একটি ব্যাঙ

একটি ব্যাঙ

এটাই সত্য যে, আমাদের অফিসে আমরা এক ধরনের স্টাফই আছি। যারা একই সঙ্গে সরকারবিরোধী ও সংশয়বাদী। সরকারবিরোধী এই দলটা অফিস শুরু করি সরকারের নানা আইন যা মানতে আমাদের ঘাম ছুটে যাচ্ছে, অর্থমন্ত্রীর নানা প্যাঁচ যা সহ্য করতে শরীর পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে, এইসব নিয়ে গজগজ করতে করতে। এ দেশের কোনো কিছুই আমাদের সুবিধা মতো হয় না। জ্যৈষ্ঠের গরমে অফিসের কাজ ফেলে টিভিসেটের সামনে বসে খেলা দেখতে দেখতে ইংল্যান্ডে কেন শীত, এ গরমে যখন রোজা রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছে তখন সে দেশের মানুষ ঠান্ডায় কত আরামে আছে, এ ঈর্ষায় আমরা ঘন ঘন নাক ফোলাই, ভ্রু কোঁচকাই। অথচ কদিন আগেই যে তাপমাত্রা পনেরতে নেমে যাওয়ায় গরমের দেশগুলো আমাদের কাছে বসবাসের জন্য অধিক যুক্তিযুক্ত হয়ে উঠেছিল, সে আশ্চর্য নীচতা ভুলে যাই!

মুঈন স্যার অফিসে জয়েন করার পর থেকে এই বিরোধী দলটা বড় বেকায়দায় পড়েছে। সরকারের নানা আইন, শৃঙ্খলার নানা বিধি এমনভাবে তিনি বাস্তবায়ন করতে চাইলেন যে, মনে হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে কাজে ফাঁকিতে অভ্যস্ত আমাদের ক্রমশ বাড়তে থাকা পেটের মেদ তিনি এবার ঝরিয়েই ছাড়বেন। এমন না যে, মুঈন স্যার ঘোর সরকারপন্থি লোক। কিন্তু সাবেক অন্যান্য স্যারদের তুলনায় তার বড় শক্তি, তিনি দুনম্বরী করেন না, কথা বলেন বুদ্ধি দিয়ে, যুক্তি দিয়ে। তার কথার পরে আমাদের কারো কোনো কথা থাকে না। ফলে স্যার সামনে এলেই, যাই বলব, টিকবে না, ভেবে সবাই মুখ থেকে বেরোতে যাওয়া নিজেদের কথা নিঃশব্দে গিলে ফেলি। তিনি নিজেই নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন। এই কয়েকদিন তার কথা বলার প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছে, হাউসে পড়া একটি ব্যাঙ।

ব্যাঙটি আমাদের কারো সামনে উপরে উঠার চেষ্টা করে না। কয়েকদিন চেষ্টার পর আমরাও আর ব্যাঙ নিয়ে মাথা ঘামাই না।

‘এতজন মিলে একটা ব্যাঙ মারতে পারলেন না, আবার বলেন যুদ্ধ করতেন!’

মুঈন স্যার একটু রাগই করেন। তবু আমরা আমাদের চেষ্টার কথা স্যারকে মিনমিন করে জানিয়ে দেই যে, ব্যাঙটা অত্যন্ত চালাক। আঘাত করতে গেলেই ডুবে যাচ্ছে। আর ডুবও এমন ডুব যে, সহজে মুখ তুলছে না। ভেসে উঠলেই লম্বা ডাল লাগানো ঝাড়ু, ছোট লাঠি, এমনকি নষ্ট টিউবলাইট দিয়ে ব্যাঙটাকে আঘাত করা হয়েছে কিন্তু কিছুতেই তার গায়ে আঘাত লাগানো যাচ্ছে না। স্যারের ধারণা, কদিন আগে ফোটা তেলাপিয়ার ছোট পোনাগুলোকে, যত দিন যায়, এই ব্যাঙ তার লম্বা জিভ দিয়ে টেনে টেনে খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে।

মুঈন স্যার রোজ অফিসে এসে প্রথমেই কিছুক্ষণ হাউসের পাশে দাঁড়িয়ে পোনার গতিবিধি দেখেন। মনে হয়, এটা তার প্রিয় কাজের একটি। সকাল বেলার ফ্রেশনেসটা তিনি হাউসের তেলাপিয়ার পোনার সাথে শেয়ার করেন। তিন দফায় তেলাপিয়ার পোনা এসেছে। তিন সাইজের পোনা এখন হাউসের স্থানে স্থানে নড়েচড়ে।

হাউসে মাছ ছাড়ার সিদ্ধান্তটা ছিল স্যারের একার। মাস দুয়েক আগে মুঈন স্যার খুব শখ করে তার প্রথম এক্সপেরিমেন্ট হিশেবে হাউসে গোটা বিশেক তেলাপিয়া ছেড়েছেন। এক তলা অফিসভবনের সামনে বাগানের পাশে পাঁচ ফুট উচ্চতা ও তিরিশ ফুট ব্যাসের ইট-সিমেন্টের হাউসটিতে এর আগে পানি ধরে রাখা যেত না বিধায় বহু বছর এটি অব্যবহৃত ছিল। মুঈন স্যার এসে হাউসের পুরনো প্লাস্টার ভেঙে নতুন করে প্লাস্টার করান আর এরপর থেকে পানির চুইয়ে পড়া অনেকাংশে বন্ধ হয়। ছাদের চৌবাচ্চা থেকে একটা পাইপের লাইনও টেনে এনেছেন হাউসের কাছে। পানি কমে গেলে এ দিয়ে হাউস ভরা হয়।

এরই মধ্যে গত সপ্তাহে একদিন টানা বৃষ্টি হয়। আর ওই বৃষ্টির মধ্যেই কোথা থেকে একটি বড় সোনাব্যাঙ সবার অলক্ষ্যে এই হাউসে এসে পড়ে। তখনো তেলাপিয়া বাচ্চা দেয় নি। নিঃসঙ্গ ব্যাঙটার জন্য তখন আমাদের মায়া হয়। এটিকে তাড়াতে প্রথম প্রথম আমরা গাছের একটি ভাঙা ডাল হাউসের উপর থেকে পানিতে ঝুলিয়ে দিয়েছি যাতে ডাল বেয়ে উপরে উঠে যেতে পারে। কিন্তু ব্যাঙটি আমাদের কারো সামনে উপরে উঠার চেষ্টা করে না। কয়েকদিন চেষ্টার পর আমরাও আর ব্যাঙ নিয়ে মাথা ঘামাই না। অফিসে যেতে আসতে মাঝে মাঝে হাউসে উঁকি দেই, দেখি, ব্যাঙটা সামনের দুটো পায়ে আবদ্ধ পানির ঘনত্বে ভর দিয়ে আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। ব্যাঙটার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেই এটি আমাদের আক্রমণের উদ্দেশ্য বুঝে যাচ্ছে আর আত্মরক্ষায় সঙ্গে সঙ্গে দিচ্ছে দীর্ঘ ডুব।

মুঈন স্যারের উৎকণ্ঠা বেড়ে যায় যখন তিনি আবিষ্কার করলেন, তেলাপিয়া মাছের ছোট ছোট পোনা হাউসের দেয়াল ঘেঁষে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে। ছোট ছোট পোনা ঝাঁক বেঁধে আকাশ দেখতে উপরে উঁকি দেয়। আমরা সবাই মুগ্ধ হই চোখের সামনে ঘটা মাছের অলৌকিক প্রজনন প্রক্রিয়ায়। এরপর আরো দু’দফায় বাচ্চা ফোটে। তখন স্যারের উৎকণ্ঠায় আমাদের চেষ্টা আরও জোরাল ও আন্তরিক হয়। আমরা ব্যাঙটাকে দূর থেকে বাড়ি দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করি। যেহেতু ব্যাঙটাকে উপরে উঠে আসার সহজ ও নিরাপদ সুযোগ করে দিয়েছিলাম আর কিছুতেই উপরে উঠে আসে নি এবং এখন স্যার-কর্তৃক শখ করে ছাড়া তেলাপিয়া বাচ্চাও দিয়েছে সেহেতু বাচ্চাগুলোকে বাঁচাতে গিয়ে ব্যাঙটার আশ্রয় ভেঙে দিতে হচ্ছেই। তখন আমরা শেষ প্রচেষ্টা হিশেবে এটাকে আঘাত করে মেরে ফেলার চেষ্টা করি। হাতের নিশানা সই আছে এমন দুয়েকজন তরুণ সহকর্মী ইটের ভাঙা টুকরো দিয়ে দূর থেকে ব্যাঙটাকে শক্ত আঘাত করার চেষ্টা করে কিন্তু ওরা ব্যর্থ হয় আর ব্যাঙটা কী শক্ত প্রাণ, কিছুতেই মরে না!

জুন মাস আসে। অফিসে আমাদের কাজের চাপও বাড়ে। এই একটা মাসই আমরা কাজ করি। করি মানে করতেই হয়। যে কারণে ব্যাঙের পিছনে বেশি সময় কারো পক্ষে দেয়া আর সম্ভব হয় না। ব্যাঙটা হাউসের পানি ও তেলাপিয়ার সংসারে থেকে যায়।

‘আপনাদের দিয়ে যুদ্ধ হতো না!’

মুঈন স্যার এই কথা বলে মূলত হাউসে থাকা ব্যাঙটিকে সরাতে বা মারতে না পারা আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতাকেই বারবার মনে করিয়ে দেন। স্যার যখন ফ্রি থাকেন তখন তিনি আমাদের ডেকে পাঠান। এবং যে কোনো ছুতোয় যুদ্ধের কথা টেনে আনেন। নানা রেফারেন্স টেনে যুদ্ধকালীন সময়ের গুরুত্ব আমাদের সামনে তুলে ধরেন। স্যারের ডাক পড়লেই আমরা আমাদের কানগুলোকে সেসব কথা শুনতে ও বের করে দিতে তৈরি রাখি। এর অর্থ, এসব শুনতে আমাদের ভালো লাগে না। তার টেনে আনা প্রসঙ্গের জেরেই একদিন আমাদের তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এই মুহূর্তে যুদ্ধ লাগলে আপনারা কী করবেন?’

আমরা প্রায় সবাই নিজেদের সাহসী বোঝাতে ‘যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তাম’ বলে স্যারকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি। বলা বাহুল্য, দেশপ্রেমের টান বা সাহসী মৃত্যুর কোনো অভিলাষ থেকে এই কথা কেউ বলি নি, এটা নিশ্চিত। আমরা যুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা বলেছি, স্যারকে খুশি করার জন্য। কে না জানে, স্যারদের যে কোনো কথায় খুশি রাখতে হয়। কিছুতেই না বলতে নেই। কিন্তু মুঈন স্যার এরপর যুদ্ধের ডিটেইলে যান এবং তখন আমরা ভালো না লাগলেও আমাদের মাথা নত রাখি।

তিনি টেবিলে রাখা পেপারওয়েট হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে বলেন, ‘আপনাদের কি মনে হয় না যে আমরা এখনো প্রতিনিয়ত যুদ্ধের মাঝেই আছি?’

আমরা কেউ কেউ সে কথার অর্থ বুঝতে না পেরে তার দিকে তাকাতে চোখ বড় করি। আমাদের জিজ্ঞাসু চোখ দেখে তিনি ডিটেইল পরিষ্কার করেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ কেন হয়েছিল? হয়েছিল মূলত একটা প্রয়োজনে। প্রয়োজনটা স্বাধীনতার। আমরা সে যুদ্ধের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা তো পেয়েছি। কিন্তু এখন আমাদের দেশটাকে গোছাতে নতুন আরেকটা যুদ্ধে নামতে হবে। অলরেডি আমরা কিন্তু তা করছি।’

আমরা কেউ কথা বলি না ফলে মুঈন স্যার নিজেই বলতে থাকেন, ‘দেশটাকে গোছানো বলতে আমরা কী বুঝি, বলতে পারেন কেউ?’

আমরা তবু কথা বলি না। আমি জানি, আরো অনেক ক্ষণ কেউ কথা বলবে না। দেশের ভাবনা আমরা কেউ ভাবি না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত চিল্লাচিল্লিও ভালো লাগে না। আমরা যখন এক সাথে নাশতায় বসি বা লাঞ্চে তখন একেকজন একেক সমস্যা নিয়ে সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাই। কারো সিলেকশন গ্রেড বন্ধ হওয়ার জ্বালা, কারো বদলি, কারো ডিউটি রোস্টার তো কারো ছুটি, এসব নিয়ে নানা আক্ষেপ। এসবের ভেতরে তেল-গ্যাস-চিনি নিয়ে সরকারকে নিত্যদিনের শালার পুত, সমন্ধির পুত করা তো আছেই। আমাদের একটাই চাওয়া, কেবল কাজে ফাঁকি দেয়া। আর দ্রুত বাসায় ফিরে যাওয়া।

আমাদের ভেতরের এসব কথা মুঈন স্যার জানেন না। তিনি বলতে থাকেন, ‘দেশটাকে সুন্দর ও স্বাবলম্বী করে তোলা। আর এর জন্য যার যার কাজটাকে তার তার ঠিক মতো করতে হবে।

অফিসে জয়েন করার পর থেকেই মুঈন স্যার এইসব নিয়ে কথা বলেন। সরকার থেকে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার জন্য তাগিদ দেয়া হচ্ছে। তিনি একটু ফাঁক পেলেই সে কথা সবাইকে মনে করিয়ে দেন। তখন অফিসে অব্যাহত রাখা আমাদের ত্রুটিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। আর যতই ভেসে উঠতে থাকে ততই মুঈন স্যারকে আমাদের অতিষ্ঠ মনে হতে থাকে। তাকে খারাপ লাগতে শুরু করে। ভালো কথা সব সময় শুনতে ভালো লাগে না। আর অফিসেও এতদিন দিয়ে আসা ফাঁকিবাজির মতো অপরাধ কে ছাড়তে চায়! কিন্তু স্যার কী ভেবেছেন, তিনি এসব বলে আমাদের সবাইকে ঠিক করে ফেলবেন? না, কিছুতেই না। কেন নয় তা পরে বলছি।

মুঈন স্যার তার কথায় অফিসিয়াল প্রসঙ্গ টেনে আনেন, ‘এই যে অফিসে সিসিটিভি ক্যামেরা বসছে, কেন বলতে পারেন? বলতে তো অবশ্যই পারেন। সরকার আমাদের কাজ মনিটরিং করতে চাচ্ছে। আমরা যথাসময় অফিসে ইন-আউট করি না। সরকারের কাছে আমরা বিশ্বস্ত না। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর সরকার কিন্তু এই টেনশন থেকে মুক্ত।’

মুঈন স্যারের ইচ্ছা, আমরা যেন ইংলিশ-টাইম মেইনটেইন করে চলি। আমরা কেউ কেউ এর আগে কোম্পানির চাকরি করে এসেছি। সময়ের হিশেবে ডিউটি করে এসেছি। কিন্তু সরকারি চাকরিতে এসেই যেন কী কারণে আলস্য আর ঢিলেমির যৌথ ভাইরাসে পেয়ে বসেছে। একজনের দেখাদেখি আরেকজন অনিয়মে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি! এইটাকে রোধ করা এক মুঈন স্যারের পক্ষে কি সম্ভব?

২.
মুঈন স্যার পিআরএলে যাবেন ছ’মাস পর। মুক্তিযোদ্ধা না হলে এক বছর আগেই যেতেন। এত বয়সেও আমাদের স্যার তার বয়স বাড়তে দেন নি। মাথার চুল পাকে নি, পড়ে নি একটি দাঁতও। দেখলে বোঝার উপায় নেই, তার একটি মেয়ে স্নাতকোত্তর করেছে। আরো বোঝার উপায় নেই, সাতচল্লিশ বছর আগে এই লোক কী করে অস্ত্র ধরে যুদ্ধ করতে পারে? ঘটনা সত্য তো! হিশাব করলে তখন তার বয়স হয় মাত্র বার বছর। এটা কি যুদ্ধ করার বয়স?

আমাদের সরকারবিরোধী মন সরকার ও দেশের নানা সমালোচনায় যখন স্যারের কাছে এতটুকু প্রশ্রয় পেতে প্রতিবার ব্যর্থ হয় তখন তাকে কব্জা করতে আরো কার্যকর ও গোপন সন্দেহবাদী মনটাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করি। সেই চেষ্টার জেরে স্যারের কাছে আমাদের ক্যাশিয়ার সাহেব একদিন কথাটা তুলেই ফেলেন, ‘স্যার, কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতাম!’

মুঈন স্যার অনুমতি দেন।

ক্যাশিয়ার সাহেব বলেন, ‘এই যে মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স বার থেকে ধরা হলো, এইটা কি ঠিক হলো? বার বছরের একটা ছেলে কিভাবে প্রশিক্ষিত বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে?’

প্রশ্ন শুনে মুঈন স্যার চমকে ওঠেন। এতটাই যে, অনেকক্ষণ তিনি কোনো কথা বলতে পারেন না। হয়তো এমন প্রশ্ন এর আগে কেউ কোনদিন তাকে করে নি। আমরা বুঝতে পারি, যা চাইছিলাম, বয়সের খোটাটা যথা জায়গায় গিয়ে লেগেছে। স্যারের হাতে পত্রিকা খোলা ছিল। তখন তিনি সেটা ভাঁজ করে টেবিলে রেখে কোনো জবাব না দিয়ে ধীর পায়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।

আমরা সংশয়বাদী দলটা দেশের নানা জেলা থেকে এলেও কী করে জানি না, এই অফিসে এসে নিজেদের সমচেতনায় এক হয়ে যেতে পারলাম। আমাদের একটা অদৃশ্য ঐক্য আছে, আছে শক্তিও। যে কোনো পর্যায়ের সরকারি চাকুরের তা থাকে। যে কারণে, অফিসের বড়কর্তা যেই আসুক, যে কোনো কিছুতে কর্তাকর্তৃক আমাদের নিজেদের সুযোগ-সুবিধার এক পশম ঘাটতির শঙ্কা দেখা দিলেই, তাকে বেকায়দায় ফেলার সব কৌশল আমরা সুযোগ মতো ব্যবহার করি। অতীতে এই সমন্বিত কৌশলে বহুবার বহু স্যার আমাদের নয় বরং আমরাই স্যারদের নিয়ন্ত্রণ করেছি।

আজ মুঈন স্যারের আসল জায়গায় আমরা একটা ধারাল পেরেক মেরেছি। মিয়া, এই যে এত সততা-সততা করেন, নিজের কাছে আগে নিজেকে পরিষ্কার করেন। বুকের পাটা থাকে তো স্বীকার করেন যে, বার বছর বয়সে আসলেই আপনি যুদ্ধ করেছেন নাকি না? যুদ্ধ কী জিনিস তা আমরা টেলিভিশনের খবরে, নাটক-সিনেমায় দেখি। দুধ ছাড়ে নাই পোলাপান যুদ্ধ করে ফেলে, এইটা মুখেই বলা যায়। বাস্তবে সম্ভব না।

আমরা গোপনে কয়েকবার এ হিশাবও করেছি, শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধা সনদ থাকার কারণে এক বছর বেশি চাকরি করায় মুঈন স্যার কী পরিমাণ সুবিধা পেয়েছেন। শেষ মুহূর্তে এসে কিভাবে প্রমোশন বাগিয়ে নিলেন আর এক বছর আগে গেলে কোথায় থাকতেন তিনি!

মুঈন স্যার বাইরে বেরিয়ে যাওয়ায় আমরা একে অন্যে আস্তে করে চতুরের হাসি বিনিময় করি। যে যে অফিসে মুঈন স্যার ছিলেন সেখানকার খবর আমরা ইতোমধ্যে নিয়েছি এবং জানতে পেরেছি, তার সময়ে অধিনস্তরা কেবল বিশৃঙ্খলাজনিত কারণে কী কী অসুবিধায় পড়েছেন। নিজেরা যাতে তেমন অসুবিধায় না পড়ি সে কারণে আগে থেকেই তাকে নিয়ন্ত্রণে আনার একটা ছোট কৌশল পরোক্ষ ব্যক্তি-আক্রমণের মাধ্যমে আমরা প্রয়োগ করি। আমরা নিশ্চিত, এটা কাজে দেবে।

মুঈন স্যার তার চেয়ারে ফিরে আসেন। আমরা তার কাছ থেকে জবাবের অপেক্ষা করি। আশা করছি, এবার আর কোনো যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে তিনি মাত্র বার বছরের একটি ছেলেকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দিতে পারবেন না।

বসতে বসতে স্যার এক এক করে আমাদের সবার দিকে তাকান। আমরা তার চোখে চোখ পড়ামাত্রই একটু হাসিমুখ রাখার চেষ্টা করছি। চেষ্টা করছেন স্যারও।

‘একাত্তর বড় কঠিন সময় ছিল। সে সময়ের ক্রাইসিসটা আপনারা কখনোই বুঝবেন না। মুখের কথায় কাউকে বোঝানো সম্ভবও না। শুধু জেনে রাখুন, যার মন একবার সে সময়ে জেগেছে, সে সময়ের বারুদ যার ভেতরে একবার জ্বলেছে, তার বার বছরের দুটো হাত তখন অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।’

আমরা চুপ থাকি। কিন্তু মন শান্ত হয় না। মনে মনে টিটকারি করি, ‘এই পেয়েছিলেন এক কথা। কিছু বললেই কঠিন সময় কঠিন সময়। যেহেতু সে সময় ছিলাম না সেহেতু যত রঙচঙ আছে, সে সময়ের বর্ণনা করতে কথায় কথায় আপনারা মাখবেনই।

স্যার এখন নিশ্চয় আরো গভীরে প্রবেশ করবেন। আমরা অপেক্ষা করি। ঠিক তখন হঠাৎ বাইরে থেকে একটি আনন্দ-ধ্বনি কানে আসে, ‘ধরি লাইছি, ধরি লাইছি!’

আনন্দ-ধ্বনিটি আমাদের ক্যাশিয়ার সাহেবের শিশুপুত্র রিয়াদের। তার বয়স আট। রিয়াদ অফিসের পাশেই একটা স্কুলে টু-তে পড়ে। স্কুল ছুটির পর প্রায়ই অফিসে বাবাকে দেখতে আসে। অফিসে আসে বলেই সে হাউসের তেলাপিয়ার পোনার কথা জানে। এও জানে পোনাগুলোর শত্রু একটা ইয়া বড় সোনাব্যাঙ পানির উপর ভেসে থাকে। ব্যাঙের দিকে কিছু ছুঁড়ে মারলে এটি ডুবে যায়।

রিয়াদের আনন্দ-ধ্বনিতে আমরা কেউ বাইরে যাই না। ও অফিসে এলে এমনিতেই ব্যাপক হৈচৈ করে। ফলে তার দিকে না যেয়ে আমরা আমাদের সম্পূর্ণ আগ্রহ স্যারের দিকে নিবদ্ধ করি।

স্যার তখন আরো কিছু বলতে যাবেন, এমন সময় আট বছরের রিয়াদ দরজার কাছে এসে চিৎকার করে ওঠে, ‘আব্বা, ব্যাঙ ধরি লাইছি। এই দেহ!’

আমরা তখন বাইরে আসি। দেখি, রিয়াদের আঙুলে পেচানো সুতোর মাথায় একটা ব্যাঙ তার পা ছড়িয়ে ঝুলে রয়েছে। রিয়াদের চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস। সে উচ্ছ্বাসে পৃথিবী জয় করার তৃপ্তি ভেসে ওঠে।

উঠে এলেন মুঈন স্যারও। ঘটনা বুঝতে পেরে তিনি কেবল একটু হাসলেন। বললেন, ‘আপনাদের দিয়ে হবে না। রিয়াদদের দিয়ে হবে।’

আমরা অপমানিত বোধ করি। কিন্তু গায়ে মাখি না। মুঈন স্যার তখন পুনরায় তার চেয়ারে ফিরে এলেন। এক গ্লাস পানি পান করে যেন একটু নির্ভারও হলেন। বললেন, ‘আপনারা এতগুলো প্রাপ্তবয়স্ক লোক এতদিন চেষ্টা করে যা পারেন নি, আট বছরের একটা শিশু তা করে দেখিয়েছে। পোনাদের হাউসকে সে শত্রুমুক্ত করেছে। এইটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন আপনারা?’

রিয়াদের এই দুরূহ কৃতিত্ব আমাদের একটা বড় ধাক্কা দিল। বরাবরের মতো স্যারের সামনে কথা বলার মুখ আমাদের আর থাকে না। আমরা যার যার সেকশনে বেরিয়ে পড়ি। দেখি, সুতোয় বাঁধা খেলনা বাস টেনে নেয়ার মতো ছোট্ট রিয়াদ ব্যাঙটাকে রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আর বারান্দায় বড়শিগেঁথা ব্যাঙের শরীর বেয়ে পড়া এক ফোঁটা টাটকা রক্ত দুপুরের রোদে ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত