আমাদের ফ্ল্যাটের ঠিক ওপরের তলায় নতুন ভাড়াটে এসেছে। তিনজনের বেজোড় পরিবার। মা-বাবা আর একমাত্র মেয়ে সুহা। মেয়েটি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। আশপাশের যেসব ছোকরা ওই পরিবারে জোড়া মেলানোর তালে আছে, তারা বলে, দীপিকা পাড়ুকোনের কার্বন কপি ওই মেয়ে।
আমি কিন্তু সুহাকে ঘাঁটাই না। কঠিন মেয়ে। আমাকে মুখের ওপর বলেছে, ‘আপনি এত শুকনা ক্যান? জিমে যেতে পারেন না!’
সেই থেকে তলেতলে বুকডন দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এদিকে হয়েছে কি, আমাদের বাসার সদর দরজায় একটা বিড়াল প্রায়ই হিসু করে যাচ্ছে। আমরা প্রথমে তা টের পাইনি।
কেয়ারটেকার তাহের মিয়া সেদিন বলল, এটা বিড়ালের কাণ্ড। আমাদের কাছে সে এভাবে বর্ণনা দিল, ‘বিলাইডা পেছনডা দরজার দিকে ঘুরাইয়া লেজ খাড়া কইরা কাঁপানি দিয়া কী য্যান করল! পরে দেহি…’
মা ধমকের সুরে বললেন, ‘বিড়ালটা এমন কাজ করল, আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে!’
তাহের মিয়া বলে, ‘আরে, ওই বিলাই হেবি শয়তান। এমন দৌড় দিল…’
হে হে করতে লাগল সে।
আট-আট ষোলোটা ফ্ল্যাট এই বাড়িতে। বত্রিশ রকমের কাজ। যে বকশিশ ভালো দেয়, তার কাজটাই আগে করে তাহের মিয়া। বিড়ালটাকে পাকড়াও করতে তাকে আগাম ১০০ টাকা দিলেন মা। সে মুখভরা হাসি নিয়ে চলে গেল।
দরজায় বিড়ালের নোংরা পানি ঝেড়ে যাওয়া আমাদের জন্য গা-ঘিনঘিনে হয়ে দাঁড়াল। আপুর এমন অবস্থা, পারলে হাতখানেক শূন্য দিয়ে হাঁটে!
বুয়া কালার মায়ের জন্য নগদে ১০০ টাকা ছাড় করে ওই দরজাসহ পুরো বাসা ডেটল-পানি দিয়ে ধোয়ামোছা হলো। এরপরও কারও স্বস্তি নেই।
এত ফ্ল্যাট থাকতে বিড়াল এসে আমাদের সদর দরজা বেছে নিল কেন, এ নিয়ে আমাদের গবেষণা চলতে লাগল।
মা দমে দমে বলেন, ‘কী অলক্ষুনে কাণ্ড!’
বাবা ভুরু কুঁচকে বলেন, ‘এটা তো প্রেস্টিজেরও ব্যাপার। লোকে বলবে কী!’
ভাইয়া ক্রিমোনোলজির ছাত্র। সবকিছুতেই তার সন্দেহ। বিড়াল সত্যিই ওভাবে কাজটা সারে কি না, তা দেখার জন্য ‘ইউরিনেশন অব ক্যাট’ লিখে গুগলে সার্চ দিল সে। বিড়ালের লেজ খাড়া করে ওই কাজ সারার ছবি অবশ্য পাওয়া গেল।
ভাইয়া বলল, ‘হুঁম, তাহের মিয়া মিথ্যা বলেনি।’
কিন্তু এত কিছু থাকতে বিড়ালটা আমাদের সামনের দরজাটাই বেছে নিল কেন? কী আছে এতে?
আমি গোয়েন্দাগিরি ফলিয়ে বললাম, ‘দরজার রংটাই গোল বাধিয়েছে। সব কয়টা ফ্ল্যাটের মধ্যে কেবল আমাদের দরজা লিচু-বিচি কালারের।’
ভাইয়া ঠোঁট উল্টে বলল, ‘কচু! বিড়াল রং চিনতে পারে, গর্দভ?’
আমার ওপর ভাইয়াই বেশি মাতব্বরি ফলায়। সে আদেশ করল, ‘ঘটে তো কিছু নেই। এবার গতর খাটা। বিড়াল তাড়ানোর ব্যবস্থা কর।’
চাচাতো ভাই আলাওলকে খবর দিলাম। আমার সমবয়সী সে। ওর ঘটে ফিচেল বুদ্ধি ভালো খেলে। সে বলল, ‘বুঝলি, বিড়াল মানেই ভণ্ড! দুনিয়ায় যত খারাপ উপমা, সব ওই বিড়ালকে নিয়ে। দেখিস না, সাধুর বেশে থাকা ভণ্ড লোককে সবাই বিড়ালতপস্বী বলে। আর বাসররাতে আর কিছু না, বিড়ালই মারতে হয়।’
আমি অধৈর্য হয়ে বলি, ‘বিড়ালটাকে কীভাবে ধরব, সেটা আগে বল।’
আলাওল বলে, ‘ইংরেজিতে ওই যে আছে না, সেট আ থিফ টু ক্যাচ আ থিফ। মানে, চোর দিয়ে চোর ধরো। আমাদেরও তাই করতে হবে।’
‘কী বলছিস?’
‘হ্যাঁ, ওটাকে তাড়াতে একটা গাট্টাগোট্টা হুলো বিড়াল পুষতে হবে।’
আপু শুনে ওকে চটি নিয়ে দৌড়াতে গেল।
দুদিন পর তাহের মিয়ার হইচই। বদমাশ বিড়াল ধরা পড়েছে! সে মুখবাঁধা একটা চটের বস্তা এনে আমাদের বাসায় ফেলে ১০০ টাকা নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল, ‘ধইরা আনতে কইছেন, ধইরা দিয়া গেলাম। এখন যা করার করেন। ফালাইতে পারুম না।’
মা আমাকে আদর করে বলেন, ‘যা তো, বাবা, বস্তাটা রিকশায় করে নিয়ে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আয়!’
মা আমার হাতে ২০০ টাকা গুঁজে দিলেন। অন্য সময় ১০০ টাকা আদায় করতেই অনেক ঘ্যানঘ্যান করতে হয়।
আমি পড়ে গেলাম দোটানায়। অনার্সে পড়া একটা ছেলে বস্তায় করে বিড়াল ফেলতে নিয়ে যাবে, এটা কেমন কথা! আবার মাকেও চটানো যাবে না। অগত্যা আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির ইঁচড়েপাকা ছেলে কিসলুকে পটাই। কিন্তু পঞ্চাশে রাজি নয়। পুরো এক শ টাকাই দিতে হলো।
বস্তা নিয়ে যখন কিসলু নামছে, আমিও বকের মতো গলা বাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলাম। টাকি ছেলে। ফাঁকি দিতে পারে।
কিসলু কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে নামতেই ঝোড়ো হাওয়ার মতো সুহা এসে ওর পথ আগলে দাঁড়ায়। ব্যস্ত কণ্ঠে বলে, ‘বস্তার ভেতর কী নিচ্ছ, কিসলু? ওটা নড়ছে কেন?’
কিসলু কিছু বলার আগেই বস্তার মুখটা খুলে ফেলল সুহা। ভেতরে উঁকি দিয়েই বিকট চিত্কার, ‘ও মাগো, এই ছেলে তো আমাদের লক্ষ্মী বিড়াল কিটিকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে! এ জন্যই তো ওটাকে সকাল থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। কী ডাকাত ছেলে রে, বাবা!’
সুহার আচমকা চিত্কারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে কিসলু। হাঁড়ির খবর ফাঁস হওয়ার আগেই দ্রুত নেমে গেলাম ওখানে। আমাকে দেখে কিসলু কিছু একটা বলতে হাঁ করল, আমি দাবড়ি মেরে দিলাম, ‘এই হতচ্ছাড়া, যাবি, না দেব কয়টা!’
আমার উসকানিতে সুহার তেজ গেল বেড়ে। সে কিসলুর দিকে তেড়ে গিয়ে বলল, ‘জানিস, এটা কত দিয়ে কিনেছি? তুই যে এটাকে বস্তায় ভরলি, এটার যদি হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত!’
কিসলু তো পড়িমরি দৌড়। আমিও যেন হার্ট অ্যাটাক থেকে বেঁচে গেলাম।
সেই থেকে কিটিকে আর বেরোতে দেয় না সুহা। আমাদের দরজাও শুকনো থাকে। উপরি পাওনা হিসেবে জুটেছে সুহার সুদৃষ্টি। কিসলুকে কিন্তু মুখ খুলতে দিইনি। ভরপেট নান-কাবাব খাইয়ে ঠান্ডা করেছি।