রক্ত, রক্ত ঝরছে। বুকের ভিতর থেকে অঝর ধারায় রক্ত ঝরছে।নীল রক্ত, নীল রক্ত, নীল রক্ত। বিবেক ধ্বংসের পথে মানুষের কষ্ট, সংস্কৃতি ধ্বংসের পথে দেশের কষ্ট, ইসলাম ধ্বংসের পথে ইসলামী মানুষের কষ্ট।নীল কষ্ট, নীল কষ্ট, নীল কষ্ট। নীল রক্তের অতল সাগরে আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে।
.
নীরব নিস্তব্ধ কুয়াশা ভরা রাত। সোডিয়াম লাইটের আলোতে যতদূর দু’চোখ যায় ততদূর কুয়াশা ঘেরা শহরটাকে অস্পষ্ট দেখা যায়। তাওহীদ নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার বুকের ভিতরটা নীল বেদনায় জ্বলে পুড়ে মরছে।চোখের কোণে নোনা জল খেলা করছে।
•
আল্লাহ মৃত্যু চাই আমি। কেন ধ্বংস লীলা সময়ে আমাকে দুনিয়ায় পাঠালে? না পারছি তোমার দেওয়া পথে ঠিকমত চলতে, না পারছি তোমার গুণগান ঠিকমত গাইতে। একটা মুসলিম দেশে জন্মগ্রহন করে কেন আমি আমার স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারি না? আল্লাহ তুমি আমাকে মৃত্যু দাও, তা না হলে একটা পথ বলে দাও। তাওহীদ অবচেতন মনে বিড়বিড় করে আরও কথা বলে যেতে থাকে।
.
তাওহীদ আজ সন্ধায় বাংলাদেশের খেলা দেখছিল। খেলার বিরতি সময়ে খেলা প্রসঙ্গ নিয়ে এক উপস্থাপিকা আসে। উপস্থাপিকার ড্রেসআপটা দেখে তার লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। সে টিভিটা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হতে যাবে, এমন সময় তার মা রুমে ডুকে।তার মা টিভিতে চোখ বুলিয়ে রাগে তাকে বলে, ‘বাবা তাওহীদ, টিভিতে এসব কি দেখছ? দিন দিন তোমার লজ্জা সরম এতই কমেছে যে ঘরে বসে এসব খারাপ অনুষ্ঠান দেখতে আরম্ভ করেছ। ঘরে যে মা-বোন আছে সেটাও ভুলে গেছ।তার মা-র রাগ উঠলে তাকে তুমি করে বলে। কিন্তু তাওহীদ কিছু বলতে পারেনি; উনি কথাগুলো বলে ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ভুল বোঝে চলে যান।
.
তাওহীদ মনে মনে বলছে, ‘মা এটা খারাপ অনুষ্ঠান ছিল না। এটা খেলার একটা অনুষ্ঠান ছিল।খেলার বিরতিতে, খেলা প্রসঙ্গে তারা কথা বলতে আসে।’ তাওহীদ একটু থামে।তার চোখে জলের কণা চিকচিক করছে। ‘মা, আমি খারাপ অনুষ্ঠান দেখছিলাম না। আমি শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখছিলাম, ক্রিকেট খেলা দেখছিলাম।’ কথাটা বলার পর তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরতে আরম্ভ করে। তাওহীদ তাকিয়ে দেখে, মেয়েটা অনরগল কথা বলেই যাচ্ছে।কিন্তু তাকে নিয়ে যে এই বাড়িতে একটা ভুল বুঝাবুঝির জন্ম হয়েছে। সেটা কি সে জানবে? তাওহীদ অপলক দৃষ্টিতে ঝাপসা ঝাপদা চোখে টিভিটার দিকে তাকিয়েই থাকে।
•
হঠাৎ বাস্তবে ফিরে আসে। চোখের পাতি বন্ধ করতেই পানি গড়িয়ে পড়ে। মনে মনে তাওহীদ বলছে, মা, আমাকে অবিশ্বাস করল? আমাকে ভুল বুঝল? একটি বার আমার কথাটা শুনতে চায়লো না! আমার কি অপরাধ ছিল? অপরাধ আমার একটাই ছিল, তা হলো টিভিতে বসে খেলা দেখা। আজ এই বোনের জন্য কথা কথা শুনতে হলো।আবার মা-র মনে আমার জন্য ঘৃণা জন্ম দিল। ঐ বোন কি পারত না এই ওয়েস্টার্ন পোশাক না পরে আসতে? একটা পর্দাশীল পোশাক পরে উপস্থাপনা করতে? আচ্ছা ঐ বোনটা কি ইচ্ছা করেই এই রকম কাপড় পরে এসেছিল? নাকি যারা পরিচালনা করে তারাই বলেছিল?
.
হঠাৎ তাওহীদ হাচ্ছি দেয়। একটু লক্ষ করলে বুঝতে পারে। কুয়াশার ভেরাজাল আরও ঘন হয়েছে।চারপাশের দালান গুলো এই ঘন কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে গেছে। এখন যে দিকে তাকায় সে দিকেই শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা।মনে হচ্ছে তাওহীদ কুয়াশার সাগরে ডুবে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মনে মনে আবার বলতে শুরু করে, বি-পি-এল খেলার সময় শুনেছিলাম।যারা উপস্থাপনা করে তাদের বলার বা করার কিছু থাকে না। যারা পরিচালনা করেন তারাই সব ঠিক করে দেন।তারা কি প্রমাণ করতে চায়? যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তারাও সমান তালে চলছে? কিন্তু এই যে অর্ধনগ্ন কাপড় পরে আসে। আবার মাঝে মাঝে এমন কাপড় পরে শরীরের বিভিন্ন অংশ স্পষ্ট হয়ে ভাসে। এই গুলোকেই কি আধুনিকতা বলে? নাকি আধুনিকতার নামে নোংরামী বলে? নাকি অপসংস্কৃতি বলে? নাকি বিবেক হারা মানুষ বলে?
•
আজ আমার মতো কত বয়সের খেলা পাগল মানুষ আছে। সেটা ছোট থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত। যখন অনেকে আমার মতো বৃব্রতকর পরিবেশে পরে তখন তাদের মনের অবস্থা কেমন হয়, একবার চিন্তা করে? যখন ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বিব্রতকর প্রশ্ন করে তখন তাদের কি জবাব দেওয়ার থাকে! একবার ভাবে? নিজের সংস্কৃতি ভুলে অপসংস্কৃতি ধরাকে কি আধুনিকতা বলে? পর্দাশীল পোশাক পরে আসলেই কি আধুনিকতা নষ্ট হয়ে যায়?
.
আজ যাদের লজ্জা নেই সরম নেই তাদের কথা বলে লাভ নেই। কিন্তু যারা পর্দা করে চলে, নিজেদের ধর্ম-কর্ম মেনে চলে। তাদের কথা একবার চিন্তা করে? তারা কিভাবে চলছে! তারা কিভাবে চলবে? তাদের কথা একবার ভাবে? তারা যে প্রতি সময়ে প্রতি পদক্ষেপে কষ্ট ভোগ করছে একবার দেখে? দেখবে না, কখনও দেখতে আসবে না।
.
এ জন্য দোষ দিব আমাদের সমাজ ব্যবস্থার। তারা কেন এদিকটা দেখে না? তারা কেন এদিকটা খবর নেয় না? আর দোষ দিব আমাদের সাধারণ মানুষদের। আমরা সাধারণ মানুষরাই পারি ঠিক করতে। কিন্তু আমরা ঠিক করব না। আমরা দেখব শুনব আর চুপ করে থাকব। যখন নিজের উপর পরে তখন তাদেরকে শেষ করে দিতে চাই। কিন্তু অবশেষে কিছুই করার থাকে না। কারণ সময় মতো যে নড়ি না।
.
আজ কোথায় গেল তারা? যারা ঐতিহ্য রক্ষা করছে বলে অহংকার করে। আজ কোথায় গেল তারা? যারা সভ্যতা টিকিয়ে রাখছে বলে অহংকার করে। আজ কোথায় গেল তারা? যারা ধর্ম রক্ষা করছে বলে অহংকার করে। আজ তাদের চোখ কি অন্ধ? তাদের কান কি বন্ধ? কেন তারা আন্দোলন করে না? কেন তারা চুপ করে থাকে? কোন লাভে চুপ করে থাকে? এই দুই দিনের দুনিয়ার মায়াজ্বালে পড়ে দুনিয়াতেই ডুবে আছে। কিন্তু একদিন যে মরতে হবে, একবার ভাবে? একদিন যে পরকালে জবাব দিতে হবে, একবার চিন্তা করে?
.
আর আমরা সাধারণ মানুষরা! একত্র হয়ে কি কিছু করতে পারি না? তাদের বিরুদ্দ্যে কি কিছু বলতে পারি না? প্রাণের ভয়ে চুপ করে থাকি। কিন্তু এক সময় তো ঠিকেই মাটির নিচে ঘুমাতে হয়। আগুনে পুড়ে মরতে হয়। তাওহীদ অবচেতন মনে বলছে আর তার চোখে আগুন জ্বলছে। মনে মনে নিজেকে দিক্কার দিচ্ছে। মাঝে মাঝে তার নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা হয়। কেন সে কিছু করতে পারছে না। তখন নিজেকে বিভিন্ন ভাবে কষ্ট দেয়।
•
আজ আধুনিকতার পিছে দৌড়ে। আমাদের বিবেক কিভাবে ধ্বংস করছি, কখন ধ্বংস করছি। সেটাই বলতে পারি না। অপসংস্কৃতির পিছে দৌড়ে।নিজেদের ঐতিহ্য, নিজেদের সংস্কৃতি ভুলতে বসেছি।সেটাও বুঝতে পারছি না।আবার নিজেদের ধর্ম কর্মটাও ভুলতে শুরু করেছি।সেটাও জানতে পারছি না। আমরা এতোই আধুনিক হয়েছি যে কোনটা ভুল কোনটা সঠিক এই বিবেকটাই হারিয়ে ফেলেছি।
.
তাওহীদ অপরাজিত সৈনিকের মতো তাকিয়ে আছে। ঘন কুয়াশা এখন মেঘে পরিনত হয়েছে। টপ টপ করে বৃষ্টি হয়ে পড়ছে। দূরের রাস্তা থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। অল্পদূর থেকে একটা পাগলের কথা শুনতে পারছে। সে বলছে, আমি পাগল না। যে আমাকে পাগল বলে সে পাগল তার চৌদ্দ গোষ্ঠী পাগল। আমি বিবেক হারাইনি। আমি সব বুঝি। বিবেক হারিয়েছে তারা- যারা বলে আমরা আধুনিকতা সৃষ্টি করেছি আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলছি। এই তারা চলে? তারা তো আধুনিকতার নামে নোংরামী করে বেড়াচ্ছে। একটু থেমে আবার বলে, আমি পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী মানুষ। আমার আবেগ নাই আমার চোখে পানি নাই তাই আমার মতো সুখী মানুষ কেউ নাই। পাগলটা দৌড়াতে দৌড়াতে অদৃশ্য হয়ে যায়।কিন্তু এখনও ওর কথা গুলো তাওহীদ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।
.
তাওহীদ নতুন ভোরের অপেক্ষায় আছে। একটা নতুন দিনের অপেক্ষায় আছে। একটা নতুন বিস্ময়ের অপেক্ষায় আছে। সে ভাবে, তার এই নীল বেদনা গুলো একদিন শেষ হবে। একদিন সব নীল বেদনা গুলো শান্তিতে রুপ নিবে।কিন্তু সে জানে না, কোনদিন রুপ নিবে। সে জানে না, ঐ-দিনটা কোনদিন আসবে।সে ঐ দিনটার অপেক্ষায় আছে।
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প