বাসাটা থেকে বেরিয়ে এল নাইমা।ঠিক একবছর আগে এসেছিল সে বাড়িটাতে। প্রতিবারই ভাবে,আর আসবেনা।এরপরও ওকে আসতে হয়।সেই নীল খামের অমোঘ আকর্ষণ ও এড়াতে পারেনা,কখনই না।যেন নীল খামে ও বন্দি হয়ে পড়েছে। নাইমা জানে এই বয়সে তার এখানে আসাটা একেবারেই উচিত নয়,বিশেষ করে যখন ওর স্বামী আছে,দু সন্তান আছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটছে নাইমা।একটু তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে ওকে।বাসায় গিয়ে কিছু ভাল মন্দ খাবার দাবারের আয়োজন করতে হবে।আজ ওর জন্মদিন।ছেলে মেয়েরা ওর প্রতি জন্মদিনেই বায়না করে তাদের জন্য বুটের হালুয়া তৈরি করতে হবে।তার হাতের হালুয়া নাকি অমৃতের কাছাকাছি।তবে ওর স্বামী জাহিদ সাহেবের ধারণা পৃথিবীতে অমৃত বলে কিছু নেই, যেটা আছে সেটা হল নাইমার হাতের বুটের হালুয়া! মধ্য বয়স এসেও একজন মানুষ কী করে এতটা প্রাণবন্ত থাকতে পারে এই প্রশ্নটা জাহিদ সাহেবকে দেখলেই নাইমার মনে হয়। রোমান্টিকতার সংজ্ঞা জাহিদের জন্য নতুন করে লেখা উচিৎ।মাঝে মধ্যে নাইমা তাকে বলে,‘এই বয়সে এত ঢং পাও কোত্থেকে?’ জাহিদ সাহেবের উত্তর,‘সালমান খান যদি আমার চাইতে দশ বছরের বড় হয়ে ‘লাভ মি,লাভ মি’ বলে কোমর দুলিয়ে নাচতে পারে তাহলে আমি আমার বউকে ‘লাভ ইউ,লাভ ইউ’ বলতে পারব না?’ এমন একজন মানুষকে স্বামী হিসেবে পেয়ে ওর কখনই উচিৎ নয় এই বাড়িটাতে আসা।তবুও নীল খামের বন্দিশালা থেকে ও মুক্ত হতে পারছেনা। ঘটনার শুরু আজ থেকে প্রায় সতেরো বছর আগে।তখন নাইমার বয়স কত হবে?ওই রকমই,ষোল কিংবা সতেরো।মেয়েদের জন্য খুবই অদ্ভুত এক সময়।এই বয়সে যাই দেখে সেটাই ভাল লেগে যায়।একই সঙ্গে দুঃখের অনুভূতিটাও হয় প্রবল।অল্পতেই ঠোঁট কামড়ে ধরে কাঁদতে
ইচ্ছে করে। এই বয়সটাতে সব মেয়েই চায় কেউ একজন তার কথা গভীর মনোযোগে শুনুক।কেউ একজন রাতে চাঁদ দেখার সময় পাশে থাকুক।এমন কারো অস্তিত্ব তাকে ঘিরে রাখুক যে শুধু তাকে নিয়েই স্বপ্ন বুনবে। ঠিক এমন একটা সময়ই নাইমার হাতে একটা বই চলে আসে।পত্র মিতালীর বই।বইটাতে শত শত ছেলে মেয়ের নাম ঠিকানা দেয়া।চাইলেই যে কারো সাথে চিঠির মাধ্যমে বন্ধুত্ব করা যায়।বইটা কিভাবে নাইমার হাতে এসেছিল,এত বছর পর আর সেটা মনে নেই ওর। বইটা মাঝে মধ্যেই উলটে পালটে দেখত নাইমা।ভাবত কাউকে একটা চিঠি লেখে।কিন্তু কেন যেন হয়ে উঠত না। বইটা উলটে পালটে দেখার সময় একটা নাম বরাবরই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করত।শুন্য। নাইমা বুঝত নামটা হয়ত মানুষটার আসল নাম না।এমনকি নামটা ছেলেদের বিভাগে না হলে ও তো জানতেই পারত না এই অদ্ভুত নামের পেছনের মানুষটা ছেলে না মেয়ে। একদিন পড়ার টেবিলে বসে খাতায় আঁকিবুকি কাটছিল নাইমা,অন্তত তখন পর্যন্ত ওর তেমনই ধারণা ছিল।কিন্তু লেখা শেষ হলে অবাক হয়ে দেখল,ও আসলে একটা চিঠি লিখে ফেলেছে,এমন কারো উদ্দেশ্যে যাকে সেচেনে না।নামটা পর্যন্ত জানেনা,শুধু জানে সে শুন্য। শুন্যকে লেখা চিঠিটা অনেকদিন যাবত পড়ে ছিল তার বইয়ের ভাঁজে।হয়ত থাকত আরো কিছুদিন কিংবা আজীবনই। একদিন বাবার চিঠির খামগুলো থেকে একটা খাম কি ভেবে যেন নিয়ে আসে নাইমা।একটা ঘোরের মধ্যেই ঠিকানা লিখে স্কুলে যাবার পথে পোস্ট বক্সের ছোট্ট ফোঁকরটা দিয়ে চিঠিটাকে ছেড়ে দেয় শুন্যের উদ্দেশ্যে। ঘোরটা চিঠি পোস্ট করার পরও দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত তাকে ঘিরে রেখেছিল।কিন্তু শুন্যর নীরবতা খুব দ্রুতই বাস্তবে ফিরিয়ে আনে নাইমাকে।বুঝতে পারে ঝোঁকের বশে এমন একটা কাজ করে ফেলা একদমই উচিৎ হয়নি।শুন্যও নিশ্চয়ই ওর ছেলেমানুষিকে পাত্তা দেবার তুলনায় অনেক পরিনত। এরপর একদিন হঠাত করেই সবকিছু উলট পালট করে দিয়ে শুন্যর জবাব এল ফারহানার ঠিকানায়। নাইমার পরিবার খুবই রক্ষণশীল।অচেনা একটা ছেলের সাথে বাড়ির মেয়ের চিঠি চালাচালি তাদের পরিবারে গুরুতর অপরাধ।এজন্যই নিজের ঠিকানার বদলে বান্ধবী ফারহানার ঠিকানা দিয়েছিল নাইমা।ফারহানার আবার এসব কোনও সমস্যা ছিলনা।ও নিজেও অনেকের সাথে পত্র মিতালী করত। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে ফারহানা নাইমার হাতে একটা নীল খাম ধরিয়ে দেয়। সেই শুরু। শুন্যের সাথে নাইমার একটা অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে ওঠে।এটাকে না ভালবাস বলা যায়,না নিছক বন্ধুত্ব।এই সম্পর্কের সংজ্ঞাটা নাইমার ঠিক জানা ছিলনা।শুন্য হয়ত জানত কিন্তু কখনো জিজ্ঞেস করার সাহস পায়নি নাইমা।সব সম্পর্কের সংজ্ঞা হয়ত জানতে নেই। শুন্যের সাথে এই সংজ্ঞাহীন সম্পর্কের মেয়াদ যখন একবছর।যখন একটু একটু করে সম্পর্কের সংজ্ঞাটা বুঝতে শুরু করছে নাইমা ঠিক তখনই তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়ে বিয়ে ঠিক হয়ে যায় ওর। নাইমা জানত শুন্য তার কাছে বিশাল একটা শুন্যতা হয়েই থাকবে সারাটা জীবন।তার জীবনে শুন্যদের ঠাই নেই। বিয়ের ঠিক একসপ্তাহ আগে শেষ চিঠি লিখেছিল নাইমা শুন্যর কাছে।জানিয়ে দিয়েছিল ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে।সম্পর্কটার ইতি এখানেই টেনে ফেলা উচিৎ। বিয়ের আগেই জবাব এসে যায় শুন্যর।তেমন কিছুই লেখা ছিলনা সেই চিঠিটাতে।শুধু একটা অনুরোধ। শুন্য প্রতি বছর নাইমার জন্মদিনে একটা করে চিঠি পাঠাবে। নাইমা কোনও জবাব দেয়নি।ওর বিয়ে হয়ে যায় জাহিদের সাথে। বিয়ের চারমাস পরই ছিল নাইমার জন্মদিন।সেদিন বিকেলে ঠিক কি মনে করে নাইমা ফারহানাদের বাসায় চলে আসে ও নিজেও সেটা পরিষ্কার জানেনা। হ্যা,পেয়েছিল নাইমা সেই নীল খাম। সেই থেকে প্রতি বছরই ফারহানাদের বাসার ঠিকানায় একটা করে নীল খাম এসে হাজির হয়। নাইমা এখন পর্যন্ত জানেনা শুন্যর আসল নামটা কী।ও সেই আগের ঠিকানাতেই থাকে কিনা সেটাও জানা নেই।কারণ সেদিনের পর আর কোনও চিঠি ওই ঠিকানায় পোস্ট করা হয়নি নাইমার।তবে না থাকার সম্ভবনাই বেশি।শুন্যের সে ঠিকানাটা ছিল একটা মেসের।এত বছর পরও শুন্য সেই মেসে থাকবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। শুন্য কখনই ওর চিঠিতে প্রেরকের ঠিকানা লেখেনা,যার কারণে নাইমা চাইলেও শুন্যের সাথে যোগাযোগের উপায় বন্ধ হয়ে গেছে। নাইমার ধারণা কাজটা শুন্য ইচ্ছে করেই করেছে।ভালই হয়েছে,নয়ত কে বলতে পারে সংজ্ঞাহীন সেই সম্পর্কের সংজ্ঞা নতুন করে জানতে মরিয়া হয়ে উঠত না নাইমা! ফারহানাদের বাসা থেকে নাইমাদের বাসায় যেতে আধঘন্টার মত লাগে।একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়ল নাইমা। ফারহানা বিয়ের পর কানাডায় থাকে।ওই বাড়িতে এখন ফারহানার ভাই থাকে।খুবই ভাল মানুষ।ছোটবেলা থেকেই নাইমাকে চেনেন।প্রতি বছর যত্ন করে চিঠিটা রেখে দেন তিনি।কখনো জন্মদিনে বা কখনো জন্মদিনের পরে কোনো একদিন এসে নাইমা চিঠিটা নিয়ে যায়। নাইমার পরিবারের কেউ ফারহানাদের বাসার ঠিকানা জানেনা।নাইমাও কখনো বলেনি।প্রতি বছর অন্য কোনও কাজে বেরিয়ে এখানে চলে আসে ও। জাহিদ এব্যাপারে কখনো সন্দেহ করেনি ওকে।সন্দেহ করার মত কিছু নেইও।অবশ্য থাকলেও জাহিদ কাউকে সন্দেহ করতে পারবেনা।আসলে সন্দেহ করার জন্য যে বিশ্রী জিনিসটা থাকতে হয় একজন মানুষের মধ্যে সেটাই নেই জাহিদের।চুড়ান্ত পর্যায়ের সরল একজন মানুষ। এমন একজন মানুষের সান্নিধ্য পেয়েও প্রতিবছর নীল খামের খোঁজে ছুটে আসাটা যে কত কুৎসিত একটা ব্যাপার সেটা খুব ভাল করেই জানে নাইমা।কিন্তু নীল খাম ওর সব কিছু কেমন এলোমেলো করে দেয়। ট্যাক্সিতে বসেই চিঠিটা পড়ে ফেলতে পারে নাইমা।ও জানে,বিশেষ কিছুই লেখা নেই,থাকেনা কখনো।হয়ত কেমন আছ,ভাল থেক,তোমার হাজবেন্ড কেমন আছে ইত্যাদি।কখনো কখনো তো নীল রঙের খামটা থেকে বেরোয় একেবারেই সাদা একটা কাগজ। নাইমা প্রতিবারের মত এবারো রাতের বেলা জাহিদ ঘুমালে বারান্দায় এসে খামটা খুলবে। পড়বে,একবার,দুবার এবং বারবার। এরপর ছিড়ে টুকরো টুকরোকরে উড়িয়ে দেবে বাতাসে।রাতের আকাশে ভেসে ভেসে সাদা এবং নীল রঙের টুকরোগুলো মিলেমিশে হারিয়ে যাবে।সেদিকে তাকিয়ে নাইমা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করবে আর কখনোই সে ওই বাড়িটাতে নীল খামের খোঁজে যাবেনা। কে জানে হয়ত কোনো একদিন সে তার প্রতিজ্ঞা পুরণও করে ফেলবে। উপসংহারঃ ঠিক একবছর পর সন্ধ্যা নেমেছে।চারদিকে ছেঁড়া ছেঁড়া আঁধার।রাস্তা দিয়ে একটা মানুষ হেঁটে চলছে।পরণে তার সাদা পাঞ্জাবী।বাতাসে উড়ছে হালকা হালকা।কিছুটা দুরেই একটা লাল পোস্ট বক্স দেখা যাচ্ছে। মানুষটা হঠাত রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল।পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ভরে একটা নীল খাম বের করল। আকাশে ডুবন্ত সূর্য।সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মানুষটা।হাতের নীল খামটা টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে দিল বাতাসে। পাক খেতে খেতে একসময় নীলসাদা টুকরোগুলো নেমে এ্ল।ঠাই নিল কালো পীচ ঢালা রাস্তায়।নীল খামের বন্দিশালা থেকে কেউ একজন আজ মুক্ত। কাগজের টুকরোগুলো মাড়িয়ে ফিরতি পথ ধরলেন জাহিদ সাহেব। নাইমা যদি সেদিনের পর কখনো খোঁজ নিত তাহলে জানতে পারত,আর কোনদিনই তার নামে কোনো নীল খাম আসেনি।