পাঞ্জাবি

পাঞ্জাবি

শুনেছি অসুখী মানুষের ভালো ঘুম হয় না।

আমি অসুখী কি না জানি না— তবে হঠাৎ-হঠাৎ সুবেহ সাদিকের আগে ঘুম ভেঙে যায়। দূরের কোনো মসজিদ থেকে— “আসসালাতু খইরুম মিনান নাওম” ধ্বনি ভেসে আসলেই দাদাজানের কথা মনে পড়ে।

দাদাজান আমৃত্যু মুয়াজ্জিন ছিলেন। ভারি কাঁচের চশমা পরেও চোখে ভালো দেখতেন না। অর্ধেকের বেশি দাঁত পড়ে গিয়েছিল। বাচ্চাদের মতোন আধোআধো বোলে আযান দিতেন।

ছেলেবেলায় প্রতিরাতে দাদাজানের আধো বোলে— আসসালাতু খইরুম মিনান নাওম ডাকে আমার ঘুম ভাঙত। আমি বিছানা থেকে নেমে, দ্রুত বাথরুমে ছুটতাম। প্রায় কৈশোর বয়স পর্যন্ত আমার বিছানা ভেজানো রোগ ছিল। দাদাজানের আযানের সুর অ্যালার্ম হয়ে প্রতিরাতে আমায় ডেকে তুলত। মস্তিষ্কের গোপন সেলে সেই অ্যালার্মটা এখনও বাজে। আমার ঘুম ভেঙে যায়। বাকি রাত অন্যমনস্কভাবে পায়চারি করতে-করতে সিগারেট ফুঁকি।

তখন সবেমাত্র কলেজে উঠেছি। অ্যাডভেঞ্চারের বয়স, সিগারেটের ধোঁয়ায় রিঙ বানানো শিখে গেছি। একদিন গলির আড়ালে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিলাম। বাবা হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে মুখের ধোঁয়া গেলার চেষ্টা করলাম।

বাবা ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে মিঠু! গাঁজা খাচ্ছিস নাকি?”

আমি কাঁচুমাচু করে উত্তর দিলাম, “না বাবা, গোল্ডলিফ…!”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও গিলে ফেলা ধোঁয়া নাক দিয়ে বের হয়ে গেল। আমি হেঁচকি তুলে কাশতে লাগলাম।

বাবা তখন বললেন, “দে তো, আমিও দুটান দিই।”

আমি দ্বিতীয়বার না-ভেবে সিগারেট ফেলে উল্টো দৌড় লাগালাম। গলিতে কাদাজলে ভরা ছিল, কিছুদূর যেতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। টের পেলাম বাবা তখনও ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরলে আমায় খুব পেটাবেন। অথচ বাবা কিচ্ছু করেননি, শুধু একবার গভীরভাবে বলেছিলেন, “সিগারেট ছেড়ে দে, মিঠু!”

অন্য অনেক কথার মতোই বাবার এ-কথাও আমার শোনা হয়নি।
উল্টো আমি চেইন স্মোকার হয়ে গেছি!

বাড়িময় লোকে-লোকারণ্য। বেশিরভাগ পাড়ার বয়স্করা। রান্নাঘর থেকেও হাড়িপাতিলের টুংটাং আওয়াজ আসছে। দফায়-দফায় চায়ের কাপ ঘুরছে সবার হাতে-হাতে। কেমন যেন চাপা উৎসব-উৎসব আমেজ।

আমি প্রবল অস্থিরতা বোধ করতে লাগলাম।

নিকোটিনের তৃষ্ণা নির্দিষ্ট সময় পর-পর ফুসফুসে চাপ দিয়ে জানান দেয়— আমার কিছু বিষাক্ত বাতাস চাই।

এত লোকের ভেতরে সিগারেট জ্বালানোর উপায় নেই। আমি সিগারেট নিয়ে বাড়ির পিছনের বাগানে এলাম। কানে এখনও সেই অদৃশ্য অ্যালার্ম— আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম, বেজে চলছে।

বাড়ির পেছনে একটা কাঠগোলাপ গাছ আছে। খুকির যেদিন জন্ম হয় সেদিন বাবা গাছটা লাগিয়েছিলেন। বাবা খুকিকে আদর করে গোলাপ ডাকতেন। ভরা বর্ষায় গাছে যখন ফুলে ভরে যেত, বাবা খুকিকে ডেকে বলতেন, “দ্যাখ গোলাপ, তুই কী সুন্দর করে ফুটেছিস!”— শুনে খুকি খিলখিল করে হাসত।

কাঠগোলাপ গাছটা খুকির জমজ বোনের মতো ছিল। খুকিকে রাগানোর জন্য আমি প্রায়ই গাছের ডাল ভেঙে দিতাম, বাঁকলে দায়ের আঁচড় কাটতাম। খুকি তখন হাত-পা ছুড়ে কাঁদত আর বাবা আড়ালে দাঁড়িয়ে হাসতেন।

বহুদিন পর আজ আবার গাছের বাঁকলে হাত রাখতেই— ঘরের ভেতর থেকে আম্মা ফুঁপিয়ে উঠলেন। আমি চমকে উঠে সিগারেট ফেলে দিলাম। অথচ আম্মা কিছুক্ষণ আগেও গুণগুণ করে কোরআন পড়ছিলেন— ফাবি আইয়ে আলাই রাব্বি কুমাতুকাজ্জিবান…

বয়স হয়ে গেলে মায়েরা বোধহয় এভাবেই হঠাৎ-হঠাৎ কাঁদে!

একদিন আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনেছিলাম, বাবা আম্মাকে বলছেন, “আমার ভুলগুলো ক্ষমা করে দিয়ো নিপু।”

আম্মা উত্তর দিয়েছিলেন, “আপনার করা ভুল সেই কবেই ভুলে গেছি!”

উত্তরে বাবা কী বলছেন আমার শোনা হয়নি। বাবা-মার ব্যক্তিগত দুঃখগাঁথা সন্তানদের কখনওই শোনা হয় না।

অথচ তাঁদের দুজনকে আমার বরাবরই সুখী দম্পতি মনে হতো।

আমি প্রায়ই ভাবতাম— বাবা কী ভুল করতে পারেন। বাবা কি যৌবনে আম্মাকে কোনো গভীর কষ্ট দিয়েছিলেন? নাকি তাঁর কোনো গোপন প্রেমিকা ছিল? তাঁদের মধ্যে কি সত্যিকার কোনো প্রেম ছিল না? নাকি দীর্ঘদিনের অভ্যাস ছিল?

এসব প্রশ্নের উত্তর এখন জানার আর উপায় নেই।

বাবা বেশ সুদর্শন পুরুষ ছিলেন। ফর্সা মুখমণ্ডলে পাকা গোঁফ। দেখতে অনেকটা কথাসাহিত্যিক জাফর ইকবালের মতোন। চারদিনে পর-পর তিনবার স্ট্রোক করা বাবা বিছানায় শুয়েও গোঁফের যত্ন নিতেন। আম্মা মুখের সামনে আয়না ধরলে বাবা কেঁচি দিয়ে গোঁফ সাইজ করতেন।

এসব খুকির কাছে শোনা কথা, আমার শোনার উপায় ছিল না। পরবাসী সন্তান পরিবারের ছোটখাটো স্মৃতিতে থাকার অধিকার ধীরেধীরে হারিয়ে ফেলে। আমিও ফেলেছিলাম।

চাকরি পেয়ে মফস্বল ছেড়ে শহরে এলাম। বছরের-পর-বছর বাড়ি আসা হতো না। দুই ইদে বাবাকে টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বলতাম, “বাবা নতুন পাঞ্জাবি কিনে নিয়েন।”

উত্তরে বাবা বলত, “তুই বাড়ি আয়, বাপব্যাটায় নতুন পাঞ্জাবি পরে নামাজ পড়তে যাব।”

যান্ত্রিক যাঁতাকলে আমারও আর বাড়ি ফেরা হয়নি। বাবার কথাও রাখা হয়নি। আমি জানি বাবাও নতুন পাঞ্জাবি কেনেনি। দাদাজানের পুরাতন পাঞ্জাবিটা ধুয়ে ইস্ত্রি করে পরেছেন। কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করলে বলছেন, “এই পাঞ্জাবিটা আমার সুফি বাবা পরতেন, এটায় জান্নাতের ঘ্রাণ আছে।”

বাইরের ঘরে কারা যেন হাসাহাসি করছে। বাচ্চাকাচ্চার কান্নার শব্দও পাচ্ছি। আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। ইচ্ছা করছে আম্মার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যেতে। কিন্তু ঘুমানোর উপায় নেই।

আমি ক্লান্ত পায়ে বসার ঘরে এলাম। ঘরের ভেতর অনেক অচেনা নারীমুখ। আমায় ঢুকতে দেখে একজন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। তার দিকে তাকিয়ে আমারও কান্না উচিৎ কি না বুঝতে পারছি না।

আমি কোনোরকমে সোফায় গা এলিয়ে চোখ বুঝলাম।

অনেকদিন আগের কথা, তখন সবেমাত্র কলেজ পাশ করেছি— একদিন এই ঘরে বসেই লক্ষ্মীকে প্রথম চুমু খাই। বাবা কী করে যেন ব্যাপারটা জেনে ফেললেন। একদিন ডেকে বললেন, “বেশিরভাগ মানুষ তার প্রথম প্রেমকে ধরে রাখতে পারে না। তুই ধরে রাখার চেষ্টা করিস।”

সেবারও বাবার কথা আমার শোনা হয়নি! লক্ষ্মীকে আমি ধরে রাখতে পারিনি। শুনেছি ডাক্তার স্বামী আর দুটো বাচ্চা নিয়ে সে বেশ সুখেই আছে।

আমি আলমারি থেকে দাদাজানের পাঞ্জাবিটা বের করলাম। মলিন সাদা পাঞ্জাবি— যেখানে একইসাথে দাদাজান আর বাবার গায়ের গন্ধ লেগে আছে!

বাবা জুটমিলের কর্মকর্তা ছিলেন। অফিস শেষে যখন বাড়ি ফিরতেন তখন বাবার শরীর থেকে পাটের গন্ধ আসত। ছেলেবেলা থেকে পাটের গন্ধটাকে আমার কাছে জান্নাতের ঘ্রাণ মনে হতো।

আমার বুকের ভেতরটা ধকধক করতে লাগল।

উঠানে শোরগোলের শব্দ পাচ্ছি। কে যেন আমার নাম ধরে ডাকল। অথচ আমার বাইরে যেতে একদম ইচ্ছে করছে না! সামাজিক জীবের বড় যন্ত্রণা, তারা চাইলেও অনেক কিছু করতে পারে না! আমাকে বাইরে যেতেই হবে। আমি খুব যত্ন করে দাদাজানের পাঞ্জাবিটা পরে বাইরে এলাম।

উঠানে অসংখ্য মানুষের ভিড়। শেষ রাতেও এত মানুষ কোত্থেকে এলো বুঝতে পারছি না। দুঃসংবাদ বুঝে এভাবেই বাতাসের আগে-আগে ভেসে বেড়ায়?

উঠানের এক কোণে বরফের চাঙ ভাঙা হচ্ছে। কী সুন্দর সাদা পাথরের মতোন বরফ! হাতুড়ির আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে এদিকওদিক ছুটে যাচ্ছে। কয়েক টুকরো বরফ আমার গায়ে এসে লাগল। আমার সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠল!

কোত্থেকে একদল ছেলেমেয়ে ছুটে এসে ভাঙা বরফ নিয়ে খেলতে লাগল।

দাদাজান যেবার মারা যান সেবারও এরকম বরফের চাঙ ভাঙা হয়েছিল। তখন খুকি ছোট। সেও এভাবে বরফ নিয়ে খেলছিল!

অদ্ভুত এক ঘোরে আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। আমি কোনো রকম টলতে-টলতে বাবার কফিনের কাছে গেলাম। কে যেন বলে উঠল, “লাশের মুখটা খুলে দেই বাবা?”— শুনে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল!

মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেও যে মানুষটা আমার নাম ধরে ডাকছিল, আমায় দেখার জন্য ছটফট করছিল— মৃত্যুর পর সে মানুষটা বুঝি লাশ হয়ে গেছে? সে এখন আর আমার বাবা নেই?

লোকটার দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো, “না, আমি লাশ দেখব না! যে মানুষটার হাস্যোজ্জ্বল, গম্ভীর কিংবা বিরস মুখ আমার চোখে এখনও ভাসে, সে মানুষটার নিথর দেহ আমি দেখতে চাই না! আমি দেখতে পারব না!”

কথাটা তাকে বলা হলো না, তার আগেই হুড়মুড় করে বৃষ্টি নামল। আমি বাবার পায়ের কাছে বসে ভিজতে লাগলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে কোত্থেকে যেন আযান ভেসে আসলো— আসসালাতু খইরুম মিনান নাওম! আর আমার মস্তিষ্কে হাতুড়ি পেটাতে লাগল দাদাজানের সেই অদৃশ্য অ্যালার্ম!

আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে ভীষণভাবে কান্নার বেগ চেপে রাখার চেষ্টা করলাম। প্রকাণ্ড আকাশ আমার হয়ে কাঁদছে, আমার বাবার জন্য কাঁদছে; আমার আর কান্না দরকার নেই!

জানি আকাশের কান্না শেষে একসময় রঙধনু উঠবে। পৃথিবীর তাবৎ মানুষ সেই রঙধনুতে সাতটি রঙ দেখবে। একমাত্র আমি সেই রঙধনুতে দেখব বাবার মুখ, বাবার সেই জান্নাতি পাঞ্জাবি!



❝পাঞ্জাবি❞
~ তরী

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত