বাঘবন্দি

বাঘবন্দি

হেলপারের কপালে ভাঁজ। হাতের ভাঁজে নোট। চিৎকার করে যাত্রী তোলে। বডিতে জোরে বাড়ি দেয়। ধোঁয়া ছেড়ে পঙ্খিরাজের মতো এগোয় দুই নম্বর বাস।

ডান পাশে বসা যাত্রীর বাড়ি তার গ্রামে। জিজ্ঞেস করল, আর কত দিন হেলপারি গরিবি?

মৃদু হেসে হেলপার বলে, মানুষ হেঁটে হেঁটে দশ-বারো মাইল দূরে বিয়ে খেতে যেত।

কিয়ুর ভিতুর কী? পান্তা ভাতত ঘি! তুই ত ব্রিটিশ আমলত আছচ।

শরীরে হাওয়ার দোলা। যেন হাওয়াকেই বলে, মানুষ খেতে পারত রাক্ষসের মতো। একেকজন কেজি, দেড় কেজি চালের ভাত খেত।

যাত্রী বলে, লবণ ছিঁডেয় কেঁচা মরিচ দিই গপগপ খাইতু।

হেলপার বলে, আমার দাদা করত কী, জ্বর উঠলে পোড়া মরিচ, পেঁয়াজ দিয়ে গরম ভাত খেয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকত। ওরে বাবারে বলে জ্বর কোথায় চলে যেত!

এখন আঁরা ওষুধ খাই খাই শরীল জ্বালাই ফেলাইর।

যাত্রীর ফেলে যাওয়া পেপার নেয় বাঘ। পড়ে : সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটে পড়েছে বিশ্ব।

ছোটবেলায় ভাত দেওয়া হতো। খেতে না পারলে দাদি লজ্জা দিত। কি করতাম জানেন? খেয়ে বাইরে যেতাম, গলায় আঙুল ঢুকিয়ে বমি করে এসে আবার খেতে বসতাম।

গাড়ি লালখান বাজার পার হয়েছে। দুই পাশে পাহাড়। যাত্রীরা কংক্রিটের বাঘ দেখে। গাড়ি এখন টাইগারপাসে। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ানো আরেকটা বাঘ হঠাৎ এগিয়ে আসে। মুখ মুচড়ায়, নাক মুচড়ায়। যাত্রীরা সব হৈ চৈ করে নামে।

হেলপার ড্রাইভারের জন্য সিগারেট আনতে গিয়েছিল। সে খেয়াল করে নি। সিগারেট জ্বালিয়ে এক টান দিয়ে ড্রাইভারকে দেয়। অদূরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে, চৌমুহনী, আগ্রাবাদ, ইপিজেড, পতেঙ্গা।

বাসে ফুটফুটে একটা শিশু আছে। মা বললেন, তাড়াতাড়ি নামো। মেয়েটি নামে না। মা কাঁপতে কাঁপতে নেমে গেলেন।

বাঘ দেখে তার খুব কৌতূহল হলো। বাঘটা গাড়িতে উঠার পর সে কাছে আসে। ডোরা কাটা লোমে হাত বুলায়।

বাঘটা কিছু বলে না। মেয়েটির হাসি হাসি মুখ দেখে।

যাত্রীর ফেলে যাওয়া পেপার নেয় বাঘ। পড়ে : সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটে পড়েছে বিশ্ব। ইয়েমেন, দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া ও নাইজেরিয়ার দুই কোটি মানুষ চরম দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। ক্ষুধা, পুষ্টির অভাব, রোগ-শোকে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে তারা। ক্ষুধার কারণে চলতি বছর ১৪ লাখ শিশু মারা যেতে পারে। যুদ্ধ, সহিংসতা, রাজনৈতিক অস্থিশীলতা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, দারিদ্র্য ও দক্ষ নেতৃত্বের অভাবে এই করুণ পরিণতি।

পেপার পড়তে পড়তে বাঘের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মেয়েটি অবাক। বাঘ কেন কান্না করছে বুঝতে পারে না। কোনো অক্ষরও দেখে না। দেখে কেবল ভেজা পৃষ্ঠা।

দৃশ্য-অদৃশ্য অনেক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। বাঘের চোখের জলে যেন তারই ইশারা।

পৃথিবীতে এভাবে হাজার হাজার বছর হাজার হাজার প্রাণ ক্ষুধায় নিভু নিভু ছিল। কে তার বেদনা বুঝেছে? সভ্যতার মাঝে আলো আসলে খুবই কম। একটি-দুটি ঝলক মেয়েটির চোখে দেখা গেলেও পরমুহূর্তে বাঘের অশ্রুতে তা ঝাপসা হয়ে যায়। মেয়েটি অথবা বাঘ, কোথাও রইল না আলো।

অদৃশ্য কেউ যেন বলল, জগতের এই অনাচার, এই-ই ভালো!

দৃশ্য-অদৃশ্য অনেক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। বাঘের চোখের জলে যেন তারই ইশারা। মেয়েটি কি তা বুঝতে পারল? বিকেলের আলোয় হয়তো বোঝার মতো উপাদান আছে।

সে বাঘের অশ্রু মুছে দেয়।

বাঘ ভেবেছিল ঘুরতে ঘুরতে পতেঙ্গা যাবে। সমুদ্রের হাওয়া খাবে। তারপর এক ফাঁকে ঢুকে যাবে কোনো জঙ্গলে। তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। মাথা নিচু করে নেমে যায়।

কোথায় যাচ্ছ? মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।

বাঘ জবাব দেয় না। ধীরে ধীরে হেঁটে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ায়।

এতক্ষণ ভয়ে লুকিয়ে থাকা যাত্রীরা হঠাৎ হিংস্র হয়ে যায়। তারা বাঘের গায়ে কংক্রিট মেখে দেয়। চোখ-মুখ বিকৃত, পা পাথরে গাঁথা, অবাক বাঘটি আকাশের দিকে তাকায়।

আকাশ জুড়ে টলটলে মেঘ।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত