দু আঙুলে কপাল টিপে ধরে আছেন রাহেনা। রাগে দপদপ করছে তাঁর মাথার শিরা। চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রু ও আগুন। আজ তিনি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন। সম্ভবত তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো সিদ্ধান্ত।
–
সফল ব্যবসায়ী কায়সার এবং বার বছরের কিশোরী মেয়ে আনিকাকে নিয়ে রাহেনার সুখের সংসার। কায়সার সাহেব এবং রাহেনার ভালোবাসার কাহিনি তাঁদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে খুব বিখ্যাত ছিল। আজও সফল জুটি হিসেবে বন্ধুবান্ধব তাঁদের উদাহরণ দিয়ে থাকেন। সাত বছরের প্রেম, আবার ১৪ বছরের সংসার। আজকাল এত দীর্ঘস্থায়ী জুটি কয়টাই বা দেখা যায়। সাংসারিক জীবনেও এ পরিবারটি সফল। স্বামী ব্যবসায়ী, স্ত্রী ব্যাংকার, কন্যা মেধাবী ও গুণী, ঢাকার স্বনামধন্য স্কুলে পড়ছে, গান ও আবৃত্তি করে চমৎকার। মাঝে মাঝে দু একটা পুরস্কারও জোটে। সুখি পরিবার বুঝি একেই বলে।
–
তবে মেঘহীন নির্মল আকাশেও কি মাঝে মাঝে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা যায় না? সেরকম এ পরিবারটির দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সহসা একটা সমস্যা এসে উপস্থিত হয়েছে। কায়সার এবং রাহেনা দম্পতির উচ্ছ্বল কিশোরী মেয়েটি হঠাৎ যেন কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। ঠিকমতো খায় না, ঘুমায় না, গল্পের বই পড়ে না, হুটহাট কিন্নর কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে ওঠে না। সবচেয়ে বড়ো কথা, ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত মেয়েটি গত কয়েকটি ক্লাস টেস্টে শূন্য পেয়েছে।
–
রাহেনা স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের কাছে খোঁজ খবর নিয়েছেন, টিচারদের কাছ থেকে শুনেছেন এক অদ্ভুত ঘটনা। আনিকার মতো মেধাবী এবং পরিশ্রমী ছাত্রী নাকি গত একমাস ধরে ক্লাসের কোনো পড়াই মনোযোগ দিয়ে শোনে না। পরীক্ষার সময়ও খাতায় না লিখে গালে হাত দিয়ে কী যেন ভাবে। টিচাররা অনেক জিজ্ঞেস করেছেন তাকে যে তার কী সমস্যা, কিন্তু সে নাকি কিছুই বলে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রাহেনা আনিকার বন্ধুবান্ধবদের সাথে কথা বলেও একই ঘটনাই শুনতে পান। আনিকা নাকি এখন আর আগের মতো গল্প করে না, খেলে না, হো হো করে হেসে ওঠে না। বন্ধুরা জোর করে মাঠে নিয়ে গেলেও চুপচাপ বসে থাকে। রাহেনা নিজেও আনিকার সাথে এ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছেন বহুবার। কিন্তু সে মাথা নিচু করে বসে থেকেছে শুধু। কিছুই বলেনি।
–
এদিকে কায়সার সাহেবও ব্যবসার কাজে খুব ব্যস্ত কয়েকদিন ধরে। তাঁর সাথে কথা বলারই সুযোগ পান না রাহেনা। তবু একদিন কায়সার সাহেবের বাসায় একটু তাড়াতাড়ি ফেরার সুবাদে তাঁর সাথে বিষয়টা শেয়ার করেন রাহেনা। কিন্তু তিনি হেসেই উড়িয়ে দেন। বলেন, “আরে দূর, এ বয়সে ছেলেমেয়েদের মুড সবসময় এক থাকে নাকি। কিছুদিন পরে ঠিক হয়ে যাবে দেখো।” অবশ্য সাথে সাথেই আনিকাকে ডাকেন তিনি। এ বয়সে পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার গুরুত্ব বুঝিয়েই “খুব কর্তব্য করা হলো” ধরনের আত্মতৃপ্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।
–
নিরুপায় হয়ে এবার রাহেনা বেগম কথা বলেন বাশারের সাথে। বাশার কায়সারের মামাতো ভাই। চমৎকার হাসিখুশি ও মিশুক ছেলে। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে অতি ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত। এতদিন গ্রামেই থাকতো, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুবাদে ভাইয়ের বাসায় এসেই উঠেছে। ভাই ভাবীকে খুবই সম্মান দিয়ে কথা বলে। প্রায়ই বাসার জন্য এবং বিশেষত ভাতিজি আনিকার জন্য এটা সেটা নিয়ে আসে। রাহেনা বাধা দেন, টিউশনি করে কটা টাকাই বা পায় সে। কিন্তু ছেলে কথা শুনলে তো! যাহোক, রাহেনা আনিকার হঠাৎ পরিবর্তনের কথাটা বাশারকে জানালেন। বাশার বললো, “ভাবী, তোমরা দুজনেই তো ব্যস্ত থাকো। ওকে তো তেমন সময় দাও না। ওকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাও, ঘুরে বেড়াও, সব ঠিক হয়ে যাবে।” রাহেনা বললেন, “কিন্তু আমার সময় কই। তোমার ভাইয়া তো সংসারের কিছুই দেখে না। আমি চাকরি করে, ঘরের কাজ করে, আনিকার পড়ালেখার দিকটা দেখে ক্লান্ত হয়ে যাই। বের হবো কখন বলো!” বাশার দয়ালুভাবে বললো, “ভাবী, তুমি চিন্তা করো না। এবার থেকে আমিই ওকে নিয়ে বের হবো।”
–
পরদিন বিকেলবেলা আনিকার রুমের দরজায় গিয়ে ধাক্কা দেন রাহেনা। আনিকা দরজা খোলে। তার চেহারা দেখেই চমকে যান রাহেনা। আনিকার চোখমুখ ফোলা, চোখ লাল, গালে শুকনো জলের দাগ। বোঝাই যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছে মেয়েটি। রাহেনার বুক গভীর কষ্টে মুচড়ে ওঠে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকেন কিছুক্ষণ। এরপর বলেন, “মা, তোর বাশার চাচার সাথে ঘুরে আয়, তোর ভালো লাগবে।”
–
আনিকা সাথে সাথে ছিটকে সরে যায় মায়ের বুক থেকে। তীব্র আতঙ্কে চিৎকার করে বলে, “না মা, প্লিজ আমাকে চাচার সাথে পাঠিও না, চাচা আমাকে কষ্ট দেয়, আমার অনেক ব্যথা লাগে মা।” রাহেনা বেগম স্তম্ভিত হয়ে যান। আনিকা কাঁদতে কাঁদতেই মাকে দেখায় উরুসন্ধিতে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ, বুকে কামড়ের চিহ্ন, পিঠে জানোয়ারের নখের আঁচড়। রাহেনার মনে হয় তিনি এখনই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন। বাশার! বাশার এই কাজ করেছে। “হায় খোদা”! বলে আর্তনাদ করে ওঠেন তিনি। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকেন তিনি। আনিকা কাঁদতে কাঁদতে বলে যায় কিভাবে স্কুল থেকে ফেরার পর বাশার তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। সে ভয়ে কাউকে বলতে পারেনি। কারণ বাশার চাচা তাকে বলেছিলেন সে যদি এসব কথা কাউকে বলে তবে কেউ বিশ্বাস করবে না। উল্টো তার বাবা মা তারই দোষ দেবে। বুকের মধ্যে বহুদিন ধরে পুষে থাকা অমানুষিক কষ্টের কথা এতদিন পরে মাকে বলতে পেরে একটু যেন হালকা হয় আনিকা। বাশারের দরজা ধাক্কা দেওয়ার শব্দে হঠাৎ সচকিত হয়ে ওঠে উভয়েই। বাশারের গলা শোনা যায়, “ভাবী, আনিকার রেডি হতে আর কতোক্ষণ লাগবে। দেরি হয়ে গেল তো!” নিজের মধ্যে বয়ে যাওয়া ঝড়কে বহু কষ্টে শান্ত করে রাহেনা বলেন, “ও আজ যাবে না। তুমি চলে যাও”।
–
রাতে কায়সার বাসায় ফিরলে রাহেনা কায়সারকে সব খুলে বলেন। কায়সার সাথে সাথে বাশারকে ডাক দিলেন। জিজ্ঞষ করলেন সব ঘটনা সত্যি কিনা। বাশার খুব অবাক হওয়ার ভান করে ভাইয়ের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, “ভাইয়া, সব মিথ্যা কথা। আসলে তোমার মেয়ে প্রেম করে। আমি সব জেনে ফেলাতে সে এখন আমার নামে এসব মিথ্যে বলছে। আনিকা কাঁদতে কাঁদতে বলে, “বাবা, বিশ্বাস করো, বাশার চাচা মিথ্যে বলছে। বাশার চাচা আমাকে অনেক ব্যথা দেয় বাবা!” কায়সার রাগে চিৎকার করে বলে ওঠেন, “ব্যস্, অনেক হয়েছে। তোমাদের মা মেয়ের জন্য কি আমি এখন আমার সোনার টুকরা ভাইকে অবিশ্বাস করবো? তোমার মেয়ে কোথায় কী করে এসেছে দেখো। এখন ধরা পড়ার ভয়ে মিথ্যা বলছে।” হাত উঠিয়ে মেয়েকে মারতে যান কায়সার। রাহেনা ঢাল হয়ে সামনে এসে দাঁড়ান। স্থির কণ্ঠে স্বামীর চোখে চোখ রেখে বলেন, “আমার মেয়ে মিথ্যে বলছে না। মিথ্যে বলছে তোমার ভাই।”
–
সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলেছেন রাহেনা। চৌদ্দ বছরের সংসারের দিকে একবারের জন্যও পিছু ফিরে না তাকিয়ে মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। মেয়ের ওপর হওয়া অত্যাচারের প্রতিশোধ তিনি একাই নিতে পারবেন। দুনিয়ার কাউকে তাঁর আর প্রয়োজন নেই। বাশারকে চৌদ্দ শিকের আড়ালে পাঠিয়ে তবেই তিনি ক্ষান্ত হবেন।
–
মেয়ের হাত ধরে থানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন রাহেনা। স্থির, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। চোখে তাঁর প্রতিশোধের আগুন।
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প