একজন ভোলা চাচা

একজন ভোলা চাচা

জ আনন্দদের বারান্দার গ্রিলে অপূর্ব সুনীল প্রজাপতি যেন বসে বসে আলাপচারিতায় মগ্ন হয়ে আছে। সবুজ পাতার ভেতর নীল প্রজাপতি! কী অপূর্ব!
আনন্দের মা সানজিদা নবী খুশিতে আত্মহারা। তিনি একজন প্রকৃত প্রকৃতিপ্রেমিক মহিলা। প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন আনন্দেÑ
Ñ ‘ওরে আনন্দ, মৌটুসী দেখে যা নীল প্রজাপতির মেলা।’
ওরা দুই ভাইবোন হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয়।
Ñ ‘কই মামণি, কই দেখি দেখি কতদিন প্রজাপতি দেখি না আমরা।’
বারান্দায় এসে ওরা দুই ভাইবোনের ডাগর ডাগর চোখজোড়া কৌতুকে চক চক করে ওঠে।
Ñ ‘ওমা, কতগুলো অপরাজিতা ফুটেছে তোমার টবের গাছে। হ্যাঁ মা ঠিক যেন নীল প্রজাপতি। বারান্দাটা যেন হাসছে।’
ওরা সবাই মিলে চোখেমুখে হীরের দ্যুতির মতো আলো ছড়িয়ে হাসছে। দক্ষিণের বারান্দায় যেন ফুলের মেলা বসিয়েছে। মা মধ্যমণি! এই ছোট্ট বারান্দাটার তেরছা রোদের আঁকিবুকি ঝিরিঝিরি বাতাসের মধুর মমতা আর প্রিয় গাছলতা, লতাগুল্মের সবুজ মায়াবী এক চিলতে ভুবন সানজিদার একান্ত বিনোদনের আয়োজন। সকালে বা বিকেলের গরম চা হাতে এখানে বসে গাছের পাতা পল্লব আধফোটা ফুলকলিদের সঙ্গে কথা বলেন সানজিদা। পৃথিবীর সকল ভাবনা-দুর্ভাবনা কর্পূরের মতো মিলিয়ে যায়। মনটা তরতাজা হয়ে ওঠে। তিনি আবার নতুন প্রাণশক্তি ফিরে পান। সংসারের কাজে, চাকরি ক্ষেত্রে সবখানে যেন পরিশ্রম করার মালমসলা জোগাড় হয়ে যায়।
মৌটুসী আবিষ্কার করে হলুদ গোলাপের তিনটি কুঁড়ির অস্তিত্ব। কী সুন্দর! মা ভাইকে বলতে ওরা যেন খুশিতে আত্মহারা! আনন্দ বলে,
‘মায়ের এই ব্যালকনি যেন বেহেশতের এক টুকরো বাগান।’
সানজিদা ছেলের এই প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা উপভোগ করেন। তাঁর দুই ছেলেমেয়েই গাছগাছড়া ভালোবাসে। পাখ-পাখালি ভালোবাসে, ভালোবাসে নদী, জলাশয়-পুকুর। শাপলাফোটা দীঘি দেখে ওরা তো ভারী খুশি হয়েছিল একবার ড. খানের এক বন্ধুর বাগানবাড়িতে যেয়ে। আশুলিয়ায় যেয়ে সেবার দিনভর কী আনন্দই না করেছিল ওরা দুই ভাইবোন! কত জাতের গাছগাছড়া। লাল পেয়ারা, সফেদা, ডালিম, করমচা, এমনকি অগ্নিশর্মা কলা পর্যন্ত। আর একধারে শুধু মেহগনি, সেগুন আরো কত জাতের কাঠের গাছ। বেশ বড় হয়েছে। প্রায় অরণ্য অরণ্য ভাব। ঢাকার দূষিত বাতাসের বাইরের এই গ্রামীণ দৃশ্যটা খুব ভালো লেগেছিল ওদের। শাপলাফোটা দীঘিতে ছোট মাছের ঝাঁক দেখে মৌটুসী আনন্দে আত্মহারা। আশুলিয়ায় ফুরফুরে বেলফুলের মতো ভাত আর রুইমাছের ভাজা মুগের ডাল। কী চমৎকার লেগেছিল খেতে! বাবুর্চি ভাই আক্কাস মিয়া ঘাড়ে লাল গামছা ফেলে মুখে জর্দাভরা পানের খুশবু। হাসিমুখ দেখলে প্রাণে জুড়িয়ে যায়। কত যতœ করে যে খাবার পরিবেশন করলেন। আজো মনে পড়ে আনন্দ আর মৌটুসীর। সানজিদা পাখ-পাখালি ভালবাসেন। দূরে কোথায় যেন একটা প্রাচীন বৃক্ষ থেকে ঘু-ঘু ডাকছিলÑ অবিরাম ঘু-ঘু-উ। ঘু-ঘু। কী যে ভালো লাগছিল মৌটুসীর মায়ের। সেই দিনটি ওদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে!
আজ ভোরবেলা সিরাজগঞ্জ থেকে এসেছেন ভোলা চাচা। এসেই ইইচই করে হাঁক ছাড়লেন,
‘কই রে সানজি কই রে আনন্দ মৌ? কই তোরা।’

সানজিদা কিচেনে গরুর গোশতের মসলা কষাচ্ছিলেন। প্রায় দৌড়ে এলেন। ভোলা চাচা এসেছেন অনেক দিন পর। ভোলা চাচা হলেন আনন্দদের পরিবারের খুশির সাগর। যেমন প্রাণবন্ত তার রসালো আলাপচারিতা, তেমনি তাঁর ভাল কাজ করার আগ্রহ। তিনি যেন অশেষ জ্ঞানের ভাণ্ডার। পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়ে তার অসীম জানাশোনা। মগজ তো নয় যেন কম্পিউটার। দেশের জন্য ভালোবাসা আর খুঁটিনাটি তথ্য তাঁর ভাণ্ডারে গিজগিজ করছে। জন্মভূমিকে তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। আর সবাইকে বিশেষ করে ছোটদের ভোলা চাচা বিভিন্ন তথ্য শুনিয়ে শুনিয়ে পাকা দেশপ্রেমিক করে তুলতে চান। তাঁর আর একটি বড় গুণ যে তিনি প্রকৃতিপ্রেমিক। মনেপ্রাণে প্রকৃতি ভালোবাসেন। অনেকে তাঁকে গাছপাগল ভোলা চাচা বলো ডাকে। এহেন ভোলা চাচা যখন তার দীর্ঘ দেহ টকটকে রঙ আর মজবুত কাঠামোর শরীরের গড়ন নিয়ে হাসিমুখে উদয় হলেন আনন্দদের নিরিবিলি ফ্যাটটি আর নিরিবিলি রইল না। খুশির বাতাসের তুর্কিনাচন ঢেউ তুলে তুলে খেলে গেল সারা ঘরময়। সানজিদার চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক। মেঝের সফেদ টাইলসে যেন রঙধনু রঙ ঘরময় যেন নীল-লাল প্রজাপতি। বহুদিন পর এবার এলেন ভোলা চাচা! চাচা থাকেন সিরাজগঞ্জ। এক বিঘা জমির ওপর তার গাছগাছালি পাখপাখালিতে ভরা সোঁদা মাটির গন্ধভরা একান্ত ভুবন। চাচীমাও খুব আমুদে মানুষ। পাকা গৃহিণী। তবে ইদানীং বাতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন। সাজুর মা আর তার ছেলে ছেলেবৌ ‘শান্তিনীড়ে থাকে’। দীর্ঘদিন। ওরাই দেখাশোনা করে। কাজের মানুষ নয় বরং আত্মীয়ের মতো সাজুর মা। আজ তিরিশ বছর হল ঐ বাড়িতে। বাবা ত উদাসীন কর্মব্যস্ত পরোপকারী এক মানুষ। ঘর সামলান। লাল চাচী। সাজুর মা, সাজু। কত যে কাঁঠাল হয়, আম হয়, করমচা, জামরুল, কদবেল পর্যন্ত। গাছপালা ফলাফলারি খোপভরা কবুতর, দরমা ভরা মোরগ-মুরগি, ক্যাম্বেল হাঁস।
তো সানজিদা দৌড়ে এসে প্রিয় চাচাকে সালাম জানালেন।
‘চাচা এতদিন পর আমাদের কথা মনে পড়ল! চাচা আপনার শরীর ভালো আছে তো! চাচীমা কেমন আছেন? সাজুর মা-রা?’
‘ওরে বাপরে বাপ সব্বোনাশ! এতগুলো প্রশ্ন করলি মা একসাথে জবাব দিতে যে আমার আলজিহ্বা পর্যন্ত শুকিয়ে যাবে। আগে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দে মা।’
সানজিদা খুশিতে কী করবে না করবে যেন দিশা পায় না।
‘চাচা … দিচ্ছি আমি কী বোকা দেখেন আগে আপনারে জিরাতে না দিয়েই হাজার প্রশ্ন করছি। এই সোফাটায় আরাম করে বসেন তো চাচা। আমি চটপট কাগজি লেবুর শরবত করে আনছি বরফ দিয়ে।
‘ওরে আমার পাগলিরে! তোর এই দশাসই চাচার যে চিনি খাওয়া নিষেধ ভুলে গেছিস! রোগ আছে যে ডায়াবেটিস মধুমেহ।’
সানজিদা দরদি গলায় বলে,
‘চাচা চিনি দেবো না। স্পেনডা দিয়ে করে দিচ্ছি। খান, যে হারে আপনি দৌড়াদৌড়ি করেন মাঝে মধ্যে একটু অনিয়ম করলে কিচ্ছু হবে না।’

‘হ্যাঁ মা, তাই অবশ্য আল্লাহর রহমে সুগার লেবেল আমার ভালোয় কন্ট্রোলে আছে। সামান্য ট্যাবলেট খাই। ডায়েট কন্ট্রোল করি। ব্যস। দেহঘড়ি টিকটিক করে চলছে ভালো। আল্লাহ ভরসা। শোন মা, তোরা কিন্তু সবসময় মনটা প্রফুল্ল রাখার চেষ্টা করবি। প্রাণ খুলে হাসবি। ছেলেমেয়ে জামাইকে নিয়ে বেড়াতে যাবি। সম্ভব হলে এক সাথে নামাজ পড়বি। ধর্মের ছায়া বড় শান্তির ছায়া। আর সমাজসেবা মানবসেবা। কী আনন্দ মারে! বুকটা জুড়িয়ে যায়। তুই তো কলেজে পড়াস। চিরদিনের মেধাবী মেয়ে। তোকে আর কী বলবো। তবু বলি একটা অভ্যেস হয়ে গেছে। এই যে ছোট্ট জীবন আল্লাহ দিয়েছেনÑ এই জীবন অমূল্য, প্রতিটি মুহূর্ত আনন্দ ভালো কাজ দিয়ে ভরাট করে রাখার জন্য। মন আর শরীর যদি বিগড়ে যায় তবে তো সবই ভেস্তে যায়। তখন ধর্মে কর্মে মন বসে না। মাননসেবা তো দূরের কথা। কেমন লেকচার শুরু করে দিয়েছি দেখেছিস তো। ঢেঁকি যেখানে যায় সেখানেই ধান ভানতে চায় রে মা। আন তোর ঠাণ্ডা শরবত খেয়ে প্রাণ জুড়াই। তারপর এই ঝোলায় তোর চাচী কী ভরে দিয়েছেন বুঝে নে।’
সানজিদা চটজলদি এক গ্লাস বরফভাসা লেবু শরবত আপেলের টুকরো সাজিয়ে ট্রে হাতে চাচার সামনে দাঁড়ায়। চাচা ঢকঢক করে শরবতটুকু শেষ করে হাতের তালুর উল্টাপিঠে ঠোঁট মুছে তার কাঁধের ঝোলা খুলে বসেন।
সানজিদা কৌতূহলী চোখে চেয়ে থাকে। আনন্দ আর মৌটুসীও ছুটে এসেছে ততক্ষণে।
ভোলা চাচা প্রশস্ত এক হাত বাড়িয়ে ওদের আদর করেন আর এক হাতে পুঁটলিগুলো টিপয়ের ওপর সাজাতে থাকেন।
সানজিদা জাদুর পোটলাগুলো খুলতে থাকে। একটায় ফুলের মতো কুমড়ো বড়ি, আর একটাতে তিলের নাড়–, আর একটাতে তেলের পিঠা, আর একটাতে আনন্দের প্রিয় নারকেলের বরফি।

দুপুরে খাবার টেবিলে ঝুরঝুর করে ঝরে মায়ামমতার ফুলরেণু। সানজিদা চাচা ও ছেলেমেয়েদের পাতে পাতে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত তুলে দেন। চিংড়ি মাছের ভর্তা, করলা ভাজি, পাবদা মাছ, মাসকলাইয়ের ডাল তুলে দিতে দিতে শান্তনীড়ের আত্মীয়স্বজন, পাড়া-পড়শি সবার খবর নেন। মৌটুসী মুরগি ছাড়া ভাত খেতে চায় না। আজ ভোলা নানার সঙ্গে বসে করলা ভাজিও খেল, মাছও খেল। মুরগি তরকারি পুরোটাই তোলা রইল। রাতে চাচা পাতলা রুটি দিয়ে খাবেন। সঙ্গে থাকবে সবজি ভাজি। ভোলা চাচার খাবার-দাবার পরিমিত। সকালে হাঁটা, নামাজের কিছুক্ষণ হলেও কুরআন তেলাওয়াত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
বিকেলের ফিকে কমলারঙের রোদ ব্যালকনি ভরে সোহাগ ছড়াচ্ছে। ওখানে সানজিদার ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান। চাচার প্রিয় এই জায়গাটা। আনন্দ আর মৌটুসীকে মোড়ায় বসিয়ে ভোলা নানা এবার গল্প জুড়ে দিলেন।
‘নানাভাই, বুবুজি আজ তোমাদের বাংলাদেশের নদীর গল্প শোনাব, কেমন?’
ওরা খুশিতে চিৎকার করে ওঠে। ‘হ্যাঁ নানু আমরা শুনব। আমরা তো এই শহরে একটা নদীও চোখে দেখি না। মা বলেন, একদিন বুড়িগঙ্গায় নৌবিহারে নিয়ে যাবেন কিন্তু নিয়ে যাবার সময় আর হয় না।’

‘শোন নানু ভাই আমাদের এই বাংলাদেশটা না নদীমাতৃক দেশ। এখন এই ঢাকা শহরের চেহারা যেমন দেখছ মাত্র তিরিশ বছর আগেও এ শহর এ রকম ছিল না। বিশাল বিশাল বৃক্ষ, পাখপাখালি আর হালকা বাড়িঘর, কম গাড়ি ঘোড়া, জন-মানুষ। বেশ পরিপাটি ঐতিহাসিক এ শহর। গৌরবের ৪০০ বছর কেটে গেছে। কিন্তু নানুভাই এ নগরটি আমার কাছে এখন মাঝে মধ্যে বসবাসের অযোগ্য মনে হয়। সে যাক, বড় হয়ে আরো অনেক কিছু জানতে পারবে। দেখ আমাদের ভাগ্য এ শহরে আজ বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, ফল পাকুড়, সবজি, মাছ, তেল, ঘি সবখানে বিষ-ফরমালিন ভয়াবহ কেমিক্যাল মিশায় এক জাতের লোভী ব্যবসায়ী। তাহলে এ দেশটা আরো বড় উন্নত হবে কী করে। আর কিছু মানুষ হয়ে উঠেছে অসহিষ্ণু, মারমুখী, কুচক্রী। তারা সমাজটাকে নষ্ট করছে। তবে হ্যাঁ, তোমরা যদি নতুন মানুষেরা বড় হয়ে রুখে দাঁড়াও, ভালো শিক্ষা, ভালো মানসিকতা প্রাণের মধ্যে ধারণ করো তবেই এ দেশটা হবে আবার সুন্দর, সুজলা, সুফলা সোনার দেশ। কী কইতে কী বয়ান শুরু করলাম। যাক আমি তোমাদের এই বাংলার কয়টা নদ-নদীর নাম বলি, তোমরা শোন। বর্তমান নদ-নদী সংখ্যা প্রায় ৩১০টি। এর মধ্যে ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী। এই নদীগুলোর ৫৪টি ঢুকেছে ভারত থেকে। শুধু ৩টি মিয়ানমার থেকে। মানে বার্মা থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। ভারতের অভিন্ন সীমান্ত নদীগুলো হচ্ছে রায়মঙ্গল, ইছামতি, কালিন্দি বেতনা, কোদালিয়া, ভৈরব, কোবাদক, গঙ্গা, পাগলা, আত্রাই, পুনর্ভবা, তেঁতুলিয়া, ট্যাঙ্গন, নাগর, মহানন্দা, ডাহুক, করতোয়া, ঘোড়ামারা, যমুনেশ্বরী, বুড়িতিস্তা, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, সুমেশ্বরী, নয়াগাঙ, সুরমা, কুশিয়ারা, ধলাই, গোমতী, ডাকাতিয়া, মহুরী, ফেনী ইত্যাদি। আর মিয়ানমার থেকে এ দেশে ঢুকে পড়েছে সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও নাফ। এ দেশের বড় বড় নদীর নাম তোমরা সবাই কমবেশি জানো।

মেঘনা, যমুনা, পদ্মা, বুড়িগঙ্গা, গড়াই আরো কত নদ-নদী, শাখা নদী এ দেশের আনাচে কানাচে। শাখা নদীগুলোর সুন্দর সুন্দর গালভরা নামও আছে। আরেক দিন তোদের শোনাব নানু। জানার শেষ নেই। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শুধু জানলেও জানার শেষ নেই। আনন্দ, মৌ তোমাদের অনেক বড় হতে হবে। অনেক বড়, বিদ্যায়-বুদ্ধিতে, আচারে-ব্যবহারে। তার মানে একজন ভালো মানুষ হতে হবে সবার আগে। তবেই হবে জীবন সার্থক। শুধু নিজের কথা ভাববে না নানুরা দশের চিন্তা মাথায় রাখবে। বিশেষ করে যারা খুব গরিব মানে হতদরিদ্র তাদের নিয়েও ভাবতে হবে। তাদের না আছে সামান্যতম শিক্ষা অর্থাৎ নিরক্ষর আর না আছে কোন সহায় সম্বল। দিন আনে দিন খায়। কী যে কষ্টের জীবন! বড় হলে বুঝতে পারবে এই সব মানুষকে। এ সংসারে কিভাবে বেঁচে আছে। ওরা এমনই এক নিরেট মানুষে পরিণত হয়েছে যে ওদের ভালো শিক্ষা, ভালো কাজের কথা বললেও আগ্রহ দেখায় না বেশির ভাগ মানুষ। ভাগ্য পরিবর্তনের বিষয়টা ওরা বোধ হয় বুঝতেই শেখেনি। শৈশব থেকেই ধরে নেয় আমরা গরিব-হতভাগাÑ এটাই আল্লাহর ইচ্ছা এই আমাদের জীবন। ওদের অনেকের মধ্যে আলোচ্য স্থবিরতাও কাজ করে মনমর্জি অনেক নিম্নস্তরের। ওদের বোঝাতে হবে। লেখাপড়া আর কর্ম দুটোই যেন ধীরে ধীরে ওরা অর্জন করতে পারে। সেই চেষ্টায় নিবেদিতকর্মী প্রয়োজন। তোরা বড় হয়ে নিজের কর্মজীবনের পাশাপাশি এদের জন্যও ভাববি। সাহায্য সহযোগিতা করবি। তবেই না এ দেশটা সুন্দর হয়ে উঠবে। যাক অনেক নসিয়ত করে ফেললাম। জানিস তো নানু শিক্ষকতা থেকে অবসর নিলে কী হয়Ñ রক্তের মধ্যে সে বীজ রয়েই যায়। পৃথিবীশুদ্ধ মানুষকে তখন ছাত্র ঠাওরায়ে অবচেতন মনে। করার কিছু নেই রে নানুভাই।’

ভোলা নানুর ভারী ভারী অথচ সুন্দর কথাগুলো খুব ভালো লাগল আনন্দের। যদিও কথাগুলো একটু ওজনদার ফট করে বুঝে নিতে সময় লাগে খানিক, তবে একবার মাথার মধ্যে ঢুকে গেলে সবই সহজ খাঁটি কথা। মৌটুসীরও নানুর বাণী বুঝতে একটু কষ্ট হলেও এখন ভালো লাগছে। আনন্দ পড়ে কাস সেভেনে আর মৌটুসী কাস সিক্সে। ওরা দুই ভাইবোনই সাধারণ বাচ্চাদের চাইতে একটু এগিয়ে আছে। সাধারণ জ্ঞানের বহরটা একটু লম্বা। তা অনেক ক্ষেত্রেই ভোলা চাচার কল্যাণে।
আজ ওরা ভোলা চাচার সঙ্গে যাবে বলধা গার্ডেনে। ধানমন্ডি থেকে নারিন্দায় যেতে ওদের সময় লাগল প্রায় দেড় ঘণ্টা। ভোলা নানা এই ঢাকা শহরের যানজট দেখে অস্থির। অবশ্য আজকাল বাংলাদেশের প্রায় সব শহরেরই এই দশা। তবু ঢাকা শহর যেন এ দুর্দশার এক নম্বর। শহর তো নয় যেন পুরো হাইওয়ে জুড়ে মাছের বাজার বসেছে। তারই মধ্যে রিকশা, গাড়ি, হরেকরকমের যানবাহন, বিশাল বিশাল বাস।

ভোলা নানা গোপীবাগ যেয়ে হাঁফিয়ে উঠলেন। ‘আর কতদূর সেন্টু মিয়া। ড্রাইভার এক গাল হেসে বলল, ‘নানাজান দূর তো বেশি না। কিন্তুক জাম লাগছে কিরহম দেখছেন তো। কিছুই কওন যায় না। আল্লাহর যদি রহম করে তাইলে এই জট থ্যাকা বাইরে হইতে পারুম।’
অবশেষে ওরা পৌঁছল বলধা গার্ডেনে। জমিদার অনেক যতেœ, মমতায় এই বাগান তৈরি করেছিলেন বহু বছর আগে। যদিও আগের সেই জলুস নেই। তবুও কিছু কিছু দুর্লভ প্রাচীন গাছ লতা, গুল্ম, ক্যাকটাস ফার্ন এখনও আছে। প্যাপিরাস গাছের গল্প শুনেছে মায়ের কাছে আনন্দ। এখানে কৃত্রিম পন্ডে আছে ভিক্টোরিয়া রিজিয়া। বিখ্যাত জলজ পদ্মজাতীয় ফুল একে বাংলায় দেও-পদ্মও বলে। কান্দা তোলা একটা থালার মতো সুবজ পাতা। এর পাতার ওপর নাকি একটা ছোট শিশু বসে থাকতে পারে। বড় সুদৃশ্য ধাঁধানো ঘাটলার দীঘি। দীঘির পারে জয় হাউজ সেখানে বসে।

এখানে এসে রবীন্দ্রনাথ ক্যামেলিয়া কবিতাটি রচনা করেছিলেন। এই বাগানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আরেক ধনাঢ্য ব্যক্তি রোজ গার্ডেন তৈরি করেন গোপীবাগে। তিনি ছিলেন বলধা জমিদারের চেয়ে একটু কম বংশীয়। সে কারণে শোনা যায় বলধার উৎসবে তার আমন্ত্রণ হতো না। রোজ গার্ডেনের জন্ম হয় এই অপমান থেকে। এক সময় রোজ গার্ডেনে প্রচুর পুষ্পের বাহার ছিল। এখন আর নেই। সুরম্য প্রাসাদটি এখনও কালের সাক্ষী হয়ে আছে। আনন্দ মৌটুসীকে নিয়ে ভোলা চাচা রোজ গার্ডেনেও বেড়িয়ে এসেছেন। কিন্তু তিনি মূলত গাছপাগল এক মানুষ। প্রাসাদ নয়Ñ গাছ, লতা, ফুল তার প্রিয়। বলধা গার্ডেনে অশোক বৃক্ষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন গাছলতা তিনি চেনালেন ওদের। কিছু কিছু গাছের গায়ে নাম লেখা আছে। সোনালি বাঁশঝাড় আর বার্ডস অব প্যারাডাইস বা বেহেশতি বুলবুল সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
ভোলা চাচা বহুবার এসেছেন ওয়ারির বলধা বাগানে। তিনি তো বৃক্ষপ্রেমিক। এবার বলধা বাগানে এসে একটু হতাশ হলেন।
‘নানুভাই! দেখ বলধা বাগানের চার পাশে ফ্যাটবাড়ি উঠছে। বাগান দুটোও যেন নিঃশব্দে কাঁদছে। আগের মতো যতœ নেই। গাছপালাগুলো যেন খানিক বিবর্ণ আর প্রাণহীন। ’
আনন্দ মাথা দোলায়।

ওরা বাসায় ফিরে গোসল করে খাবার খেয়ে বিশ্রাম করে যখন ওঠে, তখন বিকেল ফিকে হয়ে এসেছে। ভোলা নানা আসরের নামাজ সেরে জায়নামাজ ভাঁজ করে সুন্দর তসবিহদানাগুলো একান্ত মনে গুনতে গুনতে পায়চারি করছেন করিডোর জুড়ে। যেখানে কয়েকটি সবুজ ক্যাকটাস ছায়ার গুল্মলতা মাটির সুন্দর সুন্দর পটে আনন্দের মা সাজিয়ে রেখেছেন।
চায়ের টেবিলে বসে ভোলা নানা গাছলাতাগুলোর কত গল্পই না করলেন। এই প্রকৃতি যদি মানুষের হাতে বিনাশ হয়ে যায় তবে সর্বনাশ হবে মানুষেরই।
ভোলা নানা বোঝালেন। গাছের সে জীবন আছে, অনুভূতি আছে সে কথা আবিষ্কার করেন আচার্য জগদীশ চন্দ্র। বর্তমানে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিকের গবেষণায় জানা যায় গাছ চিন্তাশীলও বটে।
তার ভরাট গলায় বললেন,
‘শোন নানুভাই, বুবু দেশী ফলমূল তো তোমরা চেনোই না স্বাদ নেয়া তো দূরের কথা। চালতা, গোলাপজাম, আঁশফল, দেওফল, ডুমুর, লটকন, চুকুর, বইচি, গাব, কাউফল, মহুয়া, মাখনা, বিলিম্বি আরো কত কী।’
এবার সিরাজগঞ্জ গেলে আমি তোমাদের গ্রামগঞ্জের হাট থেকে কিছু কিছু ফল দেখাবো, পরিচয় করিয়ে দেব, খাওয়াবো, কেমন।

ওরা দুই ভাইবোন মাথা দোলায়,
‘জি আচ্ছা নানা ভাই।’
‘আর নানুভাই শাক যে আছে কত রকমের তোমরা তাও দেখনি, খাওনি। তোমরা চেন পালংশাক, লালশাক, পুঁইশাক না? এর বাইরে আছে টক-পালং, পাটশাক, কুফালশাক, পিড়িংশাক, কলমিশাক, হেলেঞ্চা, শুষনীশাক, আশকুনি, ব্রাক্ষীশাক ইত্যাদি। আমার মা বেতের ডালা হাতে নিজে বাড়ির পেছনের বিশাল আমবাগান থেকে শাক তুলে আনতেন আর মজা করে রাঁধতেন। আর জানো কত জাতের ধান আছে এই বাংলাদেশে? আজকাল অবশ্য আগের মতো সব ধান আবাদ হয় না। ভাল আউশ ধানের মধ্যে আছেÑ দুলার, ধারিয়াল, কটকতারা, পানবিড়া, মরিচাবাটি, চার্নক, কুমারী ইত্যাদি। আমন ধানের মধ্যে আছে নাইজারশাইল, লতিশাইল, দুধসর, রাজাশাইল, পাটনাই, বাদলাভোগ, কালিজিরা ইত্যাদি।’
মাগরিবের নামাজ পড়ে, ভোলা চাচা অনেকক্ষণ জায়নামাজে বসে দোয়া-দরুদ পড়লেন। এই মানুষটা নাকি প্রায় দুই হাজার বিভিন্ন ফল, কাঠ, ফুল ইত্যাদি গাছ লাগিয়েছেন। সব নিজের আঙিনায় অবশ্যই নয়। পাড়াপরশি, স্বজন, বন্ধুদের ভিটেয়। সেইসব গাছ এখন তরতরিয়ে বেড়ে উঠেছে। ফল হয়, ফুল হয়, কাঠের গাছ মেহগনি, শাল ইত্যাদি তো মূল্যবান হয়ে উঠছে। সব বিনা পয়সায়। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে যতœশ্রম দিয়ে। এতেই তার আনন্দ!
অনেকক্ষণ ধরে ভোলা নানা জায়নামাজে বসে তসবিহ গুনছেন। আনন্দ উঁকি দিয়ে দেখে ভোলা নানা অঝোর ধারায় কাঁদছেন।

আনন্দ দৌড়ে মাকে মেয়ে বলতেই মা বললেন,
‘কথা বলিস না। ভোলা চাচার বুকের ভেতর একটা গভীর দুঃখ আছে রে। আমরা জানি। ওনার ফুলের মতো ফুটফুটে ছেলেটা পেয়ারা গাছ থেকে পড়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে মারা গেছে। সে কথা, সে বেদনা উনি বুকের ভেতর চেপে রেখে বাইরে হাসি-আনন্দে ভুলে থাকেন। আমার সেই ভাইটার নাম ছিল মুনতাসীর।’
আনন্দের ডাগর চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ল। মৌটুসী অবাক হয়ে করুণ চোখ মেলে চেয়ে আছে।
বাইরে তখন শ্রাবণের বৃষ্টির কান্না। মাও চোখ মুছলেন আঁচলে। সবার প্রিয় গাছপাগল ভোলা চাচা গাছগাছড়ার পত্রপল্লবে, ফুলের কুঁড়িতে হয়তো মুনতাসীরের ডাগর চোখ দুটো খুঁজে ফেরেন। এতেই তাঁর বেদনা, এতেই তাঁর বেহেশতি আনন্দ!

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত