দেয়ালের ওপারে আকাশ

দেয়ালের ওপারে আকাশ

ক) 
– আচ্ছা রিশাদ তোমায় ছেড়ে গেল কেনো?
কাছের বন্ধুদের কাছে এ প্রশ্নটার জবাব দিতে দিতে আমি ক্লান্ত । আজও খুব দায়সারা ভাবে জবাব দিতে চেয়েছিলাম , কিন্তু পারলাম না।

কেনো জানি আরো কিছুক্ষন শহরের কোলাহল থেকে পালিয়ে বেড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে। ঐ ইট কাঠের শহরের প্রতিটা ধুলিকনাকে আমার ভয় হয়।

পাছে রিশাদের স্পর্শ মিশে থাকা এতটুকু ধুলিকনাও যদি ভুলে মাড়িয়ে যাই !

-কি হল? বললে না যে?
– রিশাদ তো আমায় ছেড়ে যায় নি! আমাদের একসাথে থাকার সুখ মুহূর্ত গুলো আমাদের ছেড়ে গেছে।

আমার সমস্ত না থাকা টা জুড়ে আছে রিশাদ।ও এখনও আমাকে ভালোবাসে। ভীষন ভালোবাসে।

খুব সহজ ভাবে বলে ফেললাম কথা গুলো। একটুও কষ্ট হলোনা !
ঠিক যেন কোন গল্পকারের মত !

(খ) 
ছোটবেলা থেকেই ভীষণ দস্যি ছিলাম আমি। সারক্ষন এঘর ওঘর ছুটে বেড়াতাম। কথা না বলতে পারলে আমার হাসফাস লাগত।

মাঝে মাঝে কথা বলার কাউকে না পেলে আমার প্রিয় নীল রঙা সাইকেলের সাথ কথা বলতাম। ও ই আমার একমাত্র একনিষ্ঠ ভক্ত ছিল।

চুপটি করে শুনতো আমার কথা। ওর একটা নামও ছিল । নীলু। আমার দেয়া।

আমার ডেইলী রুটিনের আধেক টা জুড়ে থাকত ব্যাট বল আর ক্যারাম। এসবের মাঝে পড়ে আমি কখনোই রিশাদকে বুঝিনি।

অবশ্য বোঝার বয়স ও ছিল না। এইচ এস সি’র পর যখন রিশাদ দেশের বাইরে চলে গেল তখন বুঝলাম। একটু একটু। এক সময় অনেক খানি।

কিন্তু সে বুঝা টুকু মিলত না কখনোই। সারাক্ষণ কি খেয়েছ , কি করছ, কোথায় গিয়েছিলে .. এসব জিজ্ঞেস করা কখনোই হয়নি আমার দ্বারা।

তার চেয়ে ওকে আমার গল্প শোনাতে ভাল লাগত।

আমার নিলুর গল্প, একটা ছোট্ট প্রজাপ্রতির জল তেষ্টার গল্প, একটা নদীর গল্প কিংবা ও পাড়ার মন্তুর গল্প।

যে ছোট্ট শিশু টা রোজ সন্ধ্যায় আমায় বেলি ফুল দিয়ে যেত …. !
মাঝে অনেক গুলো বছর কেটে গেছে। আমি রিশাদ কে হারিয়ে ফেলেছি। একটু একটু করে। এক সময় অনেক খানি !

(গ)
আমার চারপাশটা হটাত্ করেই খুব ভারী হয়ে গেছে। ঠিক কতটা কষ্ট হলে নিশ্বাস টা বন্ধ হয়ে আসতে চায় বলতে পারো নিবিড়?

রাতগুলোকে ইদানিং খুব ভয় হয়। অন্ধকারে নিজের একটুকরো ছায়া টাকেও ভয় হয়। কে জানে মুক্তি পেতে কখন গলা চেপে ধরে !

আমার সব প্রশ্ন গুলোর উত্তর দিয়ে রিশাদ ছোট্ট একটা মেইল করেছিল আমায় ..

ইরা ,
তোমার নামের শুরুতে প্রিয় লিখতে গিয়েও পারলাম না। ঐ শব্দ টা কখন ম্লান হতে হতে মিলিয়ে গেছে টের পাইনি।

তবু এখনো তুমি আমার প্রিয়তেই আছো। খুব গোপনে।
গত পাঁচটা বছর তোমাকে আমি উন্মাদের মত চেয়েছি। আমি আলাদা কেউ হতে পারিনি ইরা।

আর দশটা সাধারন ছেলের মত আমিও চাইতাম আমার ভালবাসার মানুষটা আমায় অন্তত একটা বার ভালবাসি বলুক। খুব চাইতাম।

মাঝরাতে বৃষ্টি এলে আমারও ভীষন ইচ্ছে হত অনুভূতির বৃষ্টিতে তোমাকে সিক্ত করতে।

শেষবার যখন তোমার অসুস্থতার কথা শুনে আমি সব ফেলে দেশে গিয়েছিলাম সেদিন আমি খুব করে চেয়েছিলাম তুমি আমার হাত টা একটু ছুঁয়ে দেবে।

সে চাওয়াটা কি খুব বেশি ছিল ?

একেকটা ক্লান্তিমাখা দিনের শেষে ভীনদেশে এই নিঃসঙ্গ রাত গুলোতে যখন তোমার সাথে একটু কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকতাম তখন তোমার ভীষন ব্যস্ত সময়…

নিজেকে খুব অসহায় লাগতো জানো.. এখনও তুমি তেমনই আছো ইরা ? আমার এখন আর একা একা লাগে না। সত্যি বলছি।

তোমায় আমি আমার পুরনো তানপুরাটায় জড়াতে চেয়েছিলাম। সারাবেলা ভীষণ বাঁজাতে চেয়েছিলাম।

কখন যে সুর কেটে গেছে… তুমি স্প্যানিশ গীটারে নতুন সুর হয়ে বেজেছ। আমি কিচ্ছুটি টের পাইনি। পুরনো আমি। ক্ষুদ্র আমি।
আমার সবটুকু সঙ্কীর্ণতা আর স্বার্থপরতা কে সঙ্গী করে পালিয়ে যাচ্ছি। আমাকে ক্ষমা করো ইরা।

(ঘ)
আরশিনগরের পিচ ঢালা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যখন নিবিড় কে আমি আমার আটপৌঢ়ে ভালবাসার কথা শোনাচ্ছিলাম,…..

ওদিকে তখন আমার বিয়ের আয়োজন চলছিল ।আজ ছেলের বাড়ি থেকে আমাকে দেখতে আসার কথা ছিল ।

ছেলেপক্ষ কনে পালানোর খবর পেয়ে চলেও গেছে। এটা নতুন কিছু নয়। তবুও মা পুরনো প্রশ্নগুলো সুধালো আবার…
– কোথায় ছিলি সারাদিন?
– নিবিড়ের সাথে।
– তো নিবিড় কে বিয়ে করে আমাদের উদ্ধার করলেই পারিস ! কদিন পর পর এত নাটক করার কি দরকার আমাদের?
– কত বার বলব মা ! নিবিড় আমার ভাল বন্ধু। এর বেশি কিছু নয় !
**************************

বেশি কিছু হতে অবশ্য খুব বেশি সময় নেয়নি নিবিড় । অকপটে জানিয়েছিল একসাথে এক বর্ষায় টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শোনার ইচ্ছা ।

আমি খুব একটা অবাক হই নি। ভালোবাসা বিষয়টাই হয়ত এমন। ছোঁয়াচে ।

খুব কাছাকাছি থাকা মানুষগুলো একে অন্যের হৃদয়ের খোঁজ রাখে বলেই হয়ত মানুষ এত সহজে ভালোবেসে ফেলে।

আমি নিবিড় কে দোষ দিইনা। শুধু আফসোস । একমাত্র বন্ধু টাকেও হারিয়ে ফেললাম। একটু একটু করে। একসময় অনেক খানি।

(ঙ) 
আজ আমি নীলচে পাড়ের শাড়ি আর হাত ভর্তি রেশমি চুড়িতে তে নিজেকে সাজিয়েছি। অনেক বছর পর। কপোলের মাঝখানে ছোট্ট একটা নীল চাঁদ।
অফিস এ ঢুকেই রেজিগনেশন লেটার টা ম্যানেজার এর রুমে রেখে এলাম।
নিবিড় এখনও অফিসে পৌঁছায় নি।
ওর ডেস্কে ছোট্ট একটা চিরকুট রেখে বেড়িয়ে এলাম ।
এলোমেলো হাতে লেখা – ভালো থেকো নিবিড় ।
আমি জানি ও ভালো থাকবে …

বাইরে বেরুতেই সকালের নরম রোদ আমাকে ছুঁয়ে দিল। সাত আট বছরের ছোট্ট একটা ছেলে রোজকার মত হাঁকিয়ে গেল
– একডা ফুল নিবেন আফা ? নেন না আফা ।ভাইজানরে দিয়েন ।
প্রতিদিনের মত আমি ওর হাতে একটা নোট গুঁজে দিয়ে পা বাড়ালাম ।আজ আর ওর সাথে গল্প করা হবে না। আজকের দিন টা শুধু আমার।

একটা দিন আমি নিজের জন্য বাঁচব। শুধু আমার জন্য।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত