কোনো এক বেলফুল ফোঁটা দিনে সে বাড়িটিতে বসবাস শুরু করে। গ্রীষ্মের ভোরের আলোয় বাড়িটিকে অনেক সুন্দর দেখায়। এমন একটা বাড়িতে বাস করছে এমন দৃশ্য সে স্বপ্নে দেখেছে অনেকবার। এবার সেই স্বপ্নের বাড়িতে বসবাস।
–
অনেক খুঁজে খুঁজে এই বাড়িটি পেয়েছে রাফেজা। মন মতো বাড়ি খোঁজার জন্য কী না করেছে সে! পেপার, ইন্টারনেট ঘেটে ঘেটে ক্লান্ত হয়েছে। অবশেষে তার বন্ধু ঝুমুর দেয় এই বাড়ির সন্ধান। বাড়িটি দীর্ঘদিন খালি পড়ে আছে। রাফেজার পছন্দ হবে কিনা এ নিয়ে ঝুমুরের মনে দ্বিধা ছিল। দ্বিধা করে নি রাফেজা। যে মিলে যাচ্ছে, স্বপ্নের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। কেমন পৌরাণিক ঘ্রাণ এই বাড়িটির চৌহদ্দিতে! তিনটে কামরা, উঠোন, উঠোনে রক্তজবার ঝাড়, লম্বা বারান্দা। পেছনের দিকটায় রান্নাঘর, খাবার ঘর। উপরে টালি দিয়ে ছাওয়া ছাদ। বাংলো টাইপ এমন বাড়িতে বসবাসের কথা সে কেবল স্বপ্নেই ভেবেছে। সে খুবই আনন্দিত হয়। এরকম খোলামেলা, আলো-হাওয়ায় পূর্ণ একটি বাড়িতে তার সন্তান বড় হবে। সন্তানের আগমন প্রত্যাশায় তার মুখে মাতৃত্বের দ্যুতি ঝলমল করে।
–
মানুষের মতো শরীর থাকলেই তুমি মানুষ নও, মানুষ হয়ে উঠতে হয়। এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
মনের আনন্দে বাড়িতে বসবাস শুরু করে সে। একেকটি ঘরে একেক রকম পর্দা টানায় যেন প্রতিটি ঘরকে আলাদা করে চেনা যায়। যেন প্রতিটি ঘর আলাদা বার্তা বহন করে। এটা শোবার ঘর। এখানে হালকা গোলাপি সার্টিনের পর্দা। দেয়ালের রঙও গোলাপি। একপাশে আকাশ নীল। লিভিং রুমে হালকা কমলা রঙ। পর্দা দেশি ডোরা সুতির। আর তার পড়ার ঘর শাদা-কালো। একটা ছোট ডিভান রেখেছে। লেখার টেবিল, চেয়ার, বইয়ের র্যাক দিয়ে ঘরটি ভরে গেছে। জানালার বাইরে রেখেছে একটি বেল ফুলের গাছ। গ্রীষ্মকাল বলে প্রচুর ফুল ফুটেছে গাছটিতে। বারান্দায় একটি কালো তুলসী গাছ লাগিয়েছে। কাজের লোক আছে একজন। সে বাড়িঘর পরিষ্কার করে। তরকারি কোটাবাছা করে দেয়। রান্নাটা এখনো সে নিজেই করে। সারাদিন থেকে কাজের মেয়েটি সন্ধ্যায় চলে যায়। সে সময় তার স্বামী আসে। এসেই টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখতে বসে যায়। রাফেজা তাকে চা-নাস্তা দিয়ে পড়ার ঘরে বসে। গান শুনে বই পড়ে। লিখতে বসে। লেখালেখিটা সে অনেকটা সবার অগোচরে করে। এমনিতে জনসম্মুখে সে লিখতে পারে না, তার ওপর লিখতে দেখলে তার স্বামী এমনভাবে তাকায় যেন নিষিদ্ধ কিছু করছে। তাই স্বামীর চোখের আড়ালে বসে লিখেতে বসে সে।
–
নতুন বাড়িতে আসার পর সাত দিন সাত রাত পর এই প্রথম নিজের লেখার টেবিলে বসে। আলোর অঙ্কুরোদগম হচ্ছে, উদ্বাহু শিখা হাত বাড়ায় পৃথিবীর দিকে—লাইনটি লিখেই অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে চলে যায়। সেই সময় মিষ্টি একটা সৌরভ তার চারপাশে ঘুরতে থাকে, যেন বৃত্তাকারে তাকে পরিভ্রমণ করছে। ঘ্রাণটি যে বেলি ফুলের নয় এটা নিশ্চিত। তবে নাম না জানা কোনো ফুলের হবে হয়তো। পেটের ওপর আলগোছে হাতটা রাখে সে। ‘সোনা আমার, বাবু আমার, আমি তোমার মা, তুমি শুনতে পাচ্ছ আমার কথা! অনেক বড় হবে তুমি! মানুষের মতো মানুষ হবে। জানো তো মানুষ হওয়া অত সহজ নয়। তোমার মানুষের মতো শরীর থাকলেই তুমি মানুষ নও, মানুষ হয়ে উঠতে হয়। এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। চেষ্টা করতে হয়। মানবিক হয়ে উঠতে হয়। একটা জীবনই হয়তো চলে যায় মানুষ হতে হতে। তবুও তোমাকে মানুষ হতে হবে। আমাকে বলো তুমি, স্বার্থপরতা নয়, মানবের জন্য কিছু করতেই তুমি পৃথিবীতে আসবে।’ বাবুটা কি একটু নড়ে উঠল! সেকি তার মায়ের কথা বুঝতে পেরেছে! হয়তো পেরেছে। পারুক না পারুক, রাফেজা প্রতিদিনই তার সন্তানের সঙ্গে কথা বলবে। ঘ্রাণটি এখনও আছে। কে যেন তার পেছনে এসে দাঁড়ায়! অথচ পেছনে ফিরে কাউকে দেখতে পায় না। মনের ভুল হতে পারে। রাফেজা বইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরে উঁকি দেয়। কাজের মেয়েটি তো হাড়ি বাসন মাজছে। তাহলে ওর কেন মনে হলো কেউ এসে দাঁড়িয়েছে! কী জানি! শরীর ভারি হচ্ছে, হরমোন পরিবর্তন হচ্ছে। এজন্য হয়তো এরকম ভাবনা আসছে! সে তার স্বামীকে ফোন করে। ‘একটু তাড়াতাড়ি আসবে আজ, ভালো লাগছে না।’ যদিও সে জানে আজও যথারীতি তার স্বামী দেরি করে আসবে। ইদানীং বোধহয় তার রাগও একটু বেড়েছে, অভিমানও।
–
নিশ্চয়ই তোমার দেরি হবে, তাই না?
হ্যাঁ।
তা তো হবেই, এখন তো আর স্ত্রীর কাছে আসা যায় না, তা রতনের বোনটা কেমন আছে?
এখানে রতনের বোনের কথা আসছে কেন?
এই জন্য যে, গেল সপ্তাহে তাকে নিয়ে গেলে বোর্ডে সার্টিফিকেট তোলার জন্য।
তাতে কী হয়েছে?
কেন ও কি আর কারো সাথে যেতে পারত না!
তোমার কী হয়েছে বলো তো? এমন করে ঝগড়া করছ কেন? তোমার লেখালেখি কি চাঙ্গে উঠেছে?
দ্যাখো, আমার লেখালেখি নিয়ে কিছু বলবে না।
কেন বলব না, শুধু শুধু সময় নষ্ট? তুমি হুমায়ূন আহমেদের মতো লিখতে পারবে?
ফোন রেখে দেয় রাফেজা। এই লোকের সঙ্গে সে কী কথা বলবে?
–
এরকম একটা স্মার্ট ছেলে অথচ বই পড়ে না, তার সঙ্গে জীবন চলবে কী করে? সে কি করবে এখন? অথচ এই লোকের বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে। না, এটা তার বাচ্চা। তার বাচ্চা কিছুতেই এরকম মাথামোটা হবে না। সে বেছে বেছে বই পড়তে থাকে। বিকেলে হাঁটতে বের হয়। নার্সারি থেকে গাছ কিনে আনে। নতুন করে বাড়ি সাজায়। এবার সে একটু শান্ত হয়।
অদ্ভুত এক রাত আজ! গা ছমছমে! নিজেকে নিশি পাওয়া মানুষের মতো মনে হচ্ছে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সে রাত্রির বয়ে যাওয়ার শব্দ শোনে। রাতজাগা কুকুরগুলো গলির মুখে জটলা করছে, দূরে একটা হুলো বেড়াল চিৎকার করছে। হুলো বেড়াল তার মোটেও পছন্দ নয়। দেখলেই কেমন যেন ভয় লাগে। এত দূর থেকেও ওই চিৎকার তার ভেতর ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেয়। কোথাও কোনো যান্ত্রিক শব্দ নেই, মানুষের চলাচল থেমে গেছে অনেকক্ষণ। একটা ঘুণপোকা ঘরের ভেতর কাঠ খেয়ে যাচ্ছে অবিরল। কাঠ খাওয়ার শব্দ, টিকটিকির শব্দ আর দেয়াল ঘড়িটার টিকটিক শব্দের সিম্ফনি চলছে। পাশের বাড়ির গোয়ালঘর থেকে গর্ভবতী গাভীটার গভীর শ্বাসটানার শব্দ আসছে। বেচারি! কেবলমাত্র নারী প্রজাতি হওয়ার জন্য তুমি ভোগ করছ এই কষ্টটুকু। অথচ শাবক জন্ম দিয়ে কেমন আনন্দিত হয়ে উঠো তুমি! জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে তাকে আদর দাও। তোমার বাৎসল্য, তোমার স্নেহের কোনো তুলনা নেই, মা। পুরুষ প্রজাতি কোনোদিন তোমার এই আনন্দ বেদনার সঙ্গী হতে পারবে না!
–
সে তার স্বামীর কথা ভুলে যেতে থাকে। স্বামী নামক কোনো মানুষের অস্তিত্ব ভুলে যেতে থাকে।
চাঁদের লাগোয়া ঘরে আড়াআড়ি পড়ে আছে আধমরা জল
উপাখ্যান গুনে গুনে রাত ভোর হয়ে গেছে
ভেসে গেছে সোনার পিনিস; ফুল্লরা মেয়ে
প্রত্নজীবীরা কবেই ফিরে গেছে আড়াল খুঁজে নিয়ে…
হায় কবিতা! বার বার কেন ফিরে আসো তুমি! তোমাকে তো কবেই ফেলে এসেছি বাবার বাড়ির অন্ধকার ঝোঁপের নিচে; বড় বাড়ির বউয়ের চারমাস বয়সী অপরিণত ভ্রূণটার মতো। বাবার সংসারে যখন ছিলাম তখন খুব করে কবিতাচর্চা করত সে। অঙ্ক খাতা, রাফ খাতা থেকে অবশেষে ডায়েরির পাতা অবধি ভরে গেল অজস্র কবিতায়। সেগুলো দেখে প্রেমপত্র ভেবে বাবা এমন মেরেছিলেন যে তিন দিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে নি। অভিমানে সমস্ত কবিতাশিশুকে পৃথিবীর আলো বাতাস থেকে দূরে বহু দূরে মাটির গহ্বরে লুকিয়ে ফেলল। সমাহিত হয়ে গেল কবিতাচর্চা। খুব শৈশবে এক সন্ধ্যায় সে দেখেছিল বড় বাড়ির বউটা লেবু ঝোঁপের নিচে শাদা একটা কাপড়ের কুণ্ডলী পুঁতে ফেললেন, বয়স্ক নারীদের বাতাসে ভেসে আসা কথামালা জোড়া দিয়ে দিয়ে বুঝল চারমাস বয়সী ভ্রূণটাকে তিনি মাটিচাপা দিয়েছেন। সেই থেকে আর কখনো লেবুগাছের কাছ দিয়ে হাঁটতেন না তিনি। ওই গাছের লেবু্ও কাউকে ছিঁড়তে দিতেন না। কেউ যদি লেবু পাতাও ছিড়ে ফেলত তবুও উহ! করে উঠতেন তিনি যেন ব্যথা পাচ্ছেন। পরের বছর অজস্র লেবু ফুলে ছেয়ে গেল গোটা গাছ। যেমন তার জবা গাছটি অজস্র ফুলে ছেয়ে যায়। সেও আর আসবে না এ গাছের কাছে। যায় নিও। জবা গাছের নিচে এখন দূর্বা ঘাস; তার মনের ওপরও। আজ এতদিন পড়ে কেন ফিরে আসছে সেইসব কথা? প্রবল বর্ষণে মৃত্তিকা সরে গেছে নাকি!
–
ধারাল ছুরি ঢুকে গেছে হৃৎপিণ্ডের কেন্দ্র অবধি। বিস্ময়ে দেখি ছুরির অপর প্রান্তে আমারই প্রেমিকের হাত!
রাফেজার স্বামী অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ইদানীং তার ঘুম আসতে চায় না। ডাক্তার অবশ্য এরকম আভাস দিয়ে দিয়েছিলেন আগেই। নিজেকে সম্মোহিত করার চেষ্টা করে। একটু চোখের পাতা লেগে আসে কী আসে না সেই সময় শব্দটা শুনতে পায় সে। একটা মিহি কান্নার শব্দ। কে কাঁদছে এত রাতে! কান্নার ধ্বনিটি যেন নিস্তব্ধতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে।
অ্যাই শুনছ! স্বামীকে ধাক্কা দেয় মৃদু।
কী হলো!
কে যেন কাঁদছে শোন!
কই কোনো কান্নার শব্দ তো শুনতে পাচ্ছি না। তোমার মনের ভুল। সারাদিন উল্টা-পাল্টা ভাবো! লেখক বউ নিয়ে তো ভালোই জ্বালা হলো আমার!
রাফেজার গলার কাছটায় কান্না জমে যায়। আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে। পারে না।
–
সকাল এসেছে নিয়ম মেনে। ঘড়ি ধরে। তার কোনো কাজ নেই। ভারি শরীরটা টানতে একটুতেই হাঁপিয়ে ওঠে। রাফেজা বসে থাকে নির্বিকার। পৃথিবীর পুরোনো কোনো রোঁয়া-ওঠা মানুষের মতো। তার মাথার ওপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি কিংবা বোমারু বিমান উড়ে যাচ্ছে। চুলের মাঝে অযুত নিযুত নক্ষত্র ঝরে পড়ছে; কামিনী ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়ছে। শাদা শাদা নক্ষত্রের অতলে ডুবে যাচ্ছে সে। মুখে কী যেন একটা কটুস্বাদের মতো লাগছে। কে যেন জোর করে মুখে ঠেসে দিয়েছে বিষ। সে এক ঢোঁকে গিলে ফেলে। হায়! জীবন তার গলায় আটকে যায়। অথবা সে জীবনের গলায়। কত নির্লজ্জ আমি! কেন বেঁচে থাকি! আমি কি এতই ভীতু যে এত জীবনকে পায়ে ঠেলে হেঁটে যেতে পারি না । না, সে পারে না। সে মা। তার সন্তানের জন্য তাকে বেঁচে থাকতেই হবে। কিন্তু রাতকে যে তার খুব ভয় হয়। প্রতি সন্ধ্যায় গুমরে গুমরে কান্না উথলে উঠতে থাকে তার ভেতর।
পৃথিবীর সমস্ত শব্দ থেমে গেলে আর আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না
আমাদের সম্মিলিত সাঁকো ভেঙে যায়
এ নশ্বর দেহ এ প্রবল রক্ত প্রবাহ
একদিন থেমে যাবে
আমিও হয়ে যাব পোকার আহার
তবু, মৃত উনুনের পাশে বসে থাকি
…বাতাসে ভাঙা মুখ জোড়া দিতে দিতে ক্লান্ত অবসন্ন এখন
আমাদের হৃৎপিণ্ড ফুটো করে কবেই তো ঝরে গেছে গোলাপ পাপড়ি
কেবল দ্বিখণ্ডিত চিবুকের ভাঁজে কাঁটার দহন
–
ধারাল ছুরি ঢুকে গেছে হৃৎপিণ্ডের কেন্দ্র অবধি। বিস্ময়ে দেখি ছুরির অপর প্রান্তে আমারই প্রেমিকের হাত! একবার ডানে একবার বামে ঢুকে যাচ্ছে ছুরির ফলা
উহ! পর্যন্ত করে না।
এ-দৃশ্যে ঘুম ভেঙে যায়। তৃতীয় কামরা হতে নারী কণ্ঠের গুমরে গুমরে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। উৎকর্ণ হয়। উৎস খুঁজতে ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা বন্ধ করে। হঠাৎ-ই সুনসান নিস্তব্ধতা নেমে আসে। পাহারাদারের অবিরাম বাঁশির আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ শুনতে পায় না সে। দরজা খুলে খাবারের ঘরের খোলা অংশটুকুতে দাঁড়ায়। কার যেন অস্পষ্ট ছায়া সরে যায়।
তৃতীয় কামরায় উঁকি দেয়।
অবিকল তারই মতো এক নারী কাদছে… কে এই নারী!
কে তুমি!
আমি তুমি কিংবা তুমিই আমি!
কী বলছ তুমি! আমার ঘরে কী করছ।
এটা আমার ঘর। এখানে আমি ছিলাম। তুমি আসার আগে। বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে আমি মরে যাই। তুমিও মরে যাবে। তুমিও তোমার বাচ্চাকে পৃথিবীর আলোয় আনতে পারবে না।
তোমার কথা ফিরিয়ে নাও। আমি অবশ্যই আমার বাচ্চাকে পৃথিবীতে আনতে পারব।
–
পারবে না, আমিও এমন ভাবতাম। আমার স্বামী আমাকে সময় দিত না, আমার শাশুড়ি আমাকে ঠিক মতো বিশ্রাম নিতে দিত না। সারাদিন কাজ করতে করতে আমি আমার গর্ভের সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না। একদিন আমার খুব জ্বর এল। গর্ভের ভেতর তার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল। ধাই এসে বলল শহরে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু যেতে পারলাম না। জ্বরে সে রাতেই আমার মৃত্যু হলো। আমি আমার সন্তান জন্ম দিতে পারি নি। তুমিও পারবে না। কিছুতেই না। কিছুতেই তোমার সন্তান পৃথিবীতে আসতে পারবে না।
অমন করে বলো না। আমি আমার সন্তানকে পৃথিবীতে আনব।
মেয়েটি হাসে উন্মাদিনীর মতো।
রাফেজা চিৎকার করে, তুমি যাও!
সে কী করবে এখন! তার চোখের সামনে সব ভেঙে যেতে থাকে। বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ধুলোর মধ্যে মিশে যেতে থাকে। সে একটা পাতার মধ্যে ঢুকে নির্লিপ্ত পড়ে থাকতে চায়। উদ্গত কান্না চেপে রেখে বসে পড়ে বিছানার প্রান্ত ঘেঁষে। এ কি স্বপ্ন নাকি বাস্তবতা ঠিক বুঝতে পারে না। অদূরে একটা অর্ধগলিত লাশ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে এক নারী। লাশের গন্ধে ভারি হয়ে উঠছে বাতাস। লাশটি দেখতে চায় সে। লাশটির মুখ দেখতে চায়। একি, এ কার লাশ! নারীটি অবিকল তারই মতো চেহারার একটি লাশ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর যে নারীটি লাশটি বয়ে নিয়ে যাছে সে আর কেউ নয় সেই নিজেই।
–
ভয়ে আঁতকে উঠে। এ কেমন দৃশ্য! তার স্বামীকে এসব কথা বলা হয় না। ডাক্তারকে ফোন করে। পাওয়া যায় না। ধীরে ধীরে প্রসবের দিন এগিয়ে আসে। সে অস্থির হয়ে ওঠে। দিনের বেলা বেশি করে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। যেন অনাবশ্যক কোনো চিন্তা তাকে বিব্রত করতে না পারে। সে ভাবতে চায় না এ বাড়িতে আর কোনো নারীর উপস্থিতি আছে যে নারী তার সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মরে গেছে। সে ভাবতে চায় না, মেয়েটির সাথে তার শ্বশুর-স্বামী কেমন ব্যবহার করেছে। কিন্তু রাত এলেই সে আর সে থাকে না। যেন মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার জন্যই অপেক্ষা করে। না ঘুমিয়ে, না ঘুমিয়ে তার চোখের নিচে কালি জমে গেছে, অথচ তা দেখারও কেউ নেই। আয়নায় নিজের চেহারা আর নিজের বলে চিনতে পারে না। রাত নামলেই মেয়েটি তৃতীয় কামরা থেকে বের হয়ে আসে। তাকে শাসায়। প্রতিদিনই ভাবে কাজের মেয়েটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করবে সে আসার আগে কে ছিল এ বাড়িতে? জিজ্ঞেস করা হয় না।
ধাত্রী গলদঘর্ম হয়ে যায়। সে কী করবে বুঝতে পারে না। বাচ্চাটি গর্ভের ভেতর উল্টে গেছে।
হঠাৎ-ই তার ভেতর পরিচ্ছন্নতার বাতিক দেখা দেয়। ঘরের ময়লা, ঝুল মেঝে পরিষ্কার না করে সে ঘুমাতে পারে না। এত এত ধুলো জমে যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই। সে যেন জগতের সমস্ত ময়লা পরিষ্কার করার দায়িত্ব নিয়েছে। ময়লা পরিষ্কার করে সে দেয়াল রং করে। তারপর দেয়ালে দামি দামি পেইন্টিং দিয়ে ঘর সাজায়। ঘরের সমস্ত পুরোনো ফার্নিচার স্টোরে ঢুকিয়ে দেয়। মিস্ত্রি ডেকে সুন্দর করে বারান্দায় টব রাখার জায়গাটিকে মেরামত করে। এবার তার মনে হয় সে ঠিকভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারবে। কিন্তু তা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। প্রসবের দিন যত এগিয়ে আসতে থাকে ততই তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে তার মনে হয় পদ্মার চরের ধূলির আস্তরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে সে।
–
অবশেষে সেই দিনটি আসে। সে চমৎকৃত হয়। না, কোনো প্রসবকালীন জটিলতা তার মধ্যে নেই। সে স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চা জন্ম দিতে পারবে। কিন্তু শেষকালে আসলেই সব গড়বড় হয়ে যায়। তার স্বামীকে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসতে বলার পরও বন্ধুদের সঙ্গ থেকে ফিরতে তার দেরি হয়ে যায়। ততক্ষণে তাকে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার সময় পার হয়ে গেছে। অবশেষে বাড়ির কাছের এক ধাত্রীকে ডেকে আনা হয়। এবার তার ভয় লাগতে থাকে। প্রসব কামরার বাইরে অপেক্ষমাণ স্বামীকেই তার সবচেয়ে আপনজন মনে হতে থাকে। রাফেজা তার স্বামীর মুখখানি মনের ভেতর গেঁথে নেয়। সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল। এর মধ্যেই প্রসবকক্ষের ভেতর ওই নারীটির উপস্থিতি তার সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। নারীটি অদ্ভুত ক্রূর চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। যেন বলতে চাইছে কি বলেছিলাম না, তোমারও ক্লিনিক পর্যন্ত যাওয়া হবে না।
তুমি চলে যাও, প্লিজ আমার বাচ্চাকে পৃথিবীতে আনতে দাও। মেয়েটি তার সামনে থেকে নড়ে না।
দেখেছ, সব কেমন হয়ে গেল! বাচ্চা জন্ম দিতে তুমি পারবে না।
পারব, আমি অবশ্যই পারব। তুমি যাও, আমার বাচ্চাকে আমি যেমন করেই হোক পৃথিবীর আলো দেখাব।
ধাত্রী গলদঘর্ম হয়ে যায়। সে কী করবে বুঝতে পারে না। বাচ্চাটি গর্ভের ভেতর উল্টে গেছে। সে অপারগ হয়ে রাফেজার স্বামীকে বলে গাড়ির ব্যবস্থা করতে। তার আর বেশিক্ষণ যুদ্ধ করার মতো শক্তি শরীরে নেই। যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
–
রাফেজা নিজেকে আশ্বস্ত করে। যুগ যুগ ধরে নারীরা বাচ্চা জন্ম দিয়ে আসছে। এটা একটা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ব্যাপার। সব নারী-প্রজাতি বনে জঙ্গলে বাচ্চার জন্ম দেয়, সেও পারবে। সে তো এক গর্ভিনী প্রাণী ছাড়া কিছু নয়। সে পারবেই!
সে প্রাণপণে নিজেকে জড়ো করে।
রাফেজা মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে থাকে। আমি মরতে চাই না, আমি বেঁচে থাকতে চাই, আমি বাচ্চার জন্ম দিতে চাই।
রাফেজা হঠাৎই ঘুমিয়ে যায়। ধাত্রী জানে ব্যথা একটু কমলে মায়েরা অনেকে ঘুমিয়ে পড়ে। সমস্ত কক্ষে নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
সেই সময় ঘরের কোণ থেখে অজস্র পিঁপড়ে সার বেঁধে রাফেজার দিকে আসতে থাকে..
ধাত্রী রাফেজাকে ডাকে।
–
রাফেজা! উঠো। পিঁপড়েরা আসার আগেই বাচ্চার জন্ম দাও।