্রার তীক্ষ্ম ও রূঢ় আচরণ শাহেদের জীবনকে তছনছ করেই চলেছে প্রতিনিয়ত। সে তার পুরনো প্রেমিক রায়হানের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছে। শাহেদ টের পেলেও কৌশলে এড়িয়ে যায় সাংসারিক আশান্তির ভয়ে। কিন্তু অশান্তির দাবানল প্রজ্বলিত রাখতে সবসময়ই তৎপর শুভ্রা। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে মোবাইলের মাধ্যমে শুভ্রা রায়হানের সাথে সহজেই যোগাযোগ করতে পারে। মাঝে মাঝে শুভ্রা শাহেদকে দেখিয়ে-দেখিয়েই রোমান্টিক আলাপ করে। শাহেদের জীবনটা প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের কাছে হার মানতে চলেছে। কি যেন এক অজানা ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে!

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত