স্কুল আজ ছুটি। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে তাই ব্যাট-বল নিয়ে মান্ডা বালুর মাঠে এসেছি ক্রিকেট খেলতে। বাড়ি আমাদের মুগদাপাড়ায়। ছুটির দিনগুলোতে প্রায় দুই কিলোমিটার পথ আমরা আসি রিকশায় চড়ে।
দুই ওভার সবে শেষ হয়েছে, সাইড লাইনে বসে থাকা আমার ছোট ভাইটি পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে দৌড়ে এল আমার কাছে। উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়েই মোবাইলটা কানে ধরলাম, ‘হ্যালো!’
অপর প্রান্তে মায়ের গলা, ‘ওরে ও তানিম! তাড়াতাড়ি বাসায় আয়। গ্রাম থেকে তোদের শিয়ালদা এসেছে এই মাত্র। তোর দাদা মস্ত বড় দুটো বোয়াল মাছ পাঠিয়েছেন, তোর বাবা বাজারে গেছে। মাছ বিক্রেতা তার বড় দা-বঁটি নিয়ে এল বলে! দেখবি না? কত বড় বোয়াল! একেবারে রাঘব বোয়াল।’
কিসের উইকেট কিপিং! বুকের ভেতর আনন্দ লাফাতে শুরু করেছে রেসের ঘোড়ার মতো। ছোট ভাইকে বললাম, ‘চল তাড়াতাড়ি। শিয়ালদা এসেছে বাসায়।’
রিকশায় চড়ে বাড়ির দিকে রওনা হলাম। ছোট ভাইটা খুশিতে আত্মহারা। আমার চেয়েও ও শিয়ালদার বেশি ভক্ত। ক্লাস নাইনে পড়ি আমি। শিয়ালদার নাম শুনে আমিও কি আর কম পাগল হয়েছি!
হব না! অমন মজার বন্ধু এই ঢাকা শহরেও আমার একজন নেই। বছরে দু-তিনবার ছুটিছাটায় আমরা গ্রামের বাড়িতে যাই। বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার এক ছায়াঢাকা পাখি ডাকা গ্রাম। বাড়িটাও অনেক বড়।
গ্রামে গেলেই শিয়ালদা চলে আসে আমাদের বাড়ি। একটু দূরেই থাকে সে। ক্লাস এইটে ছিল পরপর তিন বছর। তারপরেই পড়াশোনায় ক্ষান্ত। বাড়িতে গেলে সে আমাদের তিন ভাইবোনকে যে কত রকম গল্প শোনায় আর কত রকম কাণ্ড দেখায়! ভূত-পরির গল্প বলে। তাল-নারকেলগাছ বেয়ে বাঁদরের মতো তরতর করে উঠে যায় অনেকটা ওপর পর্যন্ত। গ্রামের মাঠ-বাগানে ঘুরে ঘুরে সে আমাদের ফুল-পাখি ও প্রজাপতি দেখায়। গত বোশেখে সে আমাদের দেখিয়েছিল অনেকগুলো পাখির বাসা, পাখির ছানা। একটা চষাখেত পাড়ি দেবার সময় একটি সাত ফুট লম্বা দাঁড়াশ সাপকে পালাতে দেখে দৌড়ে গিয়ে সাপটির লেজ ধরে মাথার ওপর বোঁ বোঁ করে ঘোরাতে ঘোরাতে যখন আমাদের দিকেই আসছিল, তখন তো ভয়ে আমরা তিন ভাইবোন দে দৌড়। সাপটিকে দূরে ছুড়ে দিয়ে আমাদের কাছে আসতেই প্রশ্ন করেছিলাম আমি, ‘না মেরে সাপটিকে ছেড়ে দিলে কেন?’ শিয়ালদা হেসে বলল, ‘দাঁড়াশ সাপ তো ধানের মাঠের ইঁদুর খায় রে! মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। দাঁতে বিষ নেই। ধানখেতের ইঁদুর তাড়ায় ওরা।’ তারপরে কিছুদূর এগোতেই সামনে পড়েছিল একটা পুকুর। দুপুরের রোদে শিয়ালদার শরীর ঘেমে গিয়েছিল। আচমকা ঊর্ধ্বমুখী লম্ফ দিয়ে পুকুরের জলে মেরেছিল দর্শনীয়-দুর্দান্ত ডাইভ, তারপরে প্রায় তিরিশ হাত দূরে গিয়ে জাগিয়েছিল মাথা। এক ডুবে তিরিশ হাত! শিয়ালদা হেসে বলেছিল, ‘ইচ্ছে করলে পঞ্চাশ হাতও পারি।’ তা যে শিয়ালদা পারবে, আমাদের তিন ভাইবোনের কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের বাগানে আমগাছ থেকে ঝুলে থাকা অজগর সাপের মতো মোটা গুলঞ্চ লতা ধরে যে তরতর করে টারজানের মতো আমগাছটাতে উঠে যায়, নেমে আসে, তাকে কি অবিশ্বাস করা যায়!
গেল বোশেখের এক সন্ধ্যায়, খোলা মাঠের মাঝখানের আমাদের একটা জামগাছে তুলে দিয়ে, গাছের গোড়ার ঝোপে বসে সে অবিকল শিয়ালের ডাক ছাড়তে শুরু করেছিল। আশপাশের বহু জায়গা থেকে প্রত্যুত্তরে ডাকছিল শিয়ালের দল। আধঘণ্টা পর যখন দু-তিনটি শিয়াল এসে জামতলার শিয়ালটিকে খুঁজছিল, তখন চিত্কার দিয়ে শিয়ালদা যেই না লাফ দিয়ে ঝোপ থেকে বেরোল—শিয়ালেরা ভড়কে গিয়ে দিল দৌড়। দেখে আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ডাকটা কত নিখুঁত হলে সত্যিকারের শিয়ালদের কাছে টেনে আনা যায়!
এই শিয়ালের ডাকের জন্যই তার নাম হয়ে গেছে শিয়াল। আমাদের শিয়ালদা। গ্রামের সবাই ওকে শিয়াল, শিয়াল ভাই, শিয়াল কাকা বলে ডাকে। মুরব্বিরা ডাকেন হরবোলা বলে। আসল নাম পিয়াল। শুধু শিয়ালের ডাক নয়, ছোট ছাগলছানা-বিড়ালছানা-কুকুরছানা ও মানবশিশুর কান্নাও হুবহু নকল করতে পারে সে। বড় কুকুর-বিড়ালের ডাকও জানে।
বাসার সামনে রিকশা থেকে নেমে আমি আর আমার ছোট ভাই রাতুল বলতে গেলে দৌড়ে চারতলায় উঠলাম। দরজা খোলাই ছিল। ঢুকতেই শিয়ালদা খুশিতে আমাদের জড়িয়ে ধরল বুকে। বলল, ‘ফকিরহাট থেকে বোয়াল দুটো এনেছি। মুগদাপাড়ায় মাছের আড়তে নেমেই চলে এলাম। তোমাদের পুকুরে এবার এই সাইজের বোয়াল পাওয়া গেছে সাতটা। দাদা-দাদি কি আর তোমাদের রেখে এত বড় মাছ খেতে পারেন! তাই তো মাছসহ পাঠিয়ে দিলেন আমাকেই।’
মাছ দুটো বঁটিতে ফেলে কাটা হচ্ছে। ছোট বোন টুম্পা শিয়ালদাকে নিয়ে গেল ড্রয়িংরুমে। আমরা দুভাইও গেলাম। জমে উঠল গল্পের আসর। যেন আমাদের সবুজ গ্রামটি এসে বসে গেছে এখন আমাদের ড্রয়িংরুমে।
গোলগাল চাঁদ আছে আকাশে। রাতের খাবার খেয়ে শিয়ালদাকে নিয়ে ছাদে এলাম আমরা। বসলাম মাদুর বিছিয়ে। টুম্পা বলল, ‘শিয়ালদা, ডাকো না শিয়ালের মতো।’
আমরাও সায় দিলাম। ঢাকা শহরের ছাদে বসে এ রকম চাঁদনি রাতে শিয়ালের ডাক শোনার মজাটাই হবে আলাদা। মহল্লার রাস্তার কুকুরগুলোরও মাথা খারাপ করে দেওয়া যাবে।
দুহাতের দশ আঙুল মুখের কাছে গোল করে ধরে শিয়ালের ডাক ছাড়তে শুরু করল শিয়ালদা। অনেকক্ষণ ডাকার পরে আমি বললাম, ‘ও দা! এই মহল্লায় তো অনেক বেওয়ারিশ কুকুর আছে। কেউ ডাকাডাকি করল না যে! শিয়ালের ডাক শুনে কুকুর ডাকবে না!’
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রাতুল বলল, ‘শিয়ালদা! গ্রামের বাড়িতে তো বহুদূরে শিয়ালের দল ডাকাডাকি শুরু করলেও আমাদের বাড়ির কুকুরগুলোসহ পাড়ার সব বাড়ির কুকুর চেঁচিয়ে গলা ফাটায়। এখানে তা হলো না কেন?’
শিয়ালদা রাতুল ও টুম্পার পিঠে দুই হাতে দুটি চাপড় মেরে বলল, ‘আরে বোকারা! বুঝলি না ব্যাপারটা? ঢাকা শহরের কুকুররা কি কখনো শিয়াল দেখেছে, নাকি শুনেছে শিয়ালের ডাক? এরা তো শিয়াল চেনেই না! তবে, দ্যাখ, এখন একটা খেলা আমি দেখাই তোদের।’
বলেই শিয়ালদা আবারও মুখের কাছে দু হাত গোল করে ধরে শুরু করল কুকুরের ডাক, যাকে বলে দুটি কুকুরের মারামারির সময়ের ভয়ংকর ডাক। অমনি পাড়ার কুকুরগুলোর যেন মাথা খারাপ হয়ে গেল। এই মহল্লার শখানেক কুকুরের ডাকে আশপাশের বাড়ির মানুষের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। মহল্লার বহু ভাড়াটের বাড়ি গ্রামে। তারা চেনে শিয়ালের ডাক। একটি বাড়ির ছাদ থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে বেড়াচ্ছিল যখন মহল্লাময়, তখন তারা হতবাক হয়ে শুনছিল! ঢাকা শহরের ছাদে শিয়াল ডাকছে! পরমুহূর্তে আবার কুকুরের মারামারির ডাক আর রাস্তার কুকুরদের হাঁকডাকে সরগরম মহল্লার সব মানুষ হতভম্ব! চেনাজানা লোকদের ফোন আসছে আমার মা-বাবার কাছে, আমার মোবাইল ফোনেও। ওটা তো রয়েছে আমার বিছানায়। মা তাড়াতাড়ি উঠে এলেন ছাদে। হেসে বললেন, ‘ওরে ও শিয়াল, থামা তোর ডাক! আমাদের বাড়ির সামনে মানুষ আর কুকুরদের ভিড় লেগে গেছে। কুকুরগুলো সব খেপে গেছে। যানজট লেগে গেছে বাড়ির সামনে। সবাই ভেবেছে আমরা ছাদে শিয়াল পুষেছি। ও তানিম, কী বলবি এখন?’
আমি হাসলাম। বললাম, সত্যি কথাটাই বলব। বলব ঢাকা শহরের মুগদাপাড়ায় আমাদের এই বাড়িতে শিয়াল এসেছে। ছাদে উঠে ডাকাডাকি করছে।