জেগে ওঠার দিন

জেগে ওঠার দিন
ফজরের পর যখন জমানো ঠান্ডা একটু একটু ফাটতে শুরু করে, হাঁসের খোয়াড় থেকে কলরব করতে করতে ঘুমভাঙা হাঁস, আর শরীর ঝাড়তে ঝাড়তে মুরগিগুলো উঠানে বেরিয়ে আসে তখন তরকারি সমেত গরম ভাতের পাতিল পুরনো লুঙ্গিতে রেখে লুঙ্গির চার কোণায় কোণাকুনি গিঁট দিয়ে, গিঁটটা চার আঙুলে টেনে পরীক্ষা করে পরী বলে, এই নেন, হয়া গেছে।

কেউ না কেউ উঠানে দাঁড়িয়ে তাড়া দেয়, কই রে জমির, বাইরো।

জমিরের যাত্রা শুরু হয় তখন। জমিরদের উঠানের পর সুরুজ আলী, সম্পর্কে তার চাচার উঠানের পরেই গ্রামের পাশ দিয়ে নামা সোজা সড়কে কৈবর্তপাড়া আর কৈবর্তপাড়ার ভেতর দিয়ে বাড়ি ও উঠান, উঠান ও বাড়ির ঘুপচি গলি পার হলে ঘোড়াউত্রার শুরু। এপাড়ে কৈবর্তপাড়া ওপাড়ে আছানপুর আর মাঝখানে তার বিপুল জলজ সংসার।

ঘোড়াউত্রার টলটলে জল। স্থানে স্থানে দেবদারুর ডাল জড়ো করে রাখা মাছের ফাঁদ পাশে রেখে নৌকায় জমির ও অন্যরা আর কৈবর্তপাড়ার কেউ কেউ নদী পার হয়। এরপর আছানপুর পেরিয়ে যে পথ হাওরে নেমে গেছে এর দু’ধারে বিস্তৃত মাঠে তখনই কোদাল নিয়ে কেউ কাজে নামে, অদূরে ট্রাক্টর জমি কর্ষণ করে চলে। এক নৌকার প্রায় সবাই, মোটামুটি একটা দল হাওর বেয়ে চলতে শুরু করলে আরো দূরে আবছা গ্রামের পিঠ বেয়ে হাঁসের ডিমের একটি গোলাকার কুসুম আকাশে মস্তক তোলে।

জমিরের হাতে ঝুলে থাকা লুঙ্গির গিঁট কিছুতেই ছোটে না। চলার ছন্দে পাতিলের অবস্থানের নড়চড় হলে একটু পরপর অন্য হাতে ঠেলে ঠিক করে আবার হাঁটা দেয়। এভাবে ঘণ্টাদেড়েক হাঁটলে নহলা হাওর, ওখানে সে তাদের পূর্বপুরুষের গেরস্থালির উত্তরাধিকার। অবশ্য ঘোড়াউত্রা থেকে একটি লিঙ্ক-খাল জমিরদের বাথান মানে নহলা পর্যন্ত যদিও গেছে কিন্তু পুরোপুরি জোয়ার না এলে জ্যৈষ্ঠ নাগাদ এখানে নৌকা ঢুকানো মুশকিল।

আশ্বিনে বর্ষা নেমে গেলে খাল দিয়ে নৌকায় করে টিন-বাঁশ ইত্যাদি এনে বাথান বানালে আস্তে আস্তে এর এক কোণায় যেতে শুরু করে বাড়ির গরু-হাঁস-মুরগির একটি অংশ আর বিভিন্ন সবজির বীজ। তখন থেকে নহলায় চাষাবাদ হয়, মুরগি-হাঁস ডিম দেয় আর খালে ধরা পড়ে মাছ।

জমির বাথানে পৌঁছেই হাঁস-মুরগিগুলো ছেড়ে দেয় আর গরুগুলোকে ঘাসের উপর খুঁটিতে বেঁধে ভাতের পাতিল বের করে। বাথানের সামনে পিঁড়িতে বসলে সারা শরীর তখন রোদের আদর নিতে থাকে। তার সহযাত্রীরা যে যার গন্তব্যে চলে গেছে। নহলার শেষ মাথায় মাইল খানেক দূরে তাদের সবচেয়ে দূরের জমিটিতে আজ ধানের চারা রোপন করা হবে। জমির যাদের ঠিক করে রেখেছে তাদের আরো আগেই ওখানে চলে যাবার কথা, নাশতা সেরে যোগ দেবে সেও।

শরীরের এই আকস্মিক খেয়ালে সে ভীষণ চমকে ওঠে আর চকিতে এদিক ওদিক কেউ নেই, তবু তাকিয়ে কেউ যে নেইই তা নিশ্চিত হতে চায়।

লুঙ্গির গিঁট খুলে পাতিল বেরিয়ে এলে এর থেকে হাত দিয়ে ভাত তুলে আনে জমির। তখনও ঈষৎ গরম থাকে ভাত আর তা পাতে তুলে নিতে নিতে রোজ পরীর কথা মনে পড়ে যায়। পরী জোর করে হাতে চেপে চেপে বেশি ভাত দিয়ে দেয়। ও কাজে জমিরের আপত্তি খাটে না। তরকারির বাটিটা ভাতের ভিতর চাপ দিয়ে ডুবিয়ে রোজ খানা তৈরি করে দেয় পরী। পাঁচ বছরের সংসার আর গেরস্থিতে নহলার যাতায়াতে একদিনও পরীর রুটিনের ব্যত্যয় হয়নি। কিন্তু আজ এই সূর্যস্নাত সকালে জমির পাতে ভাত নিয়ে পাতিলে উঁকি দিয়ে দেখে, তরকারির বাটির পাশেই আলুভর্তার একটি তুলতুলে বল পড়ে আছে আর সেই বলটা হাতে নেয়ার সাথে সাথে সে খেয়াল করে, লুঙ্গির ভেতর আচমকা তার শিশ্ন জেগে উঠছে!

শরীরের এই আকস্মিক খেয়ালে সে ভীষণ চমকে ওঠে আর চকিতে এদিক ওদিক কেউ নেই, তবু তাকিয়ে কেউ যে নেইই তা নিশ্চিত হতে চায়। ভর্তার গোলাটা সে আঙুলে ভাগ করে অর্ধেক পাতে তুলে ভাত মুখে দেয়ার আগে একটু অপেক্ষা করে। পুরুষের এই অতি স্বাভাবিক পরিবর্তন জমিরের তো নূতন নয় তবু যখন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় অপেক্ষা ও ভাবনার পরও তার শিশ্নের গতি বুঝতে ব্যর্থ হয় তখন এই একাকী সুনসান হাওরে সে ভীষণ শরমে পড়ে আর দ্বিধার জাল কাটে, দূরের জমিতে সে কি কাজে যোগ দেবে নাকি আরো দূরের আছানপুর, তার পরে ঘোড়াউত্রার ওপাড়ে কৈবর্তপাড়ার পর হাঁটতে হাঁটতে তাদের বাড়ি চলে যাবে?

এমন অদ্ভুত দ্বিধা আর সিদ্ধান্তহীনতায় ভাত খেতে যখন কষ্ট হচ্ছিল তখন তার নজরে আসে, একটি গরু খুঁটি তুলে বাথানের পাশে লাগানো ধানক্ষেতের দিকে চলে যাচ্ছে। জমির ভাতের থালা মাটিতে রেখেই হেইহেইপোপো শব্দ করে এক হাতে লুঙ্গি ধরে গরুটির দিকে এগিয়ে যায় আর এটিকে পুনরায় খুঁটিতে শক্ত করে বেঁধে খাওয়ায় মনোযোগ দিয়ে আগের ব্যাপারটা ভুলে যেতে চাইল।

খাওয়া শেষে কোমরে বিড়ির প্যাকেট-গ্যাসলাইটার আর সেকেন্ডহ্যান্ড একটি মোবাইল সেট নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে জমিতে পৌঁছোয়। তিনজন জুগালি এরই মধ্যে চার গণ্ডার জমিটির অর্ধেক শেষ করে ফেলেছে। সে এখানে এসেছে মূলত একজন জুগালির মজুরি বাঁচাতে। অতএব জমির মালিক হয়েও লুঙ্গি কাছা মেরে জমিতে নেমে পড়ে, নেমেই মুঠো ভরে ধানের চারা নিয়ে শুরু করে লাগাতে। ধান-চারার মোঠা থেকে চারা নিয়ে কিছুক্ষণ লাগাতে লাগাতে শরীরের ডানে-বাঁয়ে মুভমেন্টে জলের সাথে জমিরের একটি তাল তৈরি হয়। পানির নিচে নরম কাদা। চারাটা পাঁচ আঙুলে ধরে সে তীব্র গতিতে পানিতে ঠুকে দেয় এবং পানি ভেদ করে কাদার ভেতর চারাটা গুঁজে দিয়ে হাত উপরে এনে অন্য হাত থেকে চারা নিয়ে আবার ঠুকে দেয়। ডান থেকে বামে আর বাম থেকে ডানে আসা যাওয়ার রিদমটা দীর্ঘক্ষণ চলতে থাকে।

কিন্তু ঠাণ্ডা কাদার ভেতর জমিরের হাত আজ যেতেই চাচ্ছে না। পানি ভেদ করে কাদার স্পর্শমাত্রই সে কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে, হাতটা প্রতিবার লজ্জা পেয়ে ফিরে আসছে। ক্ষেতের কাদা আজ মনে হলো ভীষণ নরম, জল বড় সুরসুরি জাগানিয়া রসালো। সে খেয়াল করার চেষ্টা করে, আলুভর্তার গোলা দেখে তার যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তাতো এখন আর নেই কিন্তু খেয়াল করার সাথে সাথেই মনে হলো, আবার সেই ব্যাপারটা ফিরে আসছে মানে তার শিশ্ন ফুঁসে উঠছে!

পাঁচ বছরের বিবাহিত জমির ব্যাপারটার পুনর্জাগরণের কোন অর্থ খুঁজে পায় না। এ উৎপাত সহ্য করতে সে চারপাশে একটা বিরাট দেয়াল কল্পনা করার চেষ্টা করে যে দেয়াল ভেদ করে কারো দৃষ্টি লজ্জিত তাকে আরো লজ্জিত করে দেবে না। কিন্তু সে যতই তার কল্পনার দেয়ালটাকে ইটের গাঁথুনিতে উপরে তুলতে চায়, সে দেখে, তার সে দেয়াল ততই হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ে আরো খোলাশা হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে ধরা পড়ার হাত থেকে বাঁচাতে কোমরটা একটু বাঁকা করে আস্তে আস্তে ক্ষেতের মোটা আইলের উপর হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়ে জমির আর তখন ক্ষেত থেকে একজন কথা বলে, কী অইলো জমির ভাই, উঠলা কেরে?

জমির জবাব না দিয়ে কোঁচড় থেকে বিড়ি ধরিয়ে তার সেকেন্ডহ্যান্ড মোবাইলটা বের করে একটু অন্যমনস্ক হতে সাপের গেমস খেলার চেষ্টা করে। মোবাইলের সাপ দৌড়াতে দৌড়াতে সে এক টানা বিড়ি টানে আর লম্বা করে ধোঁয়া ছাড়ার সময় টের পায়, এ মসিবত আজ তাকে নাজেহাল করে ছাড়বে। জমির তখন মনোযোগ ঘোরাতে মোবাইলে কল করার চেষ্টা করে কিন্তু এ দূর-হাওরে নেটওয়ার্ক খোঁজার চেষ্টা বৃথা গেলে সে জুগালিদের আড়াল করে উঠে দাঁড়ায়। জুগালিদের একজন তখন বলে, যাওগা নিহি?

সে যেতে যেতে বলে, শইলডা ভাল্লাগতাছে না। তোরা ক্ষেত লাগা। আমি বাথানে গিয়া এট্টু শুইয়া থাকমু। বলতে বলতে হাঁটতে শুরু করে। কিছুদূর যেতেই সুরুজ আলী চাচার গলা কানে আসে, কিরে জমির, ক্ষেত লাগানি শেষনি?

-জমির জোরে উত্তর দেয়, না চাচা। হ্যারা লাগাইতাছে। আমি এট্টু বাথানে যাই।

-আমরা কিন্তু নাউ লইয়া আইছি। বিকালে আর হাইট্টা যাইস না। আমরার লগে যাবি।

-ক্যামনে আনছেন নাউ?

-এই খাল ঠেইল্যে ঠেইল্যে আনছি। বিকালে তো জোয়ার আইবই।

-অইলো, আমারে নিয়া যাইয়েন।

জমির হাঁটতে হাঁটতে বাথানে ফিরে আসে। এসে কিছু খড় বিছিয়ে একটি খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে পুরো ব্যাপারটার একটা সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে। পরী আর ওর পাঁচ বছরের সংসার। মনে পুষে রাখার মত কোনও রাগ নেই, গোস্যা নেই। পরীর সাথে সে যখন রাত্রিযাপন করে, মনে হয়, সারা ঘরে তার ভালবাসা খেলা করে। পাঁচ বছরের নিঃসন্তান থাকার দুঃখটা তখন আর কিছুতেই মনে থাকে না। নিঃসন্তান থাকার ব্যাপারটারও কোন সমাধান নেই। ডাক্তার বলে, কোন সমস্যা নাই, সন্তান হইব। প্রতিরাত পরী আর জমির দুজনেই মনে করে, হইব। কিন্তু হইব হইব জোর ভাবনার পরও কোন সন্তান হইল না। অবশ্য জমিরের কোন তাড়াহুড়ো নাই। তার এমন ভাব, যখন হওয়ার হইব নে। তবে পরী মাঝে মাঝে দূরে কোথাও তাকিয়ে থাকে কিন্তু মুখে কোন রা রাখে না। জমির তখন পরীকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়। এই একটি মাত্র অপূর্ণতা বাদ দিলে ওদের জীবনে কোন দুঃখ নাই, বিবাদ নাই।

বাথানের নির্জনতায় জমির যতই তাদের সুখের দিনের কথা মনে করার চেষ্টা করে ততই অনুভব করে, কেউ তাকে জাগিয়ে দিচ্ছে। কি লজ্জা! তখন সে লুঙ্গির উপর দিয়ে মুঠো করে শিশ্নটা চেপে ধরে বলে, এই, তুই এমুন করতাছস ক্যান? আমার কাম আছে না! বলতে বলতে সে হাতের পরশে একটু প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু নাছোড়বান্দা আজ তাকে চেপে ধরেছে। সে মুঠো করে ধরেই রাখে আর মোবাইলটা হাতে নিতে নিতে একটা মুরগি হাঁটতে হাঁটতে ঘরে ঢুকে পড়লে, মুরগির কাছে ধরা পড়ার লজ্জায় অন্যদিকে মুখ সরিয়ে শিসশিসশিস বলে ওটাকে চলে যাবার সিগনাল দেয়। মুরগিটা না গিয়ে মাথা নাড়িয়ে পায়চারি করে। জমির তখন এক হাত দিয়ে ধাওয়া করলে মুরগিটা ভয়ে পালায় আর তখনই মোবাইলে নেটওয়ার্ক ধরা দেয়।

জমির কলি ভাবীকে ফোন দেয়। তাকে ফোন দেয়া আরেক যন্ত্রণা। পরীর কাছে মোবাইল ‍দিতে বললে নানা কথা বলতে হবেই। আজও বলতে হলো।

-কি গো দেওরা, কী কইবা কও।

-একটু পরীরে দেইন না।

-ক্যান, আমার লগে কথা কও। আমি তো আছি।

-দুর ভাবী, মস্করা কইরেন না। এট্টু ওরে দেইন।

-দিতাছি গো দেওরা দিতাছি। এত উতলা অইয়ো না। বলতে বলতে ভাবী পরীকে ডাক দেয়, পরী, পরী লো….

-জমির অপেক্ষা করে। পরী প্রশ্ন করতে করতে এগিয়ে আসে, কেডা ভাবী?

-ভাবী বলে, আমার তেনার লগে কথা কও। তখন পরী মোবাইল নিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে চলে আসে। কথা বলে জমির, কী করতাছ?

-চাউল ঝারতাছি। আপনের কি ক্ষেত লাগানি শেষনি?

-আর কইয়ো না। আমার অবস্থা খারাপ।

-পরী কান সজাগ রেখে প্রশ্ন করে, ক্যান, কী অইছে?

-অইছে বউ, অনেক কিছু অইছে। তোমার কী খবর?

-আমার আবার কী খবর?

-জমির একটু শরম নিয়ে আস্তে করে বলে, তোমার হেইডার কী খবর?

-তখন পরী লজ্জা পায়, আজকা শেষ হয়া গেছে।

-তাইলে তো আমি এহনই আইয়া পড়মু।

-যান, আপনের খালি শয়তানি। কাম থুইয়া আইতে অইব না।

-আমি আইমুই আইমু।

-আমি জানি না। যা ইচ্ছা করেন। মোবাইলে টাকা উঠতাছে না?

-উডোক। বউয়ের লগেই তো কথা কইতাছি। হোনো, এইবার বৈশাখে তোমারে একটা মোবাইল কিন্যা দিমু।

-থাক, আমার মোবাইল লাগত না।

-তখন পরী প্রসঙ্গ ঘোরায়, শোনেন, এই দিকে তো আরেক ঘটনা ঘইটা গেছে।

-কী ঘটনা?

-আপনেরার তেঁতুল গাছ তো পইড়া গেছে।

-কী কও, ক্যামনে?

-মড়াৎ কইরা ভাইঙ্গা একেবারে গাঙ্গে পইড়া গেছে। গাছভর্তি এত তেঁতুল!

পরীর সাথে কথা বলে মনটা খারাপ হয় জমিরের। এত পুরাতন তেঁতুল গাছটা পড়ে গেল? গাছটা এতই পুরান যে, কেউ কেউ বলে, এর বয়স দুইশ বছর। কেউ বলে আরো বেশি। সন্ধ্যার পর কেউ এর ছায়া মাড়ায় না। বহু বছর এর ডালে ডালে ভূতেদের সংসার। তার মনে বিষণ্নতা আসে। বিষণ্নতা এই অর্থে, যদিও প্রাচীন তবু তেঁতুল গাছটা তো আর রাজিয়ার দাদার মত মরবার আগে বহুবার মরার ইঙ্গিত দেয়নি!

রাজিয়ার দাদা যখন মরবার তখন মরেনই না। প্রতিবার খোক-খাক কাশির দম আটকে বড় বড় চোখ দেখিয়ে মরি মরি করে সবাইকে লোভী করে তুললেও শেষমেষ আর মরেন না। অথচ তাঁর নড়ন-চড়ন-বলন কোনটাই দীর্ঘদিন সাড়া দিচ্ছিল না। যেদিন তিনি মারা গেলেন, সেদিনই ছিল রাজিয়ার বিয়ে। বিয়ে শেষে রাজিয়াকে বিদায় দিয়ে যেই তার মা মানে জমিরের চাচী কেঁদে ক্লান্ত হয়ে চোখ মুছে মুখ ধুতে গেছে তখনই আবার বিলাপে যোগ দিতে হয়েছিল। অবিশ্রান্ত কান্নায় চাচীর গলা বন্ধ হয়ে এসেছিল।

কিন্তু তেঁতুল গাছের ভেঙ্গে পড়ার সংবাদে এই যে চাচী বা তার অশীতিপর শ্বশুরের কথা উঠছে এর সাথে হাওরে জমিরের ওই অমীমাংসিত ঘটনার রহস্যটা কী? অথবা ডুবু নৌকার ভেসে ওঠা পেটের মত আজই রাজিয়ার নামটি উঠে আসতে হবে?

এই হিসাবের খেলাটা বড় অদ্ভুত। জমির বুঝতে পারছে, একটা পুরাতন সিলগালা করা স্মৃতির ঢাকনা আজ খুলবেই খুলবে। আর কিছুতেই বুঝতে পারছে না, দূরের জমিটা রোপন করতে এসে, নিজেকে ঐ জমি থেকে সরিয়ে এনে আরো দূরে সরিয়ে রাখা শৈশবে সে তো ইচ্ছে করে ফিরতে চাচ্ছে না। তবে কি এও এক মায়া? নানা সংকটে মাটির ব্যাংকের জমানো মুদ্রার মত জাগিয়ে দেয়া যে, আছি, আছি, কাছেই আছি।

রাজিয়া, হায়রে রাজিয়া। ওর চেহারায় এখনো ভীষণ শরম জমিরের। অকারণ তাকে একবার জড়িয়ে ধরেছিল। ঘটনাটা সে কিছুতেই মনে করতে চায় না কিন্তু রাজিয়া তাকে ঠিকঠিক দেখা দেয়। দেখা গেছে, জমির পরীর দিকে একান্তে ধাবিত হয়েছে আর অমনি খাটের পাশ দিয়ে সরে গেছে রাজিয়ার একটা ছায়া । অথচ রাজিয়ার সাথে উল্লেখ করার মত কোন সম্পর্ক ছিল না। ছিল না দুঃসম্পর্কও। রাজিয়ার এখন স্বামীর সংসার, ঘরভর্তি ওর ছেলেমেয়ে। বাপের বাড়ি বলতে গেলে আসেই না কিন্তু সে তবু আসে। আর যখন আসে তখন জমির লজ্জায় লুকোতে চায়। এই যেমন আজ, সে ছেড়ে এসেছে ক্ষেতের কাজ, চুপটি করে থাকতে চেয়েছে বাথানের কোণায় অথচ মধ্যদুপুরের এই সুবিশাল হাওরে পরী আর রাজিয়া বা এদের কেউ না শুধু তার বিশেষ অঙ্গটি অথবা ওরা তিনজনেই একাট্টা হয়ে তার নিঃসঙ্গতায় ভীষণ একটা অট্রহাসি দিয়ে চারপাশ কাঁপিয়ে দেবে মনে হচ্ছে। অদূরে ডিপকলের শব্দ কানে লাগে। তার চোখ যায় আছানপুরের দিকে। গ্রামটা একটু একটু ভেসে ওঠে। ঘণ্টাদেড়েক হাঁটলেই তো আছানপুর। এরপর ঘোড়াউত্রা-কৈবর্তপাড়া পার হলে তাদের বাড়ি। সে কি ফিরে যাবে? পরীকে বলবে এসব!

তখন সিদ্ধান্ত নেয়, খালে জোয়ারের পানি ঢোকার আগেই মাছ ধরা দরকার। পরী বলেছিল, মাছ নেই। সকল ভাবনা ঝেড়ে ফেলে লুঙ্গি কাছা মেরে একটা পাতিল নিয়ে জমির খালে নেমে পড়ে। এঁটেল কাদার এই খাল ঊরু পর্যন্ত গিলে নেয়। মাছ ধরায় পারদর্শী সে অল্প সময়েই কিছু টেংড়া আর পুঁটি ধরে ফেলে আর কাদার ভেতর কৌশলে পা টেনে টেনে এগিয়ে চলে। এমন সময় পায়ের নিচে একটি বড় মাছ অনুভব করলে দুটো হাত এক সাথে মাছটির মাথা চেপে ধরে উপরে তুললে দেখা গেল, শোল। সে মাছটা দেখে খুশি হয় আর মনে মনে বলে, আজ আর মাছ না ধরলেও চলবে। কিন্তু শোলটা বেশ বড় থাকায় খুব জোর খাটাচ্ছিল আর জমিরও শক্ত হাতে চেপে ধরে কাদায় ডুবে যাওয়া পা দুটো আলগা করার মুখে হঠাৎ মাছটা হাত থেকে পিছলে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সেও ঝাঁপিয়ে পড়ে এর উপর। কিন্তু জলের প্রাণীর আত্মরক্ষার কৌশলের কাছে ডাঙার প্রাণীর আক্রমণের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হলে জমির পাতিল নিয়ে ডাঙায় ওঠে আর মাছটার পালিয়ে যাবার কথা ভেবে অথবা মাছ-কাদায় তার নিষ্ফল ধস্তাধস্তির কথা ভেবে একা বিদ্রূপে হেসে ওঠে। সে তখন স্পষ্ট করে মাছটার উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলে, শালা, তোরে কালকা ধরমু।

তেঁতুল গাছের বিরাট লাশ নদীর উপর একলা পড়ে রয়। জমির সেখানে অপেক্ষা না করে দ্রুত নৌকা থেকে নেমে বাড়ির সামনে এসে ডাক দেয়, পরী

শরীরভর্তি কাদা নিয়ে ডিপকলে যায় জমির। কল থেকে অর্ধেক পাইপে পানি পড়ছে। পাইপের নিচে সে মাথা পেতে দেয়। হাতে ডলে ডলে পায়ের, রানের কাদা ধোয় আর কাদা লেপ্টানো লুঙ্গিটা পাইপের নিচে কচলাবার মুখে সে লক্ষ করে, তার পুরুষাঙ্গটি আবার সবল হয়ে উঠছে। তখন নিজেকে খুবই অসহায় লাগে। সে এদিক ওদিক একটি নিরীহ দৃষ্টি দিয়ে ড্রেনের গোড়ায় বসে পড়ে। ওই মূহুর্তে অপ্রত্যাশিতভাবে ডিপকলের ড্রাইভার কল বন্ধ করতে এলে জমির একটু জীবন পায়। আর ড্রাইভারের প্রতি অদৃশ্য কৃতজ্ঞতায় তাকে খাবারের নিমন্ত্রণ দিয়ে ফেলে।

বেলা পড়ে আসে। জুগালিরা ফিরে এসে জমিরকে কাজের আপডেট জানিয়ে খালে নামে। জমির আর ড্রাইভার সময় নিয়ে খেতে থাকে আর কথা বলে। জমির বলে, কিরে একলা একলা কেমনে থাহস, কষ্ট লাগে না!

-ড্রাইভার হেসে উত্তর দেয়, কিয়ের কষ্ট মিয়াভাই?

-না মানে বাড়িত যাস কহন?

-এই, সাপ্তায় একবার যাই।

এমন সময় একজন জুগালি একটা বিশাল শোল মাছ ধরে নিয়ে এলে জমির বিস্ময়ে তাকায় আর ভাবে, এটাইতো ছিল! তার হাতে সুরসুরি দিয়ে এটাই তো চলে গিয়েছিল? আহা, কার জিনিস কে বন্দি করে রে। জমির শোল মাছটির চোখের দিকে তাকায়। মাছটাকে মনে হলো, তার চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় চোখ ছোট করে আনছে কিন্তু জমিরের যে আজ বিপদের দিন তা কি এই মৎস্য আগে থেকেই জানতো? জানতো বলে জমিরকেই স্বস্তি দিতে দৌড়ে পালিয়েছিল? না হয় ওটার চোখে চোখ পড়তেই কেন রাজিয়াকে মনে পড়বে?

আহারে রাজিয়া। যে তেঁতুল গাছের নিচে সন্ধ্যায় যাওয়া প্রায় হারাম, সেই নিষিদ্ধ গাছের দিকেই এক অন্ধকার রাতে সে কিংবা রাজিয়া অথবা তারা দুজনেই নিঃশব্দে হাঁটতে হাঁটতে কেন গিয়েছিল, সে প্রশ্নের উত্তর এই বড়বেলার কোনও কাজেই কোনদিন মেলেনি। শুধু মনে পড়ে, মেম্বারের উঠানে সেদিন ভিসিআর দেখছিল সবাই। উঠানের কোণায় ঘরের দরজা, জানালা, বেড়া ঘেঁষে মেয়ে-মহিলারাও চুপি চুপি গিয়েছিল দেখতে। তখন তার কত, তের কি চৌদ্দ। রাজিয়ারও এমনই হওয়ার কথা। জমিরের চোখে পড়েছিল, রাজিয়া বাড়ির দিকে রওয়ানা করেছে। রাজিয়াকে দেখে সেও গেল পিছু পিছু। কেউ আসছে টের পেয়ে পেছনে তাকিয়ে রাজিয়া যখন নিশ্চিত হলো যে, এটা জমির, তখন সে কী মনে করে বাড়ির দিকে না গিয়ে তেঁতুল গাছের দিকে যাওয়া শুরু করল। তখন জমির রাজিয়ার কাছাকাছি এসে ওর হাত ধরে কিছুমাত্র না ভেবেই শব্দ করে গালে একটা চুমু খেয়ে চলে যাবার সময় রাজিয়া তার হাত টেনে ধরে।

এই অতি গোপন ঘটনাটা তাকে লজ্জা দেয় না, দেয় তখন, যখন তার মনে পড়ে, তেঁতুল গাছের সমস্ত ভয় ভুলে গিয়ে, যে কারো উপস্থিতি টের পাবার সর্বনাশ উপেক্ষা করে, রাজিয়ার জামা তুলে ওর ছোট ছোট বুক আপ্রাণ চেষ্টায় মুখের ভেতর সে টেনে নিচ্ছিল আর বলছিল, দুধ আয়ে না ক্যান, দুধ আয়ে না ক্যান!

জীবনের কত মূল্যবান স্মৃতি সে ভুলে গেছে। ছেলেবেলায় একে একে বাবা-মার চলে যাওয়ার কথা ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে আসছে কিন্তু তেঁতুল গাছের নিচে রাজিয়াময় সেই রাতের কথা সে কিছুতেই ভোলে না! তার সেই বোকা প্রশ্নটা এখন রাজিয়ার শিশুসন্তানও হয়তো করে না আর তেঁতুল গাছটাও নাকি আজ শেষ।

জোয়ারের পানি ঢুকেছে খালে। হাসু চাচার নৌকায় জমির আর সবাই জোত হয়ে বসে সারা দিনের কাজের হিসাব মিলাতে কথা বলে। জুগালিরা যে শোল মাছটা ধরে খুব বেটার কাজ করেছে সেটি হাসু চাচাও বলেন। আর জমির কান দিয়ে শোনে ও অমীমাংসিত ব্যাপারটিতে ধ্যান দিয়ে রাখে। সন্ধ্যার সাথে সাথে নৌকা ঘোড়াউত্রায় পড়ে। স্রোতাল ঘোড়াউত্রার জলে মাঝি শক্তি দিয়ে বৈঠা মারে আর প্রতিবার বৈঠা টানার সাথে সাথে জলে সৃষ্ট একটি ছোট গর্ত ঘুরতে ঘুরতে পিছনে চলে যায়। মাঝির কাছেই বসেছিল জমির আর গর্তটা ওর চোখে পড়ার সাথে সাথে ভয়ে চুপ হয়ে তাকায় অন্য সবার দিকে। দূরের জমিতে ধানের চারা লাগানোর সময়, বাথানে একলা মুরগির কাছে ধরা পড়ার সময় কিংবা ডিপকলের জলে যেভাবে সে অসহায় বোধ করেছিল ঠিক তেমনি এই অন্ধকার নামা সন্ধ্যায় সে ভাবনার বদলে চোখ বন্ধ করে ফেলে এবং তখনই পরীর কথা মনে পড়ে।

-সুরুজ চাচা কিছু একটা টের পান, কিরে জমির, তর কী অইছে? আজকা যে কথাই কস না!

-জমির, কই কী অইব আমার, বলে পাশ কাটে। তখন পাশের গ্রামে বাতি চোখে পড়ে আর তাদের নৌকা কৈবর্তপাড়া পার হয়ে তেঁতুল গাছটায়, যার নিচে ওদের নৌকা বাঁধা থাকে, এসে পৌঁছায়।

তেঁতুল গাছের বিরাট লাশ নদীর উপর একলা পড়ে রয়। জমির সেখানে অপেক্ষা না করে দ্রুত নৌকা থেকে নেমে বাড়ির সামনে এসে ডাক দেয়, পরী?

বাইরে অন্ধকার ঠেলে ওদের দরজা খুলে যায়। জমির দেখে, পরীর গায়ে আজ বিয়ের শাড়ি। জমিরের চোখে চোখ পড়তেই পরী লজ্জায় আঁচলমুখে হেসে ভেতরে চলে যায়। জমিরের মনটা ভাল হতে থাকে। পরীকে সাজতে দেখলে ও খুব খুশি হয়।

-রাতে খাওয়ার পর বিছানায় জমির পরীকে একটু খোঁচায়, সাজলা যে?

-পরী উত্তর দেয়, ঘটনা আছে।

-জমির পরীর একটা হাত মুঠোয় চেপে বলে, আজকা তো ঘটনারই দিন। কও আর কী ঘটছে?

-পরী তখন জমিরের মুখের উপর উপুড় হয়ে বলে, হেইদিন গণকবেটি কী কইছিল, মনে আছে?

-কী?

-কইছিল না, যে বছর এই গ্রাম একটা ঝাঁকি দিব, হেই বছর আমরার সন্তান হইব!

-হ কইছিল তো।

-পরী মুখ নিচু করে বলে, হেই বছরটা এইবার।

-জমির তখন বিস্ময় নিয়ে উঠে বসে, মানে?

-পরীর চোখে আনন্দের বাতি জ্বলে, দেখেন না, কেমন ঝাঁকিতে তেঁতুল গাছটা পইড়া গেছে!

বলেই পরী জমিরের বুকে ঝাঁপ দেয় আর জমির এই অচেনা আক্রমণ সামলাতে সামলাতে খেয়াল করে, জানালার কাছ দিয়ে রাজিয়ার একটা ছায়া আস্তে করে সরে গেছে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত