একটা বিশাল বন ছিল। বনের পাশেই ছিল ছোট্ট একটি নদী। বনে অনেক পশু-পাখি বাস করত। বনে বাস করত বাঘ, সিংহ, হাতি, বানর, ভালুক, শিয়াল, হরিণ, সাপ, গাধা, ঘোড়া, জিরাফ, নানান প্রজাতির পাখি, বাঁদুড় এবং মৌমাছি। আর নদীতে বাস করত ছোট-বড় মাছ ও কুমির। পশু-পাখিদের মধ্যে খুব মিল ছিল। কেউ কারোর দেখে হিংসা করত না। তারা সকলে মিলেমিশে বনে বাস করত। একদিন বনের পশু-পাখিরা এক জায়গায় বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিল। সেই আলোচনায় নদীর কুমিরও উপস্থিত ছিল। সে সময় তাদের পাশ দিয়ে একটা কচ্ছপ হেঁটে যাচ্ছিল। কচ্ছপ পশু-পাখিদের এক জায়গাতে বসে থাকতে দেখে তাদের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর সেও আলোচনায় যোগ দিল। কথা প্রসঙ্গে সে তাদেরকে বললো: তোমাদের মধ্যে কাদের ক্ষমতা এবং মর্যাদা বেশি। কচ্ছপের কথা শুনে সকলেই আপন আপন ক্ষমতা ও মর্যাদার জাহির করতে লাগলো।
পাখিরা বললো: আমাদের অনেক ক্ষমতা। আমরা খুব দ্রুত বনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে উড়ে যেতে পারি। আকাশে উড়ার ক্ষমতা একমাত্র আমাদেরই আছে। কুমির বললো: নদীর ভেতর কোথায় কী আছে তা আমরাই বলতে পারি। জলে এবং স্থলে চলাফেরার করার ক্ষমতা একমাত্র আমাদেরই আছে। বাঘ ও সিংহ বললো: আমাদের গায়ে অনেক শক্তি। আমরা বনের রাজা। আমাদের দেখলে বনের সকল পশুপাখি ভয় পায়। আমাদের ক্ষমতা ও মর্যাদার দুটোই আছে। আর বনের হাতি বললো: আমাদের ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। কারণ আমাদের মতো এত বড় আকৃতির কোনো প্রাণীই এই বনে নেই। শুধু তাই নয়, সারাবিশ্বের কোনো বনেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেকেই তার যুক্তি মেনে নিল কিন্তু বনের সবচেয়ে ক্ষুদ্র প্রাণী মৌমাছি তার যুক্তি কোনোভাবেই মানতে পারল না। সে বললো: আমরা ক্ষুদ্র প্রাণী হলেও আমাদের অনেক ক্ষমতা। বনের যেকোনো পশু-পাখিকে আমরা ঘায়েল করতে পারি। সে বাঘ-সিংহ হোক আর হাতিই হোক। মৌমাছি আরো বললো: হাতি কোনোভাবেই আমাদের চেয়ে শক্তিশালী প্রাণী নয়। আমাদের ক্ষমতা হাতির চেয়ে অনেক বেশি।
মৌমাছির এই দাম্ভিকতা পশুপাখিদের মধ্যে একটা হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করল। কেউ কেউ হাসিতে কুটিকুটি। কেউ আবার মৌমাছির প্রতি ভীষণ রেগে গেল। আর হাতিও মৌমাছির প্রতি ক্ষুব্ধ হলো। মৌমাছি সকলের উদ্দেশে বলল, আমার কথা বিশ্বাস না হলে একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। আমার ক্ষমতা যে বেশি তা প্রমাণ করার জন্য আমি হাতির সঙ্গে লড়াই করতে রাজি। হাতি মৌমাছির সাহস দেখে অপমান বোধ করল। এতটুকু ক্ষুদ্র প্রাণীর সঙ্গে হাতি কীভাবে লড়াই করবে? তার গায়ে একটা ফু দিলেই তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। বনের কিছু পশু-পাখি হাতিকে বললো: এই মৌমাছিকে একটা উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। ওদের এত সাহস আমাদের অপমান করে। ওদেরকে বন ছাড়া করতে হবে। বাঘ-সিংহও তাদের সঙ্গে একমত হলো। শুধুমাত্র বনের কিছু নিরীহ প্রাণী মৌমাছির পক্ষ নিল। তারা মনে মনে বললো, মৌমাছির নিশ্চয় কিছু অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে যা হয়তো আমরা জানি না। সেই ক্ষমতার কারণেই মৌমাছি হাতির সঙ্গে লড়াই করার সাহস দেখাচ্ছে। হাতির সঙ্গে লড়াই করলে সে নিশ্চয় জিতবে।
বনের পশু-পাখিরা দুই ভাগ হয়ে গেল। একদল হাতির পক্ষে আর অন্যদল মৌমাছির পক্ষে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তারা একটা সভা আহ্বান করল। সেই সভাতে কোনো দিন হাতি ও মৌমাছির মধ্যে লড়াই হবে তার দিনক্ষণ ঠিক করা হলো। ?আর শক্তিশালী প্রাণীরা একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নিল। আর তা হলো_ এই লড়াইয়ে যে হারবে তাদেরকে এই বন ছেড়ে চলে যেতে হবে। এই সিদ্ধান্তের কথা মৌমাছি ও হাতিদের জানিয়ে দেয়া হলো। হাতি মনে মনে খুব খুশি হলো। আর মৌমাছি বললো: আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমরাও এই সিদ্ধান্তে একমত। মৌমাছি ও হাতির লড়াইয়ের খবর এখন পশু-পাখির মুখে মুখে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তাদের লড়াই দেখার জন্য।
অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত লড়াইয়ের দিন চলে আসল। দলে দলে সকল পশু-পাখি লড়াই মাঠের দিকে রওনা দিল। নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই বনের পশু-পাখিরা লড়াইয়ের মাঠে উপস্থিত হলো। মৌমাছি এবং হাতিরাও উপস্থিত হলো। লড়াই পরিচালনার দায়িত্ব পড়ল শিয়ালের উপর। শিয়াল সকলেরই অনুমতি নিয়ে লড়াইয়ের প্রাথমিক কাজ শুরু করল। সে মৌমাছিদের মধ্য থেকে একজন প্রতিনিধি আর হাতিদের মধ্য থেকে একজন প্রতিনিধিকে লড়াইয়ে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানালো। তাদের মধ্য হতে দুইজন প্রতিনিধি আসল। শিয়ালের অনুমতি পেলেই তারা লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সকল পশু-পাখি মাঠের চারিদিকে গোল হয়ে অপেক্ষা করছে লড়াই দেখার জন্য। শিয়াল বাঁশিতে ফু দিল আর অমনি লড়াই শুরু হয়ে গেল। হাতি মৌমাছিকে উদ্দেশ্য করে বললো: সাহস থাকলে আয় দেখি, আমার কাছে আয়। তোকে ধরে মুখে পুরে আস্ত গিলে খাই। আর হাতির গায়ে হুল ফুটানোর জন্য মৌমাছি তার চারিদিকে উড়তে থাকলো। হাতিও চেষ্টা করছে মৌমাছিকে ধরার জন্য। কিন্তু পারছে না। মৌমাছি খুব কৌশলী। সে হাতির নাগালের বাইরে দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। কেউই হার মানতে রাজি ছিল না। তারা প্রাণপণে চেষ্টা করছিল জেতার জন্য। লড়াই খুব জমে উঠলো। পশু-পাখিরা তাদেরকে একেরপর এক উৎসাহ দিতে থাকলো। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ ধরে লড়াই চলতে থাকলো।
লড়ায়ের একপর্যায়ে মৌমাছি হাতির কানের মধ্যে ঢুকে গেল। আর কানের ভেতর ঢুকেই মৌমাছি কামড় দিতে লাগলো। কামড়ের যন্ত্রণায় হাতি ছটফট করতে লাগলো। হাতি কিছুতেই মৌমাছিকে কান থেকে বের করতে পারলো না। আর মৌমাছিও নাছোড়বান্দা। সে বিরতিহীনভাবে হাতির কানের ভেতর কামড়াতে থাকলো। অবশেষে হাতি মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিতে লাগলো। আর ভয়ংকরভাবে চিৎকার করতে থাকলো। হাতি যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকলো। কিছুক্ষণ পর হাতি চারিদিকে পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে লাগলো। হাতির ছোটাছুটি দেখে বনের পশু-পাখিরা ভয় পেয়ে গেল। অবশেষে হাতি মৌমাছির কাছে হার মানলো। সে মৌমাছির কাছে মাফ চাইলো। তারপর মৌমাছি ক্ষান্ত হলো।
এভাবে হাতির পরাজয়ে বাঘ ও সিংহের মুখে চুন-কালি পড়লো। তাদের মাথা হেঁট হয়ে গেল। তারা মৌমাছির ক্ষমতা দেখে ভয় পেয়ে গেল। আর লড়াইয়ে মৌমাছি জিতে যাওয়ায় তাদের পক্ষে যেসব নিরীহ প্রাণীরা ছিল তারা খুশিতে নাচতে লাগলো। অতপর সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক হাতিদের বন ছেড়ে চলে যেতে হলো।