রাত্রি দ্বিপ্রহর। পুরো হাসপাতালজুড়ে সুনসান নীরবতা। পাশের বেডে মা আধশোয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছে। অনু, কেমন আছ তুমি? অবশ্য তোমার তো ভালো থাকারই কথা। আমি ভালো নেই। একটা একটা করে সেল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমার।
ভেঙে পড়ছে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা। ডায়েরি লেখার মতো শক্তি বা ধৈর্য কোনোটাই আমার নেই। শরীরটা যেন বিষের কারখানা হয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়ত রক্ত দিতে হচ্ছে। দুদিন পর সেটা দূষিত হয়ে যাচ্ছে। রক্তে আমার কর্কট রোগ বাসা বেঁধেছে। আর যে বেশি দিন নেই সেটা মায়ের মুখ দেখলেই বুঝতে পারি।
যে মা ছিলেন ইস্পাত কঠিন, তিনি এখন একটু পরপরই নিঃশব্দে কাঁদেন। আমার কাছে লুকোতে চান কিন্তু প্রতিবারই হেরে যান। আমাকে কেউ কিছু বলে না কিন্তু সব বুঝতে পারি।
২০ মে, ২০১০।
বাবা আজ বাড়িতে গেছেন। শেষ সম্বল বাড়ি বিক্রি করতে। যদি কিছু টাকা আসে। আরও কিছু টাকা, আরও কয়েকটা দিন বাঁচার আশা! হায়রে জীবন! আমার দিন-রাত্রি এখন হাসপাতালের চার দেয়ালে বন্দী। আমার স্বপ্নগুলো স্যাভলন আর ফিনাইলের গন্ধ ভরা রুমের মধ্যে ডানা ঝাঁপটে মরছে!
৩১ মে, ২০১০।
জানো, আজ সন্ধেবেলা ঝড় উঠেছিল। জানালার পাশের জারুল গাছটার বাতাসের সঙ্গে সেকি তাণ্ডব! ঝড় থামার পর দেখলাম জারুল গাছটা ঝড়ের সঙ্গে হেরে মাটিতে পড়ে আছে। আচ্ছা, আমিও কি জারুল গাছটার মতো মৃত্যুর কাছে হেরে যাব? তাহলে আমার স্বপ্নগুলোর কী হবে? পড়াশোনা শেষ করে গ্রামে যাব, ছোট্ট একটা ইশকুল, শ খানেক ছাত্রছাত্রী, মাঝে মধ্যে তুমি আসবে অতিথি হিসেবে ক্লাস নিতে? মানুষের সব স্বপ্ন পূরণের জন্য এক জীবন যথেষ্ট নয়, তাই না?
অনেক দিন পর বৃষ্টি। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। মায়ের কাছে শুনলাম আজ জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ দিন, কাল পয়লা আষাঢ়। হুট করেই তাই তোমার কথা মনে পড়ে গেল। আষাঢ়শ্য প্রথম দিনের কত কথা, কত স্মৃতি! মনে আছে তোমার!
টিএসসি, কদম ফুল, নীল শাড়ি, নীল টিপ, হুট করেই তোমার হুড খোলা রিকশায় বৃষ্টিতে ভেজার শখ। রিকশাওয়ালা এক ঘণ্টা ৬০ টাকা চাইল, তুমি বলেছিলে, ‘৬০ না ১০০ টাকা দেবে।’ রিকশাওয়ালা হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। মনে পড়ে তোমার? আচ্ছা অনু, ‘মানুষের স্মৃতিগুলো এত বেয়াড়া কেন বলে পারো? আমি মরে যাচ্ছি অথচ স্মৃতিগুলো আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।’
তুমি থিয়েটার করতে। মনে আছে, তোমার ‘রক্তকরবী’র প্রথম মঞ্চায়ন তোমার সব বন্ধুদের আমি টিকিট কেটে দেখিয়েছিলাম। পরে তোমার কী বকা! এতগুলো লোকের টিকিট ইত্যাদি ইত্যাদি। আচ্ছা, তুমি তো অনেক অভিনয় করেছ। আমার সঙ্গে একটু অভিনয়ই না হয় করতে। ভালোবাসার অভিনয়। অন্তত জীবনের শেষ কটা দিন আমি ভাবতাম তুমি আমার সঙ্গেই আছ। হাসপাতালে এত আপনজন।
এই আপনজনের ভিড়ে আমি আমার ‘আপনজন’কে খুঁজি। জানি সব বৃথা চেষ্টা!
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথাই কি তাহলে সত্য! ‘আমাদের প্রিয়জনের চোখে-মুখে যে ভালোবাসা দেখি তা অনেকটাই লোক দেখানো এবং আমাদের চোখের ভ্রম।’ যা-ই হোক। এই ভেবে ভালো লাগছে যে এই লেখাগুলো তুমি কখনো পাবে না।
আমার কথাগুলো গোপনই থাক। কোনো কালে হয়তো মা শেলফ মুছতে গিয়ে পাবে, আর কেঁদে দুকূল ভাসাবে। মাইকেল মধুসূদন তোমার প্রিয় কবি ছিল। মাইকেলের একটি কবিতার দুটি লাইন খুব মনে পড়ছে, ‘আর কি হবে দেখা? যত দিন যাবে…!
‘ওই হাচাইন্না, ঝিম মাইরা আছস ক্যান? বেইল যে মাথার উপর উঠছে হেই খেয়াল আছে! কহন কইছি বই আর খাতা গুলান আলাদা করতে “…পুরাতন কাগজ বিক্রেতা বাবার ডাকে একগাদা পুরাতন বই-খাতার মধ্যে উবু হয়ে পড়তে থাকা হাচানের পড়া থামে।
‘বাজান, এই মোডা বইডা আমি রাইখ্যা দেই? কি সোন্দর কিসসা লেহা”-হাচানের আবদার।
‘ইরে চান্দু, নজরুল হবা? রবীন্দ্রনাথ হবা?’ বলেই হাচানের হাত থেকে ছোঁ মেরে ডায়েরিটা নিয়ে নেয় তার বাবা। তার চোখ চকচক করে ওঠে। ‘ডায়েরিখানের ওজন হইবো কমসে কম ৭০০ গ্রাম। কিসসা পড়লে প্যাড ভরবো! যা কামে লাইগ্যা পড়।’
বাবার কথায় মুখ গোমড়া করে কাজে মন দেয় হাচান।