বাঘ ভালুকের মন ভালো নেই। মন ভালো নেই সিংহেরও। চিতাবাঘ, হরিণ, বানর, সজারু– বনের কারও মন ভালো নেই। সিংহী বাচ্চা দেওয়ার জন্য কোথায় লুকিয়েছে, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সিংহী ভাবে, সিংহ তার বাচ্চা খেয়ে ফেলবে।
কিন্তু সে তো আগের কালের কথা। এখন তো আর কেউ বাচ্চা খায় না। এখন সবাই ভদ্র ও শিক্ষিত। অথচ সিংহীর মনে সারাক্ষণই ভয় লেগে থাকে। তাই সে বাচ্চা হওয়ার আগে পালিয়েছে। কবে ফিরবে তার কোনো ঠিক নেই। বড় বাচ্চাগুলো তো কতদিন আগে বিদেশে চলে গেছে।
তবে তারচেয়ে বেশি দুঃখ হল বন নিয়ে। এ বন নাকি থাকবে না। এখানে নাকি এয়ারপোর্ট হবে। তার মধ্যে উড়োজাহাজ তৈরির কারখানা, রেলগাড়ি তৈরির কামারশালা, আরও কত কিছু বানানো হবে। তা হলে আমরা যাব কোথায়? সিংহ এসব কথা ভাবে। ভাবে বনের অন্য সবাই।
বনে তাই সবার মনে দুঃখ। দুঃখ যেন ছড়িয়ে আছে গাছের চারার মতো। ঘাসের মতো। আর তা দিনদিন বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে।
কত কাল বৃষ্টি হয় না। বনে খাবার নেই, খাবার পানি নেই। বনের প্রাণীদের কী যে কষ্ট, তা বলে শেষ করা যায় না। ক্ষুধায় পেট চিম্সে হয়ে গেছে সবার।
চিতাবাঘ বুড়ো বানরের কোলে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “কী হবে আমাদের, বানর দাদা? বাচ্চাগুলো দুধের অভাবে মরে গেল। আমরাই-বা আর কতদিন বাঁচব?”
“বৃষ্টি হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু কষ্ট কর, আর কটা দিন। পানির কষ্ট, খাবারের কষ্ট তো আছেই। কিন্তু সব চেয়ে বড় বিপদ হল, এই বন নাকি আর থাকবে না।”
“তাই নাকি দাদা?”
“হ্যাঁ। সেই জন্য বাঘ ভালুক খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। অন্য সবাই কোথায় যাবে, ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে পড়েছে। কাঁদতে কাঁদতে অনেকে অন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়।”
“তাহলে তো খুবই বিপদ।”
“বিপদ তো বটেই। তবুও ধৈর্য ধরে থাকতে হবে।”
“ধরব কী দিয়ে? হাত-পা যে অবশ হয়ে আসছে। বনের ঘাসও নেই যে, তা খেয়ে থাকব। তারপর শোনালে বনও থাকবে না।”
ওরা কথা বলছে, এমন সময় বিশাল একটা উড়োজাহাজ বিকট শব্দ করে বনের উপর দিয়ে ঘুরপাক দিতে লাগল। সেই বিকট শব্দে ওদের কান ব্যথা করতে লাগল। জন্তুরা যে যেখানে পারে ছুটে পালাল। বুড়ো বানর ছুটে পালাতে গিয়ে বাইসনের উপর গিয়ে পড়ল প্রায়। অল্পের জন্য বেঁচে গেল। বানর বাইসনকে বনের বিপদের কথা বলতে চাইল। বাইসন কানে শোনে না। তাই বানর তাকে কিছু বলতে পারল না।
ওদিকে চিতা বাঘ গিয়ে ছিটকে পড়ল সিংহীর গোপন আস্তানায়। সিংহী সেখানে ছিল না। আস্তানায় বেশ পুরু ঘাসের গদি ছিল। চিতা সেই ঘাসের গদির মধ্যে লুকিয়ে রইল। উড়োজাহাজ অনেকবার ঘুরে ঘুরে, তারপর কোনদিকে যেন চলে গেল। চিতা ক্লান্তিতে সেই গদির উপরে শুয়ে ঘুমিয়ে গেল।
অনেক পরে সিংহী আস্তানায় ফিরে এল। চিতাবাঘের গন্ধ পেয়ে সে ভাবল, চিতা বুঝি তার বাচ্চাদের খেয়ে ফেলেছে। সে ঘুমন্ত চিতার লেজ ধরে এমন জোরে এক টান দিয়ে ছুড়ে মারল যে, ছিটকে গিয়ে চিতা এক বাঁশঝাড়ের উপর ঝুলতে লাগল।
সিংহী ভেবেছিল, চিতা তার বাচ্চাদের খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু না। খাবার কোনো চিহ্ন দেখা গেল না। তাহলে বাচ্চা চারটে গেল কোথায়? সিংহী এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুজতে সে একটু দূরে একটা ডোবার মতো জায়গা দেখতে পেল।
সেখানে অনেক কচুগাছ, বউটুবানি দণ্ডকলস, আদাভ‚তরাজ ও পেত্নিচিড়ে গাছ হয়ে একদম অন্ধকার হয়ে আছে। বৃষ্টি নেই বলে ডোবা একদম শুকনো। সেখানে গিয়ে সিংহী বাচ্চাদের গন্ধ পেল। তাড়াতাড়ি সেই ঝোপের মধ্যে ঢুকে সে দেখে, বাচ্চারা গাদাগাদি করে ঘুমিয়ে আছে। নিরাপদ জায়গায় ঘুমাচ্ছে বলে সিংহী থাবা দিয়ে শুকনো পাতা টেনে এনে ওদের চারধারে এমনভাবে গাদা করে দিল, যাতে কেউ ওদের দেখতে না পায়। তারপর সে আবার খাবারের খোঁজে বের হল।
আকাশে অত জোরে শব্দ করা জন্তুটা কী, তা বনের জন্তুরা কিছুতেই বুঝতে পারল না। সেটা যে উড়তে পারে, তা তো তারা দেখতেই পেল। এখন আবার সবাই বাঁচার উপায় খুঁজতে লাগল।
একদিন গভীর রাতে মেহগনি গাছের তলায় সভা বসল। অনেকে অনেক কথা বলল। বাঘ এক হুঙ্কার দিয়ে বলল, “দেশের এ রকম অবস্থা, তা দেখার কি কেউ নেই?”
ভালুক বলল, “নিজেদের দেখে পারে না, তারা আবার দেশ দেখবে! ফেলে দাও তোমার ওসব মামুলি কথা। আমাদের হাতে ক্ষমতা থাকলে দেখিয়ে দিতাম, কেমন করে দেখা যায়। না হয় আয়না দিয়ে দেখাতাম।”
নেকড়ে বলল, “দেখাদেখির কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। কী করা যায়, আগে ঠিক করতে হবে।”
ভালুক বলল, “সে কথাই তো ভাবছি। পেঁচা তো উড়তে পারে। সে গিয়েছিল কাকের কাছে সঠিক খবর জানার জন্য। সে এলে সঠিক খবর জানা যাবে। উপরের দিক তাকিয়ে দেখ তো, মনে হল যেন ডানার শব্দ শুনতে পেলাম।”
সবাই তখন উপরের দিকে তাকাল আর পেঁচাকে দেখতে পেল।
দেখতে পেল সে এসে একটা ঝড়ে ভাঙা তেঁতুল গাছের উপর বসে হাঁপাচ্ছে। সবাই তাকে বলল, “হাঁপাচ্ছ কেন, পেঁচাখালা? বল, বল কী খবর এনেছ?”
একটু নড়েচড়ে বসে দু-একটা কাশি দিয়ে পেঁচা বলল, “যে খবর তোমরা শুনেছ, তা মোটামুটি ঠিক। আমাদের দেশের ম-ম-ম-ম-মহা-মহা মহারানি দ-দ-দ-দ দয়াবতী মহাদেবী দেশের মানুষের উপকার করার জন্য এই বন কেটে ফেলে এখানে একটা বিশ্ব বিখ্যাত এয়ারপোর্ট বানানোর কথা ঠিক করেছেন।”
“পাশ করেছেন মানে কী? আর তুমি অমন তোতলামি করে মহারানির এক মাইল লম্বা নাম বললে কেন? তোমার গলায় কি মহারানির পোষা মহাব্যাং ঢুকেছে?”
“না, ওসব কিছু না। তোমরা যে ম-ম-ম-ম-মহারানির নাম একবারে বললে, তা যদি পুলিশের লোক একবার শোনে, তাহলে সবার নির্ঘাত ফাঁসি।… আমার আসতে দেরি হল কেন? আমি তো না জেনে ম-ম-ম-ম-ম-মহারানির নাম বলে ফেলেছিলাম। তখন ওখানকার পুলিশ আমাকে ওই নাম ঠিক করে একশ’বার মুখস্ত করিয়ে তারপরে ছেড়েছে। না হলে ফাঁসি দিত।”
“দিলে নিয়ে আসতে। সেটা কী জিনিস বল তো খালা।”
“সে সাংঘাতিক কথা। তা বলা যায় না। তোমরা সব সময় সাবধানে ম-ম-ম-ম-মহারানির নাম উচ্চারণ করবে।”
“ওই নাম দিয়ে আমরা কী করব! আর আমাদের কদিন-বা আছে! তবে পুলিশ এলে আমরা দেখিয়ে দেব। আমাদের তারা চেনে না বুঝি? তা ওই কেয়াপোট না চেয়ারপোট সেট হচ্ছে, ওটা হবে?”
“শিগগিরই হবে। নোটিস লেখা হচ্ছে। সেই নোটিস সবার কাছে যাবে। সবাই মত দেবে। তারপর টাকশাল থেকে টাকা বের হবে। টেন্ডারবাজি না কী সব হবে। তারপর।”
“তুমি যা বলছ, তার মাথামুণ্ডু আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি শুধু এইটুকু বুঝিয়ে দাও, এতবড় বনটা কেটে ফেলে, আমাদের মত জীবজন্তুর সব মেরে ফেলে, ওটা তারা বানাবে কেন?”
“তারা তো নয়, তিনি। তিনির ইচ্ছা হয়েছে বিরাট একটা কিছু করার। তবে বলে বেড়াচ্ছেন, মানুষের উপকার করার জন্য।”
“কী রকমের উপকার, একটু খুলে বল তো খালা।”
“সে অনেক কথা। অত কথা বলতে গেলে আমার ব্যাটারি ফুরিয়ে যাবে।”
“তুমি আবার ব্যাটারি লাগালে কবে থেকে?”
“ব্যাটারির যুগ এখন। যত তাড়াতাড়ি লাগানো যায়, তত ভালো। তাছাড়া আমি তো ভাবছি, এবার ভোটে দাঁড়াব।”
“দিনে চোখে দেখ না, আবার ভোটে দাঁড়াবে! আজব কথা শোনালে খালা।”
“ব্যাটারির দুনিয়া আজব দুনিয়া। এখানে চোখ-কান বিদ্যে-বুদ্ধি কিছুই লাগে না। ব্যাটারি ঘোরাতে জানলেই হয়। ব্যাটারিই সব করে দেয়।”
“বেশ ভালো কথা শোনালে খালা। এ যাত্রা যদি বনটা বেঁচে যায়, আর আমরা বেঁচে যাই, তাহলে আমরাও ব্যাটারির দলে যোগ দেব। তখন সবাই মিলে বলব, ‘জয় ব্যাটারি, জয়’। ব্যাটারির কথা এখন থাক। তা সেই মানুষের উপকারের জন্য তোমার ম-ম-ম–মহারানি কী বানাবে, তাই একটু আবার গুছিয়ে বল।”
“বেয়াক্কেল। অতগুলো ম লাগালে কেন? লাগবে মোটে চারটে।”
“ঠিক আছে। এবার থেকে গুনে গুনে চারটে লাগাব। এখন বল সেই ভয়ানক জিনিসের কথা।”
“বানাবে একটা এয়ারপোর্ট, তা তো শুনেছ। তার মধ্যে আবার ছোটবড় অনেক রকম উড়োজাহাজ বানানোর আর মেরামত করার কারখানা থাকবে। সেখানে রোজ হাজার হাজার উড়োজাহাজ তৈরি হবে।”
“তা হোক। তবে অত উড়োজাহাজ দিয়ে কী করবে সেই চার ম মহারানি?”
“তুমি এবারও ভুল করলে। তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না।”
“ব্যাটারি লাগালেও হবে না?”
“হতে পারে। সে যা হোক। উড়োজাহাজের কথা আমি যেটুকু বুঝেছি, তাই বলছি। দেশের রাস্তা সব গাড়িতে বন্ধ হয়ে গেছে। মানুসের কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য সব অচল। নদীগুলোও সব মানুষরা দখল করে নিয়ে ঘরবাড়ি বানিয়েছে। তাই ছোটবড়, মেজ-সেজ অনেক সাইজের উড়োজাহাজ বানানোর আর উড়াবার দরকার। তাই বন কেটে ফেলে সেখানে সব বানাবে। মাটিতে চলাচলের অসুবিধা বলে আকাশ দিয়ে চলাচল করবে।”
“বুদ্ধিটা ভালো। কিন্তু বন কেটে কেন? মানুষ ছাড়া কি দেশে আর কেউ নেই? আমাদের বন আমরা দেব না।”
“রাখতে পারলে রাখো। বন থাকলে আমারও ভালো। না থাকলে পুরনো বা নতুন কোনো দালানের এক ফাঁকেফোকরে আমার থাকার ব্যবস্থা করে নেব। আর ভোটে যদি জিততে পারি, তাহলে তো…”
“তাহলে তো সোনার গাছে রুপোর পাতাওয়ালা বাড়ি পাবে। তা পাও, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। আমাদের এখন বাঁচার উপায় কী, তাই বল।”
“দেশ ছেড়ে, মানে এই বন ছেড়ে অন্য দেশের বনে চলে যাও।”
“যাব কী করে? আমাদের কী তোমার মত ডানা আছে? তারচেয়ে দেশে বসেই মরব সবার সঙ্গে। বন যখন কাটবে কাটুক। এখন যদি একটু বৃষ্টি হত, তাহলে হয়ত কিছুদিন বাঁচতে পারতাম। বনের ভাগ্যে…”
ভালুকের কথা শেষ হতে না হতে সেই আগের মতো বিকট শব্দ করে একটা উড়োজাহাজ এসে বনের উপর ঘুরতে লাগল। আর কী আশ্চর্য, সেই সঙ্গে বৃষ্টিও শুরু হল! প্রথমে ঝিরঝির, তারপর ঝমঝম। বেশ কিছুক্ষণ বৃষ্টি হল। বাঘ সিংহ হরিণ পেঁচা ও আরও আরও সবাই ভিজে গেল। বৃষ্টি পেয়ে ওরা যা খুশি হল, সে আর বলার নয়। হা করে যতক্ষণ বৃষ্টির পানি যতটুকু পাওয়া, ওরা খেয়ে নিল। এখানে-ওখানে জমা পানিতে গড়াগড়ি খেল অনেকে।
দীর্ঘদিনের খরায় বন জঙ্গল শুকিয়ে যাচ্ছিল, জীবজন্তু মারা পড়ছিল। দেখে পরিবেশবাদী বনবিজ্ঞানীরা ‘সবুজ শান্তি’ আন্দোলনের সহায়তায় প্লেন থেকে বৃষ্টি দিচ্ছিল সেদিন, সেই দুঃখ ভরা বনের মাথায়।