কাকভোর কাকে বলে? বাড়ির পাশের গাছে বাসা বাধা কাকেরা যখন ঘুম তোলপাড় করে কা কা করতে থাকে সেই সময়টাকে? তাহলে এখন কাক ভোর। শুভ্র জানালার গ্রিলটা এক হাত দিয়ে ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের মনেই কথাগুলা ভাবছিল। শুভ্র’র চোখে ঘুম নেই অনেকদিন হলো। এটাকে বলে ইনসমনিয়া। খুব খারাপ একটা অসুখ। রাতে ঘুম হয়না। এখন আর ঘুম আসবে না। আরো কতকাল যে এভাবে নিদ্রাহীন রাত কাটাতে হবে। মিথিলাকে একটা ফোন
করা যায়। তবে রাগ করবে। সুন্দরী মেয়েদের সকালের ঘুমটা খুব দরকার, নাহলে চেহারায় তার ছাপ পড়ে। মিথিলা একটু বেশিই সুন্দর তাই একটু আধটু চেহারায় ঘুম না হওয়ার ছাপ পড়লে সমস্যা হওয়ার কথা না।
“মিথিলা.. ঘুমাচ্ছিস নাকি?”
“তোর মত একটা প্রেমিক যেই প্রেমিকা পায় তার আর যাই হোক ঘুম হয় না”
“রাগ করে বললি?”
“নাহ .. খুব খুশি হয়ে বললাম”
“যাহ.. তুই ঘুমা, আমি রাখলাম”“আরে যদি এখন রেখেই দিস তাহলে ঘুমটা ভাঙালি কেন?”
“স্যরি”
“ধুর.. বল কি বলবি”
“কিছুই না এমনি ভাল্লাগছিলনা, তাই ফোন দিলাম”
“ভোর হওয়া দেখতে তোর ভাল্লাগছে না?”
“আজকে লাগছেনা”
“একটা কাজ কর,আমার না খুব লটকন খেতে ইচ্ছা করছে, লটকন কিনে আমাদের বাসায় চলে আয়”“এখন লটকন পাবো কোথায়?” “তা তো জানি না, খুজে দেখ ঠিকই পাবি”
আজ আর জানালায় হাত দিয়ে কফির জন্য ওয়েট করার মানে হয়না, আজ একটু নগরীটা ঘুরে দেখতে হবে। অনেকদিন হলো এই কাজটা করা হচ্ছেনা। আগে প্রায়ই করা হতো। তার আগে প্রলয়কে খুঁজে বের করতে হবে। প্রলয় ছাড়া এই নগরীতে ঘুড়ে বেড়ানোর কোন মানেই হয় না। প্রলয় কবি মানুষ। তাকে খুঁজে পাওয়াটা কঠিন..
প্রলয়কে খুজে পাওয়া যায় আতহার আলীর চায়ের দোকানে। আতহার আলী প্রলয়কে খুব পচ্ছন্দ করে, প্রলয় গেলেই ওকে নিয়ে মাতামাতি শুরু করে, এই ভাইজানের চেয়ার মুছে দে এভাবে খাতির করতে থাকে। প্রলয়ের কথাতেই আতহার আলী তার ছেলে নান্টুকে স্কুলে ভর্তি করে। আতহার আলীর টি স্টল সবসময় রমরমা থাকে, তবে আজ আতহার আলী একাই বসে ছিল। তবে দোকান সম্ভবত কেবল খোলা হলো।
“আরে ভাইজান এতদিন পর গরীবের কথা মনে পড়ল? গাড়ি কই ভাইজান? ড্রাইভারটা বদলাইছিলেন তো? মহা ধান্ধাবাজ লোক। কেমনে তাকায় দেখলেই ভয় লাগে.. আয় হায় দেখেন ভাইজান একবার কথা কওয়া শুরু করিছি আর থামা থামির নাম নাই। যাই হোক ভাইজান কেমন আছেন?”
“ভাল আছি আতহার, তোমার প্রলয় ভাই এখন কোথায় বলতে পারো?”
“আরে ভাইজান আগে বসেন তো তারপর কইতাছি”
“বসলাম, আতহার চা খাওয়াও।”“হ হ.. শুভ ভাই, বয়েন চা বসাইছি, হইতাছে”
আতহার শুভ্র বলতে পারেনা, ও আমার নাম শুভ বলে
“আতহার প্রলয় কই আছে বলো তো”
“প্রলয় ভাই এক ফিলিমের লোকের সাথে আছে কয়দিন। তারে বলে কি ইরিসকিপট লিখে দিতাছে।”
“প্রলয় আজকাল স্ক্রিপ্টও লিখে?”
“হ ভাই, প্রলয় ভাই সব পারে”
“তা জানি।”
“ভাই চা নেন, আপনে প্রলয় ভাইজানের জানের দোস্ত তাই আপনারে তার কাপেই দিলাম খাইতে” প্রলয় আতহারের আলী দোকানে নিজে একটা কাপ কিনে দিয়ে গেছে। এই কাপে আতহার আলী শুধু প্রলয়কে চা দেয়..
“হা হা হা হা, আচ্ছা দাও বলেই আতহারের থেকে চা নিয়ে ফু দিয়ে চায়ে চুমুক দিল শুভ্র”
“ভাইজান দশে কত দিবেন, গতবার দশে আড়াই দিছিলেন, আর প্রলয় ভাই আপনার লগে ঝগড়া শুরু করে দিছিল। মনে আছে?”
“মনে আছে আতহার। তোমাকে এবার আমি দশে এগার দিলাম। চা টা পারফেক্ট হয়েছে। কিছু কম বা বেশি না” শুভ্র চা খেতে খেতেই আতহারের দোকান মানুষে ভরে উঠল। আতহারের আজকের দিনের ব্যবসা শুরু হয়েছে। আতহার খুব সৎ ব্যবসায়ী। এক ফোটাও বেঈমানী করেনা
কারো সাথে। লোকেদের চা দিতে দিতেই আতহার কথা চালিয়ে যাচ্ছে। শুভ্রর চা শেষেই ও চায়ের কাপটা আতহারের দিকে বাড়িয়ে বলল “আতহার আজ উঠতে হবে, প্রলয়কে কোথায় পাওয়া যাবে ঠিকানাটা দাও”
আতহার ঠিকানা দিতে দিতে বলল“ভাইজান আপনে একদিন ও আমার বাড়িতে আইলেন না। আমার পরিবাররে আপনার কথা আর প্রলয় ভাইয়ের কথা কত কইছি, প্রলয় ভাই তবু একদিন গেছিল আপনে একদিন ও গেলেন না,বাড়িটা পাকা কইরা দোতালা করছি, একদিন আইসেন না ভাইজান বাড়িতে, দিলডা খুশিতে ভইরা যাবে।”
“আসব আতহার, খুব শীঘ্রই আসব। এখন গেলাম আতহার, ভালো থাকো” বলে শুভ্র ফার্মগেটের দিকে হাটা শুরু করল।
ফার্মগেটের যে বাড়িটার কথা আতহার বলেছে তা পেতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। খুব সহজেই পেয়ে গেছে শুভ্র। প্রলয় একটা টেবিলের উপর পা রেখে চেয়ারে বসে চা খাচ্ছে। পরনে ধূসর বর্নের পান্জাবি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল, “দোস্ত আজ তোর কথা খুব বেশি মনে পড়ছিল, আমি তোর বাসায় যাইতাম”
“আমিই এজন্য চলে আসলাম”
“দোস্ত চল”
“কোথায়?”
“এক জায়গায়”
“কোন জায়গায়”
“এক জায়গায়”
“প্রলয় তোকে দেখে মনে হচ্ছে তোর পকেটে টাকা পয়সা হয়েছে”“হুম , দোস্ত অনেক টাকা। অনেক”
“কাহিনী কিরে? কি করতাছিস আজকাল”
“আগে বেরোহ তো”
শুভ্র আর প্রলয় পাশাপাশি হাটছে। দুজনই দুজনের খুব প্রিয় বন্ধু। একজনের আরেকজনকে ছাড়া চলেই না, কখনো মনে হয় একজন আরেকজনের থেকে দূরে চলে যাচ্ছে তবে এক হলেই সব ঠিক।“কীরে আজকাল স্ক্রিপ্টও লিখছিস?”
“হু”
“খুব হিট মুভির”
“হুম”
“তুই তো পুরাই হিট তাহলে”
“আমি না আজকাল লিখতে পারিনা”
“মানে কি?”
“যেই হাত দিয়ে মানুষ মারা হয়, সেই হাতে কবিতা লিখা যায়নারে, কবিতাকে অপমান করা হয়”
“এই প্রলয় কী যা তা বকছিস তুই”
“কিছু নারে, সত্যি কথা বললাম, কবি প্রলয় এখন খুনী প্রলয়” শুভ্র চুপ করে হাটছে, ও জানে প্রলয় কখনো ছলনা করেনা, ও যা বলে ভেবে চিন্তে বলে,
“মিথিলা কেমন আছে রে?”
শুভ্র কোন কথা না বলে হাটতে লাগল। বিকাল পড়ে গেছে। রাস্তার পাশে একলোক লটকন নিয়ে বসেছে, শুভ্র এক কেজি লটকন কিনেছে। প্রলয় অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শুভ্র র দিকে। একটা ছেলে এত সুন্দর হয় কীভাবে। গোধূলীর আড়ালে চাঁদ উকি দিচ্ছে। প্রলয় আর শুভ্র চাঁদের গন্ধ নিচ্ছে, চাঁদের গন্ধ…..