কিরিকপুরের ইঁদুরগুলো

কিরিকপুরের ইঁদুরগুলো

মোটামুটি বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখনো ই-মেইল চালু হয়নি। লোকে কম্পিউটারও ঠিকমতো চিনত না। যোগাযোগের জন্য চিঠিই ছিল ভরসা। ওই সময়টাতেই কিরিকপুর নামের এক শহরে ঘটে যায় অদ্ভুত ঘটনাটা। কিরিকপুর শহরটা কোন দেশে তা আমি জানি না। কারণ শহরের নামটা মানুষ রাখেনি। নামটা রেখেছিল ওই শহরের ইঁদুরেরা। ধেড়ে ইঁদুর, বাচ্চা ইঁদুর, চিকাজাতীয় ইঁদুর, অনেক রকম ইঁদুরের বাস ছিল ওই শহরে। তা তারা নিজেদের শহরের নাম নিজেরা রাখতেই পারে।

একদিন সকাল। হন্তদন্ত হয়ে কিরিকপুরের বার্তাবাহক ইঁদুর হেঁদো এল নগরকর্তার দপ্তরে। নগরকর্তা বুড়ো কিরিটি তখন আরামসে দুই শ বছরের পুরোনো পুঁথি কাটছিল কুটকুট করে। হেঁদোকে দেখে জলদি করে লুকিয়ে ফেলল কাগজগুলো। যদি আবার ভাগ চেয়ে বসে!

‘কী হে হেঁদো, কী খবর নিয়ে এলে?’

 ‘মহাবিপদ স্যার। কিরিকপুরের মানুষের যে নগরকর্তা আছেন, ওই যে পেটমোটা গোলগাল লোকটা!’

 ‘কী করেছে ও?’

 ‘আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে স্যার।’

 ‘হে-হে-হে। এ আর নতুন কী! আমরা ফসল খাই। ওরাও খায়। এ জন্য একটু-আধটু যুদ্ধ লাগতেই পারে। কিন্তু আমাদের তো হেরে যাওয়ার ইতিহাস নেই হেঁদো!’

 ‘কিন্তু এবার বিপদ আছে স্যার! পোস্ট অফিসে চিঠিপত্তর কাটতে গিয়েছিল কুরুটি। একটা চিঠি কাটতে গিয়ে…।’ দম নিল হেঁদো।

‘কী চিঠি? জলদি বল।’

‘চিঠিটা কাটতে গিয়ে ভয় পেয়ে যায় কুরুটি। চিঠিটা লিখেছে ওই পেটমোটা মানুষটা।’

‘কাকে চিঠি লিখেছে? কী লিখেছে? ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ দপ্তরে?’

‘তার চেয়েও ভয়াবহ স্যার। চিঠিটা পাঠানো হয়েছে জার্মানিতে। সেখানে হ্যামিলন নামের একটা শহর আছে স্যার। আপনি নিশ্চয়ই গল্পটা জানেন স্যার। চিঠিটা লেখা হয়েছে সেখানকার এক বাঁশিওয়ালার নামে! তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে কিরিকপুরে! বিনিময়ে নাকি নগরের অর্ধেক ফসল দেওয়া হবে।’

‘অ্যাঁ! ওরে হেঁদো! আগে বলবি না! তা ওই বোকা কুরুটি কী করেছে? চিঠিটা কাটেনি?’

‘সেটাই তো বলছিলাম স্যার। ওই হতচ্ছাড়া দেঁতো ইঁদুরটা ঠিকানা দেখে এতটাই ঘাবড়ে যায় যে…চিঠিটা মুখ থেকে সোজা চলে যায় ডাকবাক্সের একেবারে ভেতর। সে কোনোভাবেই ওটা কাটতে পারেনি। তারপর সোজা এসে আমাকে খবর দেয়।’

‘এবার উপায়! কী ঘটবে বল তো!’

‘চিঠিটা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার হাতে গেলেই সব্বোনাশ। ও এসে যদি এখানে বাঁশি বাজানো শুরু করে…।’

‘কিন্তু ওই বাঁশিওয়ালার তো অনেক আগেই মরে ভূত হয়ে যাওয়ার কথা।’ চিন্তিত কিরিটি।

‘তার বংশধরেরা তো আছে স্যার। এর মধ্যে নাকি ভালো বাঁশি বাজায় একজন। এখন যদি সে চলে আসে!’ যুক্তি আছে হেঁদোর কথায়।

 ‘তবে তো মহাবিপদ! কিরিকপুরের কাছেই একটা নদী! সব ইঁদুর যদি তার পিছু নিয়ে…! উফ্‌ফ, ভাবতেই কান খাঁড়া হয়ে যাচ্ছে আমার।’

 ‘একটা কিছু করুন স্যার! চিঠিটা হ্যামিলনে পৌঁছাতে আর বাঁশিওয়ালার আসতে বড়জোর এক মাস লাগবে।’

 ‘হুমম, ভাবতে দাও আমাকে। পুরোনো গল্পটা একটু বের করে দাও। দেখি ওতে কোনো ক্লু পাই কি না। তা কোন ধরনের বাঁশি বাজাত ওই বাঁশিওয়ালা? বাঁশের, নাকি স্টিলের? জানো কিছু?’

গল্পের বইটা হাতে নিয়ে ইঁদুরদের নগরকর্তা বুড়ো কিরিটি ভাবতে বসল। ভাবার জন্য রসদ চাই। তাই আলমারি থেকে বের করে নিল চার শ বছর আগের লেখা একটা কবিতার খাতা। টেকো মাথার এক ইংরেজ কবির লেখা। বেশ মজার। কাটতে কাটতেই বুদ্ধিটা পেয়ে গেল বুড়ো কিরিটি। গোঁফ চুলকাতে চুলকাতে টেনে নিল কাগজ-কলম। সে-ও একটা চিঠি লিখবে ঠিক করল। তবে সেই চিঠি জার্মানিতে নয়, যাবে চিকচিকাপুরে।

প্রায় এক মাস পরের কথা। কিরিকপুরে সাজ সাজ রব। সুদূর জার্মানি থেকে এক বাঁশিওয়ালা এসেছে। নগরের ছেলে-বুড়ো সবাই তার পিছু পিছু। লম্বা জোব্বা পরা বাঁশিওয়ালা খুব ভাব নিয়ে বসে আছে ফুল দিয়ে সাজানো ভ্যানগাড়িতে। বাঁশি বাজাচ্ছে না। আগে নগরকর্তার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। তারপর বাঁশি বাজাবে। পূর্বপুরুষের মতো ভুল সে করবে না। পরে দেখা যাবে বাঁশি বাজানোর পর এক পয়সাও জুটল না। এদিকে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার আগমনের খবরে কিরিকপুরের ইঁদুরমহলে হইচই শুরু হয়ে গেছে। নগরকর্তা সবাইকে ধৈর্য ধরতে বললেও একটু পর পর কিচিরমিচির করে উঠছে সবাই।

চুক্তির কাজ শেষ। শর্তানুযায়ী নগরীর অর্ধেক ফসল দেওয়া হবে বাঁশিওয়ালাকে। বিকেলের দিকে শুরু হবে বাঁশি বাজানো। নগরের সমস্ত মানুষকে সতর্ক করে দেওয়া হলো। কারণ বাঁশি বাজানো শুরু হতেই অলিগলি, গর্ত, নালা সব জায়গা থেকে ইঁদুরের পাল ছুটে আসবে।

 ‘স্যার, বিকেল তো হতে চলল! একটা কিছু করুন স্যার! নইলে ইঁদুরের বংশ হবে নির্বংশ!’

 ‘হেঁদো! আমার ওপর ভরসা রাখ। সময় হলেই দেখবে।’ গম্ভীর গলায় বলল বুড়ো কিরিটি।

জোব্বা থেকে লম্বা বাঁশিটা বের করল বাঁশিওয়ালা। ফুঁ দিতেই বের হলো অদ্ভুত সেই সুর। মুহূর্তে থেমে গেল সমস্ত কিচিরমিচির। বোবা হয়ে গেল সব ইঁদুর। সুরের জাদুতে তারা উঠে আসতে শুরু করল গর্ত থেকে। কিন্তু এ কী! মিনিট না পেরোতেই কেটে গেল ছন্দ! ধুড়ুম ধাড়ুম, গুড়ুম গাড়ুম, টাক ডুম ডুম টাক, গিরিটি গিরিটি কিরিটি কিরিটি পেঁ পোঁ পেঁ পোঁ টাক। বিকট শব্দে বাজতে শুরু করল ঢোল। সঙ্গে বেসুরো সানাই। ঢেকে গেল বাঁশিওয়ালার বাঁশির শব্দ। বাঁশিওয়ালা আরও জোরে ফুঁ দিল বাঁশিতে। কাজ হলো না। ধুম তাক ধুম তাক ধুড়ুম ধুড়ুম ঘুড়ুম তাক। এলোমেলো ছন্দে বাজতেই থাকল ঢোল, ঝুনঝুনি। ঢোলে ছন্দ থাকলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু ছন্দহীন ঢোলের শব্দে কিছুতেই বাঁশির সুর মেলাতে পারছে না হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। বুড়ো কিরিটির মুখে হাসি। তার চিঠি পেয়ে সময়মতো হাজির হয়েছে চিকচিকাপুরের গোটা দশেক ইঁদুরের জনপ্রিয় ব্যান্ডদল কাট্টাকাট্টি। এসেই বেমক্কা ঢোল বাজানো শুরু করে দিয়েছে আমুদে ইঁদুরগুলো।

তারপর? চিকচিকাপুরের ব্যান্ড পার্টির সঙ্গে সুবিধা করতে না পেরে পরদিন খালি হাতেই নিজের দেশে ফিরে গেল হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। কিরিকপুরের ইঁদুরেরা অবশ্য টানা তিন দিন সেই কাট্টাকাট্টি ব্যান্ডের কনসার্ট শুনেছে বেশ মজা করে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত